চেয়ারে বসে নামায পড়ার বিধান

মুফতী মুতীউর রাহমান


বর্তমানে প্রায় মসজিদেই অনেক মুসল্লীকে চেয়ারে বসে নামায আদায় করতে দেখা যায়। কিন্তু শরীয়তের বিধান অনুযায়ী চেয়ারে বসে নামায আদায় করাটা সঠিক হচ্ছে কিনা সেটা অনেকেই জানেন না।

এক পরিসংখ্যানে জানা যায়, বর্তমানে যারা চেয়ারে নামায পড়ছেন, তাদের অনেকেরই উজর-সমস্যা এতই সাধারণ যে, এ ধরনের সমস্যার কারণে চেয়ারে বসে নামায আদায় করাটা বৈধ হয় না। ফলে তাদের চেয়ারে বসে পড়া নামায আদায় হচ্ছে না। একটু কষ্ট করে চেয়ার ছাড়াই তারা নামায আদায় করতে পারেন। কিন্তু তারা সেটা না করে একটু আরামের জন্য চেয়ারে বসেই নামায আদায় করে যাচ্ছেন। এতে নামায আদায় করা সত্ত্বেও নামায শুদ্ধ না হওয়ার কারণে তারা গুনাহগার হচ্ছেন।

এজন্য নিজের উজরের অবস্হা প্রকাশ করে এ সংক্রান্ত মাসআলা বিজ্ঞ মুফতীগণের নিকট থেকে জেনে নেয়া একান্ত জরুরী। যাতে ইসলামের গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত নামায সহীহ-শুদ্ধ হয়। বক্ষমান নিবন্ধে সংক্ষেপে বিষয়টি আলোচনা করার প্রয়াস পাব।

কিয়াম তথা দাঁড়ানো নামাযের একটি ফরজ রুকন। পবিত্র কুরআনে মহান আল্লাহ ইরশাদ করেন-

حَافِظُوا عَلَى الصَّلَوَاتِ وَالصَّلَاةِ الْوُسْطَىٰ وَقُومُوا لِلَّهِ قَانِتِين

“তোমরা নামাযের প্রতি যত্নবান হও, বিশেষতঃ মধ্যবর্তী নামাযের প্রতি এবং আল্লাহর উদ্দেশ্যে তোমরা বিনীতভাবে দাঁড়াও।”

(সূরাহ বাকারা, আয়াত নং ২৩৮)

এ আয়াতের ব্যাখ্যায় মুফাসসিরগণ বলেন, এখানে নামাযে দাঁড়ানোর কথা বলা হয়েছে। (বাদায়িউস সানায়ি‘, ১ম খণ্ড, ২৮৭ পৃষ্ঠা)

তাই দাঁড়াতে সক্ষম হলে, ফরজ, ওয়াজিব ও সুন্নাতে মুআক্কাদাহ্‌ নামায দাঁড়িয়েই আদায় করতে হবে। এ সকল নামায বসে আদায় করলে, সহীহ হবে না।

(ফাতাওয়া শামী, ২য় খণ্ড, ৫৬৫ পৃষ্ঠা)

অবশ্য নফল নামায দাঁড়াতে সক্ষম হওয়া সত্ত্বেও বসে আদায় করা জায়িয আছে। তবে তাতে দাঁড়ানোর তুলনায় অর্ধেক সাওয়াব হবে।

(ফাতাওয়া শামী, ২য় খণ্ড, ৫৬৫ পৃষ্ঠা)

বিষয়টি একটি হাদীসে সুস্পষ্ট উল্লেখ রয়েছে। হাদীসটি নিম্নরূপ–

عن عِمرانَ بنِ حُصَينٍ رضيَ اللهُ عنه، قال: سألتُ النبيَّ صلَّى اللهُ عليه وسلَّم عن صلاةِ الرَّجلِ وهو قاعدٌ، فقال: مَنْ صَلَّى قَائِمًا فَهُوَ أَفْضَلُ ، وَمَنْ صَلَّى قَاعِدًا فَلَهُ نِصْفُ أَجْرِ الْقَائِمِ

হযরত ইমরান ইবনে হুসাইন (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ (সা.)কে বসে নামায আদায় করা সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করলাম। তিনি বললেন, “কেউ যদি দাঁড়িয়ে নামায আদায় করে, তাহলে তা তার জন্য উত্তম। আর বসে নামায আদায় করলে সে দাঁড়িয়ে নামায আদায় করার অর্ধেক সাওয়াব পাবে।”

(সহীহ বুখারী, ১ম খণ্ড, ১৫০ পৃষ্ঠা, হাদীস নং ১০৬৪/ সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ৭৩৫/ জামি‘ তিরমিযী, ১ম খণ্ড, ৮৫ পৃষ্ঠা)

এ হাদীসটি নফল নামাযের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। কারণ, দাঁড়াতে সক্ষম হলে, ফরজ, ওয়াজিব ও সুন্নাতের মুআক্কাদাহ নামায বসে আদায় করা জায়িয নয়। তাই ইমাম তিরমিযী (রহ.) জামি‘ তিরমিযীতে হাদীসটি উল্লেখ করার পর লিখেছেন, “কতক আলেম এই হাদীসটির মর্ম সম্পর্কে বলেছেন, এটি নফলের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। তবে হযরত সুফিয়ান সাওরী (রহ.) বলেন, কেউ কোনো অসুস্হতা বা উজরের কারণে বসে নফল নামায আদায় করলে, সে দাঁড়িয়ে নামায আদায়ের সমান সাওয়াবই পাবে। এ সম্পর্কে হাদীসের বর্ণনা রয়েছে।”

(দ্রষ্টব্য : জামি‘ তিরমিযী, ১ম খণ্ড, ৮৫ পৃষ্ঠা)

অবশ্য দাঁড়াতে সক্ষম হওয়া সত্ত্বেও নফল নামায বসে পড়লে, জমিনে বসেই পড়তে হবে। চেয়ারে বসে পড়লে নামায সহীহ হবে না। জমিনে বসে হাঁটু বরাবর মাথা ঝুঁকিয়ে রুকু করতে হবে। সিজদা করতে সক্ষম হলে, জমিনেই সিজদা করতে হবে।

(ফাতাওয়া তাতারখানিয়া, ১ম খণ্ড, ১৭১ পৃষ্ঠা)

যিনি দাঁড়াতে সক্ষম, কিন্তু নিয়মমত রুকু-সিজদা করতে অক্ষম, রুকু-সিজদা করতে মারাত্মক কষ্ট হয় বা রোগ বেড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে অথবা রোগ সারতে বিলম্ব হবে, এ ধরনের লোক দাঁড়িয়ে ইশারায় রুকু-সিজদা করে নামায আদায় করবেন। জমিনে বা চেয়ারে বসে নামায আদায় করলে নামায সহীহ হবে না। কারণ, নামাযে কিয়াম বা দাঁড়ানো একটি ফরজ। অপারগতা ছাড়া তা বাদ দিলে নামায সহীহ হবে না।

(বাদায়ি‘উস সানায়ি‘, ১ম খণ্ড, ১০৭ পৃষ্ঠা/ মাজমা‘উল আনহুর, ১ম খণ্ড, ২২৯ পৃষ্ঠা/ তাবইনুল হাকায়িক, ১ম খণ্ড, ৪৯২ পৃষ্ঠা)

কেউ যদি কোনো কিছুর উপর ভর করে বা হেলান দিয়ে কিংবা টেক লাগিয়ে দাঁড়াতে পারেন, সরাসরি দাঁড়াতে পারেন না, তাহলে তিনি কিছুর উপর ভর করে বা টেক লাগিয়ে দাঁড়িয়ে নামায আদায় করবেন। জমিনে বা চেয়ারে বসে ফরজ ওয়াজিব ও সুন্নাতে মুআক্কাদাহ নামায আদায় করলে সহীহ হবে না।

(ফাতহুল কাদীর, ২খণ্ড, ৩৩ পৃষ্ঠা/ ফাতাওয়া শামী, ২য় খণ্ড, ৫৬৭ পৃষ্ঠা)

যিনি কিছুক্ষণ দাঁড়াতে পারেন, বেশী সময় দাঁড়াতে পারেন না এবং জমিনে বসতে সক্ষম, তিনি দাঁড়িয়ে নামায শুরু করবেন। যতক্ষণ সম্ভব দাঁড়িয়ে নামায আদায় করবেন। যখন কষ্ট হবে, জমিনে বসে বাকি নামায আদায় করবেন। রুকু-সিজদা নিয়মমতো করবেন। এমতাবস্হায় চেয়ারে বসে নামায আদায় করলে নামায সহীহ হবে না। যেমন, একজন মানুষ দীর্ঘ সময় দাঁড়াতে পারেন না, ফজরের নামাযে দীর্ঘ কিরাআত পড়া হয়, তিনি যদি জামা‘আতে ফজরের নামায আদায় করেন, তাহলে দাঁড়িয়ে শুরু করবেন। যতক্ষণ সম্ভব দাঁড়াবেন। যখন কষ্ট হবে, জমিনে বসে পড়বেন। তিনি চেয়ারে বসে নামায আদায় করতে পারবেন না।

(ফাতহুল কাদীর, ২য় খণ্ড, ৩৩ পৃষ্ঠা/ ফাতাওয়া শামী, ২য় খণ্ড, ৫৬৭পৃষ্ঠা)

যারা দাঁড়াতে এবং রুকু-সিজদা করতে অক্ষম, কিন্তু জমিনে যেকোনোভাবে বসতে সক্ষম, তারা তাদের পক্ষে যেভাবে সম্ভব সেভাবে জমিনে বসেই নামায আদায় করবেন। এ অবস্হায় চেয়ারে বসে আদায় করলে নামায সহীহ হবে না। জমিনে বসে তারা ইশারায় রুকু-সিজদা করবেন। হাঁটু বরাবর মাথা ঝুঁকিয়ে ইশারায় রুকু এবং আরেকটু বেশী ঝুঁকিয়ে সিজদা করতে হবে।

(বাদায়ি‘উস সানায়ি‘, ১ম খণ্ড, ২৮৪ পৃষ্ঠা)

এ প্রসঙ্গে পবিত্র কুরআনে ইরশাদ হয়েছে-

الَّذِينَ يَذْكُرُونَ اللَّهَ قِيَامًا وَقُعُودًا وَعَلَىٰ جُنُوبِهِمْ وَيَتَفَكَّرُونَ فِي خَلْقِ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ رَبَّنَا مَا خَلَقْتَ هَٰذَا بَاطِلًا سُبْحَانَكَ فَقِنَا عَذَابَ النَّارِ

“যারা (বুদ্ধিমানরা) দাঁড়িয়ে, বসে এবং শুয়ে আল্লাহর স্মরণ করে, আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবীর সৃষ্টি সম্বন্ধে চিন্তা করে এবং বলে, হে আমাদের প্রতিপালক! আপনি তা অনর্থক সৃষ্টি করেননি। আপনি পবিত্র। আমাদেরকে জাহান্নামের শাস্তি থেকে রক্ষা করুন।”

(সূরাহ আলে ইমরান, আয়াত নং ১৯১)

আল্লামা কুরতুবী (রহ.) বলেন, হযরত হাসান বসরীসহ আরো কয়েকজন মুফাসসির বলেছেন, “আয়াতটি নামায সম্পর্কে। অর্থাৎ (বুদ্ধিমান তারা) যারা নামায নষ্ট করে না। উজর হলে বসে বা শুয়ে হলেও নামায আদায় করে। সুতরাং আয়াত থেকে জানা গেল, নামায দাঁড়িয়ে আদায় করতে হবে। দাঁড়াতে সক্ষম না হলে বসে এবং তাও সম্ভব না হলে শুয়ে নামায আদায় করতে হবে।”

(তাফসীরে কুরতুবী, ৪র্থ খণ্ড, ১৯৮ পৃষ্ঠা)

মাবসূতে সারাখসিতে রয়েছে, অসুস্হ ব্যক্তির নামাযের ব্যাপারে মূলনীতি হচ্ছে এ আয়াত-“যারা দাঁড়িয়ে, বসে এবং শুয়ে আল্লাহর স্মরণ করে।” (সূরাহ আলে ইমরান, আয়াত নং ১৯১)

এ আয়াতের তাফসীর প্রসঙ্গে ইমাম যাহহাক (রহ.) বলেন, “আয়াতটি হচ্ছে অসুস্হ ব্যক্তির সামর্থ অনুযায়ী নামায আদায়ের বিবরণ।”

(মাবসূতে সারাখসি, ১ খণ্ড, ২১২ পৃষ্ঠা)

একটি হাদীসে বিষয়টির সুস্পষ্ট নির্দেশনা পাওয়া যায়। হযরত ইমরান ইবনে হুসাইন (রা.) বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ (সা.)কে অসুস্হ ব্যক্তির নামায সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করলাম। তিনি বললেন,“দাঁড়িয়ে নামায আদায় করবে। তা সম্ভব না হলে বসে আদায় করবে। তাও সম্ভব না হলে শুয়ে নামায আদায় করবে।”

(সহীহ বুখারী, ১ম খণ্ড, ১৫০ পৃষ্ঠা/ জামি‘ তিরমিযী, ১ম খণ্ড, ৮৫ পৃষ্ঠা)

এ হাদীস দ্বারা সুস্পষ্টভাবে বুঝা গেলো, দাঁড়ানো সম্ভব না হলে, তখনই কেবল বসে নামায আদায় করা যাবে। যতক্ষণ পর্যন্ত দাঁড়ানো সম্ভব, ততক্ষণ জমিনে বা চেয়ারে বসে নামায আদায় করলে সহীহ হবে না। আবার যখন যমিনে বসে নামায আদায় করা সম্ভব, তখন শুয়ে বা চেয়ারে বসে নামায আদায় করলে, তা সহীহ হবে না।

যিনি জমিনে স্বাভাবিকভাবে বসতে পারেন না, তবে অন্য কোনভাবে বসতে পারেন, যেমন, কোনকিছুর সাথে টেক লাগিয়ে বসতে পারেন, তিনি সেভাবেই জমিনে বসে নামায আদায় করবেন। তিনি চেয়ারে বসে আদায় করলে, নামায সহীহ হবে না।

(ফাতাওয়া শামী, ২য় খণ্ড, ৫৬৫ পৃষ্ঠা)

হাঁটুতে সমস্যার কারণে অনেকে হাঁটু ভাঁজ করতে পারেন না। এ ধরনের লোকের পক্ষে যদি পশ্চিম দিকে পা ছড়িয়ে জমিনে বসা সম্ভব হয়, তাহলে তারা সেভাবেই জমিনে বসে নামায আদায় করবেন। এমনি করে যে কোনভাবে জমিনে বসে নামায পড়তে সক্ষম হলে, তার জন্য সেভাবেই জমিনে বসে নামায আদায় করতে হবে। এ অবস্হায় তার জন্য চেয়ারে নামায পড়া জায়িয হবে না।

আর যদি কেউ কোনোভাবেই বসতে না পারেন, তাহলে তিনি চিৎ হয়ে শুয়ে নামায আদায় করবেন। তিনি পশ্চিমদিকে পা ছড়িয়ে দিবেন। ইশারায় রুকু-সিজদা করবেন। যদি সম্ভব হয়, তাহলে পশ্চিম দিকে পা না দিয়ে বরং হাঁটু খাড়া রাখবেন এবং মাথার নীচে বালিশ দিয়ে দিবেন, যাতে অন্তত কিছুটা বসার মতো হয় এবং চেহারা আকাশের দিকে না হয়ে কিবলামুখী হয়।

(ফাতাওয়া শামী, ২য় খণ্ড, ৫৬৯ পৃষ্ঠা)

তবে এই শেষাক্ত ক্ষেত্রে অর্থাৎ যদি কোনভাবেই জমিনে বসা সম্ভব না হয় বা কোনোভাবেই তারা জমিনে বসতে না পারেন, তাহলে তখন শুয়ে নামায পড়ার পরিবর্তে চেয়ারে বসে নামায আদায় করতে পারবেন। তখন চেয়ারে বসে ইশারায় রুকু-সিজদা করে নামায আদায় করবেন। সিজদার জন্য রুকুর তুলনায় অধিক মাথা ঝুঁকাতে হবে।

কিন্তু আমাদের দেশে যে সামান্য উজরেই অনেকে চেয়ারে বসে নামায পড়ছেন, তা সহীহ হচ্ছে না। বিশেষ করে তাদের দ্বারা মসজিদে ব্যাপকহারে চেয়ার ব্যবহারের দ্বারা নানারূপ অসুবিধার সৃষ্টি হচ্ছে। তাই ক্ষেত্রে সকলের সচেতন হওয়া কর্তব্য।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *