পুরুষ মহিলার নামাযের পার্থক্য : নারীদের নামাজের ভিন্নতা, দলীল ও পর্যালোচনা (পর্ব-৩)


মুফতি আব্দুল্লাহ আল মাহমুদ


মেয়েদের সালাতের ভিন্নতা সম্পর্কে আহলে মাযাহেব ও ফুকাহাদের দলীল ——

পূর্বেই আলোচনা হয়েছে। নারীদের নামাজের বেশ কিছু পার্থক্য রয়েছে।  কিছুক্ষেত্রে সবাই একমত, কিছুক্ষেত্রে দ্বিমত। যেসব ক্ষেত্রে দ্বিমত তার বিস্তারিত বিবরণ গত পর্বে গিয়েছে।  যারা পার্থক্যগুলোর প্রবক্তা , তাদের দলীলগুলো আজ উপস্থাপন করা হবে ইনশা আল্লাহ!

নারীদের নামাজে যে পার্থক্যগুলোতে আহলে হাদিস ও সালাফি আলেমগণ একমত নন 

১- তাকবীরে তাহরিমার সময় মহিলারা কাঁধ পর্যন্ত হাত তুলবে। হাতের কব্জি থাকবে থাকবে বুক বরাবর। আঙ্গুলের মাথা থাকবে কাঁধ বরাবর।

২-মেয়েরা বুকে হাত বাঁধবেন। বাম হাতের পিঠের উপর ডান হাতের পাতা রাখবেন। পুরুষের ন্যায় কব্জি ধরবেন না। এবং গোলাকৃতি বানাবেন না।

৩-মেয়েরা রুকুতে সামান্য একটু ঝুঁকবেন। হাঁটুর উপর হাত রাখবেন। রুকুতে হাতের আঙ্গুলগুলো মিলিয়ে রাখবেন। হাতের বাহু পাঁজরের সাথে মিলিয়ে রাখবেন।

৪- সিজদা অবস্থায় মহিলারা এক অঙ্গের সাথে অপর অঙ্গকে মিলিয়ে রাখবে,মেয়েরা যথা সম্ভব চেপে ও মাটির সাথে মিশে সেজদা করবেন। কনুইসহ দু’হাত মাটিতে বিছিয়ে দেবেন। তাদের পেট দু’রানের সাথে মিলিয়ে দেবেন। উভয় বাহু পাঁজরের সাথে মিলিয়ে রাখবেন। হাত পায়ের আঙ্গুল কিবলামুখী রাখবেন। পা খাড়া করবেন না। এক কথায় সিজদা এমন ভাবে করবে যাতে সতরের অধিক হেফাযত হয়।

৫- উভয় বৈঠকে মহিলাগণ বাম নিতম্বের উপর বসবেন। হাতগুলো রানের উপর রাখবেন। পা দুটো ডান দিকে বের করে দেবেন। আঙ্গুলগুলো মিলিয়ে রাখবেন।

যারা এই মতের প্রবক্তা, তারা দলীল দিয়ে থাকেন-

১। হাদীস শরীফের আলোকে।

২। সাহাবায়ে কেরামের বক্তব্য ও কর্মের আলোকে।

৩। তাবেয়ী ইমাম গনের আছারের আলোকে।

হাদীস শরীফের আলোকে:

হাদিস:১
– أخبرناه أبو بكر محمد بن محمد أنبأ أبو الحسين الفسوي ثنا أبو علي اللؤلؤي ثنا أبو داود ثنا سليمان بن داود أنبأ بن وهب أنبأ حيوة بن شريح عن سالم بن غيلان عن يزيد بن أبي حبيب : أن رسول الله صلى الله عليه و سلم مر على امرأتين تصليان فقال إذا سجدتما فضما بعض اللحم إلى الأرض فإن المرأة ليست في ذلك كالرجل (سنن الكبرى للبيهقى، كتاب الحيض، باب ما يستحب للمرأة من ترك التجافي في الركوع والسجود، رقم الحديث- 3016)
তাবেয়ী ইয়াযীদ বিন আবী হাবীব রহ. বলেন-একবার রাসূল সা. দুই মহিলার পাশ দিয়ে যাচ্ছিলেন। তখন তাদেরকে (সংশোধনের উদ্দেশ্য) বললেন-“যখন সেজদা করবে তখন শরীর যমীনের সাথে মিলিয়ে দিবে। কেননা মহিলারা এ ক্ষেত্রে পুরুষদের মত নয়। (সুনানুল বায়হাকী, হাদিস নং-৩০১৬,কিতাবুল মারাসিল লি ইমাম আবু দাউদ-৫৫, হাদিস নং-৮০)

হাদিসটির ব্যাপারে মুহাক্কিকদের মন্তব্য:

১/ প্রসিদ্ধ মুহাদ্দিস, আহলে হাদিস ও সালাফী ঘরানার বরেণ্য আলেম, নওয়াব সিদ্দীক হাসান খান বুখারী শরীফের ব্যাখ্যাগ্রন্থ “আওনুল বারী” (১/৫২০) তে লিখেছেন-“উল্লেখিত হাদিসটি সকল ইমামদের উসুল অনুযায়ী দলীল হিসেবে পেশ করায় যোগ্য”.

২/ একই ধারার অপর মুহাদ্দিস মুহাম্মদ ইবনে ইসমাঈল আমীর ইয়ামানী “সুবুলুস সালাম” শরহু বুলুগিল মারাম” গ্রন্থে (১/৩৫১-৩৫২) এই হাদিসকে দলীল হিসেবে গ্রহণ করে পুরুষ ও মহিলার সেজদার পার্থক্য করেছেন।

৩/ প্রসিদ্ধ মুহাদ্দিস শায়েখ শুয়াইব আরনাউত (র:) হাদীসটির সূত্র সম্পর্কে বলেন, বর্ণনা কারী প্রত্যেক রাবী সিকাহ (নির্ভরযোগ্য) ।
( তালীক আলা মারাসিলে আবী দাউদ পৃঃ ১১৭ )

৪/ শায়খ আলবানি রহ. এই হাদিসের সনদের রাবীদেরকে নির্ভরযোগ্য আখ্যা দিয়ে হাদিসটির ব্যাপারে বলেন-
فعلة الحديث الإرسال فقط. والله أعلم.
“এই হাদিসের সকল রাবী নির্ভরযোগ্য। তবে এটি দুর্বল হওয়ার একমাত্র কারণ, হাদিসটি মুরসাল। আল্লাহ ভালো জানেন!”
(সিলসিলাতুল আহাদিসীদ দায়ীফাহ – ২৬৫২)

মুরসাল বলতে, এই হাদিসের বর্ণনাকারী ইয়াযীদ বিন আবী হাবীব একজন তাবেয়ী, তিনি রাসূল সা. থেকে হাদিস বর্ণনা করেছেন। সুতরাং মাঝে অবশ্যই কেও বাদ পরেছে। হতে পারে তিনি কেবল একজন সাহাবী, অথবা কিবারে তাবেয়ী ও সাহাবী দুজন। যেহেতু একজন তাবেয়ী থাকার সম্ভাবনা আছে তাই হতে পারে তিনি সিকাহ, হতে পারে দুর্বল। এই সম্ভাবনাটাই শায়খ আলবানির কাছে হাদিসের দুর্বলতার কারণ! আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে, শায়খ যে হালকা ভাবে হাদিসটিকে দুর্বল বললেন, আমাদের দেশে এই হাদিসটিই হয়ে গেল ”মারাত্মক দুর্বল”।

মুরসাল প্রায় সকল ইমামের নিকট শর্তসাপেক্ষে গ্রহণযোগ্য। ইবনে রাজাব হামবলী ৪ টি শর্ত উল্লেখ করেছেন মুরসাল গ্রহণযোগ্য হওয়ার জন্যে। এখানে বিস্তারিত আলোচনার স্থান না, তবে উক্ত ৪ টি শর্ত এই হাদিসে পাওয়া যায়। সুতরাং এখানে মুরসাল হওয়ার দ্বারা হাদিসটি দুর্বল হবে না।
(বিস্তারিত দেখুন, কাওয়ায়েদ ফু উলুমিল হাদিস ১৪৩-১৪৬)

হাদিস – ২
وَالآخَرُ حَدِيثُ أَبِى مُطِيعٍ : الْحَكَمِ بْنِ عَبْدِ اللَّهِ الْبَلْخِىِّ عَنْ عُمَرَ بْنِ ذَرٍّ عَنْ مُجَاهِدٍ عَنْ عَبْدِ اللَّهِ بْنِ عُمَرَ قَالَ قَالَ رَسُولُ اللَّهِ -صلى الله عليه وسلم- :« إِذَا جَلَسْتِ الْمَرْأَةُ فِى الصَّلاَةِ وَضَعَتْ فَخِذَهَا عَلَى فَخِذِهَا الأُخْرَى ، وَإِذَا سَجَدْتْ أَلْصَقَتْ بَطْنَهَا فِى فَخِذَيْهَا كَأَسْتَرِ مَا يَكُونُ لَهَا ، وَإِنَّ اللَّهَ تَعَالَى يَنْظُرُ إِلَيْهَا وَيَقُولُ : يَا مَلاَئِكَتِى أُشْهِدُكُمْ أَنِّى قَدْ غَفَرْتُ لَهَا (السنن الكبرى، كتاب الصلاة، باب مَا يُسْتَحَبُّ لِلْمَرْأَةِ مِنْ تَرْكِ التَّجَافِى فِى الرُّكُوعِ وَالسُّجُودِ، رقم الحديث-3324)
হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে ওমর রা. থেকে বর্ণিত। রাসূল সা. ইরশাদ করেছন-“মহিলা যখন নামাযের মধ্যে বসবে তখন যেন (ডান) উরু অপর উরুর উপর রাখে। আর যখন সেজদা করবে তখন যেন পেট উরুর সাথে মিলিয়ে রাখে। যা তার সতরের জন্য অধিক উপযোগী। আল্লাহ তায়ালা তাকে দেখে বলেন-ওহে আমার ফেরেশতারা! তোমরা সাক্ষী থাক। আমি তাকে ক্ষমা করে দিলাম। (সুনানে বায়হাকী-২/২২৩, হাদিস নং-৩৩২৪)

হাদিসের মান-
এই হাদিসের সনদে আবু মুতী বলখী নামে একজন রাবী আছে। তার ব্যাপারে ইমামগণের যে সমালোচনা তার সার কথা হচ্ছে, হাদিস মুখস্থ করার ক্ষেত্রে শিথিল, আর তিনি মুরজিয়া ছিলেন। উকাইলী বলেন তিনি ‘সালেহুল হাদিস’! কিন্তু ইমাম বুখারীসহ অনেকেই উনাকে দুর্বল বলেছেন। যদি উকাইলীর কথা ধরা হয়, তবে এই সনদ হাসান পর্যায়ের। যেমনটা অনেক আলেম বলে থাকেন। আর শায়খ আলবানি সহ আরো অনেকে এই হাদিসকে দুর্বল বলেছেন ইমাম বুখারী ও অন্যান্যদের কথার উপর ভিত্তি করে।
অধমের মত হচ্ছে, এই হাদিস হাসান লি গাইরিহি। কারণ দুর্বল সূত্রে হলেও এর শাওয়াহেদ আছে। সাহাবীদের ফতোয়া ও তাবেয়ীদের আছার আছে। সর্বোপরি খাইরুল কুরুনের আমল আছে এর উপর।

হাদিস- ৩
حَدَّثَنَا مُحَمَّدُ بْنُ عَبْدِ اللهِ الْحَضْرَمِيُّ قَالَ: حَدَّثَتْنِي مَيْمُونَةُ بِنْتُ حُجْرِ بْنِ عَبْدِ الْجَبَّارِ بْنِ وَائِلِ بْنِ حُجْرٍ قَالَتْ: سَمِعْتُ عَمَّتِي أُمَّ يَحْيَى بِنْتَ عَبْدِ الْجَبَّارِ بْنِ وَائِلِ بْنِ حُجْرٍ، عَنْ أَبِيهَا عَبْدِ الْجَبَّارِ، عَنْ عَلْقَمَةَ عَمِّهَا، عَنْ وَائِلِ بْنِ حُجْرٍ قال : جئت النبي صلى الله عليه و سلم ………….فقال لي رسول الله صلى الله عليه و سلم : يا وائل بن حجر إذا صليت فاجعل يديك حذاء أذنيك والمرأة تجعل يديها حذاء ثدييها (المعجم الكبير، باب الواو، وائل بن حجر الحضرمي القيل، رقم الحديث-28)
হযরত ওয়াইল বিন হুজর রা. বলেন। আমি নবীজী সা. এর দরবারে হাজির হলাম। তখন তিনি আমাকে (অনেক কথার সাথে একথাও) বলেছিলেন যে, হে ওয়াইল বিন হুজর! যখন তুমি নামায শুরু করবে তখন কান বরাবর হাত উঠাবে। আর মহিলা হাত উঠাবে বুক বরাবর। (আল মুজামুল কাবীর, হাদিস নং-২৮)

হাদিসের মান-
যারা এই আমলের পক্ষে নয় তারা বলেন, এই হাদিসের একজন রাবী উম্মে ইয়াহইয়া তার হালত জানা যায় না, যে তিনি নির্ভরযোগ্য নাকি দুর্বল? তাই হাদিসটি দুর্বল! হায়ছামী বলেন, উম্মে ইয়াহইয়া ছাড়া বাকী রাবীরা সিকাহ!
যারা এই আমলের পক্ষে তারা বলেন, উম্মে ইয়াহইয়া যে পর্যায়ের রাবী তাতে প্রতিভাত হয় তিনি কিবারে তাবে তাবেয়ীর অন্তর্ভুক্ত। আর এই স্তরের মাসতুর রাবীর বর্ণনা দ্বারা দলীল পেশ করা যায়। সুতরাং হাদিসটি হাঁসান।
অধমের খেয়াল, এই হাদিসটি হাসান লি গাইরিহি। উসূল অনুযায়ী যেহেতু এর সহীহ সূত্রে বর্ণিত বিভিন্ন আছার দ্বারা শাওয়াহেদ (সমর্থন) পাওয়া যায়, তাই এই হাদিস হাসান পর্যায়ে উন্নীত।

সাহাবায়ে কিরামের আমল ও ফতোয়া :-

হাদিস – ১
– عبد الرزاق عن إسرائيل عن أبي إسحاق عن الحارث عن علي قال إذا سجدت المرأة فلتحتفز ولتلصق فخذيها ببطنها (مصنف عبد الرزاق، كتاب الصلاة، باب تكبير المرأة بيديها وقيام المرأة و ركوعها وسجودها، رقم الحيث-5072)
হযরত আলী রা. বলেছেন-মহিলা যখন সেজদা করে তখন সে যেন খুব জড়সড় হয়ে সেজদা করে এবং উভয় উরু পেটের সাথে মিলিয়ে রাখে। (মুসান্নাফে আব্দুর রাজ্জাক-৩/১৩৮, হাদিস নং-৫০৭২, মুসান্নাফে ইবনে শাইবা-২/৩০৮, হাদিস নং-২৭৯৩, সুনানে কুবরা বায়হাকী-২/২২২)

মান- হাসান

হাদিস -২
حَدَّثَنَا أَبُو عَبْدِ الرَّحْمَنِ الْمُقْرِئ ، عَنْ سَعِيدِ بْنِ أَبِي أَيُّوبَ ، عَنْ يَزِيدَ بْنِ أَبِي حَبِيبٍ ، عَنْ بُكَيْرِ بْنِ عَبْدِ اللهِ بْنِ الأَشَجِّ ، عَنِ ابْنِ عَبَّاسٍ ؛ أَنَّهُ سُئِلَ عَنْ صَلاَةِ الْمَرْأَةِ ؟ فَقَالَ : تَجْتَمِعُ وَتَحْتَفِزُ. (مصنف ابن ابى شيبة، كتاب الصلاة، في المرأة كَيْفَ تَجْلِسُ فِي الصَّلاَةِ، رقم الحديث-2794)
হযরত ইবনে আব্বাস রা. কে জিজ্ঞেস করা হল-মহিলারা কিভাবে নামায আদায় করবে? তিনি বললেন-“খুব জড়সড় হয়ে অঙ্গের সাথে অঙ্গ মিলিয়ে নামায আদায় করবে। (মুসান্নাফে ইবনে আবী শাইবা-১/৩০২, হাদিস নং-২৭৯৪)

এই সনদের সকল রাবী নির্ভরযোগ্য!

হাদিস -৩
عن ﺍﻣﺎﻣﻨﺎ ﺍﻻﻋﻈﻢ ابي حنيفة النعمان ﻋﻦ ﻧﺎﻓﻊ ﻋﻦ ﺍﺑﻦ ﻋﻤﺮ ﺭﺿﻰ ﺍﻟﻠﻪ ﻋﻨﻬﻤﺎ ﺍﻧﻪ ﺳﺌﻞ ﻛﻴﻒ ﻛﺎﻥ ﺍﻟﻨﺴﺎﺀ ﻳﺼﻠﻴﻦ ﻋﻠﻰ ﻋﻬﺪ ﺭﺳﻮﻝ ﺍﻟﻠﻪ ﺻﻠﻰ ﺍﻟﻠﻪ ﻋﻠﻴﻪ ﻭﺳﻠﻢ . ﻗﺎﻝ :ﻛﻦ ﻳﺘﺮﺑﻌﻦ ﺛﻢ ﺍﻣﺮﻥ ﺍﻥ ﻳﺤﺘﻔﺰﻥ . ﺍﺧﺮﺟﻪ ﺍﺑﻮ ﻣﺤﻤﺪ ﺍﻟﺤﺎﺭﺛﻲ ﻭﺍﻻﺷﻨﺎﻧﻰ ﻭﺍﺑﻦ ﺧﺴﺮﻭ ﻣﻦ ﻃﺮﻳﻘﻪ ﻋﻦ ﺳﻔﻴﺎﻥ ﺍﻟﺜﻮﺭﻱ ﻋﻨﻪ . ‏(ﺭﺍﺟﻊ ﺟﺎﻣﻊ ﺍﻟﻤﺴﺎﻧﻴﺪ ﺝ١ﺹ٤٠٠ ‏)
হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে উমর রা: কে জিজ্ঞেস করা হল,রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের যুগে মহিলারা কীভাবে নামায পড়তেন?তিনি বললেন,আগে তারা চারজানু হয়ে বসতেন,পরে তাদেরকে জড়সড় হয়ে বসতে বলা হয়েছে।
(জামিউল মাসানীদ-ইমাম আবু হানীফা (রহঃ) খ: ১/৪০০, মুসনাদে আবী হানীফা বিরিওয়াতিল হাসকাফী-৩৭ )

সনদের মান- হাদিসটি সম্পূর্ণ সহীহ। এটি ইমাম আবু হানীফা সরাসরি নাফে’ থেকে, তিনি ইবনে ওমর রা. থেকে বর্ণনা করেছেন।

হাদিস -৪
ইবনে রাজাব হামবলী, তার লিখিত বুখারীর ব্যাখ্যাগ্রন্থ “ফাতহুল বারী”তে, সুনানে সাইদ ইবনে মানসুর এর উদ্ধৃতিতে একটি হাদিস উল্লেখ করেছেন,
وروى سعيد بن منصور بإسناده ، عن عبد الرحمن بن القاسم ، قال كانت عائشة تجلس في الصلاة عن عرقيها وتضم فخذيها، وربما جلست متربعة .

“আয়েশা রা. বৈঠকে দুই উরু একদম মিলিয়ে রাখতেন এবং প্রায়শই দু পা ডানদিকে বের করে নিতম্বের উপর বসতেন।”
ফাতহুল বারী ৭/৩০০- উল্লেখ্য আমি যথাসম্ভব চেষ্টা করেও এই হাদিসের সনদ খুঁজে পাই নি। সুনানে সাইদ ইবনে মানসুর এর প্রচলিত নুসখা যার আংশিক ৫ খণ্ডে প্রকাশিত। তাতেও নেই। প্রথম পর্বে বলেছিলাম, এমন বহু কিতাব বিলুপ্ত, অনেক কিতাব আজও অনুদ্ঘাটিত ও অপ্রকাশিত। ইবনে রাজাব হামবলী (মৃ ৭৯৫ হি.) এর মত ব্যক্তিত্ব বিনা তাহকীকে আন্দাজে লিখে দিবেন, ভাবা মুশকিল। আল্লাহ ভালো জানেন, হয়ত তার কাছে ছিল, মূল নুসখাতে আছে। কিন্তু আমাদের নুসখাতে (কপি) নেই!

তাবেয়ীদের আমল ও ফতওয়া:-

 

আছার – ১
حدثنا هشيم ، قال : أخبرنا شيخ لنا ، قال : سمعت عطاء ؛ سئل عن المرأة كيف ترفع يديها في الصلاة ؟ قال : حذو ثدييها(مصنف ابن ابى شيبه، كتاب الصلاة، باب من كان يتم التكبير ولا ينقصه في كل رفع وخفض،)
হযরত আতা বিন আবী রাবাহ কে জিজ্ঞেস করা হল-“নামাযে মহিলা কতটুকু হাত উঠাবে?” তিনি বললেন-“বুক বরাবর”। (মুসান্নাফে ইবনে আবী শাইবা,-১/২৭০, হাদিস নং-২৪৮৬)

আছার- ২
– حدثنا محمد بن بكر ، عن ابن جريج ، قال : قلت لعطاء : تشير المرأة بيديها بالتكبير كالرجل ؟ قال : لا ترفع بذلك يديها كالرجل ، وأشار فخفض يديه جدا ، وجمعهما إليه جدا ، وقال : إن للمرأة هيئة ليست للرجل ، وإن تركت ذلك فلا حرج.
হযরত ইবনে জুরাইজ রহ. বলেন-“আমি আতা বিন আবী রাবাহকে জিজ্ঞেস করলাম-“মহিলা তাকবীরের সময় পুরুষের সমান হাত তুলবে?” তিনি বললেন-“মহিলা পুরুষের মত হাত তুলবে না। এরপর তিনি তার উভয় হাত (পুরুষ অপেক্ষা) অনেক নিচুতে রেখে শরীরের সাথ খুব মিলিয়ে রাখলেন এবং বললেন-মহিলাদের পদ্ধতি পুরুষ থেকে ভিন্ন। তবে এমন না করলেও অসুবিধা নেই। (মুসান্নাফে ইবনে আবী শাইবা-১/২৭০, হাদিস নং-২৪৮৯, মুসান্নাফে আব্দুর রাজ্জাক,হাদিস নং-৫০৬৬,৬২৫১)

আছার -৩
حدثنا جرير ، عن ليث ، عن مجاهد ؛ أنه كان يكره أن يضع الرجل بطنه على فخذيه إذا سجد كما تصنع المرأة.
হযরত মুজাহিদ বিন জাবর যিনি মক্কাবাসীদের ইমাম ছিলেন, প্রখ্যাত তাবেয়ী, তার থেকে বর্ণিত। তিনি পুরুষের জন্য মহিলার মত উরুর সাথে পেট লাগিয়ে সেজদা করাকে অপছন্দ করতেন। (মুসান্নাফে ইবনে আবী শাইবা-১/৩০২, হাদিস নং-২৮৯৬)

আছার – ৪
– حدثنا رواد بن جراح ، عن الأوزاعي ، عن الزهري ، قال : ترفع يديها حذو منكبيها.
হযরত যুহরী রহ. যিনি মদীনাবাসীদের ইমাম, তিনি বলেন-“মহিলা কাঁধ পর্যন্ত হাত উঠাবে। (মুসান্নাফে ইবনে আবী শাইবা-১/২৭০, হাদীস নং-২৪৮৭)

আছার – ৫
– عبد الرزاق عن معمر عن الحسن وقتادة قالا إذا سجدت المرأة فإنها تنضم ما استطاعت ولا تتجافى لكي لا ترفع عجيزتها
হযরত হাসান বসরী যিনি বসরাবাসীদের ইমাম, ও কাতাদা রহ. বলেন-“মহিলা যখন সেজদা করবে তখন সে যথাসম্ভব জড়সড় হয়ে থাকবে। অঙ্গ প্রত্যঙ্গ ফাঁকা রেখে সেজদা দেবে না যাতে কোমর উঁচু হয়ে না থাকে”। (মুসান্নাফে আব্দুর রাজ্জাক-৩/১৩৭, হাদিস নং-৫০৬৮, মুসান্নাফে ইবনে আবী শাইবা-১/৩০৩)

আছার – ৬
– حَدَّثَنَا أَبُو الأَحْوَصِِ ، عَنْ مُغِيرَةَ ، عَنْ إبْرَاهِيمَ ، قَالَ : إذَا سَجَدَتِ الْمَرْأَةُ فَلْتَضُمَّ فَخِذَيْهَا ، وَلْتَضَعْ بَطْنَهَا عَلَيْهِمَا.(مصنف ابن ابى شيبة، كتاب الصلاة، في المرأة كَيْفَ تَجْلِسُ فِي الصَّلاَةِ، رقم الحديث-2795)
হযরত ইবরাহীম নাখয়ী রহ. বলেন-মহিলা যখন সেজদা করবে তখন যেন সে উভয় উরু মিলিয়ে রাখে এবং পেট উরুর সাথে মিলিয়ে রাখে। (মুসান্নাফে ইবনে আবী শাইবা-১/৩০২, হাদিস নং-২৭৯৫)

আছার – ৭
– عبد الرزاق عن معمر والثوري عن منصور عن إبراهيم قال كانت تؤمر المرأة أن تضع ذراعها وبطنها على فخذيها إذا سجدت ولا تتجافى كما يتجافى الرجل لكي لا ترفع عجيزتها
হযরত ইবরাহীম নাখয়ী রহ. আরো বলেন-“মহিলাদের আদেশ করা হত তারা যেন সেজদা অবস্থায় হাত ও পেট উরুর সাথে মিলিয়ে রাখে। পুরুষের মত অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ ফাঁকা না রাখে। যাতে কোমর উঁচু হয়ে না থাকে। (মুসান্নাফে আব্দুর রাজ্জাক-৩/১৩৭, হাদিস নং-৫০৭১)

আছার -৮
– حَدَّثَنَا إسْمَاعِيلُ ابْنُ عُلَيَّةَ ، عَنْ مُحَمَّدِ بْنِ إِسْحَاقَ ، عَنْ زُرْعَةَ بْنْ إِبْرَاهِيمَ ، عَن خَالِدِ بْنِ اللَّجْلاَجِ ، قَالَ : كُنَّ النِّسَاءُ يُؤْمَرْنَ أَنْ يَتَرَبَّعْنَ إذَا جَلَسْنَ فِي الصَّلاَةِ ، وَلاَ يَجْلِسْنَ جُلُوسَ الرِّجَالِ عَلَى أَوْرَاكِهِنَّ ، يُتَّقي ذَلِكَ عَلَى الْمَرْأَةِ ، مَخَافَةَ أَنْ يَكُونَ مِنْهَا الشَّيءُ.
হযরত খালেদ বিন লাজ্জাজ, যিনি সিরিয়াবাসীদের ইমাম, তিনি বলেন-“মহিলাদেরকে আদেশ করা হত যেন নামাযে দুই পা ডান দিক দিয়ে বের করে নিতম্বের উপর বসে। পুরুষদের মত না বসে। আবরণযোগ্য কোন কিছু প্রকাশিত হয়ে যাওয়ার আশংকায় মহিলাদেরকে এমনি করতে হয়। (মুসান্নাফে ইবনে আবী শাইবা-১/৩০৩, হাদিস নং-২৭৯৯)

আছার – ৯
– حَدَّثَنَا خَطَّابُ بْنُ عُثْمَانَ , عَنْ إِسْمَاعِيلَ , عَنْ عَبْدِ رَبِّهِ بْنِ سُلَيْمَانَ بْنِ عُمَيْرٍ قَالَ: رَأَيْتُ أُمَّ الدَّرْدَاءِ «تَرْفَعُ يَدَيْهَا فِي الصَّلَاةِ حَذْوَ مَنْكِبَيْهَا»اخرجه البخاري في جزء رفع اليدين في الصلاة برقم 50
উম্মে দারদা যিনি তাবেয়ীদের মধ্যে বিখ্যাত ফকীহ ছিলেন, তিনি নামাজে কাঁধ পর্যন্ত হাত তুলতেন। (বুখারী- জুযউ রাফয়িল ইয়াদাইন- ৫০, সনদ সহীহ)

আছার – ১০
প্রখ্যাত তাবেঈ ইমাম ইবনু সীরিন (রহঃ) এর কন্যা হাফসা (রহঃ) থেকেও উক্ত আমল প্রমাণিত । ইমাম ইবনু শাইবা (রহঃ) বর্ণনা করেন
হাফসা বিনতে সীরিন (রহঃ) বুক বরাবর হস্তদ্বয় উঠিয়ে তাকবীর বললেন ।
— মুসান্নাফে ইবনু আবি শাইবা , হাদিস নং ২৪৭৫

প্রথম পর্বে আলোচনা গিয়েছে, সুন্নাতে মুতাওয়ারিসাহ নিয়ে। সুন্নাতে মুতাওয়ারিসাহ খাবরে ওয়াহেদ এর চেয়েও শক্তিশালী। খাবরে ওয়াহেদ সহীহ হলে সেটা যদি গ্রহণ করা হয়, তাহলে অনায়াসে সুন্নাতে মুতাওয়ারিসাহ গ্রহণীয় হবে। নামাজ মুসলমানের জীবনের একটি প্রাত্যহিক স্বাভাবিক আমল। প্রত্যেক মুসলমানের জন্যেই দৈনিক পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ আদায় করা ফরজ।

রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে সাহাবায়ে কেরাম যে দীন শিখেছেন, তাঁদের কাছ থেকে তা শিখেছেন তাবেয়ীগণ। তাঁদের এসমস্ত ফতোয়া থেকে এ কথাই প্রতীয়মান হয়—নারীদের রুকু সেজদা পুরুষের মত নয়। ইমাম বুখারী রহ.এর শায়েখ ইমাম ইবনে আবী শায়বা রহ. তাঁর প্রসিদ্ধ হাদীস সংকলন ‘আলমুসান্নাফ’-এ তাবেয়ী হযরত আতা ইবনে আবী রাবাহ, ইবনে জুরাইজ, ইবরাহীম নাখায়ী, মুজাহিদ, যুহরী, হাসান বসরী, কাতাদা রাহিমাহুমুল্লাহু তায়ালা প্রমুখের ফতোয়া উল্লেখ করেছেন। তাঁরা সকলেই নারীদের জন্যে পুরুষের চেয়ে ভিন্ন নামাজ আদায়ের পদ্ধতির ফতোয়া দিয়েছেন। আগ্রহী পাঠকগণ সেখানে দেখে নিতে পারেন।

(আগামী পর্বে নারীদের নামাজ অভিন্ন মর্মে দলীলগুলো নিয়ে পর্যালোচনা হবে ইনশা আল্লাহ! )


১ম পর্বের লিংক https://adarshanari.com/ibadaat/namaz/8191/

২য় পর্বের লিংক https://adarshanari.com/ibadaat/namaz/8197/

৪র্থ পর্বের লিংক https://adarshanari.com/ibadaat/namaz/8209/

৫ম পর্বের লিংক https://adarshanari.com/ibadaat/namaz/8214/

One thought on “পুরুষ মহিলার নামাযের পার্থক্য : নারীদের নামাজের ভিন্নতা, দলীল ও পর্যালোচনা (পর্ব-৩)

  1. এখানে প্রসিদ্ধ ছয়টি হাদিস গ্রন্থ থেকে ব্যাখ্যা নেই। সব হাদিসই দুর্বল হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে। পোক্ত দলিল পেলে ভালো হতো।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *