সর্বযুগের উলামায়ে কেরাম মাযহাবের অনুসারী ছিলেন : মাযহাব ভিত্তিক সংক্ষিপ্ত তালিকা

লেখক: মুফতী মনসূরুল হক দা.বা.


কুরআন-সুন্নাহ ও তা থেকে আহরিত সকল বিধি-বিধান মেনে চলার মধ্যেই মুসলমানদের দোজাহানের শান্তি ও কামিয়াবী নিহিত। তবে কুরআন-সুন্নাহর কিছু বিধান মামুলি শিক্ষিত ব্যক্তিও বুঝতে সক্ষম; আর কিছু বিধান সংক্ষিপ্ততা ও সূক্ষ্মতাজনিত জটিলতার কারণে সকলে বুঝতে সক্ষম নয়। আবার কতক বিধান বাহ্যিকভাবে বিরোধপূর্ণ। তো সংক্ষিপ্ত, সূক্ষ্ম ও বাহ্যিক বিরোধপূর্ণ বিধানসমূহের ক্ষেত্রে আমরা হয়তো নিজেদের জ্ঞান-বুদ্ধি ও বুঝ মতো সমাধান বের করে সে অনুযায়ী আমল করবো অথবা উম্মাহর স্বীকৃত সর্বোত্তম যুগের ইমামগণের দেয়া সমাধান মেনে চলবো। ইনসাফ ও বাস্তবতার বিচারে প্রথমটি আশঙ্কাপূর্ণ ও ভয়ানক আর দ্বিতীয়টি সতর্কতাপূর্ণ ও নিরাপদ। এজন্যই গোটা মুসলিম উম্মাহ হাজার হাজার বছর ধরে সর্বোত্তম যুগের সাহাবায়ে কেরাম ও তাবেয়ীদের ব্যাখ্যার আলোকে কুরআন-সুন্নাহ অনুসরণ করে আসছে। বাস্তব কথা হলো তাদের ব্যাখ্যা ও মাযহাব সমূহ আল্লাহ তা‘আলার ফয়সালায় পরবর্তীকালে চার মাযহাবের আকৃতিতে প্রকাশ পেয়েছে। সুতরাং মাযহাব নতুন কোন জিনিস নয়। এই কারণে যে, সর্বোত্তম যুগের পরবর্তীকালে সকল মুফাসসির, মুহাদ্দিস ও ফকীহগণের মাযহাব ভিত্তিক জীবনীকোষ গুলোই এর প্রমাণ। যেগুলো “তাবাকাতুল হানাফিয়্যাহ”, “তাবাকাতুল মালিকিয়্যাহ”, “তাবাকাতুল শাফিইয়্যাহ” ও “তাবাকাতুল হানাবিলাহ” নামে এসব জীবনীকোষগুলো পরিচিত। এখানে মৃত্যুসনসহ শাস্ত্রজ্ঞ উলামায়ে কেরামের মাযহাব ভিত্তিক একটি সংক্ষিপ্ত তালিকা দেওয়া হয়:

প্রসিদ্ধ মুফাসসিরগণ যারা হানাফী ছিলেন

১. ইমাম আবু বকর আহমদ ইবনে আলী আল জাসসাস (৩৭০হিঃ) আহকামুল কুরআন ২. নসর ইবনে মুহাম্মদ (৩৭৩হিঃ) তাফসীরে সমরকন্দী ৩. আব্দুল্লাহ ইবনে আহমাদ (৭০১হিঃ) তাফসীরে নাসাফী ৪. মুহাম্মাদ ইবনে মুহাম্মাদ ইবনে মুস্তাফা (৯৫২হিঃ) তাফসীরে আবীস সাঊদ ৫. কাজী সানাউল্লাহ পানিপথী (১২২৫হিঃ) তাফসীসে মাযহারী ৬. ইসমাঈল মক্কী (১১২৭হিঃ) রুহুল বয়ান ৭. শিহাবুদ্দীন মাহমুদ আলূসী (১২৭০হিঃ) রুহুল মাআনী ৮. আশরাফ আলী থানভী (১৩৬২হিঃ) বয়ানুল কুরআন ৯. মুফতী মুহাম্মদ শফী (১৩৯৬হিঃ) মাআরিফুল কুরআন ১০. মাওলানা ইদরীস কান্ধলভী (১৩৯৪হিঃ) মাআরিফুল কুরআন

প্রসিদ্ধ মুফাসসিরগণ যারা শাফেয়ী ছিলেন

১১. আলী ইবনে মুহাম্মদ আত-তাবারী (৩১০হিঃ) তাফসীরে তাবারী ১২. হুসাইন ইবনে মাসউদ আল-বাগাবী (৫১৬হিঃ) তাফসীরে বাগাবী ১৩. মুহাম্মদ ইবনে উমর আর-রাযি (৬০৬হিঃ) তাফসীরে কাবীর ১৪. আব্দুল্লাহ ইবনে বাইযাবী (৬৮৫হিঃ) তাফসীরে বাইযাবী ১৫. আব্দুল্লাহ ইবনে খাযেন (৭৪১হিঃ) তাফসীরে খাযেন ১৬. ইসমাঈল ইবনে আমর দিমাশকী (৭৭৪হিঃ) তাফসীরে ইবনে কাসীর ১৭. জালালুদ্দীন মুহাল্লী (৮৬৪হিঃ) তাফসীরে জালালাইন ১৮. জালালুদ্দীন সুয়ূতী (৯১১হিঃ) জালালাইন, আদ-দুররুল মানসূর ১৯. মুহাম্মদ ইবনে আহমাদ শিরবীনী (৯৭৭হিঃ) তাফসীরে খতীব

প্রসিদ্ধ মুফাসসিরগণ যারা মালেকী ছিলেন

২০. মুহাম্মদ ইবনে আব্দুল্লাহ আন্দালুসী (৫৪৩হিঃ) আহকামুল কুরআন ২১. আব্দুল হক ইবনে গালেব (৫৪৬হিঃ) তাফসীরে ইবনে আতিয়্যাহ ২২. আব্দুর রহমান ইবনে মুহাম্মদ আস-সাআলাবী (৮৭৬হিঃ) আল-জাওয়াহিরুল হিসান ২৩. মুহাম্মদ ইবনে আহমাদ আল-কুরতুবী (৬৭১হিঃ) তাফসীরে কুরতুবী ২৪. মুহাম্মদ ইবনে ইউসুফ আন্দালুসী (৭৪৫হিঃ) আল-বাহরুর মুহীত ২৫. আবুল আব্বাস শিহাবুদ্দীন (৭৫৬হিঃ) আদ-দুররুল মাছনূন ২৬. ইবনু উরফাহ (৮০৩হিঃ) তাফসীরে ইবনে উরফাহ।

প্রসিদ্ধ মুফাসসিরগণ যারা হাম্বলী ছিলেন

২৭. ইবনে আদেল আবী হাফস (৮৮০হিঃ) তাফসীরে লুবাব ২৮. ইবনে রজব (৭৯৫হিঃ) তাহকীকু তাফসীরিল ফাতেহা ২৯. ইবনুল কায়্যিম আল-জাওযিয়া (৭৫১হিঃ) আত-তাফসীরুল কায়্যিম ৩০. ইবনু রজব হাম্বলী (৭৯৫হিঃ) রওয়াইয়িয়ূত তাফসীর

প্রসিদ্ধ মুহাদ্দিসগণ যারা হানাফী ছিলেন

১. ইমাম আবূ ইউসুফ র. (১৮২হিঃ) ২. ইমাম মুহাম্মদ (১৮৯হিঃ) ৩. ইমাম ত্বহাবী (৩১১হিঃ) ৪. আব্দুল্লাহ ইবনে মুবারক (১৮১হিঃ) ৫. আবূ ইয়ালা আল-মুসিলী (৩০৭হিঃ) ৬. আলাউদ্দীন মুগলতায়ী (৭৬২হিঃ) ৭. আলাউদ্দীন ইবনুত তরকুমানী (৭৪৫হিঃ) ৮. বদরুদ্দীন আল-আইনী (৮৫৫হিঃ) ৯. রযীউদ্দীন মুহাম্মদ ইবনে ইবরাহীম (৯৭১হিঃ) ১০. মুল্লা আলী কারী (১০১৪হিঃ) ১১. ইয়াহইয়া ইবনে মাঈন (২৩৩হিঃ) ১২. মাক্কী ইবনে ইবরাহীম (১২৬হিঃ) ১৩. ইয়াহইয়া ইবনে সাঈদ আল কাত্তান (১৯৮হিঃ) ১৪. ইউসুফ যাইলাঈ (৭৬২হিঃ)

প্রসিদ্ধ মুহাদ্দিসগণ যারা শাফেয়ী ছিলেন

১৫. মুহাম্মদ ইবনে ইসমাইল বুখারী (২৫৬হিঃ) ১৬. আব্দুর রহমান আন-নাসায়ী (৩০৩হিঃ) ১৭. আবূ ঈসা তিরমিযী (২৭৯হিঃ) ১৮. আবূ ইবনু হিব্বান (৩৫৪হিঃ) ১৯. ইবনু খুযাইমা (৩১১হিঃ) ২০. আবূ দাউদ আত-ত্বয়ালিসী (২০৪হিঃ) ২১. আলী ইবনে ওমর আদ-দারাকুতনী (৩৮৫হিঃ) ২২. আবূ বকর আল-বাইহাকী (৪৫৮হিঃ) ২৩. হাকেম আবূ আব্দিল্লাহ (৪০৫হিঃ) ২৪. ইবনুল আসীর (৬০৬হিঃ) ২৫. যাইনুদ্দীন আল-ইরাকী (৮০৬হিঃ) ২৬. আবূল হাজ্জাজ আল-মিযযী (৭৪২হিঃ) ২৭. শামসুদ্দীন আয-যহাবী (৭৪৮হিঃ) ২৮. হাফেজ ইবনু হাজার (৮৫২হিঃ) ২৯. হাফেজ শামসুদ্দীন আস-সাখাবী (৯০২হিঃ) ৩০. ইবনু আসাকির (৫৭১হিঃ) ৩১. আবূ বকর আল-বাগদাদী (৪৬৩হিঃ)

প্রসিদ্ধ মুহাদ্দিসগণ যারা মালেকী ছিলেন

৩২. ইবনু আব্দিল বার (৪৬৩হিঃ) ৩৩. আবূ বকর ইবনুল আরাবী (৫৪৩হিঃ) ৩৪. আবূ আব্দুল্লাহ আয-যুরকানী (১১২২হিঃ)

প্রসিদ্ধ মুহাদ্দিসগণ যারা হাম্বলী ছিলেন

৩৫. মুসলিম ইবনে হাজ্জাজ (২৬১হিঃ) ৩৬. আবূ আব্দুর রহমান আদ-দারিমী (২৫৫হিঃ) ৩৭. আব্দুর রাযযাক সানআনী (২১১হিঃ) ৩৮. আবূ দাউদ (২৭৫হিঃ)

প্রসিদ্ধ ফকীহগণ যারা হানাফী ছিলেন

১. আবূ বকর সারাখসী (৪৯০হিঃ) ২. আবুল হাসান কুদুরী (৪২৮হিঃ) ৩. কামাল ইবনুল হুমাম (৮৬১হিঃ) ৪. আব্দুল্লাহ ইবনে মাহমুদ (৬৮৩হিঃ) ৫. ইবনু নুজাইম ((৯৭০হিঃ) ৬. আলাউদ্দীন আল-কাসানী (৫৮৭হিঃ) ৭. ইবনু আবেদীন (১২৫২হিঃ) ৮. আব্দুর রহমান ইবনে মুহাম্মদ শাইখী যাদাহ (১০৭৮হিঃ) ৯. আলাউদ্দীন আল-হাসকাফী (১০৮৮হিঃ)

প্রসিদ্ধ ফকীহগণ যারা মালেকী ছিলেন

১০. শিহাবুদ্দীন আল-কারাফী (৬৮৪হিঃ) ১১. ইবনে রুশদ (৫৯৫হিঃ) ১২. শামসুদ্দীন আর-রুআইনী (৯৫৪হিঃ) ১৩. খলীল ইবনে ইসহাক আল-জুনদী (৭৬৭হিঃ) ১৪. শিহাবুদ্দীন আল-বাগদাদী (৭৩২হিঃ) ১৫. ইবনুল হাজ্জ (৭৩৭হিঃ) ১৬. আব্দুল ওহহাব ইবনে আলী (৪২২হিঃ) ১৭. আবূ ওমর আল কুরতবী (৪৬৩হিঃ) ১৮. মুহাম্মদ আদ-দুসুকী (১২৩০হিঃ) ১৯. আবুল ওয়ালীদ আল-কুরতবী (৫২০হিঃ)

প্রসিদ্ধ ফকীহগণ যারা শাফেয়ী ছিলেন

২০. আবূ ইসহাক আশ-শীরাজী (৪৭৬হিঃ) ২১. জালালুদ্দীন আস-সুয়ূতী (৯১১হিঃ) ২২. আবুল হাসান আল-মাওয়ারদী (৪৫০হিঃ) ২৩. মুহীউদ্দীন আন-নববী (৬৭৬হিঃ) ২৪. ইবনুল মুলাক্কীন (৮০৪হিঃ) ২৫. আবুল কাসেম আব্দুল আজীজ (৬২৩হিঃ) ২৬. তকী উদ্দীন আবুল বারাকাত (৮২৯হিঃ) ২৭. ইমাম গাজালী (৫০৫হিঃ) ২৮. ইমামুল হারামাইন আব্দুল মালেক (৪৭৮হিঃ) ২৯. শামসুদ্দীন আর রমল্লী (১০০৪হিঃ)

প্রসিদ্ধ ফকীহগণ যারা হাম্বলী ছিলেন

৩০. ইবনু কুদামা (৬২০হিঃ) ৩১. ইবনু বাত্তাহ আল-উকবারী (৩৮৭হিঃ) ৩২. আবুল হাসান আল-মারদাভী (৮৮৫হিঃ) ৩৩. শামসুদ্দীন আবুল ফরজ (৩৮১হিঃ) ৩৪. ইবনু মুফলিহ (৭৬৩হিঃ) ৩৫. আবূ মুহাম্মদ আল-মাকদেসী (৬২৪হিঃ) ৩৬. ইবরাহীম ইবনে মুহাম্মদ (১৩৫৩হিঃ) ৩৭. আবুল কাসেম আল-খেরাকী (৩৩৪হিঃ) ৩৮. ইবনু কুতাইবা (১০৩৩হিঃ) ৩৯. ইবনু তাইমিয়া (৭২৮ হিঃ)

উম্মাহর এ সকল প্রসিদ্ধ মুফাসসির, মুহাদ্দিস ও ফকীহ এর মাধ্যমেই আমরা লাভ করেছি তাফসীর, উসুলে তাফসীর, হাদীস, উসূলে হাদীস, ফিকহ, উসূলে ফিকহ, সহ সকল প্রকার ইলম। যাদের কাছে উম্মত সর্বতোভাবে ঋণী এবং যাদের ইলম থেকে এক মুহূর্তের জন্য বিমুখ হওয়ার কল্পনা করাও উম্মতের জন্য সম্ভব নয়। বলা বাহুল্য তাঁরা সকলেই ছিলেন কোন না কোন মাযহাবের অনুসারী। এখন এসকল ব্যক্তিত্ব যদি শুধুমাত্র মাযহাব মানার কারণে কিছু বন্ধুর দাবী অনুযায়ী তাঁরা মুশরিক হয়ে যান; তাহলে এসব বন্ধুরা কিভাবে এসকল মুশরিকদের (নাউযু বিল্লাহ্) কিতাব থেকে তাফসীর, হাদীস ও ফিকাহসহ অন্যান্য ইলম গ্রহণ করছেন!!!? আসলে মাযহাব মানলে মুশরিক হয়ে যায় একথা পাগলের প্রলাপ বৈ কিছুই নয়। ১৪ শত বছর পর্যন্ত এই পাগলামি ও প্রলাপ করার কল্পনাও কেউ করেনি। বরং এ যাবতকাল উম্মাহর সকল সদস্যই কোন না কোন মাযহাব মেনে আসছে এবং কিয়ামত পর্যন্ত মেনে চলবে ইনশাআল্লাহ। যারা কয়েকটি হাদীসের অনুবাদ পড়েই মুজতাহিদ ইমাম বনে যাচ্ছেন তাদেরকে তাদেরই একজন ইমাম মাঃ মুহাম্মদ হুসাইন বাটালভীর পঁচিশ বছরের অভিজ্ঞতার কথা স্মরণ করিয়ে দেওয়া ভাল মনে হচ্ছে। তিনি তার “ইশাআতুস সুন্নাহতে” বলেছেন- আমার পঁচিশ বছরের অভিজ্ঞতা হলো, যে ব্যক্তি ইমাম ছাড়া স্বাধীন মুজতাহিদ বনে যায় অর্থাৎ মাযহাব ত্যাগ করে শেষ পর্যন্ত সে দীন থেকেই বের হয়ে যায়। -ইশাআতুস সুন্নাহ খণ্ড-১, পৃষ্ঠা-৪ (১৮৮৮খ্রিঃ)

আল্লাহ তাআলা আমাদের সবাইকে সিরাতে মুস্তাকীমের উপর চলার ও অটল থাকার তাওফীক দান করুন। আমীন রব্বাল আলামীন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *