মাওলানা মুহাম্মাদ ওমর পালনপুরী (রাহ.)
দ্বীন-ইসলামের হেফাযত ও মুসলিম মিল্লাতের সুরক্ষার জন্য কুরবানী ও আত্মত্যাগের বিকল্প নেই। যুগে যুগে বহু গুণীজন এ কুরবানীর নাযরানা পেশ করে গেছেন।
যারা কুরবানী করেছেন তাঁরা সফল হয়েছেন। এমনই একজনের ঘটনাঃ
আমেরিকার কোনো এক মহকুমার সেক্রেটারী ছিলেন এক নারী। ধর্মে খ্রিস্টান। হঠাৎ কী মনে করে তিনি বিভিন্ন ধর্মের বই-পুস্তক নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি শুরু করলেন।
একপর্যায়ে ইসলামকেই তার কাছে সত্য মনে হল। সত্য যখন উদ্ভাসিত হয়েছে- ব্যস, কালিমা পড়ে মুসলমান হয়ে গেলেন।
ইসলাম সম্পর্কে বিস্তারিত জানার জন্য ছুটে গেলেন মুসলমানদের কাছে। মুসলমানগণ যদ্দুর বলার বললেন। সাথে সাথে এ-ও বলে দিলেন যে, ইসলাম নারীকে পর্দার কথা বলে। সে রাতেই তিনি বোরকার ব্যবস্থা করলেন।
পরদিন সকালে অফিসে গেলেন পর্দা করে- বোরকা-আবৃত হয়ে। অফিসে প্রবেশ করতেই সবাই হকচকিয়ে গেল। কালো কাপড়ে ঢাকা এ আবার কে?
জিজ্ঞাসা করল, কে তুমি?
আমি অমুক; মুসলমান হয়েছি।
মুসলিম নারীগণ কালো কাপড়ে ঢাকা থাকে নাকি?! :
হ্যাঁ, বোরকা পরেই থাকা উচিত।
আমেরিকায় তো অনেক মুসলিম নারী রয়েছে। কই তারা তো খ্রিস্টান নারীদের মতই পর্দা ছাড়া থাকে! ইসলামে পর্দার বিধান থাকলে তারাও তো পর্দা করত।
কেউ যদি মুসলমান হয়েও তার নবীর কথা না মানে, তাহলে আমার কী করার আছে? আমি তো ব্যস, যে নবীকে মেনে নিয়েছি তাঁর কথা মতই চলব।
এ অবস্থায় তো আমরা তোমাকে অফিস করতে দিতে পারি না।
কুছ পরোয়া নেহি। রুজির ব্যবস্থা তোমরা কর না; আল্লাহই করেন। মানুষ যখন সঠিক পথে চলতে চায়, তখন আল্লাহ তাআলা তার সামনে রাস্তা খুলে দেন।
শরীয়ত মোতাবেক হালালের গণ্ডিতে থেকে কেউ যদি পথ চলতে শুরু করে, তাহলে আল্লাহ পাকের দরবারে আশা, অন্য সকল পথের যাত্রী অপেক্ষা সে শ্রেষ্ঠ বিবেচিত হবে।
আল্লাহ তাআলার ওয়াদা- هُوَ الّذِیْۤ اَرْسَلَ رَسُوْلَهٗ بِالْهُدٰی وَ دِیْنِ الْحَقِّ لِیُظْهِرَهٗ عَلَی الدِّیْنِ كُلِّهٖ وَ لَوْ كَرِهَ الْمُشْرِكُوْنَ. তিনি সেই সত্তা, যিনি স্বীয় রাসূলকে প্রেরণ করেছেন হেদায়েত ও সত্য ধর্ম দিয়ে, যাতে একে তিনি সকল ধর্মের উপর বিজয়ী করেন। যদিও মুশরিক সম্প্রদায় তা অপছন্দ করে। -সূরা ছফ (৬১) : ৯
তাই সহীহ তরিকা অবলম্বনকারী ব্যক্তি ভুল পথের অনুসারী অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ হয়েই থাকে।
যাইহোক, আমেরিকাপ্রবাসী জার্মান নাগরিক এ নারী উচ্চ সম্মানের পদ ও পদবী ছেড়ে ভিন্ন কর্ম গ্রহণ করলেন।
পেটের দায়ে এখন তিনি মানুষের ঘর-বাড়িতে আয়া-বুয়ার কাজ করতে লাগলেন। এতে যা জোটে তাতেই দিনগুজরান করতে থাকলেন।
আল্লাহর কী হুকুম! একদিন তিনি বাইতুল্লাহ যিয়ারতের উদ্দেশ্যে হজ্বের সফরে রওনা হয়ে গেলেন। সেখানে আমাদের পরিচিত ইংরেজী শিক্ষিত এক ভাই তার মেযবান হলেন।
তারা যথাসাধ্য তার একরাম করলেন। আদর-যত্নের সাথে মেহমানদারি করলেন। আল্লাহর ঘরের সামনে বসে তিনি খুব দুআ করতেন। জারজার হয়ে কাঁদতেন- হে আল্লাহ! আমি তোমার মেহমান! আমার কী যোগ্যতা অছে- তোমার ঘরের মেহমান হব? আর সামর্থ্য বলতে তো আমার কিছুই নেই। কেবল তুমিই দয়া ও অনুগ্রহ করে তোমার দরবারে এনেছো। ফলে খ্রিস্টানের ঘরে জন্ম নিয়েও আমি আজ বাইতুল্লাহর ছায়ায়। এ সবই তোমার করুণা হে আল্লাহ!
মদীনা মুনাওয়ারায় রওজায়ে আতহারে দাঁড়িয়ে দুরূদ ও সালাম পেশ করে কেঁদে কেঁদে বললেন- ইয়া রাসূলাল্লাহ! আমি আপনার এক নগণ্য উম্মত। উম্মতের জন্য আপনার দিলে যে দরদ ও ব্যথা ছিল আল্লাহ যেন আমাকেও তা দান করেন।
তারপর তিনি আমাদের এ ভারত উপমহাদেশে আগমন করেন। এখানকার মুসলিম সমাজের সাথে মেশেন ও ইসলামী কৃষ্টি-কালচার শেখেন।
এখান থেকেই কুরআন শেখা শুরু করেন। পরে পাকিস্তান গিয়ে নামায-তিলাওয়াত পুরোপুরি শিখে নেন। সেখানকার মুসলিমগণ তাকে বলেন- বোন, তুমি আমাদের এখানেই থেকে যাও। এখানে তোমার একটা বিবাহের বন্দোবস্ত করে দেই।
তিনি বললেন, এখানে তো কুরআন শেখানোর মত, দ্বীন শেখানোর মত অনেক বোনই রয়েছেন। কিন্তু আমেরিকায় আল্লাহর দ্বীনের যে কী এতিমী হালত! সেখানে কুরআন শেখানোর মত কাউকে পাওয়া বেজায় ভার। আর নারীদের মাঝে কুরআনের খেদমত! তা তো বহু দূরের কথা! এজন্য আমাকে আমেরিকায়ই যেতে হবে। সেখানে কুরআনের খেদমত করতে হবে। আমি চাই, সারাজীবন দ্বীনের খাদেম হয়ে থাকতে।
আল্লাহর কী শান! এদিকে আমেরিকান এক কৃষ্ণাঙ্গ যুবক ভারত পাকিস্তান সফর করলেন। সে আমাদের এখানে এতেকাফও করেছিল। দাওয়াতের কাজে প্রভাবিত হয়ে সে নিয়ত করে নিয়েছে যে, গোটা জীবন এ কাজ নিয়েই থাকবে।
দেশে গিয়ে সে সিদ্ধান্ত নিল, একমাত্র দ্বীনদার নারীকেই সে জীবনসঙ্গিনী হিসেবে গ্রহণ করবে। ওদিকে ঐ নারী পাক্কা সিদ্ধান্ত গ্রহণ করলেন, কোনো দ্বীনদার সঙ্গী পেলে তবেই সংসার পাতব।
বহুজন বহুভাবে তাকে বুঝাল- দেখ, আমেরিকার পরিবেশে দ্বীনদার পাত্র পাওয়া খুবই মুশকিল। সে সাফ সাফ জানিয়ে দিল, মুশকিল হোক বা আসান; দ্বীনদার পাত্র পেলে তবেই বিবাহ বসব। শুনে রাখ, আমার আল্লাহর খাজানায় কোনো কমতি নেই। মুসলমানদের থেকে আমি নামায পড়ে আল্লাহর কাছে চাইতে শিখেছি। তাই আল্লাহর কাছেই চেয়ে যাচ্ছি।
উভয়েই আপন আপন জায়গা থেকে দুআ জারি রাখল। আপনজন পরিচিতজনদের জানিয়ে দিল, আগে দ্বীনদারি দেখতে হবে, তারপর স্ট্যাটাস। দ্বীনদারি ব্যতীত শুধু দুনিয়াদারির কোনো মূল্য নেই।
উভয়ের বসবাস নিউইয়র্কে। মেয়ে জার্মানী বংশোদ্ভূত শ্বেতাঙ্গ পরিবারের সন্তান। আর ছেলে কৃষ্ণাঙ্গ পরিবারের।
উভয়কে যখন উভয়ের সংবাদ ও সন্ধান দেওয়া হল, ছেলের জন্য তো এটা ছিল আকাশের চাঁদ পাওয়া। কিন্তু মেয়ের জন্য এরকম একটা ছেলেকে মেনে নেওয়া বাহ্যত খুবই মুশকিল ছিল।
তবে বাস্তব কথা হল- মেয়ের প্রশ্ন ছিল একটিই। বল, ছেলে দ্বীনদার কি না?
যখন তিনি জানতে পারলেন, ছেলে দ্বীনদার। তাবলীগেও সময় লাগিয়েছে। রাজি হয়ে গেলেন। আশপাশ থেকে আওয়াজ উঠল, কীভাবে তুমি এমন একটি ছেলের কাছে নিজেকে সঁপে দিতে যাচ্ছো?
তার জবাব ছাফ- কালো হয়েছে তাতে কী? সে যদি দ্বীনের উপর চলে আল্লাহ তাআলা তো কিয়ামতের দিন উজ্জ্বল নূরানী চেহারা দান করবেন। দুনিয়ার এ কয়েকদিন তার চামড়া কালো থাকলে কী যায় আসে? কিয়ামতের দিন যখন আজীবনের জন্য তার চেহারা চকমক করবে, তখন! یَّوْمَ تَبْیَضُّ وُجُوْهٌ وَّ تَسْوَدُّ وُجُوْهٌ. যেদিন কিছু মুখ হবে আলো-ঝলমলে আর কিছু মুখ হবে মলিন-কালিমাযুক্ত। -সূরা আলে ইমরান (৩) : ১০৬
যাহোক, তাদের ‘আকদে মাসনূন’ সম্পন্ন হল। মহিলা তার মিশন নিয়ে রইল। স্থানীয় মেয়েদেরকে সে কুরআনুল কারীম শেখাতে থাকল।
একবার এ দম্পতি আমাদের এখানে আসে। আমরা তাদের জামাতকে আলীগড় বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠাই। সেখানকার অবস্থা তো আর আপনাদের অজানা নয়- ছাত্র-ছাত্রী ও শিক্ষক-শিক্ষিকা কী পরিমাণ আল্ট্রা মডার্ন-আপটু-ডেট।
তারা যখন জানতে পারল, আমেরিকা থেকে এক নারী এসেছে। তাও কি শ্বেতাঙ্গ ঘরানার! সে আলোচনা করবে। ব্যস, তারা ইউরোপিয়ান স্টাইলে সেজেগুজে সেখানকার একটি হলে জমা হল।
রঙে ভারতীয় হলেও ঢঙে যেন তার সাথে তাল মেলাতে পারে। যেমনটি অনেকেরই আগ্রহের বিষয় হয়ে থাকে যে, তারা ইংরেজ বনে থাকবে। কথা বলার ঢং থেকে শুরু করে সেকেল-সূরত সব কিছুকে তারা ইংরেজী আদলে করার ফিকিরে থাকে।
তো তারা এভাবে একটি হলে একত্র হল। আমাদের মুবাল্লিগীন বোনেরাও তার মেহমান ছিল। সবাই যখন এসে হাযির। পাশের কামরা থেকে বোরকা পরা এক নারী হলে প্রবেশ করলেন।
ঢুকেই গেট বন্ধ করে দিলেন- যাতে কোনো পুরুষ আসতে না পারে।
উপস্থিত সবার সামনে মুখ খুললেন। হ্যাঁ, আমেরিকার সেই খোলামেলা খ্রিস্টান নারীটিই এখন তাদের সামনে মুসলিম হয়ে পর্দা করে এসেছেন। আর মুসলিম ঘরের মেয়েরা তার সামনে ইউরোপিয়ান সেজে বসে আছে!
তারপর তিনি আলোচনা শুরু করলেন। দিলের দরদে পূর্ণ ছিল তার কথাগুলো। ঈমান-একীনের কথা বললেন। আল্লাহ তাআলার কুদরতের কথা বললেন। আরো বললেন, একদিন কিয়ামত হবে। তখন সবাই আবার জীবিত হবে। হিসাব-নিকাশ হবে। জান্নাতের সুসংবাদ ও জাহান্নামের শাস্তির কথাও শোনালেন।
সুন্দর করে ছয় নম্বরের বয়ান করলেন। এরপর যে কথাগুলো তিনি বললেন, তা কেবল তার মুখেই শোভা পায়। বড় হেকমতের সাথে তিনি তাদেরকে বোঝানো শুরু করলেন। গলার স্বর নরম থেকে ধীরে ধীরে গরম হতে লাগল। বললেন, তোমরা নিজেদেরকে মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়সাল্লামের উম্মত বলে দাবি কর। অথচ তোমাদের জীবনযাত্রা এরকম!
চিন্তা করে দেখ, নবীর উম্মত হয়ে তোমরা কোন পথে হাঁটছো!
তার কণ্ঠ আরো ঝাঁঝিয়ে ওঠল- জেনে রাখো, তোমরা যে জীবন গ্রহণ করেছ বা করতে আগ্রহী আমাদের জীবন আগে এটাই ছিল। সে জীবনকে আমরা ঘৃণাভরে ছুড়ে ফেলেছি। তোমাদের আজকের এ জীবন তো ঐ জীবন, যা আমরা ফেলে দিয়ে পবিত্র জীবনে ফিরে এসেছি।
হযরত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আদর্শ গ্রহণ করে নতুন জীবন লাভ করেছি।
তার কলজেছেঁচা এ কথাগুলো এভাবেই তাদের কলিজায় গিয়ে বিঁধল। গলায় ঝোলানো দোপাট্টাগুলো ধীরে ধীরে মাথা ঢেকে নিতে লাগল।
এখন সবাই তওবার জন্য প্রস্তুত। সবাই তার নিকট ওয়াদা করল, এখন সবখানে নামাযের পরিবেশ কায়েম করবে। যিকির ও তিলাওয়াতের পরিবেশ সৃষ্টি করবে। আলোচনা শেষে তিনি ফিরে গেলেন নিজ দেশে। কিন্তু তাঁর দরদমাখা নসীহত হল আলীগড়ের নারী শিক্ষার্থীদের নিত্যসঙ্গী- জীবনের পাথেয়।
এখন আলীগড় বিশ্ববিদ্যালয়ের কারগুজারী শুনুন। সেখানে হলগুলোর রুম থেকে এখন তিলাওয়াতের সুমধুর গুঞ্জন ভেসে আসছে। যিকিরের পরিবেশ দেখা যাচ্ছে। তো আমি যা বলতে চাচ্ছি, আমাদের মা-বোনদের দ্বীনের জন্য কুরবানী করার জযবা থাকতে হবে। দ্বীনের উপর চলার যেহনিয়ত পয়দা করতে হবে। যেহেন তৈয়ার হয় তাদেরকে সুন্দরভাবে বোঝানোর মাধ্যমে।
এজন্য ঘরে ঘরে তালীমের হালকা করুন। পুরুষগণ যারা পড়তে পারেন ঘরের সবাইকে নিয়ে তালীম করবেন। ঘরে নারী-শিশুরা মনোযোগ দিয়ে শুনবে। কখনও পুরুষগণ অধিক ব্যস্ততার দরুণ তালীম করতে না পারলে ঘরের বয়োজ্যেষ্ঠ নারী সবাইকে নিয়ে তালীম করবেন। নামাযের আমলী মশক করবেন।