মেয়েদের আত্মশুদ্ধির প্রতি মনোযোগী হওয়া উচিত : থানভী রহ.

হাকীমুল উম্মত আশরাফ আলী থানভী রহ.


চরিত্র ও আচার আচরণের পরিশুদ্ধতা সম্পর্কে আমাদের মেয়েদের মনোযোগ দেওয়া খুবই জরুরি। মনে রাখা উচিত, মানুষের সঙ্গে লেনদেন, আচার আচরণ ঠিক না হলে অযীফা-ইবাদত কোনোই কাজে আসবে না।

হাদীস শরীফে এসেছে, নবী করীম সা. কে বলা হল, অমুক মহিলা অত্যন্ত ইবাদতগুযার, রাতভর ইবাদত-বন্দেগী করে, কিন্তু প্রতিবেশীকে কষ্ট দেয়। ইরশাদ হল, ‘সে জাহান্নামী।’ অন্য মহিলা সম্পর্কে বলা হল যে, সে ইবাদত-বন্দেগী অধিক করে না, তবে প্রতিবেশীদের সঙ্গে ভালো ব্যবহার করে। ইরশাদ হল, ‘সে জান্নাতী।’

আমাদের মেয়েদের পূর্ণ বুযুর্গী আজকাল তাসবীহ ও অযীফা-পাঠের মধ্যেই সীমাবদ্ধ হয়ে পড়েছে। চরিত্র সংশোধন করার দিকে মনোযোগ নেই বললেই চলে। অথচ সুন্দর চরিত্র দীনের গুরুত্বপূর্ণ অংশ। আর দীনের একটি অংশও যদি কারো মধ্যে অনুপস্থিত থাকে তবে তার দীনদারী পূর্ণাঙ্গ হয় না।

 

কেউ তো নামায-রোযাকেই সম্পূর্ণ দীন মনে করে। কেউ শুধু বাহ্যিক ভদ্রতা রক্ষায় যত্নবান, অযীফা ও ইবাদত সম্পর্কে তাদের কোনো মাথাব্যথা নেই। অথচ তাদের চরিত্রও পুরোপুরি ঠিক নেই। আর ঠিক হলেও তা কোনো কাজে আসত না।

আবার কিছু মানুষ আছে যাদের আমল-আকীদা, লেনদেন ঠিক আছে। কিন্তু তারা নিজেদের সম্পর্কে সুধারণা ও অহংকার পোষণ করে এবং অন্যদের তুচ্ছজ্ঞান করে। তাহলে তাদের মধ্যে চারিত্রিক ত্রুটি রয়েছে।

বর্তমান মেয়েরা আকীদা-আমল, নামায ও অযীফাকে দীন হিসেবে গ্রহণ করে এবং চরিত্র-আখলাককে পরিত্যাগ করে। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত গীবত-শিকায়েত, হিংসা-হাসাদ, নিন্দা-বড়াই ইত্যাদিতে মগ্ন থেকেও তাদের ধারণা, আমরা অত্যন্ত দ্বীনদার, বুযুর্গ। এটা বুযুর্গী নয়। বরং শয়তানের কুমন্ত্রণা!

পুরুষদেরকেও বলা হচ্ছে, তাদের মধ্যেও আখলাকের ত্রুটি আছে। তারাও যেন নিজেদের সংশোধন করেন।

কোনো কোনো দিক থেকে আমলের চেয়েও আখলাকের গুরুত্ব বেশি। কেননা, মন্দ আমলের কুফল নিজের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে, অন্যদিকে মন্দ আখলাকের অনিষ্ট অন্যদেরও ভুগতে হয়। এটা হককুল আবদ।

আফসোসের বিষয় এই যে, নামায না পড়া, কবীরা গুনাহে লিপ্ত হওয়াকেই শুধু গুনাহ মনে করা হয় কিন্তু হিংসা-হাসাদ, গীবত-শিকায়েত, অলঙ্কারের লোভ, ঝগড়া বিবাদ ইত্যাদিকে গুনাহই মনে করা হয় না। অথচ এগুলোই কিন্তু নামায, রোযাকে বিনষ্ট করে দিচ্ছে। 

কীভাবে সংশোধন সম্ভব?

এবার সংশোধনের পন্থা মনোযোগ সহকারে শুনুন। এর দুটি অংশ : ইলম ও আমল। অর্থাৎ প্রথমে জ্ঞান ও সচেতনতা অর্জন করতে হবে। এরপর উপযুক্ত পন্থায় সংশোধনের চেষ্টা করতে হবে। তাই ইলম বলতে সাধারণ কুরআন তরজমা পড়া, সূরা ইউসুফ পড়া কিংবা নূরনামা, ওফাতনামা পড়া উদ্দেশ্য নয়; বরং এমন কিতাব পড়তে হবে যাতে রোগের বিবরণ আছে। এভাবে রোগ সম্পর্কে সচেতনতা অর্জিত হবে।

আর আমলের মধ্যে একটি হল যবানকে সংযত করা। মেয়েদের যবান খুব চলে। আপনাদেরকে কেউ ভালো বলুক বা মন্দ বলুক আপনারা কিছু বলবেন না। যবানকে সংযত রাখুন। যবান সংযত রাখার যোগ্যতা এসে গেলে স্বামীর প্রতি অকৃতজ্ঞতা, স্বামীকে ভুল বোঝানো, নিন্দা-অভিশাপ, গীবত-শিকায়েত ইত্যাদি থেকে মুক্তি পাওয়া যাবে।

শুধু তাই নয়, স্বভাবের এই প্রবণতাগুলোও তখন বিলুপ্ত হয়ে যাবে। কেননা, গীবত-শিকায়েতের চর্চা বন্ধ করা হলে এর পিছনের প্রবণতা বাধাগ্রস্ত হবে এবং দুর্বল হতে হতে বিলুপ্ত হয়ে যাবে।

দ্বিতীয় আমল এই যে, একটি সময় নির্ধারণ করে দুনিয়ার ক্ষণস্থায়ীত্ব, মৃত্যু ও মৃত্যুর পরের ঘাঁটিগুলো সম্পর্কে- কবর, মুনকার-নাকীর-এর সওয়াল-জওয়াব, হাশর-নশর, হিসাব-কিতাব, পুলসিরাত ইত্যাদি সম্পর্কে চিন্তা করুন।

প্রতিদিন কিছু সময় এভাবে চিন্তা-ভাবনা করলে অর্থ ও মর্যাদার মোহ, লোভ-লালসা, গর্ব-অহংকার এবং এগুলো থেকে সৃষ্ট অন্যান্য মন্দ বিষয় সবই দূর হতে থাকবে।

মোটকথা, চিকিৎসার দু’টি অংশ

রোগ সম্পর্কে সচেতন হওয়া এবং তা দূর করার চেষ্টা করা। প্রথম বিষয়ের জন্য কুরআন মাজীদ অধ্যয়নের পর এমন কিতাবপত্র পড়তে, যাতে মাসআলা-মাসায়েলের সঙ্গে অন্তরের বিভিন্ন ব্যাধি যথা, হিংসা-হাসাদ, অহংকার ইত্যাদির আলোচনা রয়েছে।

অন্তত পূর্ণ বেহেশতী জেওর অধ্যয়ন করে নিবে। আর যে কাজগুলোর কথা বলা হচ্ছে তা হল, যবানকে সংযত রাখা এবং মৃত্যুর কথা চিন্তা করা।

এখানে একটি কথা মনে রাখতে হবে যে, তোতা পাখির মতো নিজে নিজে বেহেশতী জেওর পড়ে নিলে কোনো উপকার হবে না; বরং মাহরাম আলেমের কাছে সবক সবক করে পড়বে। ঘরে কোনো আলেম না থাকলে ঘরের পুরুষদের কাছে আবেদন করবে তারা যেন আলেমের কাছ থেকে পড়ে আপনাদেরকে পড়িয়ে দেয়।

পড়ার পর তা বন্ধ করে রেখে দিবে না; বরং একটি সময় নির্ধারণ করে নিজেও নিয়মিত পড়বে এবং অন্যদেরকেও পড়ে শোনাবে। আমি প্রতিশ্রুতি দিচ্ছি, এ পদ্ধতি অনুসরণ করলে খুব দ্রুত সংশোধন হয়ে যাবে ইনশাআল্লাহ।

সকল রোগের উৎস একটি। রোগ সম্পর্কে উদাসীনতা। যদি সকল বিষয়ে দ্বীনের আহকামের প্রতি লক্ষ রাখা হয় অর্থাৎ আমি যে কাজ করছি তা দ্বীন অনুযায়ী হচ্ছে না দীন-পরিপন্থী, তাহলে অল্প দিনেই আত্মা ও চারিত্রিক পরিশুদ্ধতা অর্জন হবে ইনশাআল্লাহ। দুআ করা প্রয়োজন, আল্লাহ যেন তাওফীক দান করেন। আমীন।

উৎস : খাওয়াতীন ছে আকাবিরীন কা খেতাব, পৃষ্ঠা ৫৩-৫৫

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *