পর্দা নর-নারীর দুনিয়া আখিরাতে সম্মানের প্রতীক

মেহেদী হাসান সাকিফ

সাবিহা ও মালিহা দুইজন আপন চাচাতো বোন। সাবিহার বাবা তাদের এলাকার মসজিদের ইমাম ও খতিব। সাবিহার প্রাথমিক শিক্ষার হাতেখড়ি গ্রামের ইবতেদায়ী মাদ্রাসায়। গ্রামের মাদ্রাসা থেকেই গোল্ডেন জিপিএ নিয়ে দাখিল, আলিম পাশ করে।

অন্যদিকে তার চাচাতো বোন মালিহার বাবা একজন ব্যবসায়ী। তার আরো বড় দুই ভাই দেশের স্বনামধন্য বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত। তাই, মালিহারও লক্ষ্য তার দুই ভাইয়ের মতো বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়া। সাবিহা মালিহার সমবয়সী হওয়ায় পড়াশুনাসহ সাবিহার দিনের একটা বড় অংশ কাটত মালিহার সাথে। আলিম পাশের পর সাবিহারও মালিহার মতো বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার স্বপ্ন জাগে। প্রথমে পরিবার থেকে রাজি না হলেও বিশ্ববিদ্যালয়ের যাবতীয় কার্যাদিতে পরিপূর্ণ পর্দা মেনে চলার আশ্বাসে সম্মতি দেওয়া হয়। ছোটবেলা থেকে মেধাবী হওয়ায় সাবিহা ও মালিহা দুজনই বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স পায়। গ্রাম থেকে এসে তারা সরাসরি আবাসিক হলে ওঠে।

আরও পড়ুন

    • ——————————————————-

একেবারে ক্লাস সিক্স থেকেই যেকোন প্রয়োজনে বাইরে বের হলেও মুখে নিকাব হাতে মোজা ছাড়া কখনই বাইরে বের হতো না। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম দিকেও এই ধারাবাহিকতা বজায় ছিলো। প্রথম দিকে সাবিহা যখন হাতে মোজা আর মুখে নেকাব পড়ে ক্লাসে যেতো তার অধিকাংশ মেয়ে সহপাঠীদের গায়ে শোভা পেত আঁটসাঁট পোশাক। ইসলামের পর্দার ন্যূনতম ফরজ বিধানের ধার ধারত না তারা। আলিম পড়াকালীন ফেসবুক আইডি থাকলেও কখনো কোন ছেলেদের ফ্রেন্ডরিকোয়েস্ট গ্রহণ করতো না সে।

আমাদের দেশের সব বিশ্ববিদ্যালয়গুলোই সহশিক্ষা অধ্যুষিত বিষয়টি অজানা নয় কারো। সাবিহার বিশ্ববিদ্যালয় ও এর ব্যতিক্রম নয়। প্রথমদিকে কোন ছেলের সাথে প্রয়োজন ছাড়া কথা বলাটাও ভীষণ পাপ মনে করতো। সহশিক্ষার এই কুপ্রভাবে মাত্র কয়েকমাস না যেতেই কয়েকজন ছেলের সাথে বন্ধুত্ব হয়ে যায়। এর মধ্যে একজন ছিল রনি হাসান। ক্লাসের তুখোড় মেধাবী ছাত্র। পড়াশুনোর সূত্র ধরে পরিচয় হলেও একসময় রনির সাথে তার প্রেমের সম্পর্ক গড়ে উঠে।

যেই সাবিহা একসময় হাতে মোজা ছাড়া বাইরে বের হতো না। সে এখন মাথায় নামেমাত্র স্কার্ফ পরে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে ছেলে বন্ধুদের সাথে আড্ডা দেয়। বয়ফ্রেন্ডের সাথে ঘুরে বেড়ায়। শুধু ঘুরাঘুরিতেই সীমাবদ্ধ নয়, রনির সাথে তার সম্পর্ক শারীরিক সম্পর্ক অবধি গড়ায়। তার প্রেগন্যান্ট হওয়ার খবরটি রনিকে জানানো হলে কোন কারণ ছাড়াই রনি যোগাযোগ বন্ধ করে দেয়। তাদের দীর্ঘ পাঁচ বছরের সম্পর্কটা ভেঙ্গে যায়। রনি বিষয়টা খুব সহজে মেনে নিলেও সাবিহা মানতে পারে না। এই ক্ষোভ হতাশায় একদিন
সে আত্মহত্যা করে।

এই ঘটনা থেকে খুব সহজেই আমরা পর্দার বিধান লঙ্ঘন করার দুনিয়াবি পরিণতি কতটা ভয়াবহ হতে পারি তা বুঝতে পারি।

ইসলাম মানবজাতির কল্যাণকামী এক শাশ্বত জীবনব্যবস্থা। আল্লাহতালা মানবজাতির কল্যাণের জন্য বহুবিধ বিধান দান করেছেন।
মানুষ যখন আল্লাহতায়ালার দেওয়া বিধান মেনে চলে, তখন সে তার প্রভুর নৈকট্য অর্জন তো করেই, সেই সঙ্গে লাভ করে পার্থিব নানাবিধ কল্যাণ। আল্লাহতায়ালা মানুষের জন্য তাই নির্ধারণ করেন যা তার জন্য কল্যাণকর। সেটা সে বুঝবার মতো জ্ঞান রাখুক বা না রাখুক।

নামাজ, রোজা, হজ যাকাত যেমন ইসলামের একটা ফরজ বিধান। ঠিক তেমনিভাবে পর্দাও তেমন ফরজ একটি বিধান।
পর্দা শব্দের আরবি প্রতিশব্দ হচ্ছে ‘হিজাব’। এর শাব্দিক অর্থ প্রতিহত করা, বাধা দান করা, গোপন করা, আড়াল করা, ঢেকে রাখা ইত্যাদি। ইসলামের পরিভাষায় প্রাপ্তবয়স্ক মেয়েদের আপাদমস্তক গায়ের মাহরাম পুরুষ থেকে ঢেকে রাখাকে ‘হিজাব’ বা পর্দা বলে।

ইসলামী শরিয়তে নারী-পুরুষ উভয়ের জন্যই পর্দা ফরজ করা হয়েছে। পর্দাব্যবস্থা আল্লাহর এমন এক উত্তম বিধান, যা নারী পুরুষ উভয়কেই পাশবিক উচ্ছৃঙ্খলতা থেকে হিফাজত করে এবং মানবিক মর্যাদার উচ্চাসনে অধিষ্ঠিত করে। পবিত্র কুরআনের অনেক গুলো আয়াতে পর্দার বিধানের কথা আলোচনা করা হয়েছে।

কোন মুমিন নর-নারীর ক্ষেত্রেই পর্দার বিধানকে খাটো করে দেখার সুযোগ নেই। ইসলাম নারী এবং পুরুষের জন্য আলাদা আলাদা পোশাকের বিধান দিয়েছে। দিয়েছে পর্দার হুকুম। আমাদের চারপাশে অসংখ্য মানুষ আছে, যারা পর্দা সম্পর্কে স্বচ্ছ ধারণা রাখে না। পুরুষরা মনে করে পর্দা শুধু নারীর জন্য, আর নারীরা মনে করে পর্দা তাকে পিছিয়ে দিচ্ছে অথবা পর্দা করার যৌক্তিকতা তারা খুঁজে পায় না। অথচ পর্দা নারী পুরুষ উভয়ের জন্য অবশ্য পালনীয় একটি বিধান। যেমনটি আল্লাহতায়ালা পবিত্র কোরআনের সূরা নুরে ইরশাদ করেছেন,

“মুমিনদেরকে বলুন, তারা যেন তাদের দৃষ্টি নত রাখে এবং তাদের যৌনাঙ্গের হেফাজত করে। এতে তাদের জন্য খুব পবিত্রতা রয়েছে। নিশ্চয়ই তারা যা করে, আল্লাহ তা অবহিত আছেন। আর ঈমানদার নারীদেরকে বলুন, তারা যেন তাদের দৃষ্টিকে নত রাখে এবং তাদের যৌনাঙ্গের হেফাজত করে। তারা যেন যা সাধারণত প্রকাশমান- তাছাড়া তাদের সৌন্দর্য প্রদর্শন না করে এবং তারা যেন তাদের ওড়না বক্ষদেশে দিয়ে রাখে এবং তারা যেন তাদের স্বামী, পিতা, শ্বশুর, পুত্র, স্বামীর পুত্র, ভ্রাতা, ভ্রাতুষ্পুত্র, ভগ্নিপুত্র, স্ত্রীলোক, অধিকারভুক্তবাদী, যৌনকামনামুক্ত পুরুষ ও বালক- যারা নারীদের গোপন অঙ্গ সম্পর্কে অজ্ঞ তাদের ব্যতীত কারও কাছে তাদের সৌন্দর্য প্রকাশ না করে। তারা যেন তাদের গোপন সাজ-সজ্জা প্রকাশ করার জন্য জোরে পদচারণা না করে।” –(সূরা নুর: ৩০-৩১)

এ আয়াতের শুরুতে মুমিন পুরুষদের উদ্দেশ্যে বলা হয়েছে, তারা যেন তাদের দৃষ্টি নত রাখে। জারির ইবনে আবদিল্লাহ বাজালি (রা.) থেকে বর্ণিত- তিনি বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ (সা.)-কে কোনো নারীর প্রতি হঠাৎ দৃষ্টি পড়ে যাওয়ার ব্যাপারে জিজ্ঞেস করলে তিনি বলেন, সাথে সাথেই দৃষ্টি সরিয়ে নেবে (সহিহ মুসলিম)।

বুরাইদা (রা.) থেকে বর্ণিত- তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) আলী (রা.)-কে বললেন, হে আলী! দৃষ্টির ওপর দৃষ্টি ফেলো না। হঠাৎ যে দৃষ্টি পড়ে ওটা তোমার ক্ষমার্হ; কিন্তু পরবর্তী দৃষ্টি তোমার জন্য ক্ষমাহীন পাপ (হাদিসটি বর্ণনা করেছেন ইমাম আবু দাউদ (রহ.)।

বিশ্বনবী রাসূলে আকরাম (সা.) বলেন- তোমরা (মুমিনরা) নবীপত্নীদের কাছে কিছু চাইলে পর্দার আড়াল থেকে চাইবে। এটা পর্দার (পর্দার বিধান) তোমাদের এবং তাদের অন্তরসমূহের জন্য পবিত্র থাকার উত্তম পন্থা (সূরা আহজাব: ৫৩)।

রাসূল (সা.) আরো বলেন, সাবধান! কোনো (পর) পুরুষ যেন কোনো (পর) নারীর সাথে নির্জনে অবস্থান না করে। কেননা যখনই তারা (নিরিবিলিতে) মিলিত হয়, শয়তান তাদের তৃতীয়জন হয় এবং (উভয়কে) কুকর্মে লিপ্ত করানোর প্রচেষ্টায় সে তাদের পিছু লেগে যায় ( তিরমিযী শরিফ)।

ইচ্ছাকৃত দৃষ্টিপাত কিংবা তাকানোই হচ্ছে- যৌন প্রবৃত্তির প্রারম্ভিক কারণ, যার শেষ পরিণতি নানা রকম পাপ ও ফেতনাসহ ব্যভিচার পর্যন্ত গড়ায়।
একই সূরার ২৭ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে, অনুমতি ব্যতীত কারও ঘরে প্রবেশ যেন না করা হয় (যদিও তা প্রয়োজনে হোক)।
হাদিসে প্রয়োজনে পর্দার আড়ালে থেকে কোনো জিনিষ আদান-প্রদান, শিক্ষা গ্রহণের মতো কাজগুলো করার উপদেশ দেওয়া হয়েছে। তেমনিভাবে সূরা নুর, সূরা আহজাবে পূর্ণভাবে বলা হয়েছে নারীদের পর্দা সম্পর্কে। হাদিসে যা আরও ব্যাখ্যা করা হয়েছে।
পারিবারিক ব্যবস্থাই হচ্ছে সুখ-সমৃদ্ধশালী রাষ্ট্র গঠনের আগাম শর্ত। কেননা পরিবার ব্যবস্থাপনাই হচ্ছে মূল বুনিয়াদ। যে সমাজ বা রাষ্ট্র ইসলামের পর্দার বিধানকে দূরে ঠেলে দিয়েছে সুখ-সমৃদ্ধ সমাজ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার প্রয়াস ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়েছে।

মোটকথা, ইসলামের পর্দা বিধান শুধু নারীর জন্য নয়, নারী-পুরুষ উভয়ের জন্য। তেমনি পর্দা-বিধান শুধু ব্যক্তিজীবনের বিষয় নয়। পারিবারিক, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় জীবনেরও বিষয়।

ইসলামের পর্দা-ব্যবস্থা যদি পূর্ণাঙ্গরূপে বাস্তবায়িত হয় তাহলে মুসলিম নর-নারীর ব্যক্তি জীবনের সাথে সাথে পারিবারিক, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় জীবনও সুস্থ ও পবিত্র হবে। পক্ষান্তরে পর্দা-বিধান কার্যকর না থাকলে যেখানে তা অনুপস্থিত সেখানেই পঙ্কিলতা ও অস্থিরতার অনুপ্রবেশ ঘটবে।

আজ সকল মুসলিমের ঈমানী কর্তব্য, পর্দার বিধানের দিকে ফিরে আসা। ব্যক্তি ও পরিবার এবং সমাজ ও রাষ্ট্রের শান্তি-শৃঙ্খলা এবং স্বস্তি ও পবিত্রতা রক্ষার এ ছাড়া দুসরা কোনো পথ নেই।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *