রোগীর সেবা-শুশ্রূষার ফজিলত ও প্রাসঙ্গিক কিছু কথা

মোঃ রুহুল আমিন খান


আল্লাহ তার ইবাদতের জন্য মানুষ ও জ্বিন জাতিকে সৃষ্টি করেছেন। আল্লাহর আদেশ মেনে রাসূল স.এর তরিকা মত যে কাজ করা হয় তাই ইবাদত।কিন্তু আমরা ইবাদতকে শুধু নামাজ,রোজা ও হজ্বের মধ্যেই সীমাবদ্ধ করে ফেলেছি।কিন্তু ইবাদত কেবল এই কয়েকটি আমলের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়।বরং এর পরিধি আরও ব্যাপক ও বিস্তৃত।

জনকল্যাণ বা মানবসেবামূলক সকল কাজও ইবাদতের অন্তর্ভুক্ত।কেননা আল্লাহ তায়ালা জন কল্যাণের জন্যই ধনীদের উপর যাকাত ফরয করেছেন।হযরত মুহাম্মাদ (স) সারা জীবন মানবসেবা ও জনকল্যাণ মূলক কাজ করেছেন। এবং এ কাজে তিনি তার উম্মতকে উৎসাহিত করেছেন।চিকিৎসা বা স্বাস্থ্যসেবা এ ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম নয়।ইসলাম ধর্মে রোগীদের সেবার গুরুত্ব ও ফজিলত অনেক ‏ বেশি।রাসূল এর জীবনী ও হাদিস পড়লে আমরা তা অনুধাবন করতে পারি।আবু মূসা আশ’আরী (রা:)হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন: তোমরা ক্ষুধার্তকে অন্ন দাও, রোগীর সেবা কর এবং কষ্টে পতিতকে উদ্ধার কর।(সহিহ বুখারী)

রোগীর সেবার মাধ্যমে দুনিয়ায় পার্থিব সম্বল যেমন অর্জিত হয় তেমনি আখিরাতের সম্বলও অর্জিত হয়।রাসূল (স.) বলেন , রোগীর সেবা শুশ্রূষাকারী বেহেশতের ফলমূল আহরণে রত থাকে, যতক্ষণ পর্যন্ত সে না প্রত্যাবর্তন করে।(সহীহ মুসলিম)

আর চিকিৎসকরা রোগীর সেবা করার মাধ্যমে অতি সহজে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করতে পারেন।কেননা রোগীর সেবা করা মানেই আল্লাহর সেবা করা।

আবু হুরায়রা( রা) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন,রাসূল (স) ইরশাদ করেন,
‘কেয়ামত দিবসে নিশ্চয় আল্লাহ তাআ’লা বলবেন, ‘হে আদম সন্তান, আমি অসুস্থ হয়েছিলাম, কিন্তু তুমি আমার শুশ্রূষা করো নি।’ বান্দা বলবে, ‘হে আমার প্রতিপালক। আপনি তো বিশ্বপালনকর্তা কিভাবে আমি আপনার শুশ্রূষা করব?’ তিনি বলবেন, ‘তুমি কি জানতে না যে, আমার অমুক বান্দা অসুস্থ হয়েছিল, অথচ তাকে তুমি দেখতে যাও নি। তুমি কি জান না, যদি তুমি তার শুশ্রূষা করতে তবে তুমি তার কাছেই আমাকে পেতে।?’ ‘হে আদম সন্তান, আমি তোমার কাছে আহার চেয়েছিলাম, কিন্তু তুমি আমাকে আহার করাও নি।’ বান্দা বলবে, ‘হে আমার রব, তুমি হলে বিশ্ব পালনকর্তা, তোমাকে আমি কীভাবে আহার করাব?’ তিনি বলবেন, ‘তুমি কি জান না যে, আমার অমুক বান্দা তোমার কাছে খাদ্য চেয়েছিল, কিন্তু তাকে তুমি খাদ্য দাও নি। তুমি কি জান না যে, তুমি যদি তাকে আহার করাতে বে আজ তা প্রাপ্ত হতে।?’ ‘হে আদম সন্তান, তোমার কাছে আমি পানীয় চেয়েছিলাম, অথচ তুমি আমাকে পানীয় দাও নি।’ বান্দা বলবে, ‘হে আমার প্রভু, তুমি তো রাব্বুল আলামীন তোমাকে আমি কীভাবে পান করাব?’ তিনি বলবেন, ‘তোমার কাছে আমার অমুক বান্দা পানি চেয়েছিল কিন্তু তাকে তুমি পান করাও নি। তাকে যদি পান করাতে তবে নিশ্চয় আজ তা প্রাপ্ত হতে।’ [মুসলিম : ৬৭২১; সহীহ ইবনে হিব্বান : ৭৩৬]

রোগীর সেবা করার মাধ্যমে আল্লার সেবার সুযোগকে ডাক্তার ও নার্সরা সর্বাধিক কাজে লাগাতে পারে।

অসুস্থ মানুষের সেবার মাধ্যমে আল্লাহর সেবা করার জন্য মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ আমাদের বাংলাদেশে ধর্মীয় বা অলাভজনক কোন হাসপাতাল নেই।যেখান থেকে রোগীরা কম খরচে ভাল মানের চিকিৎসা পেতে পারে। অন্যদিকে ভারতের তামিলনাড়ু প্রদেশের ভেতরে আছে খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বীদের বিখ্যাত ক্রিশ্চিয়ান মেডিকেল কলেজ (CMC)।যেখান থেকে ধর্ম, বর্ণ,নির্বিশেষে সকল শ্রেণীর মানুষ কম খরচে ভালো মানের চিকিৎসা সেবা পাচ্ছে।বাংলাদেশ থেকে প্রতিবছর অসংখ্য মানুষ চিকিৎসা নেওয়ার জন্য সিএমসি হাসপাতালে যায়।সেখানের চিকিৎসার মান কেমন এ বিষয়ে জানতে চাইলে সিএমসি থেকে চিকিৎসা নিয়ে ফিরে কুষ্টিয়ার আসিফ বলেন,”সি এম সির চিকিৎসা খরচ আমাদের দেশের (প্রাইভেট ) তুলনায় অনেক কম।তাছাড়া সেখানের রোগীর সাথে ডাক্তারের আচরণ আপন মা-বাবার আচরণের ন্যায় মানসিক প্রশান্তিদায়ক। যা আমাদের দেশের হাসপাতালে প্রত্যাশা করা বোকামি।”

সম্ভবত সেই জন্যই চিকিৎসা নিয়ে ফিরে আসা লোক জন সেখানের ডাক্তারদেরকে অকৃত্রিম শ্রদ্ধা করে।তাদের ধর্মের প্রতি একটা শ্রদ্ধাবোধ তৈরি হয়।কিন্তু আমাদের দেশে এমন কোন ধর্মীয় মেডিকেল কলেজ নেই (নাম মাত্র দু’একটা থাকতে পারে, কাজে নয়)।যদি থাকতো তাহলে নিম্নবিত্ত পরিবারের লোকজন যথাযথ চিকিৎসা সেবা থেকে বঞ্চিত হতো না।চিকিৎসা খরচ বহন করে মধ্যবিত্ত পরিবারের লোকজন সর্বস্বান্ত হতো না।

আমরা যদি বাংলাদেশে ইসলাম প্রচারের ইতিহাস পড়ি,তাহলে দেখতে পাই;খান জাহান আলীসহ অন্যান্য ইসলাম প্রচারকগণ মসজিদ নির্মাণের পাশাপাশি পুকুর খনন,রাস্তাঘাট ও বাঁধ নির্মাণ সহ নানা জনকল্যাণ মূলক কাজ করে মানবসেবা করেছেন, জনগণকে ইসলাম গ্রহণে উদ্বুদ্ধ করেছেন।

বর্তমানে দাওয়াতের বিষয়কে শুধু কয়েকটি ইবাদতের মধ্যেই সীমাবদ্ধ করে ফেলা হয়েছে।জনসেবা বা জন কল্যাণমূলক কাজে নবী করিম স.এর উৎসাহ ও অনুপ্রেরণা তেমন ভাবে তুলে ধরা হচ্ছে না।ফলে ‘ইসলাম পূর্ণাঙ্গ জীবন বিধান ‘ এ ধারনা মানুষের মন থেকে দিনদিন হ্রাস পাচ্ছে।তাই আমরা যারা দা’য়ী ইলাল্লাহর ভূমিকা পালন করি,তাদের উচিত আমাদের দাওয়াতের বিষয়কে শুধু কয়েকটি ইবাদতের মধ্যে সীমাবদ্ধ না রেখে জনকল্যাণ মূলক সকল কাজের গুরুত্ব ও ফজিলত তুলে ধরা।ডাক্তারের কানে পৌঁছে দেওয়া মানবসেবার গুরুত্ব ও ফজিলত।যাতে করে চিকিৎসকরা অসুস্থ রোগীদের বিনামূল্যে চিকিৎসা দানে উৎসাহবোধ করে।এবং সামর্থ্যবানরা মানবসেবার জন্য ক্রিশ্চিয়ান মেডিকেল কলেজ ( CMC) ন্যায় অলাভজনক হাসপাতাল প্রতিষ্ঠায় উদ্বুদ্ধ হয়।


লেখক – শিক্ষার্থী
ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগ
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা।

2 thoughts on “রোগীর সেবা-শুশ্রূষার ফজিলত ও প্রাসঙ্গিক কিছু কথা

  1. চমতকার পোস্ট! সত্যি ই একজন মুসলিন এর দায়িত্ব শুধুমাত্র নামাজসহ অন্যান্য ইবাদত এর মধ্যে ই সীমাবদ্ধনয়, বরং একজন মুসলিম এর দায়িত্ব অন্যান্য সৃষ্টির সেবা শুশ্রুষার মধ্যেও।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

%d bloggers like this: