প্রসঙ্গ : আলকুরআনের অর্থ বোঝা


লিখেছেন – মাওলানা মুহাম্মাদ যাকারিয়া আব্দুল্লাহ


এবারের (১৪৩৮ হি.) শাবান মাসের ২৯ তারিখটি ছিল জুমাবার। জুমার নামাযের পর এক ভাই একটি বই হাদিয়া দিলেন। বইটির প্রচ্ছদ দৃষ্টিনন্দন, কাগজ উন্নত, বিষয়বস্তুও ভালো- তারাবীহতে প্রতিদিনের পঠিতব্য কুরআনের বক্তব্য ও শিক্ষা। এই শিরোনামে এখন বেশ কিছু বই পাওয়া যায়। ভদ্রলোক নিজেই বইটির লেখক। শেষ প্রচ্ছদে লেখকের পরিচিতি দেয়া আছে। তাতে দেখা যাচ্ছে, তিনি বেশ মেধাবী ও অনেকগুলো সম্মানজনক ডিগ্রীর অধিকারী।

বইটি পেয়ে ভালো লাগল। কামরায় এসে পাতা ওল্টাতে লাগলাম। কিন্তু বেশিক্ষণ মনটা ভালো থাকল না।

কুরআনের অর্থ ও বক্তব্য বোঝার প্রেরণা মুমিন হৃদয়ে এক পবিত্র প্রেরণা, কুরআনের সাথে সম্পর্ক ও ভালবাসার একটি দিক। মুমিন হৃদয়ের এই চাহিদা পূরণের জন্য মানসম্মত পাঠোপকরণ প্রস্তুত ও সরবরাহ করাও গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু পাঠোপকরণ যদি এমন হয়, যা নতুন ভুল-ভ্রান্তি বিস্তারের কারণ হয়ে দাঁড়ায় তাহলে তা অত্যন্ত দুঃখজনক বটে।

আমার হাতে যে বইটি তার প্রথম প্রচ্ছদের ভেতরে ফ্ল্যাপের একটি বাক্য নিম্নরূপ-

‘কিছুই যদি না বুঝি তাহলে রোযার ক্লান্তি শেষে মূল্যবান সময় ব্যয় করে খতমে তারাবীহতে দেয়া শ্রমটুকু কি অর্থহীন নয়?’

আজকাল অনেকেই কুরআন তিলাওয়াতকে এভাবে মূল্যায়ন করে থাকেন। অর্থ না বুঝলে তিলাওয়াত অর্থহীন। নাউযু বিল্লাহ।

এই মৌলিক ভ্রান্তি থেকেই উপরের ভ্রান্তিটি উৎসারিত- কিছুই যদি না বুঝি…! অর্থাৎ অর্থ না বুঝলে খতমে তারাবীহতে কুরআন পড়া ও কুরআন শোনা দুটোই অর্থহীন! নাউযু বিল্লাহ। এই যে চিন্তাটা এখানে দেয়া হল, এর পক্ষে কুরআন-সুন্নাহর কোনো দলীল আছে কি? নেই। এটা একটা আবেগী চিন্তা। এর ভ্রান্তি সম্পর্কে দালীলিক আলোচনা আলিমগণ করেছেন। এখানে এই সংক্ষিপ্ত পরিসরে সেসবের অবতারণার অবকাশ নেই। লেখক অবশ্য নিজেও এক জায়গায় লিখেছেন- ‘অবশ্যই কুরআন না বুঝে শুনলেও তার সওয়াব পাওয়া যাবে। তবে তা বুঝার চেষ্টা অব্যাহত রাখতে হবে।… (পৃ. ২৭)

তাহলে বলা যায়, লেখকের এই মাসআলা জানা আছে যে, কুরআন না বুঝে শুনলেও সওয়াব হয়, তবে মুমিনের সাধারণ কর্তব্য, কুরআন বোঝার চেষ্টা অব্যাহত রাখা। কাজেই এ বিষয়ে দলীল-প্রমাণের প্রয়োজন নেই। কিন্তু প্রশ্ন দাঁড়িয়ে যাচ্ছে যে, কুরআন না বুঝে শুনলেও যদি সওয়াব হয় তাহলে তারাবীহতে না বুঝে পড়া বা শোনাটা অর্থহীন কেন হবে? যে মাসআলা লেখকের নিজেরও জানা আছে আবেগের বশে সেই মাসআলা পরিপন্থী কথা বলা অন্যায় নয় কি?

কুরআন আমাদের আদেশ করেছে-

یٰۤاَیُّهَا الَّذِیْنَ اٰمَنُوا اتَّقُوا اللهَ وَ قُوْلُوْا قَوْلًا سَدِیْدًا

হে ঈমানদারেরা! আল্লাহকে ভয় কর এবং সঠিক কথা বল। -সূরা আহযাব (৩৩): ৭০

কাজেই এমন কোনো কথা বলা বা লেখা থেকে অবশ্যই বিরত থাকতে হবে, যা সঠিক নয়।

এ প্রসঙ্গে আরেকটি ভুল চিন্তাও বেশ ব্যাপকভাবে লক্ষ্য করা যায়। এই লেখকের লেখাতেও তার প্রতিফলন দেখতে পেলাম। তিনি লিখেছেন-

‘কিন্তু কুরআন যদি না বুঝি তাহলে তার থেকে নির্দেশনা পাওয়া কীভাবে সম্ভব? কীভাবে আমাদের জীবনে কুরআনকে বাস্তবায়ন করতে সক্ষম হব? (পৃ. ২৭)

প্রকাশকের কথায় বলা হয়েছে-

…খুব কম সংখ্যক লোক আছেন, যারা কুরআনের অনুবাদ পড়েন কিংবা সেখানে কী বলা হয়েছে তা বোঝার চেষ্টা করেন। যে কারণে কুরআনের বক্তব্য আমরা যেমন অনুধাবন করতে পারি না তেমনি সে আলোকে আমাদের জীবনও পরিচালনা করতে ব্যর্থ হই।

এই দুটো উদ্ধৃতিতেই যে ভুল চিন্তার প্রতিফলন রয়েছে তা হচ্ছে কুরআনের শিক্ষা ও বিধান সম্পর্কে জানা এবং সে অনুযায়ী জীবন পরিচালনা করার একমাত্র উপায় হচ্ছে কুরআনের তরজমা পাঠ। এই যদি হয় তাহলে বলুন তো আমাদের দেশের অসংখ্য মানুষ যে পাঁচ ওয়াক্ত নামায পড়ছে নামাযের আগে অজু করছে, যাকাত দিচ্ছে, রমযানের রোযা রাখছে, হজ্ব করছে, পর্দা করছে তারা কি কুরআনী বিধান পালন করছে না? করছে। কুরআন না বুঝেও বা কুরআনের তরজমা পাঠ না করেও কীভাবে তারা কুরআনের এই বিধানগুলো পালন করছে? জবাব খুবই সোজা। তারা আলেমদের কাছ থেকে এই সকল বিধান জেনেছেন কিংবা শরীয়তের বিধি বিধানের উপর লিখিত বই-পত্র পড়ে সে অনুযায়ী আমল করছেন। আর এভাবে কুরআনের বিধানের উপর তাদের আমল হয়ে যাচ্ছে। কাজেই শরীয়তের বিধি-বিধান সম্পর্কে জ্ঞান অর্জনের যতগুলো সঠিক উপায় আছে, সবগুলোর দ্বারা আসলে কুরআন-সুন্নাহর বিধি-বিধানই শেখা হচ্ছে এবং শেখানো হচ্ছে। একটি শিশুকে তার বাবা বা উস্তায যখন অজু শেখালেন তখন আসলে তাকে সূরা মাইদার অজুর বিধানটি সহজভাবে শিখিয়ে দিলেন, যখন নামায শেখালেন তখন কুরআনের অনেকগুলো আয়াতের বিধান শিখিয়ে দিলেন। আর এ অনুযায়ী শিশুটি যখন অজু করছে, নামায পড়ছে তখন সে কুরআনের বিধানই পালন করছে। সে সরাসরি কুরআন বোঝেনি, কুরআনের তরজমা-তাফসীরও পড়েনি, কিন্তু কুরআনের শিক্ষা ও বিধান সে জেনেছে এবং পালন করছে। এই কথা শুধু অজু-নামাযের ক্ষেত্রেই নয়, আকীদা-বিশ্বাস, ইবাদত-বন্দেগী, লেন-দেন, সামাজিকতা, হালাল-হারাম, কর্তব্য-অধিকার, সওয়াব-গুনাহ, আদব-আখলাক সব ক্ষেত্রে। এইসকল বিষয়ে পঠন-পাঠন, বলা-শোনা, শিক্ষাদান-শিক্ষাগ্রহণ আগেও ছিল, এখনো আছে। ছেলে-বুড়ো, শিক্ষিত-অশিক্ষিত সবার জন্যই আছে। আর এভাবে আমাদের সমাজের অসংখ্য সাধারণ মুসলমান কুরআনী বিধি-বিধান জেনে এসেছেন ও পালন করে এসেছেন।

সাধারণ মানুষের পক্ষে কুরআনের বিধি-বিধান জানার এটাই সহজ ও স্বাভাবিক পন্থা। আপনি নিজেই চিন্তা করুন, সূরা মাইদার ৬ নং আয়াতটির শুধু তরজমা পড়েই কোনো সাধারণ মানুষের পক্ষে অজুর পূর্ণ ও প্রায়োগিক নিয়মটি জানা বা পালন করা কি সম্ভব? এখানে তো শুধু অজুর ফরযগুলো কুরআনের নিজস্ব ভাষায় বর্ণিত হয়েছে। অজুর সুন্নত মুস্তাহাবসহ পূর্ণ প্রায়োগিক কাঠামোটি পেতে হলে হাদীস ও সুন্নাহর শরণাপন্ন হতে হবে। কারণ, আল্লাহর রাসূলের সুন্নাহয় রয়েছে কুরআনী বিধানের ব্যাখ্যা। এরপর কুরআন-সুন্নাহর বিধি-বিধান বিন্যস্তরূপে পাওয়া যাবে ফিক্হে ইসলামীতে। আলিমগণ ফিকহে ইসলামীর মাধ্যমে সহজ ও স্বাভাবিক পন্থায় যা শিখিয়েছেন তা ঐ সূরা মাইদার বিধানেরই প্রায়োগিক রূপ। কিন্তু একজন সাধারণ মানুষের পক্ষে শুধু কুরআনের তরজমা পড়ে তা জেনে ফেলা সম্ভব নয়। একই কথা সালাতের ক্ষেত্রে, সওমের ক্ষেত্রে, যাকাতের ক্ষেত্রে এবং শরীয়তের অন্যান্য বিষয়ের অনেক মাসাইলের ক্ষেত্রে। তবে হাঁ, শরীয়তের বিধি-বিধানের সঠিক জ্ঞান নির্ভরযোগ্য পন্থায় অর্জন করার পর যখন একজন মানুষ কুরআনের তরজমা পাঠ করবেন তখন তিনি কুরআনী বর্ণনা ও উপস্থাপনার মাধুর্য উপলদ্ধি করতে পারবেন।

কাজেই সরাসরি কুরআনের তরজমা না পড়লে কুরআনী নির্দেশনা জানা যাবে না বা নিজের জীবনে বাস্তবায়ন করা যাবে না- এই চিন্তাটা সঠিক নয়, ভুল ও অগভীর চিন্তা।

এই বিষয়টি উপলদ্ধি করতে পারলে ঐ মুখরোচক উপমাটির অসারতাও স্পষ্ট হয়ে যাবে, যা আজকাল অনেকেই উচ্চারণ করে থাকেন। এই বইয়ের লেখকও তা লিখেছেন। ভূমিকা অংশে তাঁর বক্তব্য- ‘… সে হিসাবে মোট মুসলিম জনসংখ্যার ০.০১ শতাংশও কুরআনকে বুঝে সে আলোকে নিজেদের বাস্তবিক ও প্রায়োগিক ক্ষেত্রে কাজে লাগাতে সক্ষম নয়। তাইতো আমাদের ঘরে ঘরে কুরআন থাকা সত্ত্বেও সে কুরআন আমাদের কোনো কাজে আসছে না। হবে কীভাবে? একজন বাঙালীর কাছে চাইনিজ ভাষার কোনো গাইডবুক দিয়ে যদি তাকে চায়না ঘুরে আসতে বলা হয় সে যেমন পারবে না তেমন অবস্থা হয়েছে আমাদের।’ (পৃ. ১৭-১৮)

এখানে প্রথম কথা হচ্ছে, কুরআন কারীমকে এক মানবরচিত গাইডবুকের পর্যায়ে নামিয়ে নিয়ে আসা কি চরম অন্যায় নয়? কুরআন তো আল্লাহর কালাম। এর এক বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, এই কালামের শুধু বাক্যগুলো পাঠ করে যাওয়াও ইবাদত। জগতের অন্য কোনো গ্রন্থের এই মর্যাদা নেই।

দ্বিতীয়ত প্রশ্ন হচ্ছে, এই উপমাটিও কি সঠিক ও বাস্তবসম্মত? চায়না ঘুরে আসার জন্য কি কোনো গাইডবুকের তরজমা পড়াটাই একমাত্র উপায়? কেউ যদি ঐ সফরকারীকে সহজ-সরল ভাষায় প্রয়োজনীয় তথ্যগুলো জানিয়ে দেয় তাহলে কি সে তা অনুসরণ করে চায়না ঘুরে আসতে পারবে না? আজকাল যারা চায়না ঘুরে আসে তারা সবাই কি গাইডবুকের তরজমা পড়ে পড়ে চায়না ঘুরে আসে? কী হাস্যকর ব্যাপার!

অথচ এইসব হাস্যকর কথাই বলছেন উচ্চডিগ্রীধারী স্কলারেরা! তো মূল কথাটি হচ্ছে, সাধারণ মুসলমানের জন্য কুরআনের বিধি-বিধান সম্পর্কে জানার ও জানানোর সহজ ও স্বাভাবিক উপায় কিন্তু সরাসরি কুরআনের তরজমা পড়া নয়, এর স্বাভাবিক উপায় হচ্ছে, নির্ভরযোগ্য আলিম-উলামার কাছ থেকে সহীহ দ্বীনী ইলম অর্জন করা, দ্বীনী বিষয়ে নির্ভরযোগ্য বইপত্র অধ্যয়ন করা, আকীদা-ইবাদত, মাসআলা-মাসায়েল, আদব-আখলাক সম্পর্কে জ্ঞান অর্জন করা। এসবই পরোক্ষভাবে কুরআনী ইলম বা কুরআনী ইলমের সারনির্যাস। সহীহ দ্বীনী রুচি ও মৌলিক দ্বীনী ইলম অর্জিত হওয়ার পর যদি নির্ভরযোগ্য আলিমের নির্দেশনা অনুসারে যথানিয়মে কুরআনের তরজমা-তাফসীর পাঠ করা হয় তখন তা উপকারী ও ফলপ্রসূ হয়ে থাকে।

কুরআনী খিদমতে নিয়োজিত সকলকে তাদের সঠিক কর্মটির জন্য মোবারকবাদ। একইসাথে এই খিদমতের নাযুকতা সম্পর্কে সচেতন হওয়ার এবং নানা উপায়ে ও শিরোনামে কুরআনী শিক্ষা বিস্তারে ব্রতী উম্মাহর পূর্ববর্তী ও সমকালীন খাদিমগণের প্রতি শ্রদ্ধা রাখার আহ্বান জানিয়ে এখানেই শেষ করছি।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *