পুরুষ মহিলার নামাযের পার্থক্য : নারী পুরুষের নামাজ কি অভিন্ন? (২য় পর্ব)


মুফতি আব্দুল্লাহ আল মাহমুদ


নারী পুরুষের নামাজে ভিন্নতা আছে? নাকি অভিন্ন?

সাধারণত সবাই এভাবে শিরোনাম দিয়ে থাকে।  এই শিরোনামকে কেন্দ্র করে নানা তর্ক বা বিতর্ক হয়।  কেউ প্রমাণ করেন, নারী পুরুষের নামাজ একই। কেউ প্রমাণ করেন নারী পুরুষের নামাজে রয়েছে বিস্তর তফাৎ। আমার দৃষ্টিতে এই শিরোনামটিই যথার্থ নয়। কারণ, নারী পুরুষের নামাজে যেমন রয়েছে কিছু পার্থক্য, তেমনি রয়েছে মিল ও অভিন্নতা! উভয়ধারার আলেমদের মতে, নারী পুরুষের নামাজের বিধানে বেশ কিছু পার্থক্য আছে।

যে পার্থক্যগুলোর ক্ষেত্রে উভয়ধারার আলেমগণ একমত –

১- মেয়েদের নামাজে আযান বা একামত নেই

২- মেয়েরা উচ্চস্বরে কেরাত পড়বে না

৩- মেয়েদের নামাজে সতর ঢাকার পরিমাণ পুরুষের চেয়ে বেশি।

৪- মেয়েদের মাথা উন্মুক্ত থাকলে নামাজ হবে না।

৫- মেয়েরা জামাতে নামাজ আদায় করলে পুরুষের পিছনে দাঁড়াবে

৫- মেয়েদের জন্যে জুময়ায় যাওয়া ফরজ নয়।

৬- মেয়েদের জন্যে জামাতে সালাত আদায় ওয়াজিব নয়

৭- মেয়েদের সালাত আদায়ের উত্তম জায়গা মসজিদ নয়, বরং ঘরের কোণ। পুরুষের জন্যে মসজিদে জামাতে অংশ নেয়া সুন্নাতে মুয়াক্কাদা বা ওয়াজিব।

৮- ইমামের ভুল হলে ছেলেদের মত তাসবীহ বা সুবহানাল্লাহ পড়বে না, বরং মেয়েরা নামাজে হাত চাপড়ে শব্দ করবে।

৯- ছেলেদের ক্ষেত্রে উত্তম হচ্ছে সর্বপ্রথম কাতার, আর মেয়েদের জন্যে উত্তম হচ্ছে সর্বশেষ কাতার।

১০- পুরুষ নারীর ইমাম হতে পারে, কিন্তু নারী পুরুষের ইমাম হতে পারে না।

১১- ছেলেরা জামাতে নামাজ আদায়কালে ইমাম সবার সামনে দাঁড়াবে, কিন্তু মেয়েদের জামাতে মেয়ে ইমাম হলে সে সবার মাঝে সামান্য এগিয়ে দাঁড়াবে। (উল্লেখ্য, হাসান বসরী রহ., মালেকী ও হানাফী মাজহাব অনুযায়ী, শুধুমাত্র মহিলাদের জামাত নেই)

১২- নারী পুরুষ জামাত আদায়কালে ছেলেরা মুকাব্বির হতে পারবে। মেয়েরা পারবে না।

১৩- মেয়েরা পুরুষের সাথে জামাত আদায়কালে জোরে আমীন বলবে না।

১৪- মহিলা মাথার চুল বেঁধে নামায পড়তে পারে, কিন্তু (লম্বা চুল হলে) পুরুষ তা পারে না।

১৫- সেজদার সময় মহিলারা পুরুষের পর মাথা উঠাবে।

১৬- মহিলারা জামাতে নামাজ আদায় করলে তারা নামাজ শেষ করেই বেড়িয়ে যাবে। আর পুরুষের জন্যে নামাজের পর কিছুক্ষণ মসজিদে অপেক্ষা করা মুস্তাহাব।

১৭- কাতারে একাকী কোন পুরুষের দাঁড়ানো সকল আইম্মাদের মতে মাকরুহ। কিন্তু নারীর ক্ষেত্রে জায়েজ।

১৮- মেয়েদের জন্যে মুস্তাহাব হচ্ছে ওয়াক্ত শুরু হলেই সালাত আদায় করে নেয়া। পুরুষ তা করবে না। বরং আযান হলে মসজিদে গিয়ে নামাজ আদায় করবে।

এই সমস্ত পার্থক্যগুলো হাদিস দ্বারা প্রমাণিত। এতে সামান্য কমবেশ সবারই সহমত আছে। (প্রতিটা পার্থক্যের হাদিস উল্লেখ করতে গেলে নোট দীর্ঘ হয়ে যাবে বিধায়, শুধু মাসায়েল উল্লেখ করা হলো)

এত এত পার্থক্য থাকা সত্ত্বেও, মাত্র ৩/৪ টা পার্থক্যের বিরোধিতা করতে গিয়ে এই কথা বলা “নারী পুরুষের নামাজে পার্থক্য নেই”, এটা অযৌক্তিক বলেই মনে হয়।  

বরং এই শিরোনামটাই আজকে যত তর্কের বিতর্কের উৎস। কারণ নারী পুরুষের নামাজ একই, এর পক্ষে যে সমস্ত বানী ও আছার পেশ করা হয়। তার মূল মর্ম হচ্ছে, নারী পুরুষের নামাজে যেসব ক্ষেত্রে কোন পার্থক্য বর্ণিত নেই সেখানে উভয়ের নামাজ এক। এটাই যুক্তিসংগত। অর্থাৎ যেখানে পার্থক্য নেই সেখানে নারী পুরুষের নামাজ এক। এভাবে বলা হলে অর্ধেক বিতর্কই শেষ হয়ে যায়। বাস্তবতাও তাই।

এবার আসুন খেয়াল করি,
এই যে পার্থক্যগুলো, শরীয়তে এটা কেন করা হলো? জোরে কেরাত পড়া যাবে না, তাসবীহ বলবে না, হাত চাপড়াবে, চুল খোলা রাখতে পারবে না ইত্যাদি।  এই পার্থক্যগুলো লক্ষ করলেই বোঝা যায়, প্রতিটা পার্থক্যের পিছনে একটা সূক্ষ্ম কারণ নিহিত রয়েছে, সেটা হচ্ছে ‘পর্দা’ ‘আবৃত করা’ বা ‘লুকানো’! শরীয়তের মেজাজই হচ্ছে নারীকে নামাজে লুকানো, প্রকাশিত করা নয়।

একটি হাদিস এই বিষয়কে আরো স্পষ্ট করে,
عن عبد الله عن النبي صلى الله عليه وسلم قال إن المرأة عورة فإذا خرجت استشرفها الشيطان وأقرب ما تكون من وجه ربها وهي في قعر بيتها
আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা. থেকে বর্ণিত রাসূল সা. বলেন, নারী হচ্ছে ‘আউরাহ’ (যাকে লুকানো হয়)। যখন কোন মেয়ে ঘর থেকে বের হয় তখন শয়তান তাকে পুরুষের কাছে মোহনীয় করে তোলে। পক্ষান্তরে মহিলারা স্বীয় বাড়ীর সবচেয়ে গোপন স্থানে আল্লাহ পাকের অধিক নৈকট্য লাভ করে থাকে।
সহীহ ইবনে খুযাইমা- ১৬৮৫,
মুজামুল কাবীর- ৯৪৮১, তিরমিজি ১১৭৩, ইবনে হিব্বান -৫৫৯৯ (সহীহ)

এই হাদিসের শুরু অংশটুকু খেয়াল করুন। আল্লাহর নবী শরীয়তের মেজাজ বলে দিয়েছেন এক বাক্যে। “নারী হচ্ছে আউরাহ”! হজ্ব থেকে নিয়ে সালাহ, সফরসহ বহু বিধানের ক্ষেত্রে স্রেফ মেয়েদের পর্দার কারণেই এত এত পার্থক্য তৈরি হয়েছে। এই পার্থক্যগুলোর ক্ষেত্রে কিন্তু উভয়ধারার আলেমগণ একমত।

মেয়েদের নামাজের প্রচলিত আরো কিছু পদ্ধতি যাতে উভয়ধারার আলেমগণ একমত-

১- মহিলারা বুকে হাত বাধবে।

২- শেষ বৈঠকে দু পা ডানে বের করে বা পার্শ্বে ভর দিয়ে বসা।

এই ক্ষেত্রেও উভয়ধারার আলেমগণ একমত। আহলে হাদিস আলেমগণ একমত কারণ তারা এটাকেই কেবল সুন্নত মনে করেন। সেটা পুরুষের ক্ষেত্রে হোক বা নারীর ক্ষেত্রে। আর অন্যান্য আলেমগণ কেবল মহিলাদের ক্ষেত্রে এটাকে মুস্তাহাব মনে করেন।
তাহলে প্রকৃত এখতেলাফ কোন জায়গায়?

মাত্র কয়েকটি ব্যাপারে দ্বিমত পোষণ করে থাকেন। এই কয়েকটি বিষয় রদ করতে গিয়েই শিরোনাম দেয়া হয় ‘নারী পুরুষের নামাজ একই’! যেমন,

১- মেয়েরা নামাজে হাত কোন পর্যন্ত তুলবে?
মাজহাব- কাঁধ পর্যন্ত বা বুক পর্যন্ত। আর সেটা ওড়নার নীচে।
ভিন্নমত – কান পর্যন্ত

২- মেয়েরা কীভাবে রুকু করবে?
মাজহাব- পুরুষের মত ঘাড় আর নিতম্ব সমান করে দিবে না। বরং অত্যন্ত সংকোচিতভাবে সামান্য ঝুঁকবে। যাতে হাত দিয়ে উরু নাগাল পাওয়া যায়।
ভিন্নমত- পুরুষের মতই পিঠ আর ঘাড় সমান করে দিবে।

৩- নারীরা কীভাবে সেজদা করবে?
মাজহাব – সিজদা অবস্থায় মহিলারা এক অঙ্গের সাথে অপর অঙ্গকে মিলিয়ে রাখবে, কনুইসহ দু’হাত মাটিতে বিছিয়ে দেবেন। তাদের পেট দু’রানের সাথে মিলিয়ে দেবেন। উভয় বাহু পাঁজরের সাথে মিলিয়ে রাখবেন। হাত পায়ের আঙ্গুল কিবলামুখী রাখবেন। পা খাড়া করবেন না। মোটকথা সিজদা এমন ভাবে করবে যাতে সতরের অধিক হেফাযত হয়। পুরুষের মত কোমর উঁচু করে দু হাত ছড়িয়ে লম্বা হয়ে সেজদা করবে না।
ভিন্নমত – পুরুষের মতই কোমর উঁচু করে দু হাত ছড়িয়ে লম্বা হয়ে সেজদা করবে ।

প্রসঙ্গত, নারী পুরুষের নামাজের ভিন্নতা নেই, অথবা আছে। এই যে এখতেলাফ, এটা কেবল হানাফীদের বিরুদ্ধে নয়, বরং বলতে গেলে ৪ মাজহাবের সবার সাথেই এই এখতেলাফ। সুতরাং মত বর্ণনার ক্ষেত্রে “মাজহাব ও ভিন্নমত” এভাবে লেখা হয়েছে।
নারীকে বলা হয়েছে ‘আওরাহ’। অর্থাৎ যাকে লুকোনো হয়, গোপন করা হয়। ইসলামের আদি ও অকৃত্রিম দর্শন হচ্ছে এটাই। নারী তার সতর ও আওরাত এর ক্ষেত্রে যত্নশীল হবে, হওয়া উচিতও বটে । তাই অর্ধশত বছর আগ পর্যন্ত গত হওয়া প্রায় তাবৎ ফুকাহায়ে কেরাম নারীদের রুকু ও সেজদার পার্থক্য করেছেন। শালীনতা আর শরীয়তের মেজাজ “আওরাহ” এর প্রতি লক্ষ্য রেখে।

পুরুষের মত রুকু সেজদার ক্ষেত্রে সমস্যা হচ্ছে এতে ঐ মাত্রায় শালীনতা থাকে না যেটা পার্থক্য করার ক্ষেত্রে থাকে। যেমন, পুরুষের রুকু হচ্ছে এই পরিমাণ মাথা ঝুঁকিয়ে দেয়া যাতে কোমর আর ঘাড় সমান হয়ে যায়। এভাবে রুকুতে নিতম্বের আকৃতি স্পষ্ট হয়ে যায়। যেটা পুরুষের ক্ষেত্রে সমস্যা না হলেও নারীর ক্ষেত্রে মানানসই নয়।

পুরুষের সেজদার ক্ষেত্রে নিয়ম হচ্ছে, নিতম্ব উঁচিয়ে দেয়া। দু হাত বগল থেকে পৃথক করে ছড়িয়ে দেয়া। হাত যেন জমিনে না লাগে। আর পেট যেন হাঁটুতে না লাগে।

এই দু অবস্থা পুরুষের ক্ষেত্রে অবলীলায় মানানসই হলেও, মেয়েদের ক্ষেত্রে? নিঃসন্দেহে এটা শরীয়তের পর্দার মেজাজের সাথে যায় না। কারণ এভাবে মহিলারা রুকু বা সেজদায় গেলে, পিছনে মাহরাম অবস্থান করাও মুশকিল হয়ে যাবে। গায়রে মাহরাম তো কথাই নেই।  যেমন ধরুন, হজ বা ওমরাহতে যেখানে খোলা জায়গায় নামাজ পড়তে হয়। সেখানে ঐভাবে পুরুষের মত রুকু সেজদা করা কি পর্দাপুশিদার সাথে মানানসই?

(আগামী পর্বে ইনশা আল্লাহ, দলীলগুলো নিয়ে আলোচনা হবে)


১ম পর্বের লিংক https://adarshanari.com/ibadaat/namaz/8191/

৩য় পর্বের লিংক https://adarshanari.com/ibadaat/namaz/8203/

৪র্থ পর্বের লিংক https://adarshanari.com/ibadaat/namaz/8209/

৫ম পর্বের লিংক https://adarshanari.com/ibadaat/namaz/8214/

4 thoughts on “পুরুষ মহিলার নামাযের পার্থক্য : নারী পুরুষের নামাজ কি অভিন্ন? (২য় পর্ব)

  1. আসসালামু আলাইকুম। আমি ছেলেদের মতো সিজদা রুকু দেই। এটা নাকি সালাফি আকিদার লোকেরা করেন। আমার কোনো ধারনা নেই এ সম্পর্কে। আমি শুনে শুনে এইভাবে নামাজ পড়ছি। এখন আমার কাছে সন্দেহ লাগছে। এই অবস্থায় আমি কি করবো?

    1. আপনি উপরের কুরআন,সুন্নাহের আলোকে ফতোয়া গ্রহণ করে সালাত আদায় করুন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.