অধ্যাপিকা আখতারা মাহবুবা । ।
তখন রমজান মাস, গভীর রাত। নবী (সা.) ধ্যানমগ্ন ছিলেন। হঠাৎ তিনি শুনতে পেলেন কেউ যেন তাঁর নাম ধরে ডাকছেন। ‘হে মুহাম্মদ,’ তিনি চোখ খুললেন, দেখলেন এক জ্যোতির্ময় ফেরেশতা সামনে দাঁড়ানো। তাঁর জ্যোতিতে হেরা গুহা আলোকিত।
তিনি বললেন, ‘আমি আল্লাহর বাণী বাহক জিব্রাইল ফেরেশতা- হে মুহাম্মদ, পাঠ করুন আপনার প্রভুর নামে যিনি সকল কিছু সৃষ্টি করেছেন।’
মহাসত্যের প্রথম উপলব্ধিতে তিনি অভিভূত হয়ে পড়েন। নবী (সা.) দ্রুত বিবি খাদিজার কাছে ছুটে গেলেন। বিবি খাদিজা তাঁর অস্থিরতা দেখে বললেন, আপনার ভয় পাওয়ার কোনো কারণ নেই।
আল্লাহ কখনও আপনাকে নিরাশ করবেন না। অতঃপর বিবি খাদিজা চাচাতো ভাই ওয়ারাকা বিন নওফেলের কাছে নবীজীকে নিয়ে গেলেন। তিনি ছিলেন পবিত্র ইঞ্জিল কিতাবের অনুসারী জ্ঞানতাপস। ওয়ারাকা বললেন, এটা সেই নিদর্শন যা মূসা ও ঈসার প্রতি প্রেরিত হয়েছিল। সংবাদ শুনে বিবি খাদিজার অন্তর তৃপ্ত হল।
হজরত খাদিজা (রা.) ঘরে ফিরে এসে নবী (সা.)-এর হাতে হাত রেখে আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করেন। আল্লাহর দ্বীন ইসলাম গ্রহণের প্রথম সাক্ষ্যদাতার গৌরব অর্জন করেন। তিনিই প্রথম মুসলমান।
আর দ্বিতীয় সাক্ষ্যদাতা হলেন কিশোর হজরত আলী। এর পরই ইসলামের দাওয়াতি কাজ গোপনে গোপনে চলতে লাগল। ইসলামের দাওয়াতের ষষ্ঠ বছরের শেষপ্রান্তে মক্কার কাফের মুশরিকদের অত্যাচার চরম আকার ধারণ করলে হজরত আবু তালিব মুহাম্মদ (সা.) স্বগোত্রীয় লোকদের সঙ্গে নিয়ে গিরিপর্বতে আশ্রয় নেন। যা ‘শেবে আবু তালিব’ নামে পরিচিত। সংকীর্ণ গিরিপথে তিনটি বছর অতিবাহিত করা যে কষ্টকর ছিল তা বর্ণনাতীত। মক্কা ত্যাগ করে গিরিপথে আশ্রয় নেয়া ইমানদার ছিল প্রায় চারশ’।
হজরত খাদিজা তুল কুবরা (রা.) বিলাসবহুল জীবনযাপনে অভ্যস্ত হলেও গিরিপথে তার স্থিরভাবনার জীবন ছিল ইসলামের জন্য ত্যাগের। অবরোধের শুরুতে হজরত আলীর বয়স ছিল ষোলো।
কিন্তু তার সমগ্র প্রচেষ্টাই ছিল অবরুদ্ধ গোত্রের জন্য খাদ্যসামগ্রী গোপনে সংগ্রহ করা। মাত্র এক মশক পানির জন্যও ব্যয় হতো একটি স্বর্ণমুদ্রা। পানির জন্য শিশুরা সব সময় কাতর থাকত। হজরত খাদিজা ত্যাগ ও ইবাদতের মাধ্যমে আল্লাহর সাহায্য প্রার্থনা করতেন।
এই তিন বছরের অবরোধে হজরত খাদিজা (রা.)-এর বিশাল ধন-সম্পদ প্রায় শেষ পর্যায়ে চলে আসে। হজরত খাদিজা নবীজীর মক্কা থেকে আবিসিনিয়ায় হিজরতের সম্পূর্ণ ব্যয়ভার বহন করেছিলেন। হজরত মুহাম্মদ (সা.) হজরত খাদিজা (রা.)-এর সব সম্পদ ইসলামের পথে ব্যয় করেন। মানব জাতির ইতিহাসে এর চেয়ে সর্বশ্রেষ্ঠ বিনিয়োগ আর একটিও নেই।
অবরোধের বছরগুলোতে হজরত খাদিজা (রা.) ঈমানদারদের প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র সংগ্রহ করতে গিয়ে সব সম্পদ ব্যয় করেছিলেন। এমনকি তার মৃত্যুর পর কাফনের কাপড় কেনার অর্থও তার ঘরে ছিল না।
প্রিয় স্বামীর চাদর তার দাফন হিসেবে ব্যবহৃত হয়। হজরত মা খাদিজা (রা.) ৬১৯ খ্রি. মৃত্যুবরণ করেন। তার মৃত্যুর প্রায় এক মাস পর মুহাম্মদ (সা.)-এর চাচা, অভিভাবক ও ইসলামের শুভাকাক্সক্ষী হজরত আবু তালিবের মৃত্যু।
ইসলামের এই অকৃত্রিম বন্ধুদ্বয়ের মৃত্যু ছিল আল্লাহর নবী মুহাম্মদ (সা.)-এর জন্য সবচেয়ে বেশি শোকাবহ ঘটনা। তিনি তাদের মৃত্যুর বছরকে ‘শোকের বছর’ হিসেবে ঘোষণা করেছিলেন। ইসলামের জন্য উম্মুল মুমেনিন হজরত খাদিজা আত্ তাহিরার (রা.) ত্যাগ মুমিন হৃদয়ে ইতিহাস। তার মহান ত্যাগ বিজয়ে জোয়ার এনেছিল।
আল্লাহ তায়ালার পক্ষ থেকে হজরত খাদিজা (রা.) ও মুহাম্মদ (সা.)-এর জন্য সর্বশ্রেষ্ঠ উপহার ছিল তাঁদের কন্যা ‘ফাতিমা যাহ্রা’। মা ফাতিমা তার দুই ভাই কাসিম ও আব্দুল্লাহর মৃত্যুর পর জন্মগ্রহণ করেছেন। যখন তার মাতা হজরত খাদিজা (রা.) মৃত্যুবরণ করেন তখন তার বয়স ছিল মাত্র পাঁচ বছর। আল্লাহর রাসূল মুহাম্মদ (সা.) ফাতিমার মা ও বাবার ভূমিকা পালন করেন।
ইসলাম যে চারজন নারীকে তাদের মহানুভবতা ও পরিশুদ্ধতার জন্য নারীদের মধ্যে শীর্ষস্থান দান করেছে তাদের এই উচ্চ মর্যাদা পরিমাপের কারণ হল, আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের প্রতি তাদের সেবা কর্ম। মুহাম্মদ (সা.) এভাবে চার নারীকে পরিচয় করিয়ে দেন- (১) ফেরাউনের স্ত্রী হজরত আছিয়া, (২) হজরত ঈসা (আ.)-এর মা হজরত মরিয়ম, (৩) হজরত খাদিজা বিনতে খুয়াইলিদ, (৪) হজরত ফাতিমা বিনতে মুহাম্মদ।
আজকের মুসলিম দুনিয়া ও মুসলিম নারী সমাজ হজরত খাদিজাতুল কুবরা (রা.), হজরত ফাতিমা যাহ্রা এবং হজরত আলী র্কারামাল্লাহুর আদর্শ নীতি থেকে অনেক দূরে সরে গেছে। আমরা যদি ইসলামকে ধারণ করতে চাই তাহলে আমাদের সার্বিক জীবনে তাদের অনুসরণ করতে হবে।
লেখক : অধ্যাপক