সদকায়ে ফিতরের হুকুম ও পরিমাণ

সদকায়ে ফিতরের হুকুম কী এবং কোন্ দ্রব্য কী পরিমাণে আদায় করবেন

———————————————————————————————————-

মুফতী আবুল হাসান শামসাবাদী

———————————————————————————————————-

.

যাকাতের নিসাব পরিমাণ সম্পদের মালিক হলে সদকায়ে ফিতর আদায় করা ওয়াজিব। অর্থাৎ অত্যাবশ্যকীয় আসবাব সামগ্রী, ব্যবহার্য দ্রব্যাদি, বাসগৃহ ইত্যাদি বাদ দিয়ে অন্ততঃ সাড়ে বায়ান্ন তোলা তথা ৬১২.৩৬ গ্রাম রূপা অথবা সাড়ে সাত তোলা অর্থাৎ ৮৭.৪৮ গ্রাম স্বর্ণ কিংবা কিছু স্বর্ণ, কিছু রূপা ও কিছু টাকা সব মিলিয়ে সাড়ে বায়ান্ন তোলা তথা ৬১২.৩৬ গ্রাম রূপার সমমূল্যের (যা বর্তমান ঢাকার বাজার দর হিসেবে প্রতি ভরি রূপা ৯৩৩/= হিসেবে ৪৮,৯৮২ টাকা ৫০ পয়সা বা প্রায় ৪৯,০০০ [উনপঞ্চাশ হাজার] টাকা হয়) মাল-সম্পদ থাকলে, সদকায়ে ফিতর আদায় করা ওয়াজিব হবে। এ সম্পর্কে হযরত আবদুল্লাহ ইবনে উমর (রা.) হতে বর্ণিত হাদীস শরীফে রয়েছে, তিনি বলেন–

فرض رسول الله صلى الله عليه وسلم صدقة الفطر ، صاعا من شعير أو صاعا من تمر ، على الصغير والكبير ، والحر والمملوك

“রাসূলুল্লাহ (সা.) সদকাতুল ফিতর আদায় করাকে আবশ্যক করেছেন। এর পরিমাণ হলো, এক সা যব বা এক সা খেজুর। ছোট-বড়, স্বাধীন-পরাধীন সবার ওপরই এটা আবশ্যক।” (সহীহ বুখারী, হাদীস নং ১৫১২)

অবশ্য যাকাত ফরজ হওয়ার জন্য নিসাব পরিমাণ মাল-এর এক বছর অতিক্রান্ত হওয়া শর্ত, কিন্তু সদকায়ে ফিতরের ক্ষেত্রে সেই শর্ত নেই। বরং ঈদুল ফিতরের দিন সুবহে সাদিকের সময় এ পরিমাণ বা তার বেশী মালের মালিক থাকলে, তার উপর সদকায়ে ফিতর ওয়াজিব হবে। তিনি তার পক্ষ থেকে এবং তার নাবালিগ সন্তানদের কিংবা বালেগ সন্তান পাগল হলে, তার পক্ষ থেকে জনপ্রতি এক ফিতরার হিসাব ধরে (অর্থাৎ তারা যতজন হবেন, ততটি ফিতরা আদায় করতে হবে হিসেবে) ফিতরা আদায় করবেন।

বলা বাহুল্য, আপনার নিজের এবং আপনার নাবালক সন্তানদের সদকায়ে ফিতর বা ফিতরা আপনাকে আদায় করতে হবে। এমনকি আপনার যে শিশু-সন্তানটি ঈদুল ফিতরের দিন সুবহে সাদিকের পূর্বে ভূমিষ্ট হবে, তার ফিতরাও আদায় করতে হবে।

 

সদকায়ে ফিতর কোন্ দ্রব্য কী পরিমাণে আদায় করবেন :

—————————————————–

সদকায়ে ফিতর বা ফিতরা পাঁচ প্রকার দ্রব্য দিয়ে দেয়ার বর্ণনা হাদীস শরীফে রয়েছে। যেমন, সহীহ বুখারীতে বর্ণিত হয়েছে–

عَنْ أَبِي سَعِيدٍ الخُدْرِيِّ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُ، قَالَ: كُنَّا نُخْرِجُ فِي عَهْدِ رَسُولِ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يَوْمَ الفِطْرِ صَاعًا مِنْ طَعَامٍ. وَقَالَ أَبُو سَعِيدٍ: وَكَانَ طَعَامَنَا الشَّعِيرُ وَالزَّبِيبُ وَالأَقِطُ وَالتَّمْرُ

হযরত আবু সাঈদ খুদরী (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, “আমরা রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর যুগে এক সা’ পরিমাণ খাদ্য দিয়ে সদকাতুল ফিতর আদায় করতাম।” হযরত আবু সাঈদ খুদরী (রা.) বলেন, “তখন আমাদের খাদ্য ছিলো–যব, কিশমিশ, পনির ও খেজুর।” (সহীহ বুখারী : হাদীস নং ১৫১০)

সদকায়ে ফিতর হিসেবে এ হাদীসে চার প্রকার খাদ্যদ্রব্যের কথা বলা হয়েছে। উক্ত চার প্রকার দ্রব্য এক সা‘ তথা ৩ কেজি ৩০০ গ্রাম করে আদায়যোগ্য। এ ছাড়াও গম বা আটা দ্বারাও সদকায়ে ফিতর আদায় করা যায়। সেটা আধা সা‘ বা ১ কেজি ৬৫০ গ্রাম হিসেবে আদায়যোগ্য। গম বা আটা ফিতরা হিসেবে পরিশোধের ব্যাপারে হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আমর ইবনুল আস (রা.) থেকে বর্ণিত হয়েছে, তিনি বলেন–

أن النبي صلى الله عليه وسلم بعث مناديا ينادي في فجاج مكة : ألا إن صدقة الفطر واجب على كل مسلم، ذكر أو أنثى، حر أو عبد، صغير أو كبير، مدان من قمح، أو صاع مما سواه من الطعام

“নিশ্চয়ই রাসূলুল্লাহ (সা.) একজন ঘোষক প্রেরণ করলেন, যেন তিনি মক্কার পথে পথে এ ঘোষণা করেন যে, জেনে রেখো! প্রত্যেক মুসলিম নর-নারী, গোলাম-স্বাধীন, ছোট-বড় প্রত্যেকের উপর সদকায়ে ফিতর ওয়াজিব। তা দুই মুদ (আধা সা‘) গম কিংবা এক সা’ অন্য খাদ্যবস্তু।” (জামি‘ তিরমিযী, ১ খণ্ড, ৮৫ পৃষ্ঠা)

এক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে–উক্ত পাঁচপ্রকার খাদ্যদ্রব্য সবগুলো সমান মূল্যমানের নয়। বরং কোনটার মূল্য বেশী, কোনটার মূল্য মধ্যম ধরনের এবং কোনটার মূল্য কম। আবার মানুষের আর্থিক সংগতি সবার সমান নয়। বরং কেউ নিম্নবিত্তবান, কেউ মধ্যবিত্তবান, আবার কেউ উচ্চবিত্তবান বা ধনী। সুতরাং ফিতরার দ্রব্যসমূহের মূল্য-ব্যবধান দৃষ্টে এগুলো থেকে কোন একটা নির্বাচন করতে হবে আপনার আর্থিক দিক বিবেচনা করে।

যদি আপনি নিম্নবিত্তবান হন তথা আপনি সর্বনিম্ন নিসাব পরিমাণ মালের মালিক হন, তাহলে আপনি গম বা আটার হিসেবে ফিতরা আদায় করতে পারেন। গম বা আটা হিসেবে অর্ধ সা‘ বা এক কেজি ৬৫০ গ্রাম আটা বা এর বাজার মূল্য ৭০ (সত্তুর) টাকা আদায় করবেন।

আর যদি আপনি নিম্ন-মধ্যবিত্তবান হন বা আপনার নিকট নিসাবের চেয়ে কিছু বেশী মাল থাকে, তাহলে আপনি অন্ততঃ যব দ্বারা ফিতরা আদায় করতে পারেন। যব হিসেবে এক সা’ তথা ৩ কেজি ৩০০ গ্রাম যব বা এর বাজার মূল্য ২৭০ (দুইশত সত্তুর) টাকা আদায় করবেন।

আর যদি আপনি মধ্যবিত্তবান হন বা আপনার নিকট নিসাবের দ্বিগুণ পরিমাণ মাল থাকে, তাহলে আপনি অন্ততঃ সাধারণ মানের খেজুর দ্বারা ফিতরা আদায় করতে পারেন। খেজুর এক সা‘ হিসেবে ৩ কেজি ৩০০ গ্রাম সাধারণ মানের খেজুর বা এর বাজার মূল্য ৬৬০ (ছয়শত ষাট) টাকা আদায় করবেন।

আর যদি আপনি উচ্চমধ্যবিত্তবান হন বা কয়েকগুণ নিসাব পরিমাণ মালের মালিক হন, তাহলে আপনি অন্ততঃ কিসমিস দ্বারা সদকায়ে ফিতর আদায় করতে পারেন। কিসমিস হিসেবে এক সা‘ বা ৩ কেজি ৩০০ গ্রাম কিসমিস বা এর বাজার মূল্য ১৫০০ (এক হাজার পাঁচশত) টাকা আদায় করতে হবে। অথবা আপনি উন্নত মানের (আজওয়া) খেজুর দ্বারা সদকায়ে ফিতর আদায় করতে পারেন। ভাল মানের খেজুর হিসেবে এক সা‘ বা ৩ কেজি ৩০০ গ্রাম খেজুর বা এর বাজার মূল্য ১,৬৫০ (একহাজার ছয়শত পঞ্চাশ) টাকা আদায় করতে হবে।।

আর যদি আপনি উচ্চবিত্তশালী বা অবস্থাসম্পন্ন ধনী হন বা অনেক সম্পদের মালিক হন, তাহলে আপনি পনির দ্বারা সদকায়ে ফিতর আদায় করতে পারেন। পনিরের হিসেবে এক সা‘ বা ৩ কেজি ৩০০ গ্রাম পনির বা এর বাজার মূল্য ২,২০০ (দুই হাজার দুইশত) টাকা আদায় করতে হবে।

উল্লেখ্য, এখানে সম্পদভেদে সদকায়ে ফিতরের যে পরিমাণের কথা বলা হলো, এক্ষেত্রে যে কেউ যে কোনটা দিয়েও সদকায়ে ফিতর আদায় করলে তা আদায় হয়ে যাবে। কিন্তু আমাদের দেশে সাধারণত অবস্থাশালীগণও অনেকেই সর্বনিম্ন রেট তথা অর্ধ সা‘ গম বা তার মূল্য হিসেবে জনপ্রতি ৭০ টাকা হিসেবে আদায় করতে চান, তা ঠিক নয়। বরং এটা তো সর্বনিম্ন সম্পদের মালিকের জন্য চলে, কিন্তু আল্লাহ তা‘আলা যাদেরকে ওয়াসা‘আত দিয়েছেন, তাদের অন্যান্য দ্রব্য দিয়ে বেশী রেটের সদকায়ে ফিতর আদায় করা উচিত। যেমন, হযরত সাহাবায়ে কিরাম (রা.) অধিকাংশই খেজুর দিয়ে সদকায়ে ফিতর আদায় করতেন। আমাদেরও সেভাবে সাধ্যমতো উন্নত দ্রব্যের হিসেবে সদকায়ে ফিতর আদায় করা কর্তব্য।

 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *