আবুল হাসান আবদুল্লাহ
হজ্বের ফযীলত-সংক্রান্ত এ সহীহ হাদীসখানা সবারই জানা
‘যে হজ্ব করে এবং (তাতে সবধরনের) অশ্লীল কথা ও কাজ এবং গুনাহ-পাপাচার থেকে বিরত থাকে সে সদ্যজাত শিশুর মতো (নিষ্পাপ) হয়ে যায়। সহীহ বুখারী, হাদীস ১৫২১
আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের এই ক্ষমা ও মাগফিরাতের দাবি হচ্ছে, বান্দার তরফ থেকেও পাপমুক্ত জীবন যাপনে সচেষ্ট হওয়া। এটা এই মহাপুরস্কারের প্রকৃত মূল্যায়ন।
পাপমুক্ত জীবন মানে কী? প্রসঙ্গটি বেশ বিস্তৃত। এর জন্য বুঝতে হবে পাপ মানে কী। সহজ ভাষায় ইসলামের অবশ্য পালনীয় বিধি-বিধান লঙ্ঘন করাই পাপ। তাহলে ইসলামের বিধি-বিধানের পরিধি যত বড় পাপ-পুণ্যের ক্ষেত্রও তত বিস্তৃত। ইসলাম তো অন্যান্য ধর্মীয় মতবাদের মতো নিছক আচার ও আনুষ্ঠানিকতা সর্বস্ব কোনো ধর্ম নয়। ইসলাম হচ্ছে মানব-জীবনের সকল ক্ষেত্রের জন্য আলোকবর্তিকা, যে ক্ষেত্রগুলোর প্রধান প্রধান শিরোনাম এই
-
‘আকাইদ’ (বিশ্বাস),
-
‘ইবাদাত’ (উপাসনা)
-
‘মুআমালা’ (লেনদেন)
-
‘মুআশারা’ (সমষ্টিগত জীবনের নীতি ও বিধান)
-
‘আখলাক’ (স্বভাব-চরিত্র) ইত্যাদি।
এই সবগুলো ক্ষেত্রেই রয়েছে আল্লাহর বিধান ও নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সুন্নাহ। এরই নাম দ্বীন ও শরীয়ত। এরই অনুসরণ পুণ্য আর অন্যথা পাপ। সুতরাং পুণ্যময় পাপমুক্ত জীবন-যাপনের অর্থ জীবনের সকল ক্ষেত্রে আল্লাহর বিধান ও আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সুন্নাহর অনুসরণ। যাঁরা আল্লাহর ঘর সচক্ষে দর্শন করেছেন এবং তাওয়াফের সৌভাগ্য লাভ করেছেন, যারা আল্লাহর রাসূলের রওযায় সশরীরে উপস্থিত হয়েছেন এবং দরুদ ও সালাম পেশ করেছেন তাদের তো নিশ্চয়ই এই প্রেরণা জাগ্রত হয়েছে যে, আগামী জীবন ইনশাআল্লাহ আল্লাহর বিধান মোতাবেক ও রাসূলের সুন্নাহ অনুযায়ী অতিবাহিত করব। এই পবিত্র প্রেরণার সাথে যখন যুক্ত হবে সৎসাহস আর যাত্রা আরম্ভ হবে নতুন জীবনের নতুন পথে, তখন আল্লাহর পক্ষ হতে নুসরতও হতে থাকবে।
কা‘বার মালিকের প্রতিশ্রুতি ‘যারা আমার (সন্তুষ্টির) পথে মুজাহাদা করবে আমি অবশ্যই তাদের আমার (সন্তুষ্টির) পথে পরিচালিত করব। সুতরাং হজ্ব-পরবর্তী নতুন জীবনে আমাদের কাজ :
এক. আকীদা-বিশ্বাসের দুরস্তি। ইতিপূর্বে শয়তানের ধোকায় কোনো প্রকারের শিরকী-বিদআতী কাজের সাথে যুক্ত হয়ে থাকলে ভবিষ্যতে তা থেকে দূরে থাকার পাকা ইরাদা করা এবং হক্কানী আলিমদের সাহচর্যের মাধ্যমে শিরক-বিদআত সম্পর্কে মৌলিক জ্ঞান অর্জনের চেষ্টা করা। সবধরনের কুফরী ও বেদ্বীনী চিন্তা-চেতনা ও কর্মকাণ্ড থেকে আত্মরক্ষার জন্য এসব বিষয়ে প্রয়োজনীয় জ্ঞান অর্জনের চেষ্টা করা।
দুই. ইবাদত-বন্দেগীর দুরস্তি। ইসলামের ফরয ইবাদতগুলো, যেমন দৈনিক পাঁচ ওয়াক্ত নামায সময়মতো আদায় করা, সম্পদের যাকাত দেওয়া, রমযান মাসের রোযা রাখা, ফরয হজ্ব আদায় করা (এটা তো আল্লাহর রহমতে আদায় করা হয়েছে) ইত্যাদি বিষয়ে খুব যত্নবান হতে হবে। সুন্নতে মুআক্কাদার গুরুত্ব দিতে হবে। সাধ্যমত নফল আদায়ের চেষ্টা করতে হবে। এর পাশপাশি নিয়মিত কিছু পরিমাণে হলেও কুরআন তিলাওয়াত, বিভিন্ন সময়ের মাসনূন দুআ, কিছু পরিমাণে আল্লাহর যিকর ও ইস্তিগফার ইত্যাদি ইবাদতে মনোযোগী হলে ইনশাআল্লাহ অনেক খাইর ও বরকতের কারণ হবে।
তিন. লেনদেনে হারাম উপার্জন ত্যাগ করা এবং অন্যের পাওনা পরিশোধ করা অতি জরুরি। মনে রাখতে হবে, লেনদেনে হারাম ছাড়তে না পারলে দ্বীনদার হওয়া যায় না। সুদ, ঘুষ, ও অন্যান্য হারাম থেকে সম্পুর্ণরূপে মুক্ত হয়ে হালাল উপার্জনের চেষ্টা করতে হবে এবং হালাল উপায়ে যতটুকু উপার্জন হয় তাতেই সন্তুষ্ট থাকতে হবে।
চার. সমষ্টিগত জীবনের নীতি ও বিধান জেনে তা অনুসরণের চেষ্টাও জরুরি। এর সারকথা হল, প্রত্যেকের হক সম্পর্কে সচেতন হওয়া এবং তা আদায় করা। পিতা-মাতার হক, আত্মীয়-স্বজনের হক, পাড়া-প্রতিবেশীর হক, সহকর্মী ও দায়িত্বশীলের হক, সাধারণ মুসলমানের হক, এমনকি অমুসলিম ও পশু-পাখীর হকও ইসলামী শরীয়তের গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এ সম্পর্কে নির্ভুল জ্ঞান অর্জন করে সে অনুযায়ী নিজের কর্ম ও জীবন পরিচালিত করতে হবে।
পাঁচ. আখলাক তথা স্বভাব-চরিত্রের দুরস্তি। এটা ইসলামের অনেক বড় অধ্যায় এবং অনেক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। স্বভাবের ভালো প্রেরণা ও বৈশিষ্ট্যগুলো যেমন বিনয়, নম্রতা, ক্ষমাশীলতা, উদারতা, সংযম, পরোপকার, অন্যের হীত কামনা ইত্যাদি জাগ্রত ও কার্যকর করা এবং স্বভাবের মন্দ প্রবণতাগুলো যেমন অহংকার, ক্রোধ, কৃপণতা, অসংযম, অন্যের অনিষ্ট কামনা ইত্যাদি নিয়ন্ত্রণ করা একজন ভালো মানুষ হওয়ার বিকল্পহীন বিষয়।
আর এ তো স্বীকৃত কথা যে, একজন ভালো মুসলমান নিঃসন্দেহে একজন ভালো মানুষ। মানুষের স্বভাব-চরিত্র যেহেতু তার আচরণকে নিয়ন্ত্রণ করে তাই আচার-ব্যবহার সুন্দর হওয়ার জন্য স্বভাব-চরিত্র ভালো হওয়া জরুরি। একজন সাধারণ মানুষের অসৎ আচরণের চেয়ে একজন মুসল্লী বা একজন হাজ্বী ছাহেবের অসৎ আচরণ অধিক দৃষ্টিকটু। একারণে তাদের আচার-ব্যবহার সুন্দর ও শালীন হওয়া অধিক কাম্য।
তো জীবনের এই যে ধারা পরিবর্তন, তা কারো কারো কাছে অতি কঠিন, এমনকি অসম্ভবও মনে হতে পারে। বাস্তবেও তা অনেকের জন্য কঠিন তবে সংকল্প ও সৎসাহসের সাথে সঠিক উপায়ে অগ্রসর হলে তা অসম্ভব থাকে না। আল্লাহ রাব্বুল আলামীন বান্দার জন্য তা সহজ করে দেন। সেই সঠিক উপায়ের একটি হচ্ছে, ‘সাহচর্য’। বেদ্বীন লোকদের সংশ্রব ত্যাগ করে দ্বীনদার ভালো মানুষের সাহচর্য অবলম্বন করলে অনেক কিছুই সহজ হয়ে যায়।
মানুষের কর্ম ও আচরণের ক্ষেত্রে পরিবেশ-পারিপার্শ্বিকতা অনেক বড় প্রভাবক বিষয়। একারণে ইসলামে সৎসংগের খুব গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে।
দ্বিতীয় উপায় হচ্ছে, সঠিক সূত্র থেকে নির্ভুল জ্ঞান ও উপলব্ধি। দ্বীনের উপর চলার জন্য দ্বীনী ইলমের কোনো বিকল্প নেই। তাই হক্কানী আলিমদের সাথে সম্পর্ক গড়ে তোলা এবং তাদের পরামর্শ ও দিক-নির্দেশনায় দ্বীনের অতিপ্রয়োজনীয় ইলম অর্জনের পাশাপাশি সঠিক দ্বীনী রুচি, নির্ভুল উপলব্ধি, চিন্তা ও দৃষ্টিভঙ্গির স্বচ্ছতা অর্জনও অতি প্রয়োজন। এই পথে যদি জীবন গড়ার মেহনত জারি রাখা যায় তাহলে ইনশাআল্লাহ আল্লাহ রাব্বুল আলামীন এমন এক নির্মল, পবিত্র ও নতুন জীবনের সন্ধান দিবেন যার তুলনা পৃথিবীর কোনো সুখ-সম্পদের সাথেই হতে পারে না।
আল্লাহ রাব্বুল আলামীন আমাদের তাওফীক দান করুন। আমীন।