আল্লামা মনজূর নূমানী রহ.
ইসলামের বুনিয়াদি শিক্ষাগুলোর মাঝে কালিমা, নামায ও যাকাতের পর রোযার অবস্থান। আল্লাহ পাক বলেন,
يَاأَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا كُتِبَ عَلَيْكُمُ الصِّيَامُ كَمَا كُتِبَ عَلَى الَّذِينَ مِنْ قَبْلِكُمْ لَعَلَّكُمْ تَتَّقُونَ
হে ঈমানদারগণ, তোমাদের উপর রোযা রাখা ফরজ যেমন ফরজ ছিলো তোমাদের পূর্ববর্তীদের উপর। সূরা বাকারা ২/১৮৩
পুরো রমজান মাস রোযা রাখা ফরজ। যে ব্যক্তি বিশেষ অপারগতা বা অক্ষমতা ব্যতীত রমজানের একটি রোযাও ছেড়ে দেবে সে কঠিন গোনাহগার হবে। একটি হাদীসে এসেছে,
مَنْ أَفْطَرَ يَوْمًا مِنْ رَمَضَانَ مِنْ غَيْرِ رُخْصَةٍ لَقِيَ اللهَ بِهِ، وَإِنْ صَامَ الدَّهْرَ كُلَّهُ، إِنْ شَاءَ غَفَرَ لَهُ، وَإِنْ شَاءَ عَذَّبَهُ. قال الهيثمي: رَوَاهُ الطَّبَرَانِيُّ فِي الْكَبِيرِ، وَرِجَالُهُ ثِقَاتٌ.
যে ব্যক্তি কোনো বিশেষ কোনো ওজর ব্যতীত রমজানের একটি রোযাও তরক করলো, সে যদি তদস্থলে সারাজীবনও রোযা রাখে, তবু (রমযানের ঐ একটি রোযার হক আদায় হবে না।) সে আল্লাহর সামনে এমনভাবে হাজির হবে যে, আল্লাহ চাইলে ক্ষমা করবেন বা শাস্তি দিবেন। মুজামে কাবীর, ৯৫৭৪
রোযার সওয়াব
রোযার ভিতর ইবাদতের নিয়তে খানাপিনা ও কামক্রিয়া থেকে বিরত থাকতে হয় এবং আল্লাহর ওয়াস্তে আপন ইচ্ছা ও জৈবিক চাহিদা বিসর্জন দিতে হয়। এ জন্য আল্লাহ পাক এই ইবাদতের অন্যরকম সওয়াব এবং অনেক বেশী নেকী দান করেন। হাদীসে এসেছে, আল্লাহ পাক বলেন,
كُلُّ عَمَلِ ابْنِ آدَمَ يُضَاعَفُ الْحَسَنَةُ عَشْرُ أَمْثَالِهَا إِلَى سَبْعمِائَة ضِعْفٍ، قَالَ اللهُ عَزَّ وَجَلَّ: إِلَّا الصَّوْمَ، فَإِنَّهُ لِي وَأَنَا أَجْزِي بِهِ، يَدَعُ شَهْوَتَهُ وَطَعَامَهُ مِنْ أَجْلِي .
বান্দার সকল নেক আমলের সওয়াব দানের জন্য একটি নিয়ম বা স্কেল থাকে। প্রত্যেক নেক আমলের সওয়াব সেই অনুসারে দেয়া হয়। দশ গুণ থেকে সাতশ গুণ পর্যন্ত। কিন্তু রোযার বিষয়টি সাধারণ স্কেল ও নীতির ঊর্ধ্বে। বান্দা আমার জন্যই খাদ্য পানীয় বিসর্জন দিয়েছে, কামক্রিয়া বর্জন করেছে, সুতরাং সরাসরি আমি নিজে তাকে বিশেষ আজর ও সওয়াব দান করবো। সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ১১৫১
অন্য এক হাদীসে এসেছে,
مَنْ صَامَ رَمَضَانَ، إِيمَانًا وَاحْتِسَابًا، غُفِرَ لَهُ مَا تَقَدَّمَ مِنْ ذَنْبِهِ
যে ব্যক্তি পূর্ণ ঈমান ও একীনের সঙ্গে আল্লাহ পাকের সন্তুষ্টি ও সওয়াবের আশায় রমযানের রোযা রাখবে, আল্লাহ পাক তার পূর্বের সকল গোনাহ মাফ করে দিবেন। সহীহ বোখারী, হাদীস নং ২০১৪
অপর একটি হাদীসে নবীজী ইরশাদ করেন,
لِلصَّائِمِ فَرْحَتَانِ: فَرْحَةٌ عِنْدَ فِطْرِهِ، وَفَرْحَةٌ عِنْدَ لِقَاءِ رَبِّهِ
রোযাদারের আনন্দ ও খুশির মওকা দুটি। একটি লাভ হয় এ দুনিয়াতে ইফতার করার সময়। আর অন্যটি লাভ হবে আল্লাহ পাকের সামনে হাজির হওয়ার এবং তার নৈকট্যের সম্মান লাভের সময়। সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ১১৫১
আরেকটি হাদীসে এসেছে-
الصَّوْمُ جُنَّةٌ
রোযা হলো জাহান্নামের আগুন থেকে বাঁচার শক্ত ঢাল এবং সুরক্ষিত দুর্গ বিশেষ। সুনানে তিরমিযি, হাদীস নং ২৬১৬
এক হাদীসে এসেছে,
খোদ রোযাই রোযাদারের জন্য সুপারিশ করে বলবে, আমার কারণে এ বান্দা খাদ্য-পানীয় স্পর্শ করেনি, জৈবিক চাহিদা পূরণের চেষ্টা করেনি (সুতরাং হে আল্লাহ! তুমি এ বান্দাকে ক্ষমা করে দাও, তাকে পরিপূর্ণ প্রতিদান দিয়ে দাও) আল্লাহ তাআলা রোযার সুপারিশ কবুল করে নেবেন।
لَخُلُوفُ فَمِ الصَّائِمِ أَطْيَبُ عِنْدَ اللهِ، يَوْمَ الْقِيَامَةِ، مِنْ رِيحِ الْمِسْكِ
পেট খালি হওয়ার কারণে মাঝে মাঝে রোযাদারের মুখে যে গন্ধ উঠে আসে, আল্লাহ পাকের নিকট তা মৃগনাভির চেয়েও প্রিয়। সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ১১৫১
হাদীসগুলিতে রোযার যে ফযিলত এসেছে, তা ছাড়াও উল্লেখযোগ্য একটি ফযিলত ও বৈশিষ্ট্য এই যে, রোযা পশুবৃত্তি থেকে মানব প্রকৃতিকে আলাদা রাখতে উদ্বুদ্ধ করে। যখন ইচ্ছে খাওয়া, ইচ্ছে হলেই পান করা বা কামক্রিয়ায় জড়িয়ে পড়া এটা পশুর স্বভাব। আর এসব বিষয়ে মোটেই না জড়ানো হলো ফেরেশতার স্বভাব। মানুষ রোযা রাখার মাধ্যমে পশুত্ব থেকে উঠে এসে ফেরেশতার সাদৃশ্য অবলম্বন করে। তার ভিতর আত্মনিয়ন্ত্রণ ও পরিমিতিবোধ জেগে ওঠে।
রোযার বিশেষ ফায়দা
রোযার বিশেষ ফায়দা হলো, এর মাধ্যমে তাকওয়া, খোদাভীতি ও পরহেজগারীর গুণ সৃষ্টি হয়, শাহওয়াত বা কামভাব ও প্রবৃত্তিকে নিয়ন্ত্রণে আনার শক্তি অর্জিত হয়। আল্লাহ পাকের হুকুমের মোকাবেলায় নফসের কামনা ও খাহেশকে উপেক্ষা করার সদভ্যাস গড়ে ওঠে এবং আত্মার জগতের উন্নতি ও শ্রীবৃদ্ধি ঘটে।
কিন্তু এ সকল ফায়দা তো তখনই হবে, যখন রোযাদার নিজেও এগুলো অর্জনে সচেষ্ট হয়ে রোযা অবস্থায় পালনীয় নবীজির অন্যান্য হেদায়েত ও নির্দেশনাগুলি পালনে সচেষ্ট হবে। ছোট বড় সকল গোনাহ থেকে বাঁচবে, মিথ্যা বলবে না, পরনিন্দায় জড়াবে না, ঝগড়াঝাঁটিতে লিপ্ত হবে না। অর্থাৎ সকল প্রকার প্রকাশ্য-অপ্রকাশ্য গোনাহ থেকে দূরে থাকবে। এক হাদীসে এসেছে,
وَإِذَا كَانَ يَوْمُ صَوْمِ أَحَدِكُمْ فَلاَ يَرْفُثْ وَلاَ يَصْخَبْ، فَإِنْ سَابَّهُ أَحَدٌ أَوْ قَاتَلَهُ، فَلْيَقُلْ إِنِّي امْرُؤٌ صَائِمٌ
তোমাদের কেউ যখন রোযা রাখবে, তখন দিনের বেলা সে যেন মুখে কোনো অশ্লীল কথা না বলে, হৈ চৈ না করে। গায়ে পড়ে কেউ যদি তার সঙ্গে ঝগড়া করতে উদ্যত হয় এবং তাকে গালিগালাজ করে, তাহলে সে যেন শুধু এটুকু বলে ক্ষান্ত হয় যে, আমি রোযাদার। তোমার গালিগালাজের জবাব দিতে পারছি না। সহীহ বোখারী, হাদীস নং ১৯০৪
অন্য এক হাদীসে নবীজী বলেন,
مَنْ لَمْ يَدَعْ قَوْلَ الزُّورِ وَالعَمَلَ بِهِ، فَلَيْسَ لِلَّهِ حَاجَةٌ فِي أَنْ يَدَعَ طَعَامَهُ وَشَرَابَهُ
রোযা রেখেও যে ব্যক্তি মিথ্যা, মন্দকথা ও কুকর্ম ত্যাগ করে না, তার এই ক্ষুধাতৃষ্ণা অবলম্বনে আল্লাহ পাকেরও কিছু আসে যায় না। সহীহ বোখারী, হাদীস নং ১৯০৩
আরেকটি হাদীসে এসেছে,
كَمْ مِنْ صَائِمٍ لَيْسَ لَهُ مِنْ صِيَامِهِ إِلَّا الْجُوعُ
কত রোযাদার এমন আছে, মন্দ কাজ থেকে বিরত না থাকার কারণে তাদের রোযা থেকে ক্ষুধাতৃষ্ণার কষ্ট ছাড়া কিছুই অর্জন হয় না। মুসনাদে আহমদ, হাদীস নং ৯৬৮৫
মোটকথা, রোযার সুফলগুলো তখনি লাভ হবে, যখন ছোট বড় সকল গোনাহ থেকে আমরা বেঁচে থাকবো। বিশেষত মিথ্যা, পরচর্চা ও গালিগালাজ থেকে জবান হেফাজত করবো। যদি আমরা সঠিকভাবে রোযা রাখি, তবে রোযাই আমাদেরকে ফেরেশতাতুল্য বানিয়ে দেবে ইনশাআল্লাহ।
আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে রোযার হাকীকত, গুরুত্ব ও ফযিলত বোঝার তাওফীক দান করুন। রোযার উসিলায় আমাদের অন্তরে তাকওয়া ও খোদাভীতি সৃষ্টি করে দিন।