বৃদ্ধ বাবা মাকে ভাগ বাটোয়ারার পণ্য না বানাই

লুৎফুর রহমান ফরায়েজী

কয়েকটি গল্প বলবো। বাস্তব গল্প। যাপিত জীবনের গল্প।

পাশেই থাকতো আমার। সবে বাড়ি থেকে ফিরেছে। ঘর্মাক্ত শরীর। কালো চেহারাটা আরো কালো দেখাচ্ছে। মন খারাপ করে বসে আছে যুবকটা। জিজ্ঞাসা করলামঃ কী হল ভাই? মন খারাপ?

দীর্ঘশ্বাস নিয়ে জবাব দিলঃ “ভাই বাড়ি থেকে এলাম। আব্বা ও আম্মার বয়স হয়েছে। চোখে কম দেখে দুজনেই। আমার বড় দুই ভাই বউসহ ঢাকায় বাসা নিয়ে থাকে। বাড়িতে অসুস্থ্য বাবা মা একা।”

“হু, তো?”

কাঁদো কাঁদো কণ্ঠে বলে যাচ্ছে ভাইটাঃ “কাল বাড়িতে গেলে মা তরকারী পাকালো কেরোসিন দিয়ে। ঠান্ডা লাগায় নাক বন্ধ ছিল। আর চোখে কম দেখায় কেরোসিন আর সয়াবিনের পার্থক্য বুঝতে পারেনি।”

এতটুকু বলে চোখ মুছল যুবক। “বড় ভাইরা একেকটা অমানুষ। বউ নিয়ে ঢাকায় থাকে। কিন্তু মা বাবার কষ্টের কথা একবার ভাবে না।”।

বললামঃ সমাধান কী?

দৃঢ়তার সাথে জবাব দিলঃ “বিয়ে করবো। খুব দ্রুতই বিয়ে করবো। মা বাবা কষ্ট আর সহ্য হয় না।”।

খুশি হলাম জবাব শুনে। বললামঃ পড়াশোনা শেষ করার আগেই বিয়ে করবা?

বললঃ কী করবো? দরকার।

-আচ্ছা। ভাল।

কথোপথনটি হয়েছে যে যুবকের সাথে। তার সাথে আরো পাঁচ ছয় বছর পর দেখা। ফোন করে বাসায় নিয়ে গেল। ঢাকার বাসায়। বিয়ে করেছে সেই যুবক। ছেলে মেয়েও হয়েছে।

জিজ্ঞাসা করলামঃ বাসায় কে কে থাকে?

-আমার বিবি আর বাচ্চারা।

-তোমার বাবা মা কি এখনো জীবিত?

-হ্যাঁ, জীবিত।

-কী অবস্থা? আগের তুলনায় সুস্থ্য না বেড়েছে?

-বয়স বাড়ার সাথে দুর্বলতাতো বাড়বেই। কিছুদিন আগে গিয়ে দেখে এসেছিলাম। অবস্থা বেশি ভাল না।

থমকে গেলাম। একবার ভাবলাম বলবো না। কিন্তু পরক্ষণেই দৃঢ়তার সাথে তাচ্ছিল্যতার সাথে বললামঃ “আচ্ছা, ছাত্র জমানার কথা কী তোমার মনে আছে? ঐ যে, একদিন তুমি কাঁদছিলে। তোমার মা সয়াবিনের বদলে কেরোসিন দিয়ে তরকারী পাকিয়েছিলো। তখন তুমি বিয়ে করার অঙ্গীকার করেছিলে মা বাবার খিদমাতের জন্য।”

মুখটা ফ্যাকাসে করে জবাব দিলঃ হ্যাঁ, দোস্ত মনে আছে। কিন্তু কী করবো। বউ ছাড়া কী থাকা যায়? তাই ঢাকায় নিয়ে আসছি। আমি মাঝে মাঝে দেখা করতে যাইতো।”

হাসলাম। তাচ্ছিল্যের হাসি। মুখে কিছু বলিনি। কী বলবো? আমরাতো এমনি। বিয়ের সময় বাবা মায়ের প্রতি দরদ উথলে উঠে। আর বিয়ের পরের উক্তি “বউ ছাড়া কী থাকা যায়?”।

এইতো আমাদের সোনার ছেলেদের প্রকৃতি চিত্র।

আমার প্রতিবেশি। ভাল সম্পর্ক আমার সাথে। খুশি খুশি চেহারায় বলছে একদিনঃ “আজকে সকালে আব্বাকে দশ টাকা দিয়েছি। বলেছিঃ ভালমন্দ যা মনে চায় কিনে খাইয়েন।”

শুনে মৃদু হাসলাম। “আচ্ছা, দশ টাকা দিয়ে ভালমন্দ?”।

প্রশ্ন শুনে খানিক ক্ষেপে গেল। বললঃ আরে! আমিতো মাঝে মাঝে দশ বিশ টাকা দেই, আমার বড় ভাইতো তা’ও দেয় না। আমি বেশি যতœ নেই। বাবা মার।”।

আগ্রহ নিয়ে জিজ্ঞাসা করলামঃ কী কী করেন?

-এক মাস আমার কাছে থাকে মা বাবা, আরেক মাস থাকে বড় ভাইয়ের কাছে। আমার কাছে যখন থাকে তখন আমি অনেক খিদমাত করি। এটাসেটা কিনে দেই। কিছুদিন আগেও পঞ্চাশ টাকা ওষুধ কিনে দিয়েছি।

-আচ্ছা, আপনার মা যে বিছানায় পড়া, তাকে একদিন ঢাকায় নিয়ে ভাল ডাক্তার দেখানোর কথা ভেবেছেন?

-এটা কী আমার একার দায়িত্ব? আমি একা করবো কেন? বড় ভাই করে না কেন?

ক্ষিপ্ত হয়ে গেছে লোকটা। এবার ঠান্ডা মাথায় ধমক দিলাম। “ছোটকালে যখন আপনার বাবা মা আপনাদের লালন করেছে, তখন কিন্তু তারা আপনাদের বাটোয়ারা করেননি। আজ বাবা মাকে বাটোয়ারা করে দিলেন। আপনি অসুস্থ্য হলে চিকিৎসা করানো কার দায়িত্ব তা চিন্তা না করে নিজের সর্বশান্ত নিয়ে ডাক্তারের দুয়ারে ছুটেছে আপনার বাবা মা।

আজকে তাকে পঞ্চাশ টাকার চিকিৎসার কথা বড় গলায় বলার আগে নিজের সন্তানের জন্য কী করেন একবার ভেবে দেখুন। তাহলেই অনুধাবন করবেন আপনার বাবা আপনার জন্য কী করেছেন? তাহলে আর কথাগুলো বড় গলায় বলা মানাবে না। কণ্ঠস্বর মিনমিন হয়ে যাবে।

নিজের বাবা মাকে এভাবে ভাগ করবেন না। ধরে নিন আপনিই একমাত্র সন্তান। আপনারই সব দায়িত্ব। কারণ তিনি আপনার বাবা এবং মা। আর কারো বাবা মা কি না? সেটা ভাবার কোন প্রয়োজন আপনার নেই। আপনি তাদের সন্তান। সেভাবেই আপনাকে লালন করেছেন তারা। আপনাকে ভাগ করেননি তারা। আপনার প্রাপ্য পূর্ণ ভালবাসা আপনাকে প্রদান করেছেন। তাহলে আপনি কেন ভাগ বাটোয়ারায় মত্ম। কেন তাদের মোহাব্বত ও লালনের ভার ভাগ করছেন?

কথাগুলো তার পছন্দ হয়নি। তবে চুপ হয়ে গিয়েছিল।

আরেকটি গল্প দিয়ে লেখাটি শেষ করবো।

এক সাহাবী তার পিতা সম্পর্কে বিচার দায়ের করেন রাসূল সাঃ এর দরবারে। বিষয় ছিল, পিতা সন্তানের কাছে বেশি বেশি টাকা পয়সা চায়।

পিতাও ছিলেন সাহাবী এবং খুবই উঁচু মানের কবি। তিনি যখন একথা জানতে পারলেন যে, তার সন্তান তার নামে রাসূল সাঃ এর দরবারে বিচার দায়ের করেছে। তখন খুবই কষ্ট পেলেন।

ভারাক্রান্ত মনে কিছু কবিতা আবৃত্তি করলেন। মুখে মুখে নয়, মনে মনে। মুখ দিয়ে উক্ত কবিতা উচ্চারণ করেননি।

কিন্তু আল্লাহ তাআলা সবই জানেন। তাই জিবরাঈল আঃ এর মাধ্যমে উক্ত কবি সাহাবীর মনে মনে বলা কবিতার সংবাদ রাসূল সাঃ কে জানিয়ে দেয়া হল।

উক্ত পিতা উক্ত কবি সাহাবী রাঃ রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর কাছে এলে নবীজী সাঃ বললেন, তোমার স্বীয় কান এখনো যেই কবিতা শুনেনি, কিন্তু তোমার মন বলেছে, উক্ত কবিতা তুমি আমাদের শুনাও। তখন উক্ত সাহাবী বললেন-

غَذَوْتُكَ مَوْلُودًا وَمُنْتُكَ يَافِعًا … تَعِلُّ بِمَا أَجْنِي عَلَيْكَ وَتَنْهَلُ

إِذَا لَيْلَةٌ ضَافَتْكَ بِالسُّقْمِ لَمْ أَبِتْ … لِسُقْمِكَ إِلَّا سَاهِرًا أَتَمَلْمَلُ

كَأَنِّي أَنَا الْمَطْرُوقُ دُونَكَ بِالَّذِي … طُرِقْتَ بِهِ دُونِي فَعَيْنِي تَهْمُلُ

تَخَافُ الرَّدَى نَفْسِي عَلَيْكَ وَإِنَّهَا … لَتَعْلَمُ أَنَّ الْمَوْتَ وَقْتٌ مُؤَجَّلُ

فَلَمَّا بَلَغْتَ السِّنَّ وَالْغَايَةَ الَّتِي … إِلَيْهَا مَدَى مَا كُنْتُ فِيكَ أُؤَمِّلُ

جَعَلْتَ جَزَائِي غِلْظَةً وَفَظَاظَةً … كَأَنَّكَ أَنْتَ الْمُنْعِمُ الْمُتَفَضِّلُ

فَلَيْتَكَ إِذْ لَمْ تَرْعَ حَقَّ أبوتى … فعلت كما الجار المصاقب يفعل

فأوليتني حَقَّ الْجِوَارِ وَلَمْ تَكُنْ … عَلَيَّ بِمَالٍ دُونَ مَالِكَ تَبْخَلُ

অনুবাদ-

আমি তোমাকে জন্ম নেবার পর থেকে খাদ্য আহরিত করে দিয়েছি। যুবক হওয়ার পরও আমি তোমার যিম্মাদারী বহন করেছি। তোমার সমস্ত খানাপিনা আমার উপার্জিত অর্থ থেকেই হতো।

যদি কোন রাতে তুমি অসুস্থ্য হয়ে যেতে, তখন সারারাত আমি তোমার অসুস্থ্যতার কারণে বেচাইন ও পেরেশান অবস্থায় কাটিয়েছি।

যেন তুমি নয় আমিই অসুস্থ্য হয়েছি, এ কারণে আমি সারারাত কেঁদেকেটে কাটিয়ে দিতাম।

আমার মন সর্বদা তোমার ক্ষতির ভয়ে শংকিত থাকতো, যদিও আমি জানি মৃত্যুর জন্য সুনির্দিষ্ট দিন রয়েছে। এর আগে কারো মৃত্যু হতে পারে না।

তারপর যখন তুমি এ বয়সে উপনীত হয়েছো, এ বয়সে তুমি যেন পৌঁছে যাও এর আমি আকাঙ্খী ছিলাম।

তখন তুমি আমার উক্ত ইহসানের বদলে কঠোরতা আ কটুবাক্য আমাকে বলতে লাগলে, ভাবটা এমন যে, তুমিই আমার উপর দয়া করছো।

হায়! তোমার পক্ষ থেকে আমার পিতা হওয়ার অধিকার আদায় না হলেও অন্তত যদি ভদ্র প্রতিবেশির হকটাও আদায় হতো!

তাহলে কমপক্ষে তুমি আমাকে প্রতিবেশির হকতো দিতে, আর আমার সম্পদ নিয়ে আমার সাথেই কৃপণতা করতে না। {তাফসীরে কুরতুবী, সূরা বনী ইসরাঈল-৬/২৪৬, মাআরেফুল কুরআন উর্দু-৫/৩৫-৩৬}

এই কবিতা শুনে রাসূল সাঃ এর দু’চোখ বেয়ে অঝর ধারায় অশ্রু ঝরতে থাকে। নবীজী সাঃ উক্ত ছেলের কলার চেপে ধরে বলেন, “তুমি এবং তোমার সব কিছুই তোমার পিতার”। {আলমুজামুল আওসাত, হাদীস নং-৬৫৭০}

আল্লাহু আকবার! কি কবিতা। আর কি বাস্তবতা! একজন পিতা এভাবেই একটা ছেলে লালন করে চলে সেই অবুঝ বয়স থেকে। নিজের যৌবন বিলিয়ে শিশুকে করে তোলে যৌবনময়। নিজের শক্তি ক্ষয় করে দুর্বল ছেলেকে করে তোলে সবল। নিজের হাসি বিসর্জিত করে হাসি ফুটায় ছেলের মুখে।

কিন্তু আফসোস! সেই ছেলেটাই বৃদ্ধ বয়সের অসুস্থ্য বাবাকে কাঁদায়। বলে, আমি এতো করতে পারবো না। এত টাকা কেন লাগে তার? বড় ভাই কেন করে না? ছোট ভাই কেন দেখে না বলে বাবা মাকে অতিরিক্ত বস্তু বানিয়ে দেয়।

সন্তানের দায়িত্ব বুঝতে তা’ই নিজেকে বাবা হিসেবে চিন্তা করুন। তবেই অনুধাবন হবে বাবা মায়ের জন্য কী করা উচিত।

আল্লাহ তাআলা আমাদের আদর্শ সন্তান হবার তৌফিক দান করুন। পিতা মাতার খিদমাত করে জান্নাত ক্রয় করার তৌফিক দান করুন। আমীন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.