লুৎফুর রহমান ফরায়েজী
মীলাদ মানে কি?
মীলাদ শব্দটি আরবী। যার অর্থ হল জন্ম। সুতরাং মীলাদুন্নবী মানে হল নবীর জন্ম।
একজন সাধারণ মুসলমানও বুঝবেন জন্মদিন উদযাপনের কোন বিষয় নয়। এটি কেবলি আলোচনার বিষয় হতে পারে। এটি পালনীয় বিষয় হলে রাসূল সাঃ নিজেই তা পালন করে দেখাতেন। সাহাবাগণ যারা সবচে’ বেশি আশেকে রাসূল ছিলেন। নবীজী সাঃ এর প্রতি মুহাব্বাতের চূড়ান্ত পরাকাষ্ঠা প্রদর্শন করে যারা অকাতরে জীবন বিলিয়েছেন। সন্তান এতিম করেছেন। স্ত্রী বিধবা করেছেন। পরিবার, সমাজ, অর্থ, বিত্তবৈভব সবই বিসর্জন করেছেন নবীজী সাঃ এর মোহাব্বতে। কিন্তু সেসব সাহাবাগণ কেন নবীজী সাঃ এর জন্মদিন পালন করেননি? কেন, আবু বকর রাঃ, ওমর রাঃ, উসমান রাঃ ও হযরত আলী রাঃ এরম ত খুলাফায়ে রাশেদীনের জমানায় এ ঈদ উদযাপিত হয়নি?
এসব কি প্রমাণ করে? এটি উদযাপনের বিষয়? যদি এটি সওয়াবের বিষয় হতো, তাহলে সাহাবায়ে কেরামগণ কেন এটি পালন করেননি? কেন তাবেয়ীগণ পালন করেননি? কেন তাবে তাবেয়ীগণ পালন করেননি?
কেন এ ঈদের কথা কুরআন, হাদীস এবং ফিক্বহের কিতাবে লিখা হয়নি?
যা পরিস্কার প্রমাণ করে এটি একটি পরিস্কার বিদআত।
খৃষ্টানদের থেকে ধার করা এ কথিত ঈদ
খৃষ্টানরা তাদের নবীর জন্মদিন পালন করে থাকে। কিন্তু তাদের নবীর সীরাত আমলে নেয় না। অর্থাৎ তারা মীলাদুন্নবীর প্রবক্তা। কিন্তু তাদের নবীর সীরাতুন্নবীর প্রবক্তা নয়। কারণ সীরাত হল নবীর আদর্শ মেনে চলা। নবীর বাতানো পথে নিজেকে সঁপে দেয়া। যদি খৃষ্টানরা তাদের নবীর সেই সীরাতকে মেনে নিত, তাহলে তারা আর খৃষ্টান থাকতে পারতো না, হয়ে যেতো মুসলমান হয়ে। আর মদ, জুয়া, যিনা ইত্যাদিতে মত্ত থাকতে পারতো না। হয়ে যেতে খাটি মুসলমান।
খেয়াল খুশির জীবন পরিহার করে খাটি মুসলমান হবার ভয়ে ওরা তাদের নবীর সীরাত বাদ দিয়ে পালন করে মীলাদ তথা নবীর জন্ম দিবস।
ঠিক একই পদ্ধতিতে কতিপয় নামধারী মুসলমান নবীর সীরাত পালন না করে খৃষ্টানদের মত মীলাদুন্নবী পালনে মত্ত। যাদের না চেহারায় আছে নবীর সুন্নত, না পোশাকে নবীর সুন্নত, না আখলাকে নবীর সুন্নত। কিন্তু সেজে বসেছে বিশাল আশেকে রাসূল।
আমাদের নবীজী সাঃ ২৩ বছর নবুওয়তী জিন্দিগীতে যেসব বিষয়ের জন্য মার খেলেন, রক্তাক্ত হলেন, সেই সীরাত রেখে একটি অযথা ও বিদআতি কর্ম মীলাদুন্নবী পালন করা খৃষ্টানদের বড়দিন পালনের মত ধোঁকাবাজী ছাড়া আর কিছু নয়।
মীলাদুন্নবী অস্বিকারকারী কেউ নয় কিন্তু সীরাতুন্নবী অস্বিকারকারীর অভাব নেই!
মীলাদুন্নবী মানে হল, নবীর জন্ম। নবীর জন্ম কেউ অস্বিকার করে না। আরবের মুশরিকরাও নবীর মীলাদকে অস্বিকার করেনি। অস্বিকার করে না কোন কাফির, মুশরিক বা নাস্তিকও। কিন্তু তারা কেউ নবীজী সাঃ এর সীরাতকে মানে না।
তাই মীলাদুন্নবীর মাঝে কোন ফযীলতের বিষয় নেই। ফযীলতের বিষয় হল সীরাতুন্নবী পালনে।
মীলাদুন্নবীতে খুশি সবাইঃ আরবের মুশরিকরাও খুশি ছিল!
রাসূল সাঃ এর জন্মে যেমন পৃথিবীর সকল মুমিন খুশি। খুশি পৃথিবীর সকল সৃষ্টিজীবও। তেমনি খুশি ছিল আবু লাহাবও। খুশি ছিল আবু তালেবও। কিন্তু নবীর জন্মের এ খুুশি তাদের জন্নাতে নিয়ে যেতে পারেনি। যেহেতু তারা নবীজী সাঃ এর সীরাতকে নিজের জীবনে বাস্তবায়ন করেনি।
তাই নবীর জন্মে খুশি হওয়া মানেই জান্নাতে যাবার মাধ্যম মনে করা আহমকী ছাড়া কিছু নয়। যতক্ষণ না নবীজী সাঃ এর সীরাত তথা আনীত জীবন বিধান নিজের জীবনে বাস্তবয়ান করবে, ততক্ষণ পর্যন্ত এ ঈদে মীলাদুন্নবী ব্যর্থতায় পর্যবশিত হবে।
তাই মীলাদ নিয়ে মাতামাতি নয়, নবীজী সাঃ এর সীরাত নিজের জীবনে আঁকড়ে ধরতে হবে।
আমাদের প্রিয় নবীজী সাঃ এর মৃত্যু দিবসে এ কোন ইবলীসী আনন্দে মেতে উঠে কথিত আশেকে রাসূলরা?
অধিকাংশ ঐতিহাসিক এবং সীরাত বিশেষজ্ঞগণ একথার উপর একমত যে, ১২ ই রবিউল আউয়াল তারিখে রাসূল সাঃ এ দুনিয়া থেকে আল্লাহর সান্নিধ্যে চলে যান।
যেসব ঐতিহাসিক এবং সীরাত গবেষকগণ এমত পোষণ করেন, তাদের কয়েকজনের নাম নিচে উদ্ধৃত করা হল-
১- ইবনে সাদ হযরত আয়শা রাঃ এবং হযরত আব্দুল্লাহ বিন মাসউদ রাঃ থেকে নকল করেছেন যে, রাসূল সাঃ ১২ ই রবিউল আউয়াল ইন্তেকাল করেছেন। {তবাক্বাতে ইবনে সাদ-২/২৭২}
২- হাফেজ যাহাবী রহঃ ও তাই বলেন- {তারীখে ইসলাম লিয যাহাবী-৫৬৯।
৩- হাফেজ ইবনে কাসীর রহঃ ও একই কথা নকল করেছেন- {আলবিদায়া ওয়ান নিহায়া-৫/২৫৫।
৪- ঐতিহাসিক ইবনে আসীর রহঃ ও তাই লিখেছেন- {আসাদুল গাবাহ-১/৪১, আলকামেল-৪/২১৯}
৫- ইবনে হাজার আসকালানী রহঃ ও ১২ ই রবিউল আউয়াল ইন্তেকালের কথা বলেছেন। {ফাতহুল বারী-১৬/২৬১}
৬- মুহাদ্দিস ইবনে হিব্বান রহঃ এর মতও তাই। {আসসীরাতুন নাবাবিয়্যাহ লিইবনে হিব্বান-৪০৪}
৭- ইমাম নববী রহঃ একই কথা বলেছেন। {শরহে মুসলিম}
৮- ঐতিহাসি ও মুফাসসির ইবনে জারীর তাবার তাবারী রহঃ ১২ ই রবিউল আউয়াল ওফাতের কথা উল্লেখ করেছেন। {তারীখে তাবারী-৩/২০৭}
৯- ইমাম বায়হাকী রহঃ এরও একই রায়। {দালায়েলুন নবুয়্যাহ-৭/২২৫}
১০- মোল্লা আলী কারী রহঃ ও এই ফায়সালাই দিয়েছেন। {মিরকাত শরহে মিশকাত-১১/১০৪}
১১- সীরাত বিশেষজ্ঞ মাওলানা শিবলী নূমানী ও তাই ফাতাওয়া দিয়েছেন। {সীরাতুন নবী-২/১৮৩}
১২- কাযী সুলাইমান মানসূরপূরী একই কথা বলেছেন। {রাহমাতুল্লিল আলামীন-১/২৫১}
১৩- আররহীকিল মাখতুমের লেখক সফীউর রহমান মুবারকপুরীও তাই বলেন। {আর রহীক-৭৫২}
১৪- মাওলানা আবুল হাসান আলী নদবীও তাই লিখেছেন। {আসসীরাতুন নববিয়্যাহ-৪০৪}
১৫- আহমাদ রেজা খাঁ বেরেলবীও তাই ফায়সালা করেছেন। {মালফুযাতে আহমদ রেজা}
এবার পাঠকদের কাছে আমার জিজ্ঞাসা। পৃথিবীর কোন ধর্মের মূল ব্যক্তির মৃত্যু দিবসে তার প্রকৃত অনুসারীদের কখনো আনন্দ উল্লাস করতে দেখেছেন?
নাকি সেই মহান ব্যক্তিত্বের শত্রুরা আনন্দ উল্লাস করে থাকে?
রাসূল সাঃ এর মৃত্যুর দিনে কোন ব্যক্তি আনন্দ করতে পারে না। আনন্দ করতে পারে কেবল শয়তান। আর তার দোসররা।
রাসূল সাঃ এর মৃত্যুর খবর শুনে সেদিন সাহাবাগণ বাকরুদ্ধ হয়ে গিয়েছিলেন। যে যেই স্থানে ছিল, সেখানেই নিথর হয়েছিল। চোখ দিয়ে বয়েছিল অশ্রুর বন্যা।
আর নিশ্চয় শয়তান হাসছিল। বগল বাজাচ্ছিল। ইহুদী-খৃষ্টান আর মুশরিকরা হাসছিল। মনে মনে আনন্দে নাচছিল।
ঠিক একই কাজটাই কি করা হচ্ছে না রাসূল সাঃ এর মৃত্যু দিবসে?
৯০ ভাগ মুসলমানের রাষ্ট্রে আমাদের মহান নবীর মৃত্যু দিবসে এভাবে জশনে জুলুস বের করে আনন্দ করা, হুল্লোড় করা, মিষ্টি বিতরণ করা, আনন্দ র্যালী বের করা দেখেও রাসূল সাঃ এর সাচ্চা অনুসারীরা কি করে চুপ করে বসে থাকে? আমাদের রাসূল প্রেম গেল কোথায়?
যে ব্যক্তি নিজের মায়ের মৃত্যু দিবসে আনন্দ উল্লাসের আয়োজন করতে পারে না। মন সাড়া দেয় না।
নিজের সন্তানের মৃত্যু দিবসে আনন্দ করতে পারে না।
স্বজনের মৃত্যু দিবসে আনন্দ র্যালি বের করতে পারে না।
সেই ব্যক্তি কি করে আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের শ্রেষ্টতম সৃষ্টি, যাকে সমগ্র জগতের জন্য রহমাত স্বরূপ আল্লাহ তাআলা প্রেরণ করেছেন, যার নাম আমাদের কালিমার অংশ। যার নাম না বলে কবরে মুক্তি নেই, হাশরের ময়দানে যার সুপারিশ ছাড়া উপায় নেই। যার হাতে হাউজে কাউসারের পানি পান করা ছাড়া আমাদের গত্যান্তর নেই।
সেই নবীজী সাঃ এর মৃত্যু দিবসের দিন কতিপয় নবীর দুশমন আনন্দ র্যালি বের করবে, আনন্দ উল্লাস করবে, ঈদের আনন্দ করবে। এটি কি করে একজন নবী প্রেমিক বরদাশত করতে পারে? কি করে মিষ্টি বিতরণ করতে পারে?
সাড়ে চৌদ্দশত বছর আগে ১২ই রবিউল আউয়ালে আমাদের প্রিয় নবীর ইন্তেকালের এ দিনে সাহাবারা ছিলেন অশ্রুসজল। আর ইবলিশ ছিল হাস্যোজ্জল। সাহাবাগণ ছিলেন কান্নারত আর ইবলীশ এবং ইহুদী খৃষ্টানদের ছিল ঈদের দিন।
আজ সাড়ে চৌদ্দশত বছর পর এসে সেই ইবলীশ এবং ইহুদী খৃষ্টানদের ঈদ আমাদের দেশে পালিত হয় মহা আড়ম্বরের সাথে। কতিপয় নবীর দুশমনদের এ দৌরাত্ম কি এতটাই বেশি হয়ে গেছে যে, এমন ভয়াবহ নবী দুশমনদের প্রতিহত করার মত ঈমানী শক্তি কোন নবীর আশেকের নেই?
আমি কার কাছে যাব? কার কাছে মাতম করবো? কার কাছে বিচার জানাবো? এ কেমন জুলুম ভাই? এ কেমন অবিচার ভাই? তুমি তোমার মায়ের মৃত্যু দিবসে ঈদ করতে পারো না। বাবার মৃত্যু দিবসে আনন্দ করতে পারো না। সন্তানের মৃত্যুর দিন মিষ্টি বিতরণ করতে পারো না, তাহলে তোমার পরিবারের চেয়েও কি আমার নবী কম মোহব্বতের হয়ে গেল? কি করে এসব নবীর আশেক দাবী করে রাসূল সাঃ এর মৃত্যু দিবসে আনন্দ উল্লাস আর ঈদ পালন করতে পারে এ নবী বিদ্বেষীরা?
জন্মের খুশিতে ঈদ পালন নয় রোযা রাখাই আমার নবীর শিক্ষা
আবু কাতাদা আনসারী রাযিঃ থেকে বর্ণিত। তিনি বলেনঃ একদা রাসূল সাঃ কে তাঁর সোমবারে রোযা রাখার ব্যাপারে জিজ্ঞেস করা হল, [কারণ রাসূল সাঃ সোমবার দিন রোযা রাখতেন] তখন রাসূল সাঃ [কারণ দর্শাতে গিয়ে] বলেন যে, এদিন আমি জন্ম নিয়েছি, আর এদিনই আমার উপর কুরআন নাজিল হয়েছে। [তাই আমি শুকরিয়ার নিমিত্তে রোযা রাখি]
{সহীহ মুসলিম,হাদীস নং-২৮০৭
সুনানে আবু দাউদ,হাদীস নং-২৪২৮
সুনানে বায়হাকী [কুবরা],হাদীস নং-৮২১৭
সহীহ ইবনে খুজাইমা,হাদীস নং-২১১৭
মুসনাদে আবি আওয়ানা,হাদীস নং-২৯২৬
মুসনাদে আহমাদ,হাদীস নং-২২৫৫০}
আমরা লক্ষ্য করলেই দেখতে পাবো, রাসূল সাঃ আমাদের এই হাদীসে কি চমৎকার একটি শিক্ষা দিলেন। সেটা হল-জন্মের খুশিতে রোযা রেখে আল্লাহর শুকরিয়া জানানো, এই কাজে আনন্দ উল্লাস করা মুসলমানের কাজ নয়।
আর আমরা জানি-ঈদের দিন রোযা রাখা হারাম যা নাকি বহু হাদীসে সরাসরি উল্লেখ আছে। যদি নবীজী সাঃ এর জন্মদিনটা ঈদের দিন হত তাহলে নবীজী সাঃ নিষিদ্ধ রোযা রাখলেন কেন? রাসূল সাঃ এর রোযা রাখার মাধ্যমে এটাই শিখালেন যে, এটা কোন ঈদের দিন নয়। আনন্দ উল্লাসের দিন নয়। বরং শুকরিয়া জানিয়ে রোযা রাখার দিন।
নবীর জন্মদিন পালন হল খৃষ্টানদের কালচার। মুসলমানদের নয়। বরং মুসলমানদের কালচার হল শুকরিয়া হিসেবে রোযা রাখা। তাই আসুন সত্যিকার অর্থে নবীর সুন্নাতের পাবন্দির মাধ্যমে নবীকে ভালবাসি। কথিত “জশনে জুলুশে ঈদে মীলাদুন্নবী” পালন করে ঈমান বিধ্বংসী মারাত্মক বিদআতে শরীক না হই। আল্লাহ তায়ালা আমাদের বুঝার তৌফিক দান করুন। আমীন।
মাশাআল্লহ
জাযাকাল্লাহ খাইর
জাযাকাল্লাহ।
ওয়া ইয়্যাকুম
মিলাদুন্নবীতে কষ্ট পাওয়া নবীর উম্মতের লক্ষণ নয়।
খৃষ্ট্রানদের উৎসব আর মুসলিমদের উৎসবের পার্থক্য বুঝা আপনার মত জ্ঞানীর থাকা উচিত বলে মনে করি।
জাযাকুমুল্লাহ । বাস্তবতা জাতির সামনে তুলে ধরার জন্য অনেক শুকরিয়া
জাযাকাল্লাহ খাইরান