মুহাম্মাদ আবু আখতার
কুরআন মাজীদ আল্লাহ তায়ালার নাজিলকৃত শ্রেষ্ঠ আসমানী কিতাব।
এ কিতাব যেমন মর্যাদার দিক দিয়ে শ্রেষ্ঠ তেমনি এ কিতাব তিলাওয়াতের গুরুত্ব ও ফজিলত অপরিসীম।
অত্যন্ত দুঃখজনক হলেও সত্য যে, বর্তমান মুসলিম সমাজের একটি বিরাট অংশ সহীহভাবে কুরআন তিলাওয়াত করতে জানে না। এদের মধ্যে বেনামাজী লোক যেমন আছে তেমনি অনেক দ্বীনদার নামাজী লোকও আছে। সারাজীবন নামাজ পড়ে যাচ্ছে। কিন্তু সহীহভাবে কুরআন তিলাওয়াত শিক্ষার ব্যাপারে তাদের মাঝে চরম উদাসীনতা লক্ষ্ করা যায়। অথচ সুরা কিরাত সহীহ না হলে নামাজও সহীহ হয় না। এ ব্যাপারে তাদের কোন ভ্রুক্ষেপ নেই। তবে যারা সহীহভাবে কুরআন তিলাওয়াতের গুরুত্ব বুঝতে পেরেছে তারা এ ক্ষেত্রে অবহেলা করতে পারে না। অনেকে নামাজের জন্য প্রয়োজনীয় সূরাগুলো উস্তাদের সাহায্য ছাড়া বিভিন্ন বই থেকে বাংলা উচ্চারণ দেখে মুখস্ত করে নেয়। আধুনিক শিক্ষিত শ্রেণীর মাঝে এ প্রবণতা একটু বেশি লক্ষ্য করা যায়। অথচ সহীহভাবে কুরআন তিলাওয়াত শিক্ষার জন্য উস্তাদের বিকল্প নেই। একথা সুস্পষ্ট যে, আরবী বেশ কিছু হরফের বিকল্প বর্ণ বাংলাতে নেই। তাই বাংলা উচ্চারণে সহীহভাবে কুরআন তিলাওয়াত আদৌ সম্ভব নয়। দুনিয়াবী শিক্ষার জন্য অনেকে তার সন্তানদেরকে বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পড়ানোর পাশাপাশি মোটা অংকের টাকা খরচ করে প্রাইভেটভাবেও কয়েকজন শিক্ষকের কাছে পড়ায়। কিন্তু সামান্য কিছু টাকা খরচ করে সন্তানদেরকে উস্তাদের কাছে কুরআন তিলাওয়াত শিক্ষার জন্য পাঠাতে তারা আগ্রহী নয়। আসল কথা হলো তারা দুনিয়াবী শিক্ষার মূল্য বুঝতে পারলেও কুরআন শিক্ষার মূল্য বুঝতে পারে নি। তাই তারা কুরআন শিক্ষাকে দুনিয়াবী শিক্ষার চেয়ে গুরুত্বহীন মনে করে। এজন্য তারা নিজেরা সহীহভাবে কুরআন শিক্ষা করতে এবং অধীনস্থ সন্তানদেরকে কুরআন শিক্ষাদানে আগ্রহবোধ করে না। তারা কুরআন শিক্ষাকে হেয় চোখে দেখে। অথচ রাসুলুল্লাহ (সা) কুরআন শিক্ষাকারী ও শিক্ষাদানকারীকে সর্বোত্তম ব্যক্তি হিসেবে ঘোষণা করেছেন। হজরত উসমান ইবনে আফফান (রা) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছেন,
“তোমাদের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ ঐ ব্যক্তি যে নিজে কুরআন শিখে ও অপরকে শিক্ষা দেয়।” (বুখারিঃ ৫৹২৭)
যারা সহীহভাবে কুরআন তিলাওয়াত শিক্ষা করেছে ও কুরআন হিফজ করেছে এবং নিয়মিত তিলাওয়াত করে আল্লাহর দরবারে তাদের মর্যাদা অপরিসীম। তারা কিয়ামতের দিন সম্মানিত লিপিকার ফেরেশতার সঙ্গী হওয়ার সৌভাগ্য লাভ করবে। আর যারা কুরআন হিফজ করে নি এবং দ্রুত তিলাওয়াত করতে পারে না তাদের জন্য সহীহভাবে তিলাওয়াত করতে একটু কষ্ট স্বীকার করতে হয়। সহীহভাবে কুরআন তিলাওয়াতের সময় আরবী হরফগুলো ঠিকমত উচ্চারণ করতে অনেকের কষ্ট অনুভূত হয়। কিন্তু এজন্য তিলাওয়াত ছেড়ে দেয়া ঠিক নয়। কেননা কুরআন তিলাওয়াতে কষ্টের জন্যও দ্বিগুণ নেকী রয়েছে। একটি তিলাওয়াতের জন্য আরেকটি কষ্ট করার জন্য। হজরত আয়েশা (রা) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ (সা) বলেছেন,
কুরআনের তিলাওয়াতকারী হাফেজগণ লিপিকার সম্মানিত ফেরেশতাদের সঙ্গী হবে। আর কষ্টদায়ক হওয়া সত্ত্বেও যে বারবার কুরআন মাজীদ পাঠ করে, সে দ্বিগুণ পুরস্কার পাবে। (বুখারিঃ ৪৯৩৭)
কুরআন তিলাওয়াত একটি গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত। এর দ্বারা অনেক নেকী হাসিল করা যায়। তবে এজন্য তিলাওয়াত সহীহ হওয়া জরুরী। অশুদ্ধ তিলাওয়াতে নেকীর পরিবর্তে গোনাহ হয়। এ দুনিয়াতে নেকীর মূল্য ও গোনাহের ক্ষতি বুঝতে না পারায় সহীহভাবে কুরআন তিলাওয়াত শিক্ষায় আমরা অবহেলা করি। কিন্তু যখন নেকীর মূল্য ও গোনাহের ক্ষতি আমাদের বুঝে আসবে তখন সহীহভাবে কুরআন তিলাওয়াত শিক্ষায় অবহেলার কারণে আফসোসের কোন সীমা থাকবে না। কুরআন তিলাওয়াতে প্রতি হরফেই নেকী রয়েছে। এ ব্যাপারে হজরত আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছেন, “যে ব্যক্তি আল্লাহর কিতাব (কুরআন মাজীদ)এর একটি হরফ পাঠ করবে, তার একটি নেকী হবে। আর একটি নেকী দশটি নেকীর সমান হয়। আমি বলছি না যে, ‘আলিফ-লাম-মীম’ একটি হরফ; বরং আলিফ একটি হরফ, লাম একটি হরফ এবং মীম একটি হরফ।” (অর্থাৎ তিনটি হরফ দ্বারা গঠিত ‘আলিফ-লাম-মীম, যার নেকীর সংখ্যা হবে ত্রিশ।) ( তিরমিজিঃ ২৯১০)
আল্লাহ তায়ালা পবিত্র কুরআনে বলেছেন,
“তোমরা তারতীলের সাথে কুরআন তিলাওয়াত কর। ” (সুরা মুযযাম্মিলঃ ৪)
তাফসীরকারগণ তারতীলের ব্যাখ্যায় বলেছেন ধীরে সুস্থে সুস্পষ্টভাবে এবং সহীহভাবে তিলাওয়াত করা। তাই তাড়াহুড়ো করে অস্পষ্টভাবে এবং অশুদ্ধ উচ্চারণে কুরআন তিলাওয়াত করা উচিত নয়। বরং সর্বদা ধীরে সুস্থে সুস্পষ্টভাবে এবং শুদ্ধ উচ্চারণে কুরআন তিলাওয়াতের চেষ্টা করা আমাদের একান্ত কর্তব্য।
সম্পদশালীগণ দান-সাদকার দ্বারা অনেক নেকী হাসিল করার সুযোগ লাভ করতে পারে। কিন্তু যাদের ধন-সম্পদ নেই তাদের জন্যও অন্য উপায়ে আল্লাহ তায়ালা অনুরূপ নেকী লাভের সুযোগ রেখেছেন। নেকী লাভের সে সুযোগ লাভ হয় গোপনে প্রকাশ্যে সর্বাবস্থায় বেশি বেশি কুরআন তিলাওয়াত করার মাধ্যমে। এর দ্বারা সাদকার সমতুল্য নেকী লাভ হয়। এ সম্পর্কে হজরত উকবা ইবনে আমির (রা:) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ (সা) কে বলতে শুনেছি: প্রকাশ্যে কুরআন পাঠকারী প্রকাশ্যে দান-খায়রাতকারীর সমতুল্য এবং গোপনে কুরআন পাঠকারী গোপনে দান-খায়রাতকারীর সমতুল্য।
(তিরমিযীঃ২৯১৯)
আমাদের দ্বারা প্রতিনিয়ত অসংখ্য গোনাহ সংঘটিত হচ্ছে। আর আমাদের নেক আমলেও ইচ্ছায় অনিচ্ছায় অনেক ত্রুটি-বিচ্যুতি হয়ে থাকে। এর ফলে কিয়ামতের দিন আল্লাহর শাস্তি থেকে নাজাত পাওয়া খুব কঠিন। আল্লাহ তায়ালা সেদিন অতি সূক্ষ্মভাবে বিচারকার্য পরিচালনা করবেন। কেউ বিন্দুমাত্র নেক কাজ করলেও তার প্রতিদান দিবেন। আর কেউ বিন্দুমাত্র পাপ কাজ করলেও তার শাস্তি দিবেন। তবে যারা নিয়মিত কুরআন তিলাওয়াত করে তাদের নাজাতের ব্যাপারে আশা করা যায়। কেননা কুরআন কিয়ামতের দিন তিলাওয়াতকারীর নাজাতের জন্য সুপারিশ করবে।
কেননা কুরআন কিয়ামতের দিন তিলাওয়াতকারীর নাজাতের জন্য সুপারিশ করবে। এ ব্যাপারে হজরত আবূ উমামা (রা) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি রাসূল (সা) কে এ কথা বলতে শুনেছি যে,
“তোমরা কুরআন মাজীদ পাঠ কর। কেননা, কিয়ামতের দিন কুরআন, তার পাঠকের জন্য সুপারিশ-কারী হিসাবে আগমন করবে।”
(আহমাদঃ ২১৬৪২)
আমাদের দৃষ্টিতে কেউ মহামূল্যবান কিছু অর্জন করলে তার প্রতি আমাদের ঈর্ষা হয়। তাদের অনুরূপ কিছু পাওয়ার জন্য তখন অন্তরে আকাঙ্ক্ষা জাগে। সে আকাঙ্ক্ষিত জিনিস লাভের জন্য আমাদের চেষ্টার কমতি থাকে না। যেকোনো মূল্যে তা অর্জনের জন্য প্রাণপণে চেষ্টা করি। হাদীসে শুধুমাত্র দুটি বিষয়ে ছাড়া এরূপ ঈর্ষা পোষণ করা উচিত নয় বলে উল্লেখ করা হয়েছে। হজরত আব্দুল্লাহ ইবনে উমর (রা) কর্তৃক বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছেন, “দু’জন ব্যতীত অন্য কারো ক্ষেত্রে ঈর্ষা করা উচিত নয় ।
(১) যাকে আল্লাহ কুরআন (তিলাওয়াত ও মুখস্ত করার শক্তি) দান করেছেন, সুতরাং সে (এর আলোকে) দিবা-রাত্রি পড়ে ও আমল করে।
(২) যাকে আল্লাহ তা‘আলা ধন-সম্পদ দান করেছেন এবং সে (আল্লাহর পথে) দিন-রাত ব্যয় করে।” (বুখারিঃ৫৹২৫)
এতসব ফজিলত লাভের জন্য আমাদেরকে বেশি বেশি কুরআন তিলাওয়াত করা কর্তব্য। আর তিলাওয়াতে আগ্রহ সৃষ্টির জন্য মিষ্টি স্বরে কুরআন তিলাওয়াত করা উচিত। রাসুলুল্লাহ (সা) মিষ্টি স্বরে তিলাওয়াত করার নির্দেশ দিয়েছেন। যারা মিষ্টি স্বরে কুরআন তিলাওয়াত করে না তাদেরকে তার উম্মতের অন্তর্ভুক্ত নয় বলে ভর্ৎসনা করেছেন। হযরত আবূ লুবাবাহ বাশীর ইবনে আব্দুল মুনযির (রা) হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছেন,
“যে ব্যক্তি মিষ্টি স্বরে কুরআন পড়ে না, সে আমাদের অন্তর্ভুক্ত নয়।” (অর্থাৎ আমাদের ত্বরীকা ও নীতি-আদর্শ বহির্ভূত।)
(আবূ দাউদ: ১৪৭১)
কুরআন মুখস্ত করার পর নিয়মিত তিলাওয়াত করা উচিত। কেননা নিয়মিত তিলাওয়াত না করলে কুরআন ভুলে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে। রাসুলুল্লাহ (সা) এ বিষয়টি একটি সুন্দর উপমার মাধ্যমে বুঝিয়েছেন হজরত আব্দুল্লাহ ইবনে উমার (রা) হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছেন, “কুরআন-ওয়ালা হল বাঁধা উট-ওয়ালার মত। সে যদি তা বাঁধার পর তার যথারীতি দেখাশোনা করে, তাহলে বাঁধাই থাকবে। নচেৎ ঢিল দিলেই উট পালিয়ে যাবে।” (বুখারিঃ৫৹৩১)
যারা কুরআন তিলাওয়াত শিক্ষা করার পরও নিয়মিত কুরআন তিলাওয়াত করে না এবং কুরআন অনুযায়ী আমল করে না তাদের শাস্তি হবে অত্যন্ত কঠিন। রাসুলুল্লাহ (সা) কে স্বপ্নযোগে তাদের শাস্তি দেখানো হয়েছে। রাসুলুল্লাহ (সা) তার দীর্ঘ স্বপ্ন বর্ণনার এক পর্যায়ে বলেন, “আমরা [রাসুলুল্লাহ (সা) এবং দু’জন ফেরেশতা] চলতে চলতে চিৎ হয়ে শায়িত এক ব্যক্তির পাশে এসে উপস্থিত হলাম। তার শিয়রে পাথর হাতে এক ব্যক্তি দাঁড়িয়ে আছে। ঐ ব্যক্তি পাথর দিয়ে তার মাথা চূর্ণ করে দিচ্ছিল। নিক্ষিপ্ত পাথর দূরে গড়িয়ে যাওয়ার ফলে তা তুলে নিয়ে শায়িত ব্যক্তির নিকট ফিরে আসার পূর্বেই বিচূর্ণ মাথা আবার জোড়া লেগে যাচ্ছিল। সে পুনরায় মাথার উপরে পাথর নিক্ষেপ করছিল। আমি জিজ্ঞাসা করলাম, লোকটি কে? তাঁরা বললেন, চলুন। [এরপর ফেরেশতা যখন স্বপ্নের ব্যাখ্যা দিচ্ছিলেন তখন বললেন]
আপনি যার মাথা চূর্ণ করতে দেখলেন, সে এমন ব্যক্তি যাকে আল্লাহ কুরআনের শিক্ষা দান করেছিলেন, কিন্তু রাতের বেলায় সে কুরআন থেকে বিমুখ হয়ে নিদ্রা যেতো এবং দিনের বেলায় কুরআন অনুযায়ী আমল করতো না। তার সাথে কিয়ামত পর্যন্ত এরূপই করা হবে।”
(বুখারিঃ ১৩৮৬)
তাই এ ভয়াবহ পরিণতি হতে বাঁচতে এবং অপরিসীম ফজিলত লাভের জন্য আমাদের জন্য সহীহভাবে কুরআন শিক্ষা করে নিয়মিত তিলাওয়াত করা এবং সে অনুযায়ী নেক আমল করা আমাদের জন্য আবশ্যক। আল্লাহ আমাদের সকলকে সেই তাওফিক দান করুন।
আমিন।
লেখক – শিক্ষার্থী,
ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া।
01957157565
01837351293