মুক্তিযোদ্ধার দৌহিত্র

আমিন মুনশি


বসন্তের শেষ বিকেলে নদীর পাড়ে বসে মানিক তার ফেলে আসা সোনালি দিনগুলোর কথা ভাবছে। অতীতকে রোমন্থন করতে খুব ভালোবাসে মানিক। অতীত নিয়ে ভাবতে এবং সে অনুযায়ী কর্মপন্থা নির্ধারণ করতে বেশ পারদর্শী সে। মানিকের বয়স বিশের কাছাকাছি। হালকা-পাতলা সুডৌল। শ্যাম বর্ণের চেহারা। উদাস নেত্রে মানিক তাকিয়ে আছে নদীর জলতরঙ্গের দিকে। প্লাবনের সময় উত্তাল নদী যেমন তট ভেঙ্গে নিয়ে যায় ঠিক তেমনি মানিকদের সংসারেও কালবৈশাখী ঝড় এসে সবকিছু লন্ডভন্ড করে দিয়েছে!

মানিকদের বাড়ি পদ্মার কূল থেকে খুব বেশি দূরে নয়। মানিক এখন তার স্মৃতির পাতা উল্টাচ্ছে আর আঁখিযুগল দিয়ে তপ্ত বারি ফেলছে। তার দাদা মৌলানা বশির আহমদ ছিলেন মুক্তিযুদ্ধের সেক্টর কমান্ডার। সময়টা ১৯৭১সাল। অত্যাচারী পাকিস্তানিরা তখন এদেশে ধ্বংস- লুটপাট করছিল। মৌলানা বশির তখন দেওবন্দ থেকে সবে মাওলানা পাশ করে দেশে ফিরেছেন। একেবারে টগবগে যুবক। তারুণ্যদীপ্ত চোখ। পাকিস্তানিদের নৃশংস গণহত্যা-ধর্ষন দেখে তিনি তখন আর বসে থাকতে পারেননি। যোগ দিলেন মুক্তিবাহিনীতে। ঘর থেকে বের হওয়ার সময় তার মা তাকে বলেছিল- “জীবন বাজি রেখে বৈষম্য সৃষ্টিকারী জালেম পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করবি।” মায়ের সেই প্রেরণার বাণীতে দীপ্ত শপথ নিয়েছিল মৌলানা বশির। তার আপন খালাতো ভাই ফিরোজ চৌধুরী কলেজ পাশ করেই হানাদারদের পক্ষে আত্মসমর্থন দিয়েছে। এতে সমাজের সবাই ফিরোজের উপর দারুণ ক্ষীপ্ত। তার এমন কৃতকর্মে প্রতিবেশিরাও তাকে ঘৃনার চোখে দেখে। ‘রাজাকার ফিরোজ’ বলে তার নাম নেয় সবাই। কিন্তু মৌলানা বশিরকে সবাই প্রীতি করে, কাছে টেনে নেয়। তার নম্র-অমায়িক আচরণে সবাই মুগ্ধ। তাই মুক্তিযুদ্ধের ট্রেনিং নেয়ার পর এলাকাবাসী জোর করেই তাকে স্থানীয় মুক্তিবাহিনীর দলনেতা বানিয়েছে…

মৌলানা বশির দিনদিন সাহসী হয়ে উঠতে লাগলেন। চোখের সামনে পাকিস্তানিদের বর্বরতা-হিংস্রতা দেখে তার কোমল মনটি হঠাত করেই ইস্পাতসম দৃঢ় হয়ে যায়। দেশমাতৃকার জন্য তার মন ছটফট করতে থাকলো সারাক্ষণ। তবু তিনি বিচলিত না হয়ে বরং দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে তার দলকে সুসংহত করে বলিষ্ট নেতৃত্ব দেন। হানাদার বাহিনীর অনেকগুলো গুরুত্বপূর্ণ ঘাঁটি নিজ তত্ত্বাবধানে গেরিলা হামলার মাধ্যমে ধ্বংস করে দেন। এদিকে ফিরোজ তার খালাতো ভাই মৌলানা বশিরের কর্মকান্ড এবং জনপ্রিয়তা দেখে হিংসায় জ্বলে উঠে। ষড়যন্ত্রের উন্মত্ত খেলা উন্মোচনের লক্ষ্যে দাড়ি-টুপি লাগিয়ে মুক্তিবাহিনীতে ঢুকে পড়ে ফিরোজ। মুক্তিবাহিনীর বিভিন্ন কলাকৌশল গোপনে সে পাকিস্তানি মিলিটারিদের কাছে সরবরাহ করতে থাকে। ফলে মুক্তিযোদ্ধাদের অপূরনীয় ক্ষতিসাধন হয়। বারবার তাদের অপারেশন ব্যর্থ হয়ে যায়। মৌলানা বশির তার ভাইয়ের চক্রান্ত বুঝতে না পেরে তাকে দলে স্থান দিয়েছিল। ভেবেছিল সে হয়তো নিজেকে শুধরে নিয়েছে। কিন্তু পরে যখন তার কূটকৌশল বুঝতে পারলো তখন অনেক সময় পার হয়ে যায়। ততোদিনে ফিরোজ চৌধুরী হয়ে উঠে পাকিস্তানি পিশাচদের প্রিয়পাত্র। দখলদার পাকিস্তানিদের সহযোগিতায় একদিন সে মৌলানা বশিরকে অজ্ঞাত স্থানে নিয়ে অকথ্য নির্যাতন করে প্রায় মৃতাবস্থায় ফেলে আসে। হত্যাযজ্ঞের মাধ্যমে তাদের গ্রামকে পরিণত করে মৃত্যুপুরীতে। মৌলানা বশিরের অনুচরদের মধ্যে যারা বেঁচে গিয়েছিল তারাও তখন বসে থাকেনি। প্রাণপণ লড়াই করে শত্রুমুক্ত করেছিল তাদের এলাকা…

একসময় স্বাধীন হয় এই ভূখন্ড। বিশ্ব মানচিত্রে আলো ছড়ায় লাল-সবুজের বাংলাদেশ। মুক্তিযোদ্ধাদের নামপরিচয় জমা পড়তে থাকে রাষ্ট্রীয় রেজিস্ট্রি খাতায়। সত্যমিথ্যা যাচাইয়ের পর্যাপ্ত সুযোগ না থাকায় দেশদ্রোহীদের অনেকেই মুক্তিযোদ্ধার সার্টিফিকেট নিয়ে পার পেয়ে যায় আসামির তালিকা থেকে। আবার অনেক প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধার নামও বাদ থেকে যায়। এই যেমন, রাজাকার ফিরোজ। সে এখন স্বাধীন বাংলাদেশের একজন বিশিষ্ট সমাজসেবক। আগামি নির্বাচনে তার এমপি হওয়ার সম্ভাবনা প্রবল। পক্ষান্তরে অলৌকিকভাবে বেঁচে যাওয়া মৌলানা বশির আহমদ খেতাব পেয়েছেন যুদ্ধাপরাধীর। তথাকথিত বুদ্ধিজীবিরা তাদের লেখায়-কথায় এসব খেতাব দিয়ে বেড়ায়। হুজুর দেখলেই যাদের মাথায় শয়তান পেশাব করে। এরাই আবার ধর্মনিরপেক্ষতার বুলি আওড়ায় মিডিয়ায়-টকশোতে!

রাজপথে সেদিন ভাগ্যচক্রে ফিরোজ চৌধুরীর পতাকাশোভিত গাড়ীর পাশ দিয়ে যাচ্ছিলেন মৌলানা বশির। ফুটপাত ঘেঁষে বশিরকে চলতে দেখে পিলে চমকে উঠে ফিরোজ। গাড়ি থামিয়ে সে ভালোভাবে পরখ করতে থাকে বশিরকে। পাঁচকুল্লি টুপি, জুব্বা পরিহিত তার খালাতো ভাই মৌলানা বশির খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হেঁটে যাচ্ছে। অদূরে জামিয়া ইসলামিয়া নামে বিশাল মাদরাসা দেখে ফিরোজের অনুমান করতে ভুল হলোনা যে, বশির ঐ মাদরাসায় অধ্যাপনা করে। সমাজসেবক ফিরোজের চেহারা তখন হঠাতই বিবর্ণ রূপ ধারণ করে। অস্তিত্ব রক্ষায় ব্যাকুল হয়ে উঠে তার ক্ষমতালোভী মন। খুনের নেশায় মরিয়া হয়ে উঠে তার পশুপ্রবৃত্তি। বশিরকে সে কোনভাবেই বাঁচতে দিবেনা। সামান্য একটা মোল্লার কারণে যদি শেষে নিজের ক্যারিয়ারটা নষ্ট হয়ে যায়! এসব সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতে সে রাতে আর ঘুম হলোনা ফিরোজের।

পরদিন ভোরের আলো ফোটার আগেই সে চলে আসে জামিয়ার বিশাল ফটকের সামনে। মৌলানা বশির যখন ফজরের নামাজ পড়িয়ে প্রাতঃভ্রমণে বের হচ্ছিলেন ঠিক তখনই তার সামনে পড়লো ফিরোজের অভিশপ্ত চেহারা। ফিরোজকে দেখতেই তিনি ‘রাজাকার”রাজাকার’ বলে চিৎকার দিয়ে জাপটে ধরলেন তাকে। দৈনিক সত্যবাণীর চিফ-রিপোর্টার তারেক হাসান তখন যাচ্ছিলেন সেই রাস্তা দিয়ে। মোটরবাইক থেকে তিনি তার মাদরাসাশিক্ষক বশির আহমদের আর্তনাদ শুনে থমকে দাঁড়ালেন। জিজ্ঞেস করতেই মৌলানা বশির বললেন, এইতো সেই রাজাকার যার কথা ক্লাসে তোমাদের শুনাতাম। আকস্মিক এই ঘটনায় কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে যায় সাংবাদিক তারেক হাসান। তড়িঘড়ি করে যেই তিনি ক্যামেরা সেদিকে তাক করে ক্লিক করলেন ঠিক তখনই ফিরোজের রিভলবার থেকে গুলি বের হয়ে বিদ্ধ হয় মৌলানা বশিরের হৃদপিন্ডে। আশেপাশের মুসুল্লিরা ফিরোজের দিকে তেড়ে আসতেই তার সাঙ্গপাঙ্গরা তাকে উঠিয়ে নিরাপদে সরে যায়। আর মৌলানা বশিরের নিথর-নিস্তব্ধ দেহ পড়ে থাকে মসজিদের সামনে। অতঃপর তাকে নিয়ে যাওয়া হয় তার গ্রামের বাড়িতে…

মৌলানা বশিরের প্রিয় দৌহিত্র এই মানিক। গতকাল সে নিজহাতে তার দাদাকে কবরস্থ করার পর থেকেই মন খারাপ মানিকের। দাদাকে হারানোর ব্যথা আর অসংখ্য স্মৃতি তাকে গ্রাস করে রেখেছে। দাদার মুখনিঃসৃত মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত কাহিনী এবং প্রত্যয়ের বাণী আর শুনতে পাবেনা সে। এরকম হাজারো ভাবনা ভাবতে ভাবতে অশ্রুতে তার কপোল-বুক ভেসে গেছে। এদিকে তাদের বাড়িতে নেমেছে শোকের ছায়া। বিভিন্ন মিডিয়াকর্মীরা ভিড় করছে তাদের বাড়িতে।
সমাজের মানুষের কাছে মৌলানা বশির সমাদৃত হলেও জাতীয় মিডিয়াগুলোতে সমাদৃত হতে পারেননি। ‘মাদরাসার হুজুর খুন’ ‘রাজধানীতে এক মৌলবাদীর মৃত্যু’- এ জাতীয় সংবাদ ছেপেছে সবাই। ব্যতিক্রম শুধু দৈনিক সত্যবাণীর অনুসন্ধানী রিপোর্ট। তারা শিরোনাম করেছে- ‘সমাজসেবীর গুলিতে নিহত এক আলেম মুক্তিযোদ্ধা’। রীতিমত দীর্ঘ কলাম ছেপে চাঞ্চল্য সৃষ্টি করেছে দেশব্যাপী। চোখ ছানাবড়া করে দিয়েছে অন্যান্য গণমাধ্যমের। তাই তারা সত্যানুসন্ধান করতে এসেছে মানিকদের গ্রামে।

শেষদৃশ্য-
অনেকক্ষণ পর মানিককে দেখা গেল নদীর পাড় থেকে চোখ মুছতে মুছতে বাড়ি ফিরছে। মানিককে দেখেই সংবাদকর্মীরা তার কাছে জটলা করলো। বিভিন্ন প্রশ্নের সদুত্তর নিয়ে তারা বেরিয়ে গেল বাড়ি থেকে। মানিকের মা সাংবাদিকদের কাছে সব কথা বলতে নিষেধ করলেও মানিক তা শুনেনি। সত্যকথা অকপটে বলার সৎসাহস দেখাতে গিয়ে বিণিময়ে তার বাবাকে গুম হতে হয়েছে। মানিক সে নির্ভীক পিতার আদর্শে আদর্শবান। হয়তো এ জন্য তাকেও ভোগ করতে হবে নানান নির্যাতন। তবুও সে হিম্মতহারা নয়। কারণ, সে কুরআনের হাফেজ। কিছুদিন পরেই হয়ে যাবে আলেম। তাই মিথ্যার সামনে মাথা নোয়ানো তার শোভা পায়না…

পরদিন সকালে মানিককে মাদরাসায় রওয়ানা হতে দেখা গেছে। ভবিষ্যত তার কোনদিকে গড়াবে- সেটি আমরা জানিনা। তবে একজন আলেম মুক্তিযোদ্ধার দৌহিত্র কখনোই স্বদেশের জন্য হুমকি হতে পারেনা- এমনটাই সবার বিশ্বাস।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *