(পূর্ব প্রকাশিতের পর) ১ম পর্ব
শরীয়তের দৃষ্টিতে এমএলএম
যেহেতু এই মজলিসে উপস্থিত সকলেই কোনো না কোনো ফতোয়া বিভাগ বা তাখাসসুস-এর সাথে জড়িত তাই এমএলএম-এর শরয়ী হুকুম নিয়ে আলোচনার পূর্বে ফিকহুল মুআমালা তথা ব্যবসা-বাণিজ্য ও লেনদেন সংক্রান্ত কিছু মৌলিক কথা আরজ করছি। সীমিত সময়ে অনেক কিছুই হয়ত বলা সম্ভব হবে না। তাই মোটা মোটা কয়েকটা কথা বলব।
ফিকহুল মুআমালার মাসআলাগুলোর জবাব দেওয়ার পূর্বে করণীয়
১. নতুন কোনো বিষয় সামনে এলে প্রথমে তা ভালোভাবে বোঝার চেষ্টা করতে হবে। তাড়াহুড়ো করা যাবে না। প্রশ্নের বিষয়টি বুঝে না এলে প্রশ্নকারীকে ব্যাখ্যা জিজ্ঞাসা করতে হবে। সংশ্লিষ্ট কারবার সম্পর্কে ভালোভাবে অবগত আছেন এমন ব্যক্তিদের থেকেও তথ্য ও ব্যাখ্যা নেওয়া যেতে পারে। মনে রাখতে হবে, লেনদেন, চিকিৎসা বিজ্ঞানসহ যে কোনো নতুন বিষয়ে জিজ্ঞাসিত বিষয়টি যথাযথ উপলব্ধি করা সঠিক জবাব দেওয়ার ক্ষেত্রে আবশ্যকীয় পূর্বশর্ত।
২. বিষয়টা ভালোভাবে বোঝার পর এ ক্ষেত্রে শরীয়তের কী কী মৌলিক নীতি তথা উসূল ও যাওয়াবেত রয়েছে সেগুলো মাথায় হাযির করতে হবে।
৩. নীতিমালা ও যাওয়াবেতের আলোকে ফুকাহায়ে কেরাম যেসব সমাধান দিয়ে গেছেন তাতে যদি বিষয়টা পেয়ে যাই এবং উত্থাপিত মাসআলাটির বর্তমান বিবরণ ও প্রেক্ষাপট যদি পূর্বে বর্ণিত মাসআলার মতোই হয় তাহলে সেখান থেকেই তথা ফিকহি জুযইয়াত থেকেই সমাধান দেওয়া হবে।
৪. আর যদি বিষয়টা একেবারেই নতুন হয় অথবা মাসআলা পুরাতন হলেও এর প্রেক্ষাপট ভিন্ন হয় বা উদ্দেশ্য ও পারিপার্শ্বিক দিক থেকে নতুনত্ব থাকে তবে দুইটি কাজ একসাথে করতে হবে : ক) ফিকহি জুযইয়্যাত দেখতে হবে। খ) উসূল ও যাওয়াবিত দেখতে হবে।
এবং দেখতে হবে যে, উসূলের সাথে জুযইয়্যাত সাংঘর্ষিক তো নয়। সাংঘর্ষিক হলে ফিকির করতে হবে। কেননা
বাস্তবেই সাংঘর্ষিক হলে জুযইয়া গ্রহণযোগ্য হবে না।
ফিকহুল মুআমালা সংক্রান্ত কিছু নীতিমালা (উসূল)
শরীয়তের অন্যান্য বিষয়ের ন্যায় মুআমালার ক্ষেত্রেও এমন কিছু না সূচক উসূল ও যাওয়াবিত রয়েছে, যেগুলো খুবই মজবুত এবং সুদূর ফলপ্রসু। এখনো যদি এসব উসূলের আলোকে অর্থ ও বাণিজ্যব্যবস্থা সাজানো হয় তাহলে তা অবশ্যই সফল হতে বাধ্য।
বর্তমানে পুঁজিবাদী অর্থব্যবস্থা পতনের দিকে চলেছে, ইসলামের ঐ উসূলগুলো মেনে নিয়ে নিষিদ্ধ বিষয়াবলি থেকে যদি বেঁচে থাকা হত তাহলে কখনো এমন পরিস্থিতির মুখাপেক্ষী হওয়া লাগত না।
ফিকহুল মুআমালা তথা লেনদেন বিষয়ক শরীয়তের সেই মৌলিক নির্দেশনাগুলোর কয়েকটি এই :
১. الأكل بالباطل তথা অন্যের সম্পদ অন্যায়ভাবে ভোগ করা।
কুরআন মজীদে আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন-
ولا تاكلوا اموالكم بينكم بالباطل
তোমরা পরস্পরে একে অন্যের সম্পদ অন্যায়ভাবে ভোগ করো না। (সূরা বাকারা : ১৮৮)
‘আকলবিল বাতিল’ বিষয়ে ফিকহের একটি বড় অধ্যায় রয়েছে।
২. ‘আলগারার’ বা প্রতারণা।
হাদীসে এসেছে-
نهى رسول الله صلى الله عليه وسلم عن بيع الغرر
রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ‘গারার’যুক্ত বেচাকেনা থেকে নিষেধ করেছেন।-সহীহ মুসলিম,
হাদীস : ৩৭৮১; মুসনাদে আহমদ ১/৩০২, হাদীস : ২৭৫২
এ বিষয়েও ফিকহুল মুআমালার একটি অধ্যায় রয়েছে।
৩. ‘বাই ওয়া শর্ত’।
হাদীস শরীফে আছে-
لا يحل سَلَفٌ وبيع ولا شرطان في بيع
-জামে তিরমিযী, হাদীস : ১২৩৪; মুসনাদে আহমদ ২/১৭৪; সুনানে আবু দাউদ, হাদীস : ৩৫০৪; জামিউল মাসানিদ ২/২২
এটিও ফিকহের একটি অধ্যায়।
৪. ‘আলগাবানুল ফাহিশ’। এটিও ফিকহের একটি অধ্যায়।
৫. ‘আলগাশশু ওয়ালখিদা’।
হাদীস শরীফে এসেছে-
من غشنا فليس منا
-সহীহ মুসলিম, হাদীস : ১৬৪; জামে তিরমিযী, হাদীস : ১৩১৫; মুসনাদে আহমদ ২/২৪২
৬. ‘তালাক্কিল জালাব’।
হাদীস শরীফে আছে-
نهى أن يتلقى الجلب
-জামে তিরমিযী, হাদীস : ১২২১; মুসনাদে আহমদ ২/২৮৪; সহীহ মুসলিম, হাদীস : ৩৭৯২
এটিও ফিকহের একটি অধ্যায়।
৭. ফিকহের আরেকটি অধ্যায় হল ‘আসসামাসিরা’ তথা দালালি।
৮. ফিকহের আরেকটি অধ্যায় হল ‘বাইয়ুল হাযিরি লিলবাদী’।
হাদীস শরীফে এসেছে-
نهى أن يبيع حاضر لباد
-সহীহ মুসলিম, হাদীস : ৩৭৯৭
৯. ফিকহের আরেকটি অধ্যায় হল ‘আননাজাশ’।
হাদীস শরীফে এসেছে-
أن رسول الله صلى الله عليه وسلم نهى عن النجش
-সহীহ মুসলিম, হাদীস : ৩৭৯১
এতক্ষণ যে সকল বিষয়ের কথা বললাম সেগুলোর ব্যাখ্যা আপনাদের অনেকেরই জানা আছে। প্রসঙ্গের প্রয়োজনে কয়েকটির আলোচনা ও বিশ্লেষণ করব ইনশাআল্লাহ।
আমি এগুলোকে ফিকহের একেকটি অধ্যায় হিসেবে উল্লেখ করলাম। এর অর্থ এই নয় যে, ফিকহের কিতাবে এসব শিরোনামে পৃথক পৃথক বাব রয়েছে। তবে আপনি লক্ষ্য করবেন যে, লেনদেন বিষয়ক মাসআলাগুলোর আলোচনা ও হুকুম বর্ণনা করতে গিয়ে ফুকাহায়ে কেরাম উপরোক্ত নীতিগুলোর আশ্রয় নিয়ে থাকেন। আর বর্তমান সময়ের অনেক লেখক এসব বিষয়ে পৃথক পৃথক বই লিখেছেন। যেমন এ কিতাবটি দেখুন-نظرية الشرط في الفقه الإسلامي। এ মোটা কিতাবটি শুধু ‘শর্ত’ সম্পর্কে লেখা হয়েছে। এমনিভাবে ‘আলগারার’ সম্পর্কে শাইখ ছিদ্দীক আদদারীরের কিতাব الغرر وآثره في العقود দেখুন, এক বিষয়ে কত বড় কিতাব। যারা বিভিন্ন দারুল ইফতায় দায়িত্বরত আছেন তাদেরকে বলছি, আপনারা এ কিতাবগুলো পড়ুন। দেখবেন লেনদেনের মাসআলা ও ফতোয়ার ক্ষেত্রে এই ৯-১০টি বিষয়ের কত বেশি প্রভাব রয়েছে।
শরয়ী হুকুম
এদেশের এমএলএম ব্যবসার শুরুতেই আমরা বেফাকুল মাদারিসিল আরাবিয়ার মুফতী বোর্ডে বিষয়টি উত্থাপন করেছি। বেফাকের মুফতী বোর্ড দীর্ঘদিন আলোচনা-পর্যালোচনার পর এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছে যে, এমএলএম পদ্ধতি নাজায়েয। এরপর প্রায় এক বছরজুড়ে পুরো বাংলাদেশের প্রায় সব বড় মাদরাসা ও দারুল ইফতা থেকে তাসদীক তথা সম্মতিসূচক স্বাক্ষর নেওয়া হয়েছে।
আমাদের জানা মতে, এখনো ঐসব ফতোয়া বিভাগগুলোর মত আগের মতোই বহাল আছে। নির্ভরযোগ্য কারো থেকে এখন পর্যন্ত ভিন্ন কোনো মন্তব্য পাওয়া যায়নি। এটি ছিল বেফাকের বড় কাজ। উক্ত ফতোয়ায় দুটি বিষয় স্পষ্ট হয় :
১. এমএলএম সিস্টেমটাই নাজায়েয।
২. এ সিস্টেম অনুসরণ করে যেসব কোম্পানি চলে তার ব্যবসার ধরনের কারণে প্রথমে তা নাজায়েয। এরপর তাতে শরীয়ত নিষিদ্ধ অন্য কোনো কারণ থাকলে তো নাজায়েয হওয়ার বিষয়টি আরো দৃঢ় হবে। বস্ত্তত এমএলএম পদ্ধতির অনেক প্রতিষ্ঠানেই শরীয়তপরিপন্থী অনেক বিষয় থাকে।
এমএলএম নাজায়েয কেন
এমএলএম নাজায়েয হওয়ার কারণগুলোকে দু ভাগে ভাগ করা যায়। যথা : ক) মৌলিক কারণ খ) শাখাগত কারণ।
সাধারণ শিক্ষিত লোকদের প্রশ্নের জবাবে আমরা সাধারণত মৌলিক বিষয়গুলো উল্লেখ করে থাকি। তাদেরকে ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রে ইসলামের দৃষ্টিভঙ্গিটা বুঝিয়ে সেগুলোর সাথে এমএলএম কীভাবে সাংঘর্ষিক তা বোঝানোর চেষ্টা করি। যেমন-১. শরীয়তের একটি মৌলিক দৃষ্টিভঙ্গি হল, বেচাকেনা হবে সরাসরি। বিনা কারণে মধ্যস্বত্ত্বভোগী সৃষ্টি হবে না। বিক্রেতা ও ভোক্তার মাঝে অযাচিতভাবে বিভিন্ন স্তর ও মাধ্যম সৃষ্টি করা শরীয়তের পছন্দ নয়। এজন্যই হাদীসে ‘তালাক্কির রুকবান ও বাইয়িল হাযিরি লিলবাদী’ ইত্যাদির ব্যাপারে নিষেধাজ্ঞা এসেছে। অর্থাৎ ক্রেতাবিক্রেতার মাঝে অযাচিত মধ্যসত্ত্বভোগী প্রবেশে বাধা দেওয়া হয়েছে। বিক্রেতাকে সরাসরি বাজারে ঢোকার সুযোগ দিতে বলা হয়েছে। মাঝপথে থামিয়ে দিতে বারণ করা হয়েছে। কিন্তু এখন বাজারে ঢোকা তো অনেক দূরের কথা, বিক্রেতার বাড়ি থেকেই পণ্য নিয়ে আসা হয়। দাদন ব্যবসায়ীরা প্রথমে কৃষকদেরকে সুদের শর্তে ঋণ দেয়। সাথে এ শর্তারোপও করে যে, উৎপাদিত ফসল তার কাছে বা তার লোকদের কাছেই বিক্রি করতে হবে। পরিশেষে সুদে আসলে শোধ করতে গিয়ে কৃষকের তেমন কিছু আর বাকি থাকে না। আপনারা জানেন এক্ষেত্রে শরীয়তের নির্দেশনা হল মুযারাআ করা। তা করা হলে কৃষকগণ সুদের গুনাহ থেকেও বাঁচত এবং ফসল ক্ষতিগ্রস্ত হলে তাদের সর্বনাশ হত না।
২. ভোক্তা বা বৃহত্তর সমাজের স্বার্থ ব্যবসায়ী বা ব্যক্তিস্বার্থের উপর প্রাধান্য পাবে।
এজন্য শরীয়ত ‘আননাজাশ’ বা দালালিকে অপছন্দ করে। কারণ এর দ্বারা দালাল উপকৃত হলেও ভোক্তা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। আপনি শরীয়তের পুরো উসূল পড়লে দেখবেন, পুরোটা ভোক্তার পক্ষে, তবে বিক্রেতার বিপক্ষেও নয়। তাই বিক্রেতার ক্ষতি হোক শরীয়ত এটা চায় না। এজন্য সাধারণ অবস্থায় পণ্যের দাম নির্ধারণ করে দেওয়ার বিধান নেই।
হযরত আবু হুরায়রা রা. বলেন, এক ব্যক্তি এসে বলল, আল্লাহর রাসূল! দ্রব্যমূল্য বেড়ে গেছে। আপনি পণ্যের দাম নির্ধারণ করে দিন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, না। আমি বরং দুআ করব যেন দম কমে যায়।-সুনানে আবু দাউদ, হাদীস : ৩৪৫০
উক্ত হাদীসে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দাম নির্ধারণ করে দেননি। কারণ হতে পারে একটি পণ্যে বিক্রেতার খরচ পড়েছে ১০/-টাকা। এখন ৯/- টাকা নির্ধারণ করা হলে বিক্রেতা ক্ষতিগ্রস্ত হবে। অতএব বিক্রেতা ক্ষতিগ্রস্ত হোক শরীয়ত এটা চায় না। কিন্তু সমাজের বৃহত্তর অংশ তথা ক্রেতা বা ভোক্তার ক্ষতি না হওয়ার বিষয়টি শরীয়তে অগ্রাধিকারযোগ্য।
এখন আমরা দেখব, শরীয়তের এ দুটি দৃষ্টিভঙ্গি এমএলএম-এর সাথে কিভাবে সাংঘর্ষিক। প্রথম উসূলটি ছিল, বেচাকেনায় অযাচিত মধ্যস্বত্ত্বভোগী সৃষ্টি না হওয়া। কিন্তু এমএলএম-এর মধ্যে একটি পণ্য বা সেবার উপকারভোগী হয় বহু স্তরের লোক। অসংখ্য মধ্যস্বত্ত্বভোগী তাতে বিদ্যমান। তারা বলে, আমরা এ পদ্ধতি অনুসরণ করি ভোক্তাদের উপকারের জন্য। অন্যান্য কোম্পানি বিজ্ঞাপণের পিছনে যে অর্থ খরচ করে আমরা তা না করে ঐ পরিমাণ অর্থ ক্রেতাদেরকে কমিশন আকারে দেই। এবং তারা আরো বলে, আমরা মধ্যস্বত্ত্বভোগী উঠিয়ে দিয়ে ঐ মুনাফা ক্রেতাদেরকে কমিশন আকারে দেই।
আসলে এসব কথা সত্যের অপলাপমাত্র। কেননা তাদের ভাষায় তারা পণ্যের মূল্যের ৪৫% ভোক্তাদের দিয়ে দেয়। দেখুন, তারা বহু স্তর বানিয়ে প্রত্যেক স্তরকে যে কমিশন দেয় সেটা ভোক্তাদের অর্থ থেকেই দেয়। যেমন, ১০,০০০/- টাকা গাছের মূল্য হলে এর ৪৫% হল ৪,৫০০/- টাকা। এই ৪,৫০০/- টাকা তাদের ভাষায় মধ্যস্বত্ত্বভোগী নিয়ে নেয়। বাকি থাকে ৫,৫০০/- টাকা। এর ভিতরে কোম্পানির লভ্যাংশও ধরা আছে। তাহলে এখানে ভোক্তার লাভ হল না; বরং আরো বেশি ক্ষতি হল। ৫,৫০০/- টাকার পণ্য ১০,০০০/- টাকায় নিতে হচ্ছে।
একটি বহুল প্রচলিত এমএলএম কোম্পানি বলে থাকে, তারা পণ্যের লভ্যাংশের ৮৮% পরিবেশককে দিয়ে দেয়। অবশিষ্ট ১২% নিজেরা রাখে। আমরা বলব, ১২% এর স্থানে ২০% যদি কোম্পানি লাভ করত তবুও ভোক্তা বেশি উপকৃত হত যদি কিনা মধ্যস্বত্ত্বভোগীদের উঠিয়ে দেওয়া হত। তারা বলে, ৮৮% লাভ পরিবেশকদেরকে দেয়। কিন্তু চেইন যদি লম্বা হতে থাকে তাহলে তো ১০০%ও ছাড়িয়ে যাবে।
কিভাবে তারা এত বিপুল পরিমাণ কমিশন দেয়
তারা আরো বলে, ক্রেতাদেরকে লাভবান করার জন্য বিজ্ঞাপনের খরচ বাঁচিয়ে সেটা তাদেরকে ফেরত দেই।
প্রথম কথা হল, তারা বিজ্ঞাপন দেয় না-কথাটা পুরোপুরি সত্য নয়। দ্বিতীয়ত ক্রেতাদেরকে লাভবান করাই যদি উদ্দেশ্য হয় তাহলে প্রথমেই পণ্যের মূল্য ঐ পরিমাণ কমিয়ে দিন এবং সরাসরি ক্রেতাকে হ্রাসকৃত মূল্যে পণ্য বিক্রয় করুন। তাহলেই তো হল। তা না করে স্তর সৃষ্টি করে ঘুরিয়ে দেন কেন?
আমি তাদের অনেককে বলেছি, আপনাদের পণ্য বা সেবা যদি যথাযথ মূল্যেই বিক্রি করে থাকেন তবে যতটুকু আপনার লাভ দরকার তা রেখে দাম নির্ধারণ করে বাজারে ছাড়ুন। যেমন, ১০,০০০/- টাকায় যদি আপনার ৪,৫০০/-টাকা লাভ থাকে এবং তা থেকে পরিবেশকদেরকে ৪,০০০/- টাকা দিয়ে থাকেন তাহলে আপনি পণ্যটি সরাসরি ৬,০০০/- বা ৬,৫০০/- মূল্যে বাজারে ছাড়ুন দেখবেন কোনো বিজ্ঞাপন দরকার হবে না, পরিবেশকও লাগবে না, খুচরা বিক্রেতারা দলে দলে এসে আপনার কাছে ভিড় করবে কারণ আপনাদের ভাষ্যমতে এমনিতেই আপনাকে পণ্যের মূল্য বাজার দরের সমান বা কম। এসব কথা শুনে তাদের অনেক কর্মকর্তা চুপ মেরে গেছে। দ্বিতীয় উসূলটির সাথেও যে এমএলএম সাংঘর্ষিক তা বলা হয়নি।
মোদ্দাকথা : বহু স্তরে বিপণনের এ পদ্ধতি শরীয়তের দৃষ্টিভঙ্গি এবং উসূল যাওয়াবেতের সাথে সাংঘর্ষিক।
৩য় উসূল
আকলু মালিল গায়র বিলবাতিল (বাতিল পন্থায় অন্যের সম্পদ গ্রহণ)।
কুরআনুল কারীমের আয়াত-
لا تاكلوا اموالكم بينكم بالباطل
এর ব্যাখ্যায় রঈসুল মুফাসসিরীন হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আববাস রা. বলেছেন, أن يأكله بغير عوض (শর্তযুক্ত আকদে) বিনিময়হীন উপার্জনই হল বাতিল পন্থার উপার্জন। (আহকামুল কুরআন, জাসসাস ২/১৭২)
হযরত হাসান বসরীসহ অন্যান্য অনেক তাফসীরবিদও আয়াতটির একই ধরনের তাফসীর করেছেন (দ্রষ্টব্য: রূহুল মাআনী ২/৭০, ৫/১৫; তাফসীরুল মানার ৫/৪০)
এমএলএম-এর মধ্যে ‘আকলু মালিল গায়র বিলবাতিল’-এর উপস্থিতি
এমএলএম কারবারগুলোতে ডাউনলেভেল থেকে আপ লেভেলে যে কমিশন আসে তা বিনিময়হীন হাসিল হয়। কারণ ১ম স্তরের সরাসরি জোগাড় করা ক্রেতারা ছাড়া ২য় স্তরের পরবর্তী স্তরগুলোতে যে সকল ব্যক্তি যুক্ত হয় তারা কোম্পানিতে যোগ হয়েছে অন্যান্য লোকজন কর্তৃক এবং তাদের স্বাক্ষরে। সুতরাং যে কমিশন বা পারিশ্রমিক নিম্নস্তর থেকে আসছে তা বিনিময়হীন হওয়ার কারণে ‘আকলু মালিল গায়র বিলবাতিল’ তথা (অন্যের সম্পদ বাতিল পন্থায় আহরণ)-এর অন্তর্ভুক্ত। এ বিষয়ে একটু পরে আরো কিছু আলোচনা করব ইনশাআল্লাহ।
৪র্থ উসূল
লেনদেনের ক্ষেত্রে শরীয়তের একটি উসূল হল, আকদ তথা চুক্তির সময় পণ্য সুনির্ধারিত হওয়া। যেন পরবর্তীতে এ নিয়ে ঝগড়া-বিবাদ না হয়। দেখুন, কোনো কিছুর প্রতিকার করা থেকে তা প্রতিরোধ করা অর্থাৎ গোড়া থেকেই হতে না দেওয়া অনেক ভালো। অসুখ হওয়ার পর চিকিৎসা করে ভালো হওয়ার চেয়ে আগে থেকেই সতর্ক থাকা উচিত যেন অসুখ না হয়। তাই শরীয়ত পূর্ব থেকেই ঝগড়া বিবাদের ছিদ্রগুলো বন্ধ করে দিতে চেয়েছে। ফেতনা-ফাসাদের রাস্তা বন্ধ করে দিয়েছে। এজন্য শরয়ী উসূল মোতাবেক কারবার করলে ঝামেলা হওয়ার সুযোগ থাকে না।
দেখুন সূরা বাকারার ২৮২ নং আয়াতে যেসব নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে সেগুলো অনুসরণ করা হলে চুক্তি, ঋণ ইত্যাদি নিয়ে বর্তমানে যেসব ফেতনা হয় তা কখনো হত না।
আমি বলছিলাম, বেচাকেনার ক্ষেত্রে পণ্য ও মূল্য সুনির্ধারিত হওয়া আবশ্যক। তদ্রূপ ইজারার ক্ষেত্রে প্রাপ্য সেবাও নির্দিষ্ট হতে হবে। অজানা বা অস্পষ্টতা থাকতে পারবে না। আকদের সময়ই সব পরিষ্কার করে নিতে হবে। এখন ক্রয়-বিক্রয় করে ফেলি পরে ঠিক করে নিব তা হবে না। কেনাবেচা যখন সংগঠিত হবে তখন স্বচ্ছতার সাথেই হতে হবে।
৫ম উসূল
বেচাকেনা ‘আলগারার’ বা প্রতারণামুক্ত হতে হবে। মাবসূতের ভাষ্য মতে ‘আলগারার’ হল-
ما يكون مستور العاقبة অর্থাৎ যার পরিণাম অজানা। -কিতাবুল মাবসূত ১২/১৯৪
এমএলএম পদ্ধতি যেভাবে উপরোক্ত দুটি উসূলের পরিপন্থী
একজন ডিস্ট্রিবিউটর যে চুক্তিতে কোম্পানির সাথে যুক্ত হয় তাতে লোকটি তার ডাউন লেভেল থেকে কমিশন লাভ করতে থাকবে। অথচ তার ক্ষেত্রে ডাউন লেভেল সৃষ্টি হবে কি না, হলে তা কত দিন এবং কয়টি স্তর পর্যন্ত চলবে তা সম্পূর্ণ অনিশ্চিত, যা শরীয়তে নিষিদ্ধ আলগারারে বাস্তব দৃষ্টান্ত।
তদ্রূপ ৪র্থ উসূলেরও পরিপন্থী। কারণ এমএলএম এর একজন ক্রেতা-পরিবেশক কোম্পানিকে তার নির্ধারিত টাকাগুলো দিচ্ছে দুটি জিনিসের বিনিময় হিসেবে : ক) নির্ধারিত পণ্য বা সেবা খ) পরিবেশক হিসেবে কমিশন প্রাপ্তি। আমরা দেখতে পাচ্ছি যে, বিনিময়ের প্রথমটি জানা থাকলেও দ্বিতীয়টির পরিণাম অজানা। এরকম আরেকটি দৃষ্টান্ত পাকিস্তানের বিজনেস ডটকম। তাদের পলিসি ছিল, টাকার বিনিময়ে একজনকে কম্পিউটার প্রশিক্ষণ দিবে। এরপর সে আরো কিছু লোককে ওখান থেকে প্রশিক্ষণ নিতে রাজি করবে এবং এর বিনিময়ে সে কমিশন পাবে। এখানে পরবর্তী স্তরটা অজানা। কারণ লোক পাওয়া না পাওয়া অনিশ্চিত। তদ্রূপ ট্রি প্লান্টেশনের ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। এখানে আপনি দুটি জিনিস কিনলেন : ক) পণ্য তথা গাছ। খ) সেবা তথা ৫০০ পয়েন্ট। এই সেবাটার প্রাপ্যতা ও পরিণাম অজানা।
১ম পর্ব adarshanari.com/economics/10505
পর্ব ২ https://adarshanari.com/economics/10519/