মুফতি আব্দুল্লাহ আল মাহমুদ
নারী পুরুষের নামাজের পার্থক্য নেই-
এই মর্মে মোটা দাগে ৩ টা দলীল পেশ করা হয়।
১- হাদিস
২- আছারে সাহাবী
৩- আছারে তাবেয়ী
প্রথম দলীল
*// নারী-পুরুষ উভয় জাতির উম্মতকে সম্বোধন করে রাসূল(সা:) বলেছেন,“তোমরা সেইরূপ সালাত আদায় কর, যেইরুপ আমাকে করতে দেখেছ”। (বুখারী, মুসলিম, মিশকাত হা/৬৮৯ //
সাধারণত এই দলীলটি সবাই উল্লেখ করে থাকেন। শায়খ আলবানী রহ. তার সিফাতুস সালাহ গ্রন্থে এই হাদিসকে কেন্দ্র করেই বলেছেন, “এখানে নারী ও পুরুষ উভয়কেই সম্বোধন করা হয়েছে। সুতরাং উভয়ের নামাজে কোন ভিন্নতা নেই”!
**হাদিসে কি নারী পুরুষ উভয়কেই সম্বোধন করা হয়েছে? “রাসূল সা. নারী ও পুরুষকে সম্বোধন করে বলেছেন”, এই কথাটুকু বাড়তি সংযোজন। রাসূল সা. নারীদের সম্বোধন করে বলেন নি। যাদের বলেছেন, তারা নারী ছিলেন না। এই বাড়তি সংযোজন নিজস্ব ইজতেহাদ ও উপলব্ধি মাত্র। পূর্ণ হাদিস বিশ্লেষণ করলে এই দলীলের যথার্থতা প্রশ্নবিদ্ধ হয়।
প্রথমে উক্ত হাদীসটির পূর্ণরূপ দেখে নেই: . ﻋَﻦْ ﺃَﺑِﻲ ﺳُﻠَﻴْﻤَﺎﻥَ ﻣَﺎﻟِﻚِ ﺑْﻦِ ﺍﻟﺤُﻮَﻳْﺮِﺙِ، ﻗَﺎﻝَ : ﺃَﺗَﻴْﻨَﺎ ﺍﻟﻨَّﺒِﻲَّ ﺻَﻠَّﻰ ﺍﻟﻠﻪُ ﻋَﻠَﻴْﻪِ ﻭَﺳَﻠَّﻢَ، ﻭَﻧَﺤْﻦُ ﺷَﺒَﺒَﺔٌ ﻣُﺘَﻘَﺎﺭِﺑُﻮﻥَ، ﻓَﺄَﻗَﻤْﻨَﺎ ﻋِﻨْﺪَﻩُ ﻋِﺸْﺮِﻳﻦَ ﻟَﻴْﻠَﺔً، ﻓَﻈَﻦَّ ﺃَﻧَّﺎ ﺍﺷْﺘَﻘْﻨَﺎ ﺃَﻫْﻠَﻨَﺎ، ﻭَﺳَﺄَﻟَﻨَﺎ ﻋَﻤَّﻦْ ﺗَﺮَﻛْﻨَﺎ ﻓِﻲ ﺃَﻫْﻠِﻨَﺎ، ﻓَﺄَﺧْﺒَﺮْﻧَﺎﻩُ، ﻭَﻛَﺎﻥَ ﺭَﻓِﻴﻘًﺎ ﺭَﺣِﻴﻤًﺎ، ﻓَﻘَﺎﻝَ : « ﺍﺭْﺟِﻌُﻮﺍ ﺇِﻟَﻰ ﺃَﻫْﻠِﻴﻜُﻢْ، ﻓَﻌَﻠِّﻤُﻮﻫُﻢْ ﻭَﻣُﺮُﻭﻫُﻢْ، ﻭَﺻَﻠُّﻮﺍ ﻛَﻤَﺎ ﺭَﺃَﻳْﺘُﻤُﻮﻧِﻲ ﺃُﺻَﻠِّﻲ، ﻭَﺇِﺫَﺍ ﺣَﻀَﺮَﺕِ ﺍﻟﺼَّﻼَﺓُ، ﻓَﻠْﻴُﺆَﺫِّﻥْ ﻟَﻜُﻢْ ﺃَﺣَﺪُﻛُﻢْ، ﺛُﻢَّ ﻟِﻴَﺆُﻣَّﻜُﻢْ ﺃَﻛْﺒَﺮُﻛُﻢْ » .
আবূ সুলাইমান মালিক ইবনু হুওয়ায়রিস হতে বর্ণিত। তিনি বলেন: আমরা কয়জন নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম -এর নিকটে আসলাম। তখন আমরা ছিলাম প্রায় সমবয়সী যুবক। বিশ দিন তাঁর কাছে আমরা থাকলাম। তিনি বুঝতে পারলেন, আমরা আমাদের পরিবারের নিকট প্রত্যাবর্তন করার জন্য উদগ্রীব হয়ে পড়েছি। যাদের আমরা বাড়িতে রেখে এসেছি তাদের ব্যাপারে তিনি আমাদের কাছে জিজ্ঞেস করলেন। আমরা তা তাঁকে জানালাম। তিনি ছিলেন কোমল হৃদয় ও দয়ার্দ্র। তাই তিনি বললেন: তোমরা তোমাদের পরিজনের নিকট ফিরে যাও। তাদের (কুরআন) শিক্ষা দাও, সৎ কাজের আদেশ কর এবং যে ভাবে আমাকে সালাত আদায় করতে দেখেছ ঠিক তেমনভাবে সালাত আদায় কর। সালাতের ওয়াক্ত হলে, তোমাদের একজন আযান দেবে এবং যে তোমাদের মধ্যে বড় সে ইমামত করবে। . বুখারী, হাদীস নং-৬০০৮
উক্ত হাদীসে খেয়াল করুন!
* কতিপয় যুবক সাহাবী এসেছেন। তাদের সবাই যুবক। তাদের মাঝে কোন নারী ছিল না।
* বাড়িতে গিয়ে স্বীয় এলাকাবাসীকে কুরআন শিক্ষা সৎ কাজের আদেশের নির্দেশনা দিলেন।এরপর তোমরা বলে পরপর তিনটি নির্দেশনা দিলেন।
যথা-
১/আমাকে যেভাবে দেখেছো সেভাবে তোমরা নামায পড়বে।
২/নামাযের সময় হলে তোমাদের মধ্য হতে একজন আযান দিবে।
৩/নামাযের জন্য তোমাদের থেকে যে বড় সে ইমাম হবে।
পর্যালোচনা ও বিশ্লেষণ –
** প্রথমত হাদিসে উল্লেখই আছে, যারা রাসূল সা. এর সামনে ছিলেন। তারা পুরুষ। সম্বোধন তাদেরকেই ছিল।
** দ্বিতীয়ত হাদীসটির শেষ দিকে নবীজী সা. আযান ও ইমামতের নির্দেশ দিয়েছেন। এই নির্দেশটি আরো স্পষ্ট করে, এখানে নারী পুরুষ উভয়কেই সম্বোধন করার দাবী সঠিক নয়।
** তৃতীয়ত এই হাদিসটি বুখারী, মুসলিমসহ আরো অন্যান্য গ্রন্থে ১০ টি রেওয়ায়ত, সহীহ সনদে এসেছে। অর্থাৎ মালেক বিন হুয়াইরিস রা. এর মদীনায় এসে রাসূল সা. এর কাছ থেকে ইসলাম শেখার বিবরণ। সেখানে মাত্র একটি বর্ণনায় আছে যে রাসূল সা. বলেছেন “সাল্লু কামা রায়াইতুমুনি উসাল্লি” অর্থাৎ আমাকে যেভাবে দেখছ সেভাবে নামাজ আদায় করো। এছাড়া অন্য বর্ণনাগুলোতে এই কথাটা নেই। সেখানে কোথাও আছে, “তোমরা নিজ এলাকায় ফিরে গিয়ে তাদের নামাজ শেখাবে। তারা যেন নামাজ পড়ে এই এই ওয়াক্তে। আর নামাজের সময় এলে একজন আযান দেয়, আর বয়োজ্যেষ্ঠ যে সে ইমামতি করে।” বুখারী (৬৫৩) অন্য রেওয়াতে আছে, মালেক বিন হুয়াইরিস ও তার চাচাত ভাই রাসূল সা. এর কাছে এলেন। তিনি বললেন, যখন তোমরা দুজন সফরে যখন বের হবে তখন আযান একামত দিবে। আর তোমাদের মধ্যে যে বড় সে ইমাম হবে। (তিরমিজী – ২০৫, সহীহ) এই হাদিসে একদম পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে, এখানে নির্দেশ পুরুষদেরকে দেয়া হয়েছে। অন্যান্য রেওয়ায়ত গুলো চেক করতে চাইলে, মুসলিম – ২৯২/৬৭৪, বায়হাকী ২২৩৭, ২২৩৮, ২৬৬৭ ইত্যাদি।
তদুপরি যদি মেনে নেয়া হয় যে মহিলাদেরকেও সম্বোধন করা হয়েছ। তারপর যে প্রশ্নগুলো আসবে…
১- রাসূল সা. কে মত নামাজ পড়ার মর্ম কী?এর মর্ম কী এই, রাসূল সা. এর মত আরকান ও আমলগুলো আদায় করা? নাকি এর মর্ম এই, রাসূল সা. এর মত খুশু খুজু স্থিরতা আনার চেষ্টা করা?
২- হুবহু রাসূল সা. এর মত নামাজ আদায় করতে যদি মহিলাদের নির্দেশ দেয়া হয়ে থাকে, তাহলে নামাজে রাসূল সা. এর অন্যান্য আমল, যেমন টাখনু খোলা রেখে নামাজ আদায়। ইত্যাদি। এগুলোও কি রাসূল সা. মালেক বিন হুয়াইরিসকে বাড়িতে গিয়ে মহিলাদের শিখাতে বলেছেন? মহিলাদের আযান একামত ও উচ্চস্বরে কেরাত পড়তে বলেছেন? যেভাবে রাসূল সা. পড়তেন। আর উক্ত সাহাবীও রাসূল সা. কে পড়তে দেখেছেন!যদি উত্তর হয়, না এইগুলা রাসূল সা. বলেন নি। তাহলে বোঝা যাবে হাদিসে মহিলাদের নামাজ নিয়ে কিছুই বলা হয় নাই। বলা হলে পার্থক্যের ক্ষেত্রগুলো রাসূল সা. কেন বলে দিলেন না? যে মহিলারা আস্তে কেরাত পড়বে, টাখনু ঢাকবে। চুল খোলা রাখবে না। কারণ এগুলো তো রাসূলের নামাজের বিপরীত চিত্র। মালেক বিন হুয়াইরিসের যত রেওয়ায়েত আছে একটা রেওয়াতেও নেই কেন, ঐ পার্থক্যগুলোর কথা। যেগুলোর ব্যাপারে সবাই একমত।
তবে, দ্বিতীয় পর্বে বলেছিলাম, স্বতঃসিদ্ধ মত হচ্ছে, যেসব বিধানে নারীদের ব্যাপারে ভিন্ন কিছু কুরআন বা হাদিসের মাধ্যমে অথবা ইজমা ও কিয়াসের মাধ্যমে প্রমাণিত নয়, সেক্ষেত্রে নারী পুরুষের মধ্যেই শামিল। এটা প্রমাণে বিস্তর দলীল দস্তাবেজ এর প্রয়োজন নেই। কারণ এতে সবাই একমত।কিন্তু নারীদের নামাজে রুকু সেজদার পার্থক্য তো, হাদিস, আছার ও ইজমা, কেয়াস দ্বারা প্রমাণিত।
এমনকি, শায়খ আলবানি রহ. তার কিতাবে এক ইবনে হাজাম জাহেরী ছাড়া জমহুরের মতের বিপরীত আর কারো মত উপস্থাপন করেন নি। ইবনে হাজাম জাহেরী ছিলেন জাহেরী সম্প্রদায়ের মতবাদপ্রবর্তক। যাদের মূল কথা হচ্ছে, হাদিস কুরআনে বাহ্যিক যা অর্থ, তাই মানব। এই নীতির আলোকে দেয়া তার কিছু উদ্ভট ফতোয়ার কারণে তাকে একাধিকবার দেশ ছাড়তে হয়েছে। ইবনে হাজাম যাহেরী রহ. এর ভুলভ্রান্তি বিস্তারিত আলোচনা করা এখানে সম্ভব না। তার কয়েকটি মাসআলা উল্লেখ করছি,
১- কুরআনে বলা আছে, মা বাবাকে ‘উফ’ বলো না। সুতরাং তাদের গালি দেয়া জায়েজ। গালি তো উফ না।
২- হাদিসে বলা আছে, বিয়ের আগে কনেকে দেখে নিতে, যাতে বিয়েতে উদ্বুদ্ধ হওয়া যায়। তিনি ফতোয়া দিলেন, কনেকে এমনকি উলঙ্গ করেও দেখা যাবে। কারণ তা আরো বেশি উদ্বুদ্ধ করবে।
৩- হাদিসে এসেছে, কুকুর মুখ দিলে ৭ বার ধৌত করতে। কিন্তু শুয়োর এর ব্যাপারে কিছু বলা হয় নাই। সুতরাং শুয়োর মুখ দিলে তা পান করা ও উজু করা বৈধ।
৪- আয়াতে বলা আছে, দারিদ্রতার ভয়ে সন্তানকে হত্যা করো না। তিনি ফতোয়া দিলেন, এখানে দারিদ্র্যতার কথা বলা আছে। সুতরাং ধনী হলে হত্যা করতে অসুবিধে নাই। কারণ তার দারিদ্রতার ভয় নেই।
“ইবনে হাজাম এর ভিন্নমত সম্পর্কে ইমামদের অভিমত”
হাফেজ ইবনে আব্দুল বার রহ. বলেন- যাহেরীদের সম্পর্কে আমার মত হলো, তারা আহলে সুন্নাহ ওয়াল জামায়াহ থেকে বের হয়ে গেছে। (আল ইস্তেযকার – ৩০৯)
ইমাম নববী বলেন, বাহ্যিকবাদী তথা যাহেরী মতবাদ এক আজীব মাজহাব। যা চূড়ান্ত পর্যায়ের ভ্রান্ত। ইবনে হাজাম যাহেরী থেকে বর্ণিত মতটি (কোন এক মাসআলায়) নিকৃষ্টতম মাসআলার একটি। আল্লাহ তার উপর রহম করুন। (আল মাজমূ ১/১১৮) –
ইবনে তায়মিয়া রহ. ইবনে হাজাম যাহেরীর হাদিস বিষয়ক জ্ঞানের কথা স্বীকার করে তার ভুলভ্রান্তি নিয়ে দীর্ঘ আলোচনা করেছেন। এবং তিনি যাহেরীদেরকে ভ্রান্ত ফেরকা জাহমিয়াদের মধ্যে শামিল করেছেন। ( মিনহাজুস সুন্নাহ ২/৫৮৩, দারউ তায়া’রুজিল আকলি ওয়ান নাকল ৫/২৪৯)
সুতরাং ইবনে হাজাম যাহেরী যদিও হাদিস বিশারদ ছিলেন। কিন্তু তার ফিকহের অবস্থা ছিল করুণ! তাই, উম্মাহর সকল আয়িম্মাহর বিপরীতে গিয়ে তার উদ্ভট ফতোয়াকে সমর্থন হিসেবে পেশ করা মানানসই না। উল্লেখ্য, ইবনে হাজাম রহ. খায়রুল কুরুনের কেও নন। তার জন্ম ৩৯৪ হি, স্পেনে। ইন্তেকাল ৪৪৬ হি।
শায়খ আলবানি নিঃসন্দেহে বড় মাপের মুহাদ্দিস ছিলেন। শায়খ আলবানির এই মতকে কেন্দ্র করেই পরবর্তীতে অনেকেই বলেছেন নারী পুরুষের নামাজের পার্থক্য নেই। কিন্তু এখানে যে কথাটা না বললেই নয়, হাদিস বিশারদ হওয়া আর ফিকহ বিশারদ হওয়া এক নয়। শায়খ আলবানির অনেক ফতোয়াই উম্মাহ গ্রহণ করে নাই। যেমন, মহিলাদের স্বর্ণ ব্যবহার হারাম, ফিলিস্তিনিদের নিজ ভূখণ্ড ছেড়ে হিজরত করা ওয়াজিব, তিনি আরো বলেছেন, “সবাইকে সালাফী পরিচয় দিতে হবে”, নাপাক থাকা অবস্থায় কুরআন স্পর্শ করা জায়েজ ইত্যাদি। এই মতগুলো কেও গ্রহণ করে নি।
এমনকি অনেক মত খোদ আহলে হাদিস/সহীহ আকীদার ভাইরাও গ্রহণ করেন নাই।
- যেমন, বেতর ৩ রাকাত পড়া।
- এক রাকাতের বেতর না থাকা,
- শবে বরাতের হাদিস সহীহ হওয়া,
- ইমাম জোরে কেরাত পড়লে মুক্তাদি সুরা ফাতেহা পড়বে না।
- রুকু থেকে উঠে হাত বাধা বেদাত হওয়া ইত্যাদি।
এগুলো শায়খ আলবানির মত। কিন্তু গ্রহণ করেন না অনেকেই। উল্লেখ্য, শায়খ আলবানি ও শায়খ বিন বাজ, সালেহ আল উসাইমিনের ভিন্নমত বা ইখতেলাফ নিয়ে দুই খণ্ডে ৮০০ শত পৃষ্ঠারও বেশি একটি কিতাব রয়েছে। যেটা লিখেছেন ড. সাদ ইবনে আব্দুল্লাহ আল বারীক। যার নাম হচ্ছে “আল ইজাযু ফি বাদি মা ইখতালাফা ফীহী আলবানি ওয়া ইবনু উছাইমিন ওয়া ইবনু বায রাহিমাহুমুল্লাহু তায়লা”!
দ্বিতীয় দলীল
//উম্মে দারদা (রা:) তার সালাতে পুরুষের মতই বসতেন। আর তিনি একজন ফকীহা ছিলেন। (আত-তারীখুস স্বাগীর, বুখারী ১/৩৫৫ পৃঃ, ফাৎহুল বারী ২/৩৫৫)।//
বিশ্লেষণ-
প্রথমত, উম্মে দারদা তিনি একজন ফকীহ তাবেয়ী। উপরে দেখতে পাচ্ছেন, যারা এই দলীল উপস্থাপন করেছেন, তারা ফাতহুল বারী (বুখারীর ব্যাখ্যাগ্রন্থ) এর উদ্ধৃতিও দিয়েছেন। অবাক করার মত ব্যাপার হচ্ছে, ফাতহুল বারীতে স্পষ্ট করে লেখা আছে, এই উম্মে দারদা সাহাবী নন। তিনি তাবেয়ী! শুধু ফাতহুল বারী কেন, তারীখের কিতাব তাহযীবুত তাহযীব, তাহযীবুল কামাল, সিয়ারু আলামিন নুবালা ইত্যাদি গ্রন্থগুলো চেক করলেই বুঝতে পারবে, এখানে উম্মে দারদা সুগরা উদ্দেশ্য। কারণ মাকহুল এর সাথে উম্মে দারদা কুবরা যিনি সাহাবী, তার সাথে কখনো দেখাই হয় নি । তাহলে মাকহুল কীভাবে উম্মে দারদা (সাহাবী) থেকে বর্ণনা করবেন? এ বিষয়টা জানার পরেও তাবেয়ীর কথাকে সাহাবীর কথা বলে প্রচার করা দুঃখজনক। (তাহযীবুল কামাল ৩৫/৩৫৫)
দ্বিতীয়ত, উম্মে দারদা হুবহু পুরুষের মত বসতেন না। ইবনে রজব হামবলী রহ. ফাতহুল বারীতে উল্লেখ করেছেন, হাদিসের বাকী অংশ যেটা হারব আল কিরমানি সূত্রে বর্ণিত, উম্মে দারদা পুরুষের মত বসতেন তবে তিনি বাম নিতম্বের দিকে ঝুঁকে বসতেন। এতে বরং পুরুষের নামাজের চেয়ে ভিন্নতাই প্রমাণিত হয়।
قال الحافظ ابن رجب في فتح الباري(7/299) قال حرب الكرماني : نا عمرو بن عثمان : نا الوليد بن مسلم ، عن ابن ثوبان ، عن أبيه ، عن مكحول ، أن أم الدرداء كانت تجلس في الصلاة جلسة الرجل إلا إنها تميل على شقها الأيسر ، وكانت فقيهةً
তাছাড়া ইমাম বুখারীর বাক্য প্রয়োগ “পুরুষের মত বসতেন আর তিনি ফকীহ ছিলেন” দ্বারা অনেকে বলেন, এখানে তার বসাটা অন্যান্য তাবেয়ীদের তুলনায় ব্যতিক্রম ছিল। আর তাই ইমাম বুখারী সেটার প্রতি জোর দিতে গিয়ে ‘তিনি ফকীহ ছিলেন’ কথাটা যুক্ত করেছেন। তাই যদি হয়, তাহলে এর মর্ম দাঁড়ায় খায়রুল কুরুনে মহিলাদের বসার পদ্ধতি পুরুষের চেয়ে ভিন্ন ছিল। কেবল একজন তাবেয়ী ব্যতিক্রম ছিলেন। তিনি কিছুটা পুরুষের মত বসতেন। তাহলে এর দ্বারা বরং ভিন্নতাই প্রমাণিত হচ্ছে।
তৃতীয়ত: তারীখের কিতাবগুলোতে রয়েছে, উম্মে দারদা খুব অল্প বয়সী ও ইয়াতীমাহ ছিলেন। তাই তিনি পুরুষের কাতারে দাড়িয়ে নামাজ আদায় করতেন এবং পুরুষদের ক্বেরাতের মজলিশেও বসতেন। এরপর তিনি বড় হলে একদিন তাকে আবু দারদা মহিলাদের কাতারে যুক্ত হতে বলেন। এ থেকে বোঝা যায়, তিনি নামাজে যদি পুরুষদের মত বসেও থাকেন, তবে সেটা পুরুষদের দেখে দেখে করতেন ঐ বয়সে , যখন তিনি সাবালিকা হন নি। (সিয়ারু আলামিন নুবালা ৪/২৭৮, তারীখুল ইসলাম ২/১০২৫, তাহযীবুল কামাল ৩৫/৩৫৪) ৪/
তদুপরি যদি তাবেয়ীর আমলটাকে ঐভাবে ধরে নেই যে নামাজে পুরুষ আর মহিলাদের বসার ক্ষেত্রে পার্থক্য নেই। তবে এর বিপরীতে সহীহ সনদে সাহাবীর আমল আছে..
ইমাম তাহাবী, (শারহু মুশকিলিল আছার ১৩/২৪৩ ও আহকামুল কুরআনের ১/১৬৪ হা. ২৬৬) একটি হাদিস সহীহ সনদে উল্লেখ করেছেন। হাসান বসরী রহ. তার মা এর সূত্রে, (যিনি উম্মে সালামার খাদেমা ছিলেন) উম্মুল মুমীনীন উম্মে সালামা থেকে বর্ণনা করেন যে, উম্মে সালামা দু পা ডানে দিয়ে বসতেন, অর্থাৎ মেয়েরা যেভাবে সালাতে বসে। উল্লেখ্য তাবেয়ী হাসান বসরী রহ. নিজেও উম্মে সালামার দুধসন্তান।
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, শাইখ কামালুদ্দীন জাফরী এক টিভি আলোচনায় বলে বসলেন, “সহীহ বুখারীতে আছে, নবীজীর স্ত্রী সম্ভবত উম্মুল মুমীনীন সওদা রা. صلت صلاة الرجل و كانت فقيهة অর্থাৎ সাওদা রা. পুরুষের মত নামাজ আদায় করলেন আর তিনি ফকীহ ছিলেন।” তিনি যা বললেন, তার আরবী বা ভাবার্থ কোনটাই বুখারীতে নেই। এমনকি আমি অনুসন্ধান করে অন্য কোন হাদিস গ্রন্থেও এই হাদিস দেখি নি, বা যারা উনার মত বলেন যে নারীদের নামাজ অভিন্ন, তাদের কাউকে এমনটা লিখতে দেখি নি। সুতরাং আমার খেয়াল, তিনি এক্ষেত্রে ভুল করে উম্মে দারদার হাদিসের অর্থকে সামান্য বদলে, বানিয়ে সেটাকে আরবীতে বলেছেন। এটা একটা তাসামুহ বা মিস্টেক। আল্লাহ ভালো জানেন। সাহাবী ও সালাফের নীতি হলো, তারা হাদিস বর্ণনায় আরো বেশি সতর্কতার পরিচয় দিতেন।
তৃতীয় দলীল
ইবরাহীম নাখয়ী (র:) বলেন, ‘সালাতে মহিলারা ঐরূপ করবে, যেরূপ পুরুষরা করে থাকে। (ইবনে আবি শাইবা ১/৭৫/২, সিফাতু সালাতুন্নবী ১৮৯ পৃঃ)। ইবরাহীম নাখয়ীর আছারটি শায়খ আলবানি রহ. সিফাতুস সালাতে উল্লেখ করেছেন। তিনি সেটাকে সহীহ সনদও বলেছেন। তিনি যে আরবী বাক্য দিয়েছেন المرأة تفعل في صلاتها كما يفعل الرجل কিন্তু উক্ত আছার মুসান্নাফে ইবনে আবী শাইবাতে পাওয়া যায় না। তাই শায়খের দাবীকে অনেকে “শিবহুত তাহরীফ” (বিকৃত কথার অনুরূপ) বলেও আখ্যা দিয়েছেন।
অধমের খেয়াল হচ্ছে, ইবরাহীম নাখয়ীর যে আছারটি শায়েখ উল্লেখ করেছেন, তা সম্ভবত শায়েখ মুসান্নাফে ইবনে আবী শাইবার মুখতাসার, যাতে প্রচুর মিস্টেক আছে। সেই গ্রন্থ থেকেই শায়েখ তুলে দিয়েছেন। যার কারণে ভুলটা হয়েছে। ইবরাহীম নাখয়ী বলেন নি যে, “মহিলারা নামাজে তাই করবে যা পুরুষরা করে”! তবে একটা আছার আছে, যেখানে ইবরাহীম নাখয়ী বলেছেন ‘মহিলারা পুরুষের মত বসবে।” عَنْ إبْرَاهِيمَ ، قَالَ : تَقْعُدُ الْمَرْأَةُ فِي الصَّلاَةِ كَمَا يَقْعُدُ الرَّجُلُ এতে শুধু বসার ক্ষেত্রে অভিন্নতা প্রমাণ হয়। কিন্তু রুকু সেজদার ক্ষেত্রে পার্থক্য নেই, এটা প্রমাণ হয় না।
বরং অন্য বর্ণনায় আছে,ইবরাহীম নাখয়ী রহ. বলেন-মহিলা যখন সেজদা করবে তখন যেন সে উভয় উরু মিলিয়ে রাখে এবং পেট উরুর সাথে মিলিয়ে রাখে। (মুসান্নাফে ইবনে আবী শাইবা-১/৩০২, হাদিস নং-২৭৯৫) তাছাড়া কথা হচ্ছে, শায়খ আলবানি রহ. যখন বসার ক্ষেত্রে অভিন্নতা প্রমাণ করতে তাবেয়ীর আছার দিয়ে দলীল পেশ করলেন, তাহলে নারী পুরুষের নামাজে ভিন্নতা প্রমাণ করার ক্ষেত্রে এত এত বিপুল পরিমাণ আছারকে কেন গ্রহণ করা হবে না?
১ম পর্বের লিংক https://adarshanari.com/ibadaat/namaz/8191/
২য় পর্বের লিংক https://adarshanari.com/ibadaat/namaz/8197/
৩য় পর্বের লিংক https://adarshanari.com/ibadaat/namaz/8203/
৫ম পর্বের লিংক https://adarshanari.com/ibadaat/namaz/8214/