রোযার আহকাম ও জরুরী মাসাইল

মুফতী সাঈদ আল-হাসান শামসাবাদী


মহিমান্বিত মাস রমজান। এ মাসে আল্লাহ তাআলা প্রতিটি জ্ঞানসম্পন্ন, বালেগ ও মুসলিম নর-নারীর উপর রোযা ফরজ করেছেন।

মহান আল্লাহ ইরশাদ করেন,
یٰۤاَیُّہَا الَّذِیۡنَ اٰمَنُوۡا کُتِبَ عَلَیۡکُمُ الصِّیَامُ کَمَا کُتِبَ عَلَی الَّذِیۡنَ مِنۡ قَبۡلِکُمۡ لَعَلَّکُمۡ تَتَّقُوۡنَ
অর্থ- হে ঈমানদারগণ! তোমাদের উপর রোজা ফরজ করা হয়েছে, যেরূপ ফরজ করা হয়েছিল তোমাদের পূর্ববর্তী লোকদের উপর, যেন তোমরা পরহেযগারী অর্জন করতে পার।

তবে যারা শরয়ী কোন কারণে রোযা রাখতে অক্ষম, তারা অন্য মাসে ক্বাযা করতে পারবেন। ইরশাদ হচ্ছে,
وَمَن كَانَ مَرِيضًا أَوْ عَلَىٰ سَفَرٍ فَعِدَّةٌ مِّنْ أَيَّامٍ أُخَرَ
অর্থাৎ, অসুস্থ বা মুসাফির ব্যক্তি রমজানে রোযা না রেখে পরবর্তী সময়ে রাখতে পারবে।

প্রশ্ন হতে পারে, যে ব্যক্তি একদম রোযা রাখতেই পারে না, যেমন, অশীতিপর বৃদ্ধ অথবা এমন অসুস্থ ব্যক্তি যার সুস্থতার আশা করা যায় না, তার  হুকুম হল, প্রতি রোযার পরিবর্তে ফিদয়া আদায় করবে।  আল্লাহ ইরশাদ করেন,
وَعَلَى الَّذِينَ يُطِيقُونَهُ فِدْيَةٌ طَعَامُ مِسْكِينٍ
অর্থাৎ, যারা রোযা রাখতে একেবারে অক্ষম,  তাদের করণীয় হচ্ছে, ফিদয়া তথা মিসকিনকে খাদ্য প্রদান করা।

ফিদয়া কি? 

ফিদয়া হল, প্রতিটি রোযার পরিবর্তে ১জন মিসকীনকে দুবেলা পেট ভরে খাওয়ানো অথবা সদকায়ে ফিতর পরিমাণ গম, আটা কিংবা তার মূল্য (৭০ টাকা) সদকা করে দেয়া।

এবার আসুন, রোযা সংক্রান্ত কিছু গুরুত্বপূর্ণ মাসআলা জেনে নেয়া যাক-

রোযার ফরয বা রোকন

১. নিয়ত করা। অর্থাৎ, মনে মনে রোযা রাখার সংকল্প করে নেবে। মুখে উচ্চারণের দরকার নেই, এটি মুস্তাহাব আমল।
২. সুবহে সাদিক থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত পানাহার ও সহবাস থেকে বিরত থাকা।

যেসব কারণে রোযা ভেঙ্গে যায়, তবে শুধু ক্বাযা করতে হয় :

১. রোযার কথা স্মরণ থাকাবস্থায় অনিচ্ছায় গলার ভেতর পানি ঢুকে যাওয়া।
২. ভুলে খাওয়ার পর রোযা ভেঙে গেছে ভেবে ইচ্ছাকৃত পানাহার করা।
৩. দেহের কোন জখমে বা কান ও নাকে ঔষধ দেয়ার পর তা পেটে চলে যাওয়া। মস্তিষ্কের ক্ষেত্রেও একই হুকুম।
৪. হস্তমৈথুনে বীর্যপাত করা।
৫. ইচ্ছাকৃত মুখ ভরে বমি করা।
৬. সময় আছে ভেবে সুবহে সাদিকের পর কিছু খাওয়া।
৭. সূর্য ডুবে গেছে ভেবে সূর্যাস্তের পূর্বেই ইফতার করা।
৮. কোন অখাদ্য বস্তু যেমন- পাথর, লোহা, ফলের আটি ইত্যাদি গিলে ফেলা।
৯. জোরপূর্বক রোযাদারকে কেউ কিছু খাইয়ে দিলে।
১০. সামনের বা পেছনের রাস্তা দিয়ে কোন কিছু প্রবেশ করানো।
১১. রোযা অবস্থায় হায়েয/পিরিয়ড বা নেফাস শুরু হলে।

যেসব কারণে রোযা ভেঙ্গে ক্বাযা-কাফফারা দুটোই ওয়াজিব হয়:

১. রোযাবস্থায় জেনে বুঝে কিছু খাওয়া বা পান করা। এমনকি বিড়ি, সিগারেট বা হুক্কা হলেও।
২. জেনে বুঝে স্ত্রী সহবাস করা। বীর্যপাত হোক বা না হোক।

উল্লেখ্য, সুবহে সাদিক হয়ে গেছে জানা সত্ত্বেও আজান শোনা না যাওয়ায় খানা-পিনা বা সহবাস করলেও ক্বাযা-কাফফারা আসবে।

কাফফারা আদায়ের নিয়ম :

একটি রোযার জন্য দুই মাস লাগাতার রোযা রাখতে হবে। অসুস্থতার কারণে ধারাবাহিকতা ছুটে গেলে পুনরায় নতুন করে রোযা রাখতে হবে। পেছনের রোযাগুলো কাফফারার রোযা হিসাবে ধর্তব্য হবে না।
তবে মহিলাদের হায়েযের কারণে ধারাবাহিকতা নষ্ট হলে অসুবিধে নেই।

যেসব কারণে রোযা ভাঙ্গে না, তবে মাকরূহ হয়ে যায় :

১. কুলি করার সময় গড়গড়া করা এবং নাকে পানি দেয়ার সময় উপরের দিকে পানি পৌঁছানো মাকরূহ।
২. সারা দিন ফরজ গোসল না করে অপবিত্র থাকা।
৩. এমন কাজ করা, যার দ্বারা রোযাদার নিতান্তই দুর্বল হয়ে পড়ে। যেমন, রক্ত দেয়া বা শিঙ্গা লাগানো।
৪. রোযার হালতে গীবত করা, গালি-গালাজ, ঝগড়া-মারামারি করা, টিভি-সিনেমা ইত্যাদি দেখা, গান-বাদ্য শ্রবণ করা এবং যে কোনো বড় ধরণের গুনাহে লিপ্ত হওয়া।
৫. অকারণে কোনো কিছু চাবানো, লবণ টেস্ট করা, টুথপেস্ট/মাজন ব্যবহার করা ইত্যাদি।

যেসব কারণে রোযা ভাঙ্গে না, মাকরূহও হয় না :

১. মিসওয়াক করা। তবে মিসওয়াকের আর্দ্রতা বা কোনো অংশ গলায় ঢুকে গেলে রোযা ভেঙ্গে যাবে।
২. চোখে সুরমা দেয়া।
৩. সুগন্ধির ঘ্রাণ নেয়া। তবে আগরবাতি বা লোবানের ধোঁয়া ইচ্ছে করে নাকে টেনে নিলে রোযা ভেঙ্গে যাবে।
৪. গোসল করা।
৫. ওষুধের প্রয়োজনে ইনজেকশন নেয়া। তবে বিনা প্রয়োজনে খাবারের ইনজেকশন নেয়া মাকরুহে তাহরীমী।
৬. ভুলে কিছু খাওয়া বা পান করা।
৭. অনিচ্ছায় গলার ভেতর কোনো ধোঁয়া বা মশা-মাছি ঢুকে যাওয়া।
৮. অনিচ্ছায় কানে পানি ঢুকে যাওয়া।
৯. অনিচ্ছায় বমি করা।
১০. স্বপ্নদোষ হওয়া।
১১. দাঁত থেকে রক্ত পড়া, যা গলায় প্রবেশ করেনি।
১২. ঘুমের মাঝে বা সজাগ অবস্থায় গোসল ফরজ হলো, কিন্তু ফজরের আগে গোসল করা গেল না, এমতাবস্থায় রোযার নিয়ত করে নিল।
১৩. তেল দেয়া।
১৪. মা সন্তানকে বুকের দুধ খাওয়ানো।
১৫. গাড়ির বা রান্নার ধোঁয়া নাকে যাওয়া।
১৬. নখ বা চুল ইত্যাদি কাটা।
১৭. সহবাসে লিপ্ত না হয়ে স্ত্রীকে শুধু চুমু দেয়া বা আলিঙ্গন করা।

যেসব কারণে রোযা না রাখার অনুমতি আছে তবে পরবর্তীতে ক্বাযা করে নিতে হবে :

১. অসুস্থতার কারণে রোযা রাখার শক্তি নেই, বা রোগ বেড়ে যাওয়ার আশংকা থাকলে।
তবে রোযা রাখার পর অসুস্থ হয়ে পড়লে এবং রোযা রাখলে তা বাড়ার নিশ্চিত সম্ভাবনা থাকলে রোযা ভাঙতে পারবে। শুধু ক্বাযা করলেই চলবে।
২. গর্ভবতী মহিলা রোযা রাখলে যদি নিজের বা সন্তানের ক্ষতির আশংকা করে।
৩. শরয়ী মুসাফিরের জন্য সফরের হালতে রোযা না রাখার সুযোগ রয়েছে। তবে অস্বাভাবিক কষ্ট না হলে রোযা রাখাই উত্তম। আর অস্বাভাবিক কষ্ট হলে রোযা রাখা মাকরূহ।
৪. শরয়ী মুসাফিরের জন্যে সফরের হালতে রোযা না রাখার অনুমতি আছে।
৫. ক্ষুধা বা পিপাসা যদি এত বেশি হয় যে, কোনো দ্বীনদার ডাক্তার প্রাণের আশংকা করেন।
৬. মহিলাদের হায়েজ বা ঋতুকালীন সময়ে এবং নেফাস বা সন্তান ভূমিষ্ঠ হওয়ার পরবর্তী অসুস্থকালীন সময়ে রোযা রাখা যাবে না। পরে ক্বাযা করে নেবে।

* যাদের জন্য রোযা ভাঙ্গার অনুমতি আছে, তাদের উচিৎ রমজানের সম্মান বজায় রেখে প্রকাশ্যে কোনো কিছু না খাওয়া।

রোযার কিছু আধুনিক মাসায়েল :

১. এন্ডোস্কপি : রোযা অবস্থায় এন্ডোস্কপি করানো যায়। তবে পরীক্ষা করার সময় যদি নলের ভিতর দিয়ে পানি বা কোনো ঔষধ ভিতরে প্রবেশ করানো হয় তাহলে রোযা নষ্ট হয়ে যাবে। অন্যথায় নষ্ট হবে না। এন্ডোস্কপির মতোই মলদ্বার দিয়ে নল ঢুকিয়ে যে পরীক্ষা করা হয় তারও একই হুকুম।

২. এনজিওগ্রাম : সাধারণ পদ্ধতির এনজিওগ্রামের কারণে রোযা নষ্ট হয় না।

৩. ইনজেকশন ও ইনসুলিন : ইনজেকশন ও ইনসুলিন গ্রহণের কারণে রোযা নষ্ট হয় না। তবে যেসব ইনজেকশন খাদ্যের কাজ দেয় তা জটিল ওযর ছাড়া গ্রহণ করা মাকরূহ।

৪. নাইট্রোগ্লিসারিন : এরোসল জাতীয় এ ঔষধটি ব্যবহার করলে রোযা নষ্ট হয় না।

৫. ভেন্টোলিন ইনহেলার : রোযা অবস্থায় ইনহেলার ব্যবহার করলে রোযা নষ্ট হয়ে যায়।

৬. ওষুধ বা অন্য কোন উপায়ে মহিলাদের মাসিক বন্ধ : কোনো মহিলা যদি রমযানের রোযা রমযান মাসেই পূর্ণ করার উদ্দেশ্যে ওষুধের মাধ্যমে মাসিক বা পিরিয়ড বন্ধ রাখে। তাহলে যে কয়দিন পিরিয়ড বন্ধ থাকবে, সে নিয়মিত নামায-রোযা পালন করতে থাকবে। তবে কৃত্রিম উপায়ে মাসিক বন্ধ রাখা কতটা স্বাস্থ্যসম্মত, ব্যাপারটা ভেবে দেখা প্রয়োজন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *