(পূর্ব প্রকাশিতের পর)
পূর্বের পোস্টে এমএলএম নাজায়েয হওয়ার উসূলী কারণগুলো সংক্ষেপে আলোচনা করা হয়েছিল। এখন আমরা কোনো কোনো কারণের বিশ্লেষণও করতে চেষ্টা করব ইনশাআল্লাহ। এমএলএম নাজায়েয হওয়ার শাখাগত কারণগুলো নিয়ে আলোচনা করব। এর আগে প্রথম অংশের (এমএলএম অবৈধ হওয়ার মৌলিক কারণ) সাথে সম্পৃক্ত দুটি গুরুত্বপূর্ণ কথা আরয করতে চাই।
১. প্রথম কথাটি হল উসূলে শরীয়ত ও মাকাসিদে শরীয়ত অর্থাৎ শরীয়তের মৌলিক নীতিমালাগুলো ও শরীয়তের উদ্দেশ্যাবলি সকল মাযহাব, সকল ফকীহ ও মুফতীর অভিন্ন সম্পদ ও অভিন্ন পাথেয়।
২. আর দ্বিতীয় কথা যা আরয করতে চেয়েছি তা হচ্ছে প্রথমটির ফলাফল। অর্থাৎ একই কারণে পুরো পৃথিবীর সকল মাযহাব ও নির্ভরযোগ্য মুহাক্কিক আলেমগণ হালাল-হারাম সংক্রান্ত মৌলিক বিষয়গুলোতে প্রায় অভিন্ন মত পোষণ করে থাকেন। এমএলএম-এর ক্ষেত্রেও তা-ই ঘটেছে। বিশ্বের মুহাক্কিক আলেমগণ এমএলএম পদ্ধতিকে নাজায়েয বলেছেন।
পাকিস্তান
পাকিস্তানে এমএলএম ভিত্তিক কোম্পানি ছিল বিজনেস ডটকম। তাদের ব্যাপারে জামিআতুল উলূমিল ইসলামিয়া করাচি থেকে নাজায়েয় হওয়ার ফতোয়া এসেছে। তদ্রূপ দারুল উলূম করাচি থেকেও একই রকম ফতোয়া দেওয়া হয়েছে।
দারুল উলূম থেকে প্রথমে জায়েয হওয়ার একটি ফতোয়া আসলেও পরবর্তীতে তারা সেটি প্রত্যাহার করেছেন। (এ প্রসঙ্গে বিস্তারিত আলোচনা একটু পরে করা হবে)
তদ্রূপ লাহোর থেকেও নাজায়েযের ফতোয়া এসেছে।
বাংলাদেশ
বাংলাদেশের ঢাকায় ১৪২৩ হিজরী মোতাবেক ২০০৩ সালে এ বিষয়ে মুফতী বোর্ড কর্তৃক তাফসীলী ফতোয়া তৈরি হয়। উপমহাদেশের মধ্যে সম্ভবত এ বিষয়ে এটিই সর্বপ্রথম তাফসীলী এবং বোর্ডভিত্তিক ফতোয়া।
ভারত
২০০৭ সালে ভারতের ইসলামী ফিক্হ একাডেমী এ বিষয়ে পুরো দেশের মুফতীদের নিয়ে সেমিনারের আয়োজন করে। ৩০ মার্চ থেকে ২ এপ্রিল পর্যন্ত জামেয়া ইসলামিয়া মুহাযযাবপুর আযীমগড়ে সেমিনার অনুষ্ঠিত হয়। এটি ছিল ইন্ডিয়া ফিকহ একাডেমীর ১৬ তম সেমিনার।
এতে দেশ-বিদেশের ২শ-এর অধিক ফকীহ, মুফতী ও মুহাক্কিক আলেম-উলামা এবং অর্থনীতি ও ব্যবসা-বাণিজ্যে অভিজ্ঞ জেনারেল শিক্ষিত বিজ্ঞ লোকেরা অংশগ্রহণ করেন।
তারা দীর্ঘ আলোচনা-পর্যালোচনার পর এমএলএম নাজায়েযের ফতোয়া দিয়েছেন। (বিস্তারিত দেখুন : নেটওয়ার্ক মার্কেটিং শরয়ী নুকতায়ে নযর)
দারুল উলূম দেওবন্দের প্রধান মুফতী খায়রাবাদী ছাহেব দামাত বারাকাতুহুমও নাজায়েয ফতোয়া দিয়েছেন।
আরব বিশ্ব
সৌদী আরবের সর্বোচ্চ ফতোয়া বোর্ডের মুফতীগণও এমএলএমকে হারাম বলেছেন। যদিও এমএলএম-এর প্রচলন আরববিশ্বে খুব বেশি নয়। ধন-দৌলতের প্রাচুর্য থাকায় এবং আমাদের মতো হুজুগে না হওয়ায় তাদেরকে এমএলএম এ ভিড়ানো সহজ হয় না।
এমএলএম দ্রুত বিস্তার লাভ করে দুই ধরনের জায়গায় :
১. পুঁজিবাদের দেশে।
পুঁজিবাদীদের একটি নীতি হল, নিজের টাকা না খাটিয়ে বা অল্প পুঁজি দিয়ে কৌশলে অন্যের অর্থ দিয়ে টাকা কামানো। এ ব্যাপারে তারা বেশ তৎপর। এজন্য দেখবেন, বীমা, লটারী, শেয়ারবাজার, কমোডিটি এক্সচেঞ্জ ইত্যাদি ব্যবসায়িক পলিসি ওদের দেশে খুব চালু। এগুলোর গোড়ার কথা একটাই। তা হল, নিজ থেকে পুঁজি না খাটিয়ে বা অল্প পুঁজি দিয়ে কৌশলে সাধারণ লোকদের টাকাগুলো কুক্ষিগত করা।
২. আমাদের দেশের মতো তৃতীয় বিশ্বে (তাদের ভাষায়) এটি বেশ জনপ্রিয়তা লাভ করে। এর কারণ বেকারত্ব, স্বল্প আয় এবং পেশাগত জবাবদিহিতার অভাব।
আমাদের দেশে কাজে ফাঁকি দেওয়ার প্রকোপ বেশি। যারা অন্য পেশায় থেকে এমএলএম এ তৎপর হয় তাদের মূল পেশা যে চরম ক্ষতিগ্রস্ত হয় সে কথা বলে বুঝানোর প্রয়োজন নেই। মূল পেশায় জবাবদিহীহতা ও দায়িত্বশীলতার মানসিকতা না থাকায় এমনটি হয়ে থাকে।
আরেকটি কারণ হুজুগে স্বভাব। এটিও আমাদের একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য! কারো থেকে শুনতে দেরি, বা কেউ বলতে দেরি ঐ কাজে নেমে পড়তে তেমন দেরি হয় না।
মোটকথা এমএলএম বিষয়ে বিশ্বের বিভিন্ন এলাকার মুফতীগণ স্ব স্ব স্থানে থেকে এক ধরনের ফতোয়াই প্রদান করেছেন।
এটি একটি কাকতালীয় ব্যাপার। আমাদের ফতোয়াটি তৈরি হয়েছে বাংলায়। ভারতের আলেমদের নিকট তা হয়ত পৌঁছেনি। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় হল, এমএলএম-এর যে ফিকহী বিশ্লেষণ আমরা করেছি ৪ বছর পরে স্ব স্থানে থেকে ঠিক ঐভাবেই তারা তাতবীক দিয়েছেন। এখানে কারবারটিতে যে মৌলিক দোষগুলো চিহ্নিত করা হয়েছে ওখানেও সেগুলোকে মৌলিক ত্রুটি বলে চিহ্নিত করা হয়েছে।
একসময় একটি ফতোয়া দ্বারা বিভ্রান্তি ছড়ানো হত। এখন তা জানাজানি হওয়ার কারণে আর বেশি সুবিধা করতে পারে না। বিষয়টি হল, পাকিস্তানের এমএলএম ভিত্তিক কোম্পানি বিজনেস ডটকম। এটি মূলত ওমানী কোম্পানি ছিল। করাচিতে তারা এমএলএম পদ্ধতিতে কম্পিউটার প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করে।
দারুল উলূম করাচির ফতোয়া বিভাগে এ বিষয়ে ইস্তেফতা করা হয়। ওখানকার উস্তাদ, আমাদের আমীনুত তালীম মাওলানা আবদুল মালেক ছাহেবের সঙ্গী মাওলানা ইছমাতুল্লাহ ছাহেব ইস্তেফতার জওয়াব লিখেন। হয়ত তারা খুব তাড়া করেছিল তাই তিনি তাড়াহুড়ো করেই সংক্ষিপ্ত একটি উত্তর লিখে দেন এবং কোনো পর্যায়ে হযরত মাওলানা তাকী উসমানী দামাত বারাকাতুহুম-এর দস্তখতও নিয়ে নেন। এরপর এমএলএম ওয়ালারা ইন্টারনেটে তা ছেড়ে দেয়। মাওলানা ইছমতুল্লাহ ভেবেছেন, সাদাসিধে আন্দাযে ওরা প্রশ্ন করেছে। তাই গভীরে না ঢুকেই তিনি এর জবাব লিখে দেন। এবং সাধারণ দৃষ্টিতে তা জয়েয হওয়ার মত প্রকাশ করেন। এটি ওদের হাতে পৌঁছার পর তারা যেন আকাশের চাঁদ হাতে পেয়ে গেল। ইন্টারনেটের কল্যাণে যত দেশে এমএলএম আছে সবখানেই তা ছড়িয়ে দিল। কপি করে লোকদের হাতে হাতে বিলি করা হল।
বেফাকে যখন জায়েযের ফতোয়া তৈরি হয় তখন আমরা ঐ ফতোয়া দেখে বিব্রত হই। আমরা তখন করাচিতে যোগাযোগ করি। পরে জানা গেল, মাওলানা ইছমতুল্লাহ ছাহেব খুব তাড়াহুড়ো করে এটি তৈরি করেছেন। এবং হযরত মাওলানা তাকী উসমানী দামাত বারাকাতুহুম সফর বা অন্য কোনো কারণে খুব তাড়ায় ছিলেন। এমতাবস্থায় ঐ ফতোয়ায় তাঁর স্বাক্ষর নেওয়া হয়। মাওলানা ইছমতুল্লাহ-এর উপর যেহেতু তাঁর আস্থা ছিল তাই তিনি স্বাক্ষর করে দেন।
এরপর যখন তাদের নিকট এ বিষয়ের তাফসীল পৌঁছেছে, নিউ টাউন ও অন্যান্য জায়গা থেকে জায়েযের ফতোয়া দেওয়া হয়েছে, তখন তারা তাদের ফতোয়া নিয়ে নতুন করে চিন্তা-ভাবনা করেন এবং পূর্বের ফতোয়া প্রত্যাহার করে নাজায়েযের ফতোয়া প্রদান করেন।
এই প্রত্যাহারকৃত ফতোয়ার মাধ্যমে একসময় এমএলএম ওয়ালারা বিভ্রান্তি ছড়াত। এখনও হয়ত কেউ ছড়াতে পারে। তাই আসল ঘটনা বলে দিলাম। আমাদের নিকট কেউ পূর্বের ফতোয়া পেশ করলে আমরা বলি, ফতোয়াটি যেখান থেকে শুরু হয়েছিল সেখান থেকেই এর সমাপ্তি ঘটানো হয়েছে।
এই একটি প্রত্যাহারকৃত ফতোয়া ছাড়া উপমহাদেশের নির্ভরযোগ্য কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান থেকে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে এমএলএম জায়েয হওয়ার ফতোয়া আছে বলে আমাদের জানা নেই।
দারুল উলূমের পূর্বের ও পরের দু’টো ফতোয়াই আমাদের কাছে রয়েছে।
আগামী পর্বে আমরা উক্ত জায়েজ ফতওয়া সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করব। পাশাপাশি এমএলএম এর বাকি আলোচনাও শেষ করার চেষ্টা করব। আজ এ পর্যন্তই থাক। আল্লাহ আমাদের বোঝার তাউফিক দেন।
১ম পর্ব adarshanari.com/economics/10505
পর্ব ২ https://adarshanari.com/economics/10519/