বারবার তওবার পরে গুনাহ হতে থাকলে করণীয়

প্রশ্ন: আসসালামু আলাইকুম। আমি আশা করছি, আপনারা আমাকে আল্লাহ্‌র শাস্তি ও গজব থেকে রক্ষা করবেন। আমি মুসলিম, ইসলামী পরিবেশে ও সচ্চরিত্রের উপর বড় হয়েছি। অন্যদের চোখে আমি এখনও তেমন। কিন্তু, হায় মুসিবত! নিজেকে কন্ট্রোল করার ক্ষেত্রে আমি খুব দুর্বল। অন্যদের অগোচরে মোবাইলে পর্নোগ্রাফি, অশ্লীল ছবি ও ভিডিও দেখি। আমি জানি আল্লাহ্‌ আমাকে দেখছেন। কিন্তু প্রতিবারই আমি এ অশ্লীল কাজে লিপ্ত হই। শুধু দেখা নয়; বরং হস্তমৈথুনে লিপ্ত হই।

আমি বিবাহিত এবং আমার সন্তান আছে। আমি জানি যে, আমি যা করছি সেটা পশুদের কাজ। আমি জানি যে, এ কাজ আমার নেক আমলগুলোকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে; বরং সমূলে ধ্বংস করে দিচ্ছে। আমি নামায পড়ি ও তওবা করি। একদিন বা দুইদিন সবর করি। পুনরায় এতে লিপ্ত হই।

এসব দৃশ্য ও ভিডিও দেখা এবং কুকামে লিপ্ত হওয়ার জন্য নিজের ভেতরে তীব্রভাবে অদ্ভুত তাড়না অনুভব করি। আমি জানি না— আমি কী করব? আমি জানি যে, আমার প্রভু যদি আমার মৃত্যু দেন তাহলে আমি জাহান্নামে প্রবেশ করব। কিন্তু আমি নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারছি না। আপনারা আমাকে রক্ষা করুন। আল্লাহ্ আপনাদের প্রতি রহম করুন।

উত্তর: ওয়া আলাইকুমুসসালাম।

সম্মানিত ভাই, আপনি পাপে লিপ্ত হয়ে এবং বারবার এর পুনরাবৃত্তি করে যে মানসিক যন্ত্রণায় আছেন তা আমরা অনুধাবন করছি। এটি ইতিবাচক আলামত যে, আপনার অন্তরের একটি অংশ অসুস্থ হলেও অপর একটি সুস্থ ও নিরাপদ অংশ রয়েছে।

এ রোগের মূলোৎপাটন করতে হলে— যা কিছু আপনাকে আল্লাহ্‌র অবাধ্যতার দিকে ধাবিত করে সে সবের প্রবেশদ্বার রুদ্ধ করে দিতে হবে, যা কিছু আপনাকে আল্লাহ্‌র রহমত থেকে নিরাশ করে দেয় সেগুলোর ফটক বন্ধ করে দিতে হবে। আল্লাহ্‌ তাআলা বলেন: “বলুন, হে আমার বান্দাগণ! তোমরা যারা নিজেদের প্রতি অবিচার করেছ— আল্লাহ্‌র অনুগ্রহ হতে নিরাশ হয়ো না; নিশ্চয় আল্লাহ্‌ সমস্ত গোনাহ ক্ষমা করে দেবেন। নিশ্চয় তিনি ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু।”[সূরা যুমার, আয়াত: ৫৩]

আল্লাহ্‌ তাআলা আরও বলেন: “এবং তারা আল্লাহ্‌র সাথে কোন ইলাহ্‌কে ডাকে না। আর আল্লাহ্‌ যার হত্যা নিষেধ করেছেন, যথার্থ কারণ ছাড়া তাকে হত্যা করে না। আর তারা ব্যভিচার করে না; যে এগুলো করে, সে শাস্তি ভোগ করবে। কিয়ামতের দিন তার শাস্তি বর্ধিতভাবে প্রদান করা হবে এবং সেখানে সে স্থায়ী হবে হীন অবস্থায়; তবে যে তাওবা করে, ঈমান আনে ও সৎকাজ করে, ফলে আল্লাহ্‌ তাদের গুনাহসমূহ নেক দ্বারা পরিবর্তন করে দেবেন। আর আল্লাহ্‌ ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু। আর যে তাওবা করে ও সৎকাজ করে, সে তো সম্পূর্ণরূপে আল্লাহ্‌র অভিমুখী।” -সূরা যুমার, আয়াত: ৬৮-৭১

ইবনুল কাইয়্যিম (রহ.) “আল-জাওয়াব আল-কাফী” গ্রন্থে (পৃষ্ঠা-১৬৫) বলেন: ন্যায্যতা ও অনুগ্রহ নির্ভর আল্লাহ্‌ তাআলার হেকমত হচ্ছে যে, “গুনাহ থেকে তাওবাকারী যেন ঐ ব্যক্তির ন্যায় যার গুনাহ নেই”।

যে ব্যক্তি শির্ক, হত্যা ও ব্যভিচারের গুনাহ থেকে তওবা করবে আল্লাহ্‌ তাকে এ নিশ্চয়তা দিয়েছেন যে, তিনি তার গুনাহগুলোকে নেকীতে পরিণত করে দিবেন। এ বিধানটি সব ধরণের গুনাহ থেকে তওবাকারীর ক্ষেত্রে প্রযোজ্য।

আল্লাহ্‌ তাআলা বলেন: “বলুন, হে আমার বান্দাগণ! তোমরা যারা নিজেদের প্রতি অবিচার করেছ— আল্লাহ্‌র অনুগ্রহ হতে নিরাশ হয়ো না; নিশ্চয় আল্লাহ্‌ সমস্ত গোনাহ ক্ষমা করে দেবেন। নিশ্চয় তিনি ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু।” -সূরা যুমার, আয়াত: ৫৩

অতএব, এ আম বিধান থেকে কোন একটি গুনাহও বাদ পড়বে না। কিন্তু এটি তাওবাকারীদের জন্য খাস। [সমাপ্ত]

আল্লাহ্‌ তাআলা তাঁর কিতাবে মুত্তাকীদের গুণ বর্ণনা করেছেন যে, তারা যদি কোন কবিরা গুনাহ করে ফেলে কিংবা সগিরা গুনাহতে লিপ্ত হওয়ার মাধ্যমে নিজেদের উপর অবিচার করে ফেলে তখনই তারা আল-আযিয (পরাক্রমশালী) আল-গাফ্‌ফার (ক্ষমাশীল) কে স্মরণ করে এবং কৃত গুনাহর জন্য ক্ষমাপ্রার্থনা করে। সে গুনাহর উপর কায়েম থাকে না এবং অবাধ্যতায় অব্যাহত থাকে না।

তিনি আরও বলেন: “তোমরা তোমাদের প্রভুর ক্ষমা ও সেই জান্নাত লাভের চেষ্টা করো যার বিশালতা আসমান ও জমিনের মত। মুত্তাকীদের জন্য তা প্রস্তুত করা হয়েছে; যারা সুদিন ও দুর্দিনে (আল্লাহ্‌র পথে) ব্যয় করে এবং যারা ক্রোধ সংবরণকারী ও মানুষের প্রতি ক্ষমাশীল। আল্লাহ্‌ মুহ্‌সিনদেরকে ভালবাসেন। এবং যারা কোন অশ্লীল কাজ করে ফেললে কিংবা নিজেদের প্রতি জুলুম করে ফেললে আল্লাহ্‌কে স্মরণ করে এবং নিজেদের পাপের জন্য ক্ষমা চায়। আল্লাহ্‌ ছাড়া পাপ ক্ষমা করবে কে? আর তারা যা করে ফেলে, জেনে-বুঝে তারা তা পুনঃপুনঃ করতে থাকে না। এমন লোকদের প্রতিদান হচ্ছে তাদের প্রভুর পক্ষ থেকে ক্ষমা আর এমনসব জান্নাত যার তলদেশ দিয়ে নদী প্রবাহিত হয়। সেখানে তারা চিরকাল বাস করবে। সৎকর্মশীলদের এই প্রতিদান কতই না উত্তম!” -সূরা আলে ইমরান, আয়াত: ১৩৩-১৩৬

পুনঃপুনঃ গুনাহকারী দ্বারা উদ্দেশ্য হচ্ছে: গুনাহতে লিপ্ত হওয়া এবং তওবা ও ক্ষমাপ্রার্থনা ব্যতিরেকে পুনঃপুনঃ গুনাহ করতে থাকা।

আর যে ব্যক্তি গুনাহ করল। এরপর অন্তর থেকে শুদ্ধভাবে তওবা করল। আবার দুর্বলতায় পড়ে পুনরায় গুনাহ করল। তারপর আবার শুদ্ধভাবে তওবা করল। যার অবস্থাটি এমন—গুনাহ ও অবাধ্যতা এবং তওবা, অনুশোচনা ও রহিম রাহমানের দিকে ফিরে আসার মাঝে; সে ইনশাআল্লাহ্‌ আল্লাহ্‌র ক্ষমার আওতাধীন। আশা করা যায় আল্লাহ্‌ তার স্খলনকে মাফ করে দিবেন, তার গুনাহ ক্ষমা করে দিবেন।

আবু হুরায়রা (রা.) হতে বর্ণিত তিনি বলেন, আমি রাসুলুল্লাহ (সা.) কে বলতে শুনেছি, তিনি বলেন: “এক বান্দা গুনাহ্ করল। তারপর সে বলল: হে আমার রব্ব! আমি তো গুনাহ্ করে ফেলেছি; আমাকে ক্ষমা করে দিন। তখন তার রব্ব বলেন: আমার বান্দা কি একথা জেনেছে যে, তার একজন রব্ব রয়েছে; যিনি গুনাহ্ মাফ করেন ও গুনাহর কারণে শাস্তি দেন। আমি আমার বান্দাকে মাফ করে দিলাম। এরপর আল্লাহর ইচ্ছায় কিছুকাল কেটে যায়। এরপর সে আবার আরেকটি গুনাহ করে। তিনি বলেন, তখন সে বলে: ও আমার প্রভু! আমি তো আরেকটি গুনাহ্ করে ফেলেছি; আমাকে মাফ করে দিন। তখন আল্লাহ্ বলেন: আমার বান্দা কি জেনেছে যে, তার একজন রব্ব আছেন; যিনি গুনাহ্ মাফ করেন ও গুনাহর কারণে শাস্তি দেন? আমি আমার বান্দাকে মাফ করে দিলাম (তিনবার); সে যা ইচ্ছা তা করুক।” -সহিহ বুখারী : ৭৫০৭; সহিহ মুসলিম ২৭৫৮

ইমাম নববী “শরহে সহিহ মুসলিম” গ্রন্থে (১৭/৭৫) বলেন:

যদি কোন গুনাহ পুনঃপুনঃ শতবার করা হয় কিংবা হাজার বার করা হয় কিংবা এরচেয়েও বেশিবার করা হয় এবং প্রত্যেকবার গুনাহ থেকে তওবা করে তার তওবা কবুল করা হবে এবং তার গুনাহ মাফ হবে। আর যদি সকল গুনাহর পর একবার তওবা করে তাহলেও তার তওবা সহিহ হবে।

যে ব্যক্তি পুনঃপুনঃ গুনাতে লিপ্ত হয় তাকে লক্ষ্য করে আল্লাহ্‌ তাআলা বলেন: “তুমি যা ইচ্ছা তা কর আমি তোমাকে মাফ করে দিলাম” এ কথার অর্থ হচ্ছে- যেহেতু তুমি গুনাহ করে তওবা করেছ অতএব আমি তোমাকে মাফ করে দিলাম।

সুতরাং প্রত্যেক গুনাহর শেষে আল্লাহ্‌র কাছে তওবা করতে থাকুন। তওবার ক্ষেত্রে বিশ্বস্ত হোন, অনুতপ্ত হোন, কৃত গুনাহ্‌র জন্য মর্মজ্বালা অনুভব করুন। আর কখনও গুনাহ না করার সংকল্প করুন। এরপর তওবাকে পরিপূর্ণ করার জন্য নিম্নোক্ত পদক্ষেপ গ্রহণ করুন:

যে রাস্তাগুলো আপনাকে গুনাহের দিকে ধাবিত করে সে রাস্তাগুলো বন্ধ করে দেওয়া। তা এভাবে যে, একাকী না থাকা; বরং সবসময় অন্যদের মাঝে থাকা, আপনার স্ত্রী ও সন্তানদের মাঝে থাকা। যদি আপনি আপনার স্ত্রী থেকে দূরে থাকেন তাহলে আপনার স্ত্রীকে সাথে রাখার সর্বোচ্চ চেষ্টা করুন। আপনার স্ত্রী থেকে দূরে থাকবেন না। আপনার স্ত্রীর মাধ্যমে নিজেকে পবিত্র রাখুন এবং আপনার মাধ্যমে আপনার স্ত্রীকেও পবিত্র রাখুন। আর যদি আপনি আপনার পরিবারের কাছেই থাকেন এবং তাদের সাথে বসবাস করেন তাহলে আপনি তাদের থেকে দূরে যাবেন না। আপনি আপনার স্ত্রীকে ভালবাসুন। তার মাধ্যমে আপনার প্রয়োজন পূরণ করুন। যখনই আপনার অন্তরে দেখার খায়েশ জাগবে কিংবা কোন কিছু আপনার নজরে পড়ে যাবে তখনই আপনি শয়তানকে হারামের দিকে আপনাকে নিয়ে যেতে দিবেন না। বরং আপনি দেরী না করে হালালকে গ্রহণ করুন।

সদা-সর্বদা দুনিয়া ও আখিরাতের কল্যাণকর কোন কাজে নিজেকে ব্যস্ত রাখুন। কারণ অবসর সময় মানুষের নষ্টের কারণ। এমন নষ্ট যার কোন সীমা নেই।

মোবাইল থেকে ইন্টারনেট সংযোগ চূড়ান্তভাবে বিচ্ছিন্ন করা; হতে পারে আপনার মোবাইল সেটটি পরিবর্তন করাই আপনার জন্য বেশি ভাল হবে। এমন মোবাইল সেট ব্যবহার করবেন সে সেটে ইন্টারনেট ব্যবহার করা যায় না। অন্তরে ঈমান, আল্লাহ্‌র ভয়, আল্লাহ্‌র হিসাব গ্রহণের কাঠিন্য, আল্লাহ্‌ আপনাকে দেখছেন ও আপনাকে মনিটর করছেন এ অনুভূতিগুলো মযবুত করা। কুরআন তেলাওয়াত, নফল নামায ও তাহাজ্জুদ নামায পড়া বাড়ানো।

হেদায়েতের উপর অটল থাকার জন্য আল্লাহ্‌র কাছে বেশি বেশি দোয়া করা। সবচেয়ে উপকারী দোয়া হচ্ছে  اهدنا الصراط المستقيم  অর্থ- “আমাদেরকে সরল পথ দেখান”।

আমরা আল্লাহ্‌র কাছে আমাদের ও আপনার হেদায়েতের প্রার্থনা করছি। আল্লাহ্‌ই তাঁর সন্তুষ্টি ও রেজামন্দির তাওফিকদাতা।

সূত্র: islamqa.net

2 thoughts on “বারবার তওবার পরে গুনাহ হতে থাকলে করণীয়

  1. ভাই মাসিক আদর্শ নারীতে প্রচারীত ইসলামীক কাহিনী গুলো কোথায়।

    1. আস্তে আস্তে প্রকাশ হবে ইনশা আল্লাহ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *