ক্বাযা নামায প্রসঙ্গে জামিয়া আযহার কী বলে? আযহারের বিরুদ্ধে অভিযোগ ও তার খণ্ডন

আশরাফ মাহদি
————————-

জামিয়া আযহারের লকব ধারণ করে যখন কেউ উমরি ক্বাযা ওয়াজিব হওয়ার ব্যাপারে শায মাসআলা বয়ান করেন তখন এই মাসআলার ব্যাপারে আযহারের অবস্থান জেনে রাখাটা জরুরী৷ নাহলে ব্যক্তির কথাকে জাস্টিফাই করতে গিয়ে দ্বীনী প্রতিষ্ঠানের উপর ভুল ধারণা সৃষ্টি হতে পারে৷

উমরি ক্বাযার ব্যাপারে দারুল ইফতা মিসরের ফতোয়া হচ্ছে, বিগত সময়ের ছুটে যাওয়া নামাজের কাজা আদায় করা ওয়াজিব৷ কারণ, চার মাযহাবের ইমামগণ উক্ত মাসআলার ক্ষেত্রে ইজমা প্রতিষ্ঠিত করেছেন।

আযহারের ফতোয়ায় এই মাসআলার ধরণটা আরেকটু নির্দিষ্টভাবে বলা আছে। যেই নামাজ ক্বাযা হয়ে গেছে, পরদিন সেই ওয়াক্ত চলে আসলে আগে ক্বাযা আদায় করতে হবে। এরপর চলমান ওয়াক্তের নামাজ আদায় করবে। অর্থাৎ যদি আগের দিনের ফজর ছুটে গিয়ে থাকে তাহলে পরেরদিন ফজর পড়ার আগে ক্বাযা ফজরটি পড়ে নেবে। এভাবে যতদিনের নামাজ ক্বাযা হয়েছে ততদিনের প্রত্যেক ওয়াক্ত আদায়ের আগে একটা ক্বাযা পড়ে নেবে।  অর্থাৎ ক্বাযাকে আদার উপর অগ্রগণ্য করবে।  ক্বাযাকে আদার উপর এই মুকাদ্দাম করার দলিল হিসেবে নিসইয়ানের হাদিসের মাফহুমকে উল্লেখ করা হয়েছে।
এছাড়াও উমরি ক্বাযা ওয়াজিব হওয়ার ব্যাপারে আরো স্পষ্ট দলিল বর্ণনা করা আছে।

অতএব এটা খুবই স্পষ্ট যে, উমরি ক্বাযা আদায় ওয়াজিব হওয়ার ব্যাপারে চার মাযহাবের ইজমা নিয়ে দেওবন্দ ও আযহারের মাঝে কোন মতবিরোধ নেই৷

 

তাহলে মিজানুর রহমান আযহারী যে বললেন উমরি ক্বাযা ওয়াজিব না?

সেটি আসলে আহলে হাদিসদের একটি শায মত এবং ইমাম নববী বলেছেন সেটি জাহেরীদের ত্রুটিপূর্ণ মত। এই মতকে গ্রহণ করা যাবে না৷

কিন্তু এই মত বর্ণনা করার কারণে মিজানুর রহমান আজহারীকে কাফেরও বলা যাবে না। আজকাল আমাদের দেশে কিছু মানুষের মধ্যে আজহারী বিদ্বেষ এতটাই চরমে যে এক আযহারীর কারণে প্রতিষ্ঠান আযহারকেই অনেকে তুলোধুনো করে ছাড়ছেন৷ দুইদিন আগে জামিয়া রশিদিয়ার এক সম্মেলনে এমনই একজন মুফতির বক্তব্য শুনছিলাম। তিনি বলছিলেন,
“মিসর মুসলিম কান্ট্রি।  কিন্তু সেখানে দেওবন্দী ধারার কোন মাদরাসা নাই। এই আযহারে পড়াশুনা করে, মানুষেরা এরকম হয়, যাদের উপমহাদেশের দ্বীনী পরিবেশের সাথে কোন সম্পর্ক নাই। ওখান থেকে বড় বড় ডিগ্রি হাসিল করে সত্য, কিন্তু অবস্থা এই হয়, বিমানে বসে শুয়োরের গোশত খায় এবং বলে যে শুয়োর হারাম আগে ছিল, এখন পরিচ্ছন্ন পরিবেশে লালিত পালিত হওয়ার কারণে আর নাই৷”

এটা সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন একটা কথা। দুনিয়াতে শুয়োরের গোশত হালাল হওয়ার ফতোয়া কোন মুফতিই দেয়নি৷ এখন কোন ভণ্ড যদি আযহারী পোশাক লাগিয়ে নিজেকে আযহারী দাবী করে এমন ফতোয়া বলে বেড়ায় তাহলে সেই দায় আযহার কেন নিবে? আর সেই ভণ্ডকে দিয়ে একটা অঞ্চলের দ্বীনী পরিবেশকে বিচার করে ফেলাটা কতটা ভয়াবহ! এইভাবেই গুজব ছড়াতে ছড়াতে আমাদের দেশে এমন কথাও ছড়িয়ে যায় যে আযহারে খৃষ্টান উস্তাদ আছে! শিয়া উস্তাদ আছে! নাউজুবিল্লাহ!

অভিযোগটা যিনি আরোপ করছিলেন সেই মুফতি সাহেব ফেনির এক মসজিদের খতিব। কিন্তু আযহারের মত প্রতিষ্ঠানের ব্যাপারে না জেনে এমন হুকুম যে মুফতি লাগায় তাকে মুফতি বলাটা খুবই ঝুঁকিপূর্ণ। কারণ জামিয়া রশিদিয়ায় এত বড় মজলিশে সবার সামনে বিশ্ববিখ্যাত দ্বীনী প্রতিষ্ঠানের ব্যাপারে মিথ্যা তোহমত বা অপবাদ দিয়ে অনাস্থা তৈরী করার আগে বিশ্লেষণের প্রয়োজন বোধ না করাটা বড় ধরণের সমস্যা।  যা এক অঞ্চলের ওলামাদের সাথে আরেক অঞ্চলের ওলামাদের বিরোধ সৃষ্টির জন্য যথেষ্ট।

শুয়োরের মাংস যে হারাম এই ব্যাপারে জায়েজের কোন ফতোয়া দেওয়ার সুযোগই নেই। আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাতের কোন ফকিহ নিজের উসুলে কিতাবুল্লাহর সুস্পষ্ট নসকে কিয়াস দ্বারা বাতিল করার পক্ষে মত দেননি। যেটা দেশে কওমী মাদরাসায় পড়ানো হয়, তার সাথে এখানের সিলেবাসে আরো কিছু যুক্ত হয় ঠিক, কিন্তু এখানে সুস্পষ্ট নসকে তাবীল করে জায়েজ বানানোর কোন উসুল পড়ানো হয় না।  শুয়োরের গোশতের হুরমত কিতাবুল্লাহর সুস্পষ্ট নস দ্বারা প্রমাণিত।

আর এটা খুবই যৌক্তিক যে আযহারের কোন আলেম এমন কোন হারামকে হালাল বলে ফতোয়া দিলে সেটা নিয়ে তোলপাড় হতে খুব একটা সময় লাগতো না। অথচ মুফতি সাহেবের ভাবখানা এমন যেন আযহারে পড়ে সবাই এসবই করে বেড়ায়!

দেওবন্দের শ্রেষ্ঠত্ব বোঝানোর জন্য আযহারকে খারাপ প্রমাণ করতে হবে এটা খুবই নিচু মানসিকতা। অথচ আমরা আমাদের আযহারী উস্তাদদেরকে দেখেছি দরসে দেওবন্দী ওলামা ও মানহাজের প্রশংসা করতে৷ কিন্তু তারা যদি জানতেন যে বাংলাদেশের কিছু মুতাআসসিব ও অবুঝ লোকেরা আযহারের ব্যাপারে না জেনে বিভ্রান্তি ছড়ায় তাহলে তাদের ধারণাটা কী দাঁড়াবে!? জবানদারাজি তথা গলাবাজি করার আগে এগুলোও একটু ভাবা উচিত। প্রচুর বই পুস্তক লেখা হয়েছে আযহারের ব্যাপারে শুবুহাতের রদ নিয়ে। মুফতি সাহেবের এতই যদি আলোচনা করার ইচ্ছা জাগে একটা কিতাব অন্তত মুতালায়া করে নিতে পারতেন।

কিন্তু তিনি সেই কাজ না করে অযাচিতভাবেই এমন একটি দ্বীনী ধারার প্রতিষ্ঠানের উপর ভিত্তিহীন এক অভিযোগ আরোপ করে দিলেন যে, হাজার বছর ধরে যে প্রতিষ্ঠান এ অঞ্চলে দ্বীনের খেদমত করে এসেছে।  শুধু এই অঞ্চলই নয়, আমাদের এশিয়ার মধ্যেও অনেক দেশে আলেম বলতেই আযহারীদের বোঝানো হয়। মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া এক্ষেত্রে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। আযহারীদের খেদমত এতটাই ব্যাপক যে শুধু ইলমে দ্বীনই নয়, বিশ্বের অনেক অঞ্চলে দ্বীনের দাওয়াত পৌঁছেছে এই আযহারীদের মাধ্যমে এবং দেশে দেশে দ্বীনী শিক্ষাকেন্দ্র গড়ে তোলার বড় বড় প্রজেক্ট আযহার দীর্ঘদিন ধরে বাস্তবায়ন করে আসছে।

তাই মন্তব্যের আগে বাস্তবতা ভাল করে জেনে নিন। অযথা বিতর্ক উস্কে দিয়ে, ইখতিলাফ তৈরী করলে সেটা সবার জন্যই বিপদ। আল্লাহ আমাদের বুঝ বাড়িয়ে দিন।

2 thoughts on “ক্বাযা নামায প্রসঙ্গে জামিয়া আযহার কী বলে? আযহারের বিরুদ্ধে অভিযোগ ও তার খণ্ডন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *