যিলহজ্বের প্রথম দশরজনীর আমল ও তার ফজিলত

মাওলানা তানভীর সিরাজ

প্রতিটি মাস, দিন নিজের বিচিত্র বৈশিষ্ট নিয়েই বিরাজমান। মুহররম, সফর, রবিউল আওয়াল, শাবান, রমজান আর যিলহজ্ব ইত্যাদি আরবি মাসসমূহ নানা ইতি ঐতিহ্যের কারণে মুসলিম সমাজে সমাদৃত, প্রসিদ্ধ আর অম্লান হয়ে আছে। সেই ধারাবাহিকতায় যিলহজ্ব মাসও বিভিন্ন ঐতিহাসিক ইতিবৃত্ত নিয়ে মর্যাদাবান অবস্থানে রয়েছে। কোরআনের একাধিক স্থানে তার আলোচনা এসেছে। এসেছে হজ্বের শিক্ষা। তার গুরুত্ব বুঝানোসহ সমূহ ইতিকথা নিয়ে এই মহানমাস বিশ্ববাসীর মাঝে বেশ পরিচিত। এই মাসেই ইসলামের দ্বিতীয় খলিফা নির্বাচিত হন, তৃতীয় খলীফা শাহীদ হন, বিশ্ববিখ্যাত মুহাদ্দিস ইমাম বুখারী, সম্রাট জাহাঙ্গীর, বিদ্রোহী কবি নজরুল, সত্যের সন্ধানী সালমান ফারসী র.- পরলোক গমন করেন। এবং লক্ষাধিক সাহাবির জনসমুদ্রে মহানবী সা. বিদায় হজ্জ পালনসহ ইসলামের অনেক বিশ্ববরেণ্য ব্যক্তির যোগবিয়োগের সাথে সাথে জগতবিখ্যাত নানাবিধ কাজ সম্পাদিত হয় এই মাসে । তাও আবার আলোচ্যবিষয়ের দিনগুলোতে। যিলহজ্জের প্রথম দশদিনে নেকির কাজ বে-হিসাব পুণ্যে পরিণত হয় এবং রাব্বুল আলামীনের সন্তুষ্টির মধ্য দিয়ে জান্নাতের ওয়ারিশ হয়।

যিলহজ্জের প্রথম দশরজনীতে আমাদের যে আমলগুলো করতে হয়
যিলহজ্জের চাঁদ দেখা, যিলজ্জের চাঁদ উদিত হওয়ার আগেই নক, চুল ইত্যাদি কেটেছেটে ফেলা, সিয়াম পালন, তাকবীরে তাশরীক তাসবীহ পাঠ করা, আরাফার দিনে রোযা রাখা, ঈদের রাতে ইবাদতে রাত জাগা, দশমদিনের সেরা আমল কুরবানিসহ ইত্যাদি আমল দিয়ে যিলহজ্জের প্রথমদশ দিন-রাত আমরা অতিবাহিত করি।

চাঁদ দেখা;
যিলহজ্জের চাঁদ উঠছে কিনা সতর্ক থাকা। কারণ এই চাঁদ উঠা না উঠার উপর শরীয়তের অনেক বিষয়াদি ভিত্তি করে। সঠিক সময়ে চাঁদ দেখতে আমরা যদি গাফলতি করি তা হলে রোযা, কুরবানি ইত্যাদি আমল একদিন আগেপরে হয়ে যাবে। তাই অনেক আলেম চাঁদ দেখা’কে ওয়াজিব বা আবশ্যকও বলেছেন।
চাঁদ দেখে দেখে আমরা যে দোআ পড়ব,

“اللهم أهله علينا باليمن والإيمان والسلامة والإسلام ربي و ربك الله ”

অর্থ, হে আল্লাহ্‌! আপনি ইহাকে আমাদের উপর উদিত করুন কল্যাণ ও ঈমানের সঙ্গে এবং নিরাপদতা ও ইসলামের সঙ্গে। আমার প্রতিপালক এবং ( হে নতুন চাঁদ!) তোমার প্রতিপালক আল্লাহ।
তিরমিযি, হাদিস নং ৩৪৫১।

নক ইত্যাদি পশম কাটাছাটা;
যিলহজ্জ মাসের আরেকটি মুস্তাহাবি আমল হল, চাঁদ উঠার আগে নক,চুল আর পশমাদি কাটাছাটার প্রয়োজন হলে কেটেছেটে ফেলা এবং কুরবানির দিন পশুর গলায় ছুরি দেয়ার আগ পর্যন্ত এসবে হাত না দেয়া। তবে খিয়াল রাখতে হবে যে, কাটতে ছাটতে ৪০ দিনের বেশি হল বা আপনি ভুলে গেলেন কাটতে, আবার এদিকে কুরবানির চাঁদ উদয় হয়ে গেছে। এমন যদি হয় তাহলে চাঁদ উদয় হলেও আপনি যা কাটার তা কাটতে ছাটতে পারবেন। নারী পুরুষের অভিন্ন হুকুম।
এতে করে উক্ত আমলকারী কুরবানি করার ছুয়াব পায়। সুতরাং যারা কুরবানি করলনা তারা কুরবানি করার নেকি পাইল আর যারা কুরবানি করল, তারা কুরবানির দ্বিগুণ নেকি পাইল। তবে সামর্থ্যবান ব্যক্তি যদি কুরবানি না করে ওয়াজিব তরকের গুনাহ হবে।

প্রতি রাতই শবেকদর;
সহজভাষায় যদি বলি তাহলে বলতে হয়, আল্লাহ্‌ বলেন,”বান্দা আমার রহমত থেকে নিরাশ হয়ো না।” কারণ আমার রাগের উপর দয়ার দালান। তাই বলি, আমরা না হয় আমাদের অপরাধের ফলাফলে একটি লাইলাতুলকদর হারিয়েছি,কিন্তু পেয়েগেছি সুনিশ্চিত দশটি লাইলাতুলকদর আর তা হল, যিলহজ্জের প্রথম দশরজনী। আলহামদুলিল্লাহ্‌। হাদিসে পাকে এসেছে।

عن أبي هريرة رضي الله عنه قال قال رسول الله صلى الله عليه وسلم ،ما من أيام أحب إلي الله أن يتعبد له فيها من عشر ذي الحجة يعدل صيام كل نهار منها بصيام سنة وقيام كل ليلة منها بقيام ليلة القدر.
(رواه الترمذي و إبن ماجه،مشكوة : 128،فهم المرام شرح فيض الكلام :296 )

আশেকে রাসূল আবু হুরাইরা রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূল সা. বলেছেন, এমন কোনো দিন নেই যাতে ইবাদত বন্দেগী আল্লাহ্‌র কাছে সবচেয়ে বেশি প্রিয়, আছে। তা হলো যিলহজ্জের প্রথম দশদিন। যার প্রত্যেকদিনের রোযা এক এক বছর (নফল) রোযা সমতুল্য আর এক একটি রাত লাইলাতুলকদর সমপরিমাণ নেকি! খাদেমুর রাসূল আনাস র. থেকে বর্ণিত আছে যে, যিলহজ্জের প্রতিটি দিন একহাজার দিনের সমতুল্য আর আরাফার দিন একদিনই দশহাজার দিনের সমতুল্য।
(বাইহাকী, লাওয়াকিহুল আনওয়ার : ৯২, ফাহমুল মুরাম শারহে ফাইযুল কালাম : ২৯৭।) “সুবহানআল্লাহ। (তিরমিযি,ইবনে মাজা,মিশকাত, ফায়জুল কালাম)

যিলহজ্জের ৯ রোযা;
عن بعض أزواج النبي صلى الله عليه وسلم قالت: «كان النبي صلى الله عليه وسلم يصوم تسع ذي الحجة، ويوم عاشوراء، وثلاثة أيّام من كل شهر». (رواه أحمد وأبو داود والنسائي وغيرهم). وقال الإمام النووي عن صوم أيّام العشر أنّه مستحب استحباباً شديداً.
রাসূল সা. -এর কোনো এক স্ত্রী আমাদের মা বলেন,”নবী সা. যিলহজ্জের ৯ রোযা, আশুরার রোযা আর প্রত্যেক মাসে তিনটি করে সিয়াম পালন করতেন। ” ইমাম আহমদ, আবু দাউদ ও ইমাম নাসায়ীসহ অনেকে হাদিসটি বর্ণনা করেছেন। বিশ্ববিখ্যাত হাদীস ব্যাখ্যাকার ইমান নববী র. ৯ রোযার কথা ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বলেন, তা কঠিন মুস্তাহাব, অসাধারণ মুস্তাহাব। নাসায়ী শরিফের একহাদিসে এসেছে “রোযা ঢাল সরূপ।” যা মানুষকে পরনিন্দা, গীবত ও মিথ্যাচার থেকে রক্ষা করে। শয়তানের কুমন্ত্রণা আর জাহান্নামের আগুন থেকেও বাঁচিয়ে রাখে। এমনি ব্যাখ্যা করেছেন শায়খুল হাদিস আল্লামা যাকারিয়া কান্দলবী র.।

আরাফার বিশেষ রোযা;
খাদেমুর রাসূল আনাস র. থেকে বর্ণিত আছে যে, যিলহজ্জের প্রতিটি দিন একহাজার দিনের সমতুল্য আর আরাফার দিন একদিনই দশহাজার দিনের সমতুল্য।
(বাইহাকী, লাওয়াকিহুল আনওয়ার : ৯২, ফাহমুল মুরাম শারহে ফাইযুল কালাম : ২৯৭।)
সহীহ মুসলিমের প্রসিদ্ধ একহাদিসে এসেছে, রাসূল সা. বলেছেন, আরাফাতের দিনে (চাঁদ দেখা হিসেবে ৯ তারিখ) যিলহজ্জের রোযা রাখার ব্যাপারে আমি ধারণা করি যে, আল্লাহতালা রোযাদারের একবছর আগের ও পরের (ছোট)গুনা বা পাপ ক্ষমা করে দিবেন।
قال صلى الله عليه وسلم :«صيام يوم عرفة، أحتسب على الله أن يكفر السنة التي قبله، والسـنة التي بعده…> [أخرجـه مسلم ]

তাকবীরে তাশরীক;
তাকবীরে তাশরীক হল, যে তাকবীর যিলহজ্জের ৯ তারিখ ফজর থেকে ১৩ তারিখ আছর পর্যন্ত পড়া হয়। যে কারণে এই দিনগুলোকে আইয়্যামে তাশরীক বা তাশরীকের দিনসমূহ বলা হয়। সংখ্যা হিসেবে পাঁচদিন হয়। পুরুষদের পড়তে হয় বড় আওয়াজে আর মহিলাদের পড়তে হয় ছোট আওয়াজে। তাকবীর যদিও ওয়াজিব কিন্তু, মহিলাদের আওয়াজ ছতর হিসেবে ছোট করা ফরজ।
এই তাসবীহ কেবল একবার পড়া ওয়াজিব হয়, তিনবার পড়া ওয়াজিব নয়। এ মর্মে হযর‍ত আলী ও আব্দুল্লাহ বিন আব্বাস র. থেকে বর্ণিত আছে।
ما ورَد مِن قولِ عليّ وابن عبّاس ن أنّه مِن صُبح يومِ عرفة إلى العصرِ من آخر أيّام التشريق (الثالث عشر )

তাকবীরে তাশরীক নিচে দেয়া হল।

” الله أكبر الله أكبر لا إله إلا الله،
والله أكبر,
الله أكبر ولله الحمد.”

ঈদের রাতে ইবাদতে রাত জাগা;
দ্বীনে ইসলামের বড় বড় পাঁচরাতের মধ্যে দুই ঈদের রাত অন্যতম। সামনে আসছে কুরবানির ঈদ। দিনের বেলা আমরা গরুছাগল আল্লাহ্‌র ওয়াস্তে কুরবানি দিবো, এই তো তার ঠিক আগের রাতটি ঈদের রাত,আর তা দেবো আল্লাহকে। ওলামারা বলেন, মাগরিব, এশা আর ফজর যদি অন্তত জামাতের সাথে পড়ি তাহলেও আমরা সেই ফযিলত পেরে পারি।
হাদিসে আছে এই দুইরাতকে যে ব্যক্তি জীবিত রাখবেন, কিয়ামত দিবসে তাকে আল্লাহ্‌ তাকে জীবিত রাখবে। হতে পারে মাফ করে দিবেন বা তার প্রতি বিশেষ রহমত করবেন ইত্যাদি। কারণ আনন্দঘন রাতে সে যেমন আল্লাহকে ভুলেনি, আল্লাহ কি করে কঠিন মুহূর্তে তার প্রিয় বান্দাকে ভুলবেন! সুবহানআল্লাহ।

কুরবানি করা;
কুরবানির দিন ফরজ ইবাদতের পর কুরবানি করাই হল সবচে’ বড় ইবাদত এবং আল্লাহ্‌র কাছে অনেক বেশি প্রিয়।

فعَنِ عَائِشَةَ رضي الله عنها أَنَّ رَسُولَ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم قَالَ:
«مَا عَمِلَ آدَمِىٌّ مِنْ عَمَلٍ يَوْمَ النَّحْرِ إلى أَحَبَّ اللَّهِ مِنْ إِهْرَاقِ الدَّمِ، إِنَّهَا لَتَأْتِى يَوْمَ الْقِيَامَةِ بِقُرُونِهَا وَأَشْعَارِهَا وَأَظْلاَفِهَا، وَإِنَّ الدَّمَ لَيَقَعُ مِنَ اللَّهِ بِمَكَانٍ قَبْلَ أَنْ يَقَعَ مِنَ الأَرْضِ فَطِيبُوا بِهَا نَفْساًِ»
[رواه ابن ماجه والترمذي وحسنه ]

আম্মাজান আয়েশা র. থেকে ববর্ণিত আছে যে, নবী কারীম সা. বলেছেন :
ঈদুল আযাহার দিন কুরবানির চে’ আল্লাহর কাছে বনি আদমের আর কোন আমল এত অধিক প্রিয় নয়। কিয়ামত দিবসে তার শিং, পশম আর নক ইত্যাদি কোলে করে নিয়ে হাযির হবেন কুরবানি করেছেন যে ব্যক্তি, আর নিশ্চয় কুরবানির পশুর রক্ত মাটিতে পড়ার আগেই আল্লাহর দরবারে কুরবানি করাটা কবুল হয়ে যায়, সুতরাং খুশি মনে (আল্লাহ্‌ ওয়াস্তে) কুরবানি করো।
তিরমিযি, ইবনে মাজা,মিশকাত :১২৮, ফায়যুল কালাম: ২৯৬ পৃ।
তাই আসুন, আমরা যে নেক আমল করি না কেন কেবল আল্লাহ্‌র জন্যই করি,করবো। লোক দেখানো বা সুনামের জন্য নয় ত নয়, এক আনাও নয়, বরং সব আনা যেন আল্লাহর জন্য হয়। আল্লাহ আমাদের সবাইকে তাওফিক দান করেন। আমীন। ওয়াল হামদুলিল্লাহি রাব্বিল আলামীন।

লেখক: ফাযেলে দারুল উলুম মুঈনুল ইসলাম হাটহাজারী

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *