কোরআন শিখে আলেম হয়ে আমরাও দ্বীনের খেদমত করতে চাই: বললেন মাদরাসার হিজড়া শিক্ষার্থী

সমাজ যাদেরকে দূরদূর করে তাড়িয়ে দেয়, দেখে ঘৃণার চোখে, উপেক্ষার সমাজে যাদেরকে জুলুম করে নির্লজ্জ সেজে চাঁদা আদায় করে জীবিকা নির্বাহ করতে হয়, সেই অবহেলিত, অবাঞ্ছিত তৃতীয় লিঙ্গের অসহায় মানুষদের কল্যাণে এগিয়ে এসেছেন একদল দরদী আলেম।

দেশে এই প্রথম হিজড়া জনগোষ্ঠীর জন্য আনুষ্ঠানিকভাবে একটি মাদরাসা চালু করেছেন একদল ওলামায়ে কেরাম। সেখানে সম্পূর্ণ বিনা খরচে তাদের দ্বীনী শিক্ষার ব্যবস্থা করা হয়েছে।

শুক্রবার (৬ নভেম্বর) ঢাকার কামরাঙ্গীরচর ছাতা মসজিদ রোড এলাকার দাওয়াতুল কোরআন নামে তৃতীয় লিঙ্গের মাদ্রাসাটির আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন হয়। শনিবার (৭ নভেম্বর) থেকে সেখানে তৃতীয় লিঙ্গের শিক্ষার্থীরা ভর্তি হতে পারবেন।

জানা গেছে, মরহুম আহমেদ ফেরদৌস বারী চৌধুরী ফাউন্ডেশনের উদ্যোগে এই মাদ্রাসাটি চালু হয়েছে। এই মাদ্রাসায় পড়ালেখার জন্য হিজড়াদের কোনও খরচ লাগবে না। ২০২০ সালে সরকার স্বীকৃত কওমি সিলেবাস অনুযায়ী মাদ্রাসাটি পরিচালিত হবে। প্রাথমিকভাবে ১০ জন শিক্ষকের সমন্বয়ে অনাবাসিক এই মাদ্রাসাটির যাত্রা শুরু হয়েছে।

মাদ্রাসাটির প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক হাফেজ মাওলানা মুফতি মোহাম্মদ আব্দুর রহমান আজাদ জানান, শনিবার থেকে ভর্তি শুরু হলে বলতে পারবো কতজন শিক্ষার্থী ভর্তি হচ্ছে। এখানে পড়াশুনা করতে শিক্ষার্থীদের কোনও খরচ লাগবে না। আপাতত মাদ্রাসাটি অনাবাসিক হবে।তৃতীয়-লিঙ্গের-মাদরাসা-696x392

১০ জন শিক্ষক দিয়ে মাদ্রাসাটি পরিচালিত হবে জানিয়ে আব্দুর রহমান বলেন, ‘মাদরাসা শিক্ষকদের মধ্যে বাংলা, ইংরেজি ও কারিগরিতে দক্ষ অনেক শিক্ষকও আছেন।’

মাদ্রাসাটির শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ সচিব মোহাম্মদ আব্দুল আজিজ হুসাইনী বলেন, ‘হিজড়া তো সমাজের মধ্যে অবহেলিত ও সুবিধাবঞ্চিত। তারা শিক্ষা অর্জন করতে পারছে না। এই কারণে তারা সমাজের ভেতরে উচ্ছৃঙ্খল। কিন্তু তাদের তো আল্লাহ সৃষ্টি করেছেন। কোনও মায়ের সন্তান। তাদের আদর্শ শিক্ষা দেওয়ার দায়িত্ব তো আমাদেরই। এদের আদর্শ করতে হলে প্রথমে কোরআন শিক্ষা দরকার। তাই এই মাদ্রাসার উদ্যোগ নেওয়া। এরপর তাদের কারিগরি শিক্ষা দিয়ে মানবসম্পদে পরিণত করাই আমাদের চিন্তা।’

শুরুতে মাদ্রাসাটিতে তৃতীয় লিঙ্গের শিক্ষার্থীদের কোরআন শিক্ষা দেওয়া হবে উল্লেখ করে আব্দুল আজিজ বলেন, ‘মাদ্রাসায় নুরানি বিভাগ থেকে নিয়ে হেফজুল কোরআন, দাওরায়ে হাদিস থাকবে। আসলে গত বছর সরকার কওমি মাদ্রাসার যে সিলেবাসের (সনদ) স্বীকৃতি দিয়েছে সেই অনুসারে এই মাদ্রাসাটি পরিচালনা করবো।’

প্রাথমিক পর্যায়ে মাদ্রাসার শিক্ষকদের ১০ হাজার টাকা করে বেতন দেওয়া হচ্ছে জানিয়ে তিনি বলেন, যারা ঊর্ধ্বতন পর্যায়ে আছে তাদের বেতন ৩০ হাজার টাকা। শিক্ষকসহ মাদ্রাসার পরিচালনার খরচ দিচ্ছে মরহুম আহমেদ ফেরদৌস বারী চৌধুরী ফাউন্ডেশন।

ঢাকা দক্ষিণ সিটির ৫৭ ওয়ার্ডে অবস্থিত দাওয়াতুল কোরআন তৃতীয় লিঙ্গের মাদ্রাসাটির উদ্বোধন অনুষ্ঠানে হিজরা কল্যাণ ফাউন্ডেশনের সভাপতি আবিদা সুলতানা মিতু বলেন, ‘তৃতীয় লিঙ্গের মানুষদের জন্য এই প্রথম দেশে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান চালু হয়েছে। হিজড়াদের মৌলিক চাহিদা মেটানোর সুযোগ দেওয়া হলে তারা রাস্তায় নেমে কাউকে বিরক্ত করবে না। তারাও সাধারণ মানুষের মতো জীবনযাপন করতে চায়। আমি এজন্য মাদ্রাসাটির উদ্যোক্তাদের ধন্যবাদ জানাই।’

মাদ্রাসার শিক্ষার্থী রানী হিজড়া বলেন, ‘আমাদের শিক্ষার কোনও ব্যবস্থা নেই। সরকার স্বীকৃতি দিলেও শিক্ষার সেরকম কোনও ব্যবস্থা করে নাই। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো ভর্তি নেয় না। আমারও তো মানুষ। সাধারণ মানুষের মতো আমাদেরও শিক্ষা অর্জন করার অধিকার রয়েছে।’

তিনি আরও বলেন, ‘যাত্রাবাড়ীতে আমাদের অর্ধশতাধিক হিজড়া রয়েছে। সবাই মুসলিম। এখানকার হুজুররা যাত্রাবাড়ীতে আমাদের আবাসস্থলে গিয়ে কোরআন পড়াতেন। কোরআন শিখে আমরাও মাওলানা হতে চাই। রাস্তায় গিয়ে টাকা তুলে পেট চালাতে চাই না। চাকরি করে জীবন চালাতে চাই।’

%d bloggers like this: