আমি হিফজ থেকে স্নাতকোত্তর কওমি মাদ্রাসা তারপর বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েছি। হিফজখানার আড়াই বছরে আমি জানতামও না যে মাদরাসায় এ ধরণের গর্হিত কাজ হয়। হিফজখানা আমার কাছে বরাবরই এক পবিত্র ক্যাম্পাস। আমার হিফজের সম্মানিত উস্তায হাফেজ নজরুল ইসলাম সাহেব ছিলেন একজন আদর্শ শিক্ষক ও আত্মমর্যাদাসম্পন্ন উঁচু ব্যক্তিত্বের অধিকারী।
হিফজ শেষ করে দেশের অন্যতম শীর্ষ ইসলামী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান জামিয়া ইমদাদিয়ায় ভর্তি হই। দুই হাজার শিক্ষার্থীর বিশাল বিদ্যাপীঠ। অর্ধশতাধিক শিক্ষক। কোনোদিন এ ধরণের বিষয় আমাদের কানে আসেনি। ফলে কওমি মাদ্রাসায় অধ্যয়নকালে আমার ধারণাও ছিল না যে, মাদ্রাসায় বলাৎকার হয়। আসলে মাদ্রাসাগুলো অবস্থা এমনই পবিত্র। দুঃখজনক হলো, হাজারে দুএকটা ঘটনা ঘটছে। হাজারে কেন, লাখেও যদি দুএকটি হয় তবুও মাদ্রাসার পবিত্র আঙিনায় তা কিছুতেই মেনে নেওয়া যায় না। হাজারে দুএকটি ঘটনা আমাদের বরাবরই লজ্জিত করে।
তবে ইদানীং মিডিয়ায় বিষয়টি এমনভাবে আলোচিত হচ্ছে, মাদ্রাসা মানেই যেন বলাৎকার। কিছুদিন আগে একটি টিভি চ্যানেলের ওয়াজ ও ইসলাম-বিদ্বেষ নিয়ে দেশের আলেমসমাজ ও তৌহিদী জনতা বিক্ষুব্ধ হয়ে তা বর্জনের ডাক দিয়েছিল তখন সে চ্যানেলটি মাদ্রাসাকে আরো নেতিবাচকভাবে মানুষের সামনে তুলে ধরার নতুন ষড়যন্ত্রে নামে। দেশের কোনো অঞ্চলে বিচ্ছিন্ন দুএকটি ঘটনা ঘটলে এটিকে জাতির সামনে বড় করে তুলে ধরাকেই তারা এখন তাদের সবচেয় বড় কর্তব্য হিসেবে নিয়েছে। এ যেন তাদের অস্তিত্ব রক্ষার লড়াই। আমাদের হৃদয়কে ক্ষতবিক্ষত করেই চলেছে গণমাধ্যমের কলঙ্ক এ টিভি চ্যানেলটি।
বিচ্ছিন্ন যে দুএকটি ঘটনা ঘটে, এরও অধিকাংশই মিথ্যা অপবাদ। অনেকদিন আগে আমার পরিচিত এক প্রতিষ্ঠানের এক শিক্ষককে এহেন অভিযোগে বহিষ্কার করা হয়েছিল। শিক্ষক বরাবরই দাবি করে আসছিলেন তিনি নির্দোষ। প্রায় ৬ মাস পর আসল খবর জানল এলাকাবাসী। এলাকার এক প্রভাবশালী রাজনৈতিক নেতা যিনি মাদ্রাসার ক্যাশিয়ার, টাকা তসরুফ করেন। এ বিষয়টি ওই শিক্ষক জানতেন। যখনই ক্যাশিয়ার দেখল যে, তার অর্থ কেলেঙ্কারি মানুষ জেনে যাবে তখনই ওই শিক্ষকের বিরুদ্ধে বলাৎকারের মিথ্যা অভিযোগ করে তাকে চাকরীচ্যুত করেন তিনি। ৬ মাস পর ওই ছাত্রই বলল যে, ঘটনা মিথ্যা। তখন এলাকাবাসী মাফ চেয়ে সে শিক্ষককে আবার আনতে চেয়েছিল, কিন্তু তিনি আর সেখানে আসতে রাজি হননি।
বিচ্ছিন্ন যে দুএকটি ঘটনা ঘটে, তা বন্ধে আমাদের ঊর্ধ্বতনদের কঠোর ভূমিকা সন্তোষজনক নয়। তারা কেন এ বিষয়ে জাতীয়ভাবে কঠোর পদক্ষেপ নিচ্ছেন না তা আমাদের বোধগম্য নয়। প্রশ্নফাঁসের সময়ই কয়েকটি কওমি মহিলা মাদ্রাসায় যৌন কেলেঙ্করি ধরা পরে। তখন প্রশ্নফাঁস বন্ধে তাদের পদক্ষেপের মতো তেমন কোনো ব্যবস্থা বোর্ড নিয়েছিল বলে আমি জানি না। সেই মহাসচিব কিন্তু এখন আর নেই। বেফাকের বর্তমান মহাসচিব আমাদের প্রত্যাশার প্রতীক। আমরা আশা করব, তিনি এ বিষয়ে কঠোর পদক্ষেপ নেবেন। দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হলে বিচ্ছিন্ন দুএকটি ঘটনার বদনাম মাদ্রাসাকে নিতে হবে না।
বেফাকের কর্তৃপক্ষের কাছে আমাদের বিনীত অনুরোধ, নিম্নের পদক্ষেপগুলো নেয়া যায় কি-না ভেবে দেখবেন।
১. মাদরাসা স্থাপন ও প্রতিষ্ঠার জন্য প্রতি জেলায় একটি কমিটি রাখা। যে কেউ যেন দুটি রুম ভাড়া করে সেখানেই ‘জামিয়া’ বা দুই রুমবিশিষ্ট বিশ্ববিদ্যালয় খুলতে না পারে সে ব্যাপারটি দেখবে এ কমিটি। প্রয়োজনীয় অবকাঠামো আছে কি-না তা যাচাই করে মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠার প্রাথমিক অনুমতি দেবে এ কমিটি।
২. কেনো প্রতিষ্ঠানে যেন আয়-ব্যয় ও হিসাব সংক্রান্ত অস্বচ্ছতা না থাকে সে ব্যাপারেও প্রতি জেলা/উপজেলায় একটি কমিটি রাখা।
৩. প্রতিষ্ঠানের আর্থিক সঙ্গতি থাকলে শিক্ষকদের জন্য কোয়ার্টার্সের ব্যবস্থা করে স্ত্রী-সন্তানসহ শিক্ষকদের থাকার ব্যবস্থা করে দেওয়া।
৪. প্রতিটি কওমি মাদ্রাসায় শিক্ষকদের পাক্ষিক ছুটির ব্যবস্থা রাখা। বিশেষত আবাসিক ক্ষেত্রে অবিবাহিত শিক্ষক নিয়োগ না দেওয়া এবং বিবাহিতদেরও অন্তত দুই সপ্তাহ পরপর ৩ দিনের ছুটির ব্যবস্থা করা।
৫. দেশের কোনো ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে যেন যৌন নিপীড়নের ঘটনা না ঘটে সেজন্য এ ধরণের অপরাধ মনিটরিংয়ের জন্য প্রতি জেলা/’উপজেলায় বেফাকের একটি কমিটি থাকা। যে কেউ ষড়যন্ত্র করে যেন মিথ্যা অভিযোগ চাপিয়ে দিতে না পারে। আবার কিছুতেই যেন অপরাধীরা ছাড় না পায়। কোনো শিক্ষক অভিযুক্ত হলে তাকে বাঁচানোর বা আড়াল করার চেষ্টা কিছুতেই নয়, সুষ্ঠু তদন্তের মাধ্যমে আলেমদের তত্ত্বাবধানে তাকে রাষ্ট্রীয় আইনে বিচারের আওতায় আনা।
৬. কোনো মাদ্রাসা প্রধান তার অধীনস্থ কোনো শিক্ষকের চারিত্রিক সমস্যা দেখেলে তাকে ইসলাহের জন্য কোনো বুজুর্গের পরামর্শে পাঠানো।
৭. কোনো মাদ্রাসায় যৌন নিপীড়নের ঘটনা ঘটলে সে মাদ্রাসার প্রধানও দায়ী। প্রতিষ্ঠান প্রধান হিসেবে মনিটরিংয়ে ত্রুটি ধরা পড়লে প্রতিষ্ঠান প্রধানকেও বহিস্কার ও সেজন্য সে মাদ্রাসার রেজিস্ট্রেশন ৩ বছরের জন্য বাতিল করা।
৮. যৌন কেলেঙ্করিতে বহিস্কৃত হলে কোনো মাদ্রাসায় সে আর শিক্ষক হিসেবে যেন চাকরি করতে না পারে বা নতুন মাদ্রাসা খুলতে না পারে সে ব্যাপারে বেফাকের জেলা কার্যালযে সতর্কতামূলক ব্যবস্থা রাখ।
৯. মহিলা মাদ্রাসগুলোতে শতভাগ মহিলা শিক্ষক নিশ্চিত করা।
১০. শিক্ষকদের পাঠদানের পাশাপাশি শিক্ষকের ব্যক্তিত্বটাও ছাত্ররা ফলো করে। সব শিক্ষকের আত্মশুদ্ধি, উঁচু ব্যক্তিত্ব ও উত্তম চরিত্রের ব্যাপারে বেফাকের পক্ষ থেকে শিক্ষক প্রশিক্ষণ বাধ্যতামূলক করা। প্রতিষ্ঠান প্রধানদেরকেও প্রশিক্ষিত করা।
লেখক – মাওলানা যুবায়ের আহমাদ
পরিচালক, বাইতুল হিকমাহ একাডেমী, গাজিপুর।