ঘুমের কতিপয় সুন্নত ও আদব

মাওলানা আনওয়ার হুসাইন 

ঘুম আল্লাহ তাআলার অনেক বড় নিআমত। বান্দার প্রতি আল্লাহ তাআলার এক বিশেষ অনুগ্রহ ও দান। সুস্থ ও স্বাভাবিক জীবন যাপনের জন্য ঘুমের বিকল্প নেই। শারীরিক-মানসিক ক্লান্তি ও অবসাদ দূর করতে এই পৃথিবীতে আল্লাহ তাআলা ঘুমকে অন্যতম প্রধান মাধ্যম বানিয়েছেন।

দিনভর ক্লান্তিকর চলাফেরার পর মানুষ যখন নিস্তেজ হয়ে পড়ে; কর্মক্ষম মানুষ অক্ষম হয়ে পড়ে, শক্তিমান মানুষ দুর্বল হয়ে পড়ে, সে সময় এ নিআমতই হয়ে ওঠে তার একমাত্র অবলম্বন, যার মাধ্যমে সে শারীরিক ও মানসিক প্রশান্তি লাভ করে। ফিরে পায় পরবর্তী দিবসের জন্যে নতুন প্রাণশক্তি ও নবতর উদ্যম।

কোনো ব্যক্তি যত প্রখর মেধারই অধিকারী হোক, যত শক্তিশালীই হোক-কেবল দু-একটি রাত বিনিদ্র কাটলে বা নিয়মতান্ত্রিক ঘুমের ব্যাঘাত ঘটলে  মেধাশক্তি অকেজো হয়ে যায়। আচার-আচরণে, চলা-ফেরায় এবং কথাবার্তা ও কাজেকর্মে ভারসাম্য নষ্ট হয়ে যায়। বস্তুত এ নিআমতের কদর সে-ই সর্বাধিক বুঝতে পেরেছে, যার রাত কাটে নিদ্রাহীন; বিভিন্ন ব্যবস্থাপত্র গ্রহণের পরও আরামের বিছানায় এপাশ ওপাশ করে যার রাত ভোর হয়।

আমরা কি কখনো ভেবে দেখেছি, আল্লাহ তাআলার কী মহান নিআমত নিয়মিত ভোগ করে যাচ্ছি? অবিরত তাঁর কত বড় অনুগ্রহ লাভ করে যাচ্ছি!

ঘুমের রয়েছে কিছু সুন্নত ও আদাব। নিচে তার কিছু উল্লেখ করা হল-

 

এক. ঘুমের পূর্বে ওযু করা

ঘুমের পূর্বে ওযু করে নেয়া উত্তম। হাদীস শরীফে এসেছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন- যখন তুমি বিছানায় গমন করবে তখন নামাযের ওযুর মতো ওযু করে নাও। -সহীহ বুখারী, হাদীস ২৪৭

মুজাহিদ রাহ. বলেন, আমাকে আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা. বলেন- তুমি অযু ছাড়া ঘুমুতে যাবে না। কেননা সকল রূহ পুনরুত্থিত হবে ঐ অবস্থার ওপর যে অবস্থায় তা কবজ করা হয়েছে। -জামে মা‘মার ইবনে রাশেদ।

 

দুই. ঘুমের পূর্বে বিছানা ঝেড়ে নেয়া

ঘুমের পূর্বে বিছানা ঝেড়ে নেয়া মুস্তাহাব। আবু হুরায়রা রা. হতে বর্ণিত তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন-

যখন তোমাদের কেউ বিছানায় শয্যা গ্রহণ করতে যায়, সে যেন তার লুঙ্গির/চাদরের ভেতর দিক দিয়ে নিজ বিছানা ঝেড়ে নেয়। কারণ তার জানা নাই যে, বিছানার উপর তার অনুপস্থিতিতে পীড়াদায়ক কোনো কিছু পড়েছে কি না।’ -সহীহ বুখারী, হাদীস ৬৩২০

এজন্য ঘুমাতে যাওয়ার পূর্বে বিছানা ভালোভাবে ঝেড়ে নিয়ে পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন বিছানায় ঘুমাতে হবে। বিছানা পরিষ্কারের জন্য কোনো কাপড় বা বিছানার ঝাড়– দিয়েও পরিষ্কার করতে কোনো অসুবিধা নেই। হাদীস শরীফে যে লুঙ্গির কথা এসেছে মুহাদ্দিসীনে কেরাম এর কারণ ব্যক্ত করেছেন এই যে, সে সময় সাহাবায়ে কেরামের নিকট বাড়তি কাপড় ছিল না। যে কারণে পরিধেয় কাপড়ই বিছানা ঝাড়ার কাজে ব্যবহার করা হত।

 

তিন. ঘুমের পূর্বে চুলা, মোম বাতি ইত্যাদি নিভিয়ে দেয়া

ঘরে চুলা জ্বালানো থাকলে বা মোমবাতি, কয়েল ইত্যাদি জ্বালানো থাকলে যা থেকে অসাবধানতাবশত আগুন লাগার আশঙ্কা থাকে, ঘুমের পূর্বে তা নিভিয়ে ফেলা। এগুলো জ্বালানো রেখে ঘুমানো নিষেধ। হাদীস শরীফে এসেছে, আবদুল্লাহ ইবনে উমর রা. হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন-

তোমরা যখন ঘুমাতে যাবে ঘরে আগুন জ্বেলে রাখবে না। -সহীহ মুসলিম, হাদীস ২০১৫

আবু মূসা আশআরী রা. হতে বর্ণিত তিনি বলেন-

একবার রাতে মদিনার এক ঘরে আগুন লেগে ঘরের লোকজনসহ পুড়ে গেল। এদের অবস্থা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে অবহিত করা হল। তিনি বললেন এ আগুন নিঃসন্দেহে তোমাদের শত্রু। সুতরাং তোমরা যখন ঘুমাতে যাবে তখন তা নিভিয়ে দিবে। -সহীহ বুখারী, হাদীস ৬২৯৪

 

চার. পাত্র, মশক ইত্যাদির মুখ ঢেকে রাখা

ইসলামের শিক্ষা হল খাবার এবং পানপাত্র ব্যবহারের পর তা ঢেকে রাখা। খোলা না রাখা। যেন ময়লা আবর্জনা থেকে সুরক্ষিত থাকে এবং কীট-পতঙ্গ ইত্যাদির বিচরণ থেকে হেফাযত থাকে। বিশেষত রাতে শয্যাগ্রহণের পূর্বে এসব পানাহারের পাত্র ঢেকে রাখার প্রতি শরীয়তের বিশেষ নির্দেশ এসেছে। আল্লাহ তাআলা এর বরকতে বিভিন্ন ধরনের মহামারী রোগ বালাই থেকে হেফাযত করেন। হাদীস শরীফে এসেছে, জাবের ইবনে আবদুল্লাহ রা. হতে বর্ণিত তিনি বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলতে শুনেছি-

তোমরা রাতে বাসনগুলো ঢেকে রাখবে, মশকগুলোর মুখ আটকে রাখবে। কারণ বছরে একটি রাত এমন আছে, যে রাতে মহামারী অবতীর্ণ হয়। যে কোনো খোলা পাত্র এবং বন্ধনহীন মশকের ওপর দিয়ে তা অতিবাহিত হয়, তাতেই সে মহামারী নেমে আসে।-সহীহ মুসলিম, হাদীস ৫১৫০

 

পাঁচ. পাত্র মশক ইত্যাদির মুখ বন্ধ করার সময় বিসমিল্লাহ বলা

নবীজী ইরশাদ করেন-

আর তোমরা আল্লাহর নাম নিয়ে মশকের মুখ বন্ধ করবে এবং আল্লাহর নাম নিয়ে তোমাদের পাত্রগুলোকে ঢেকে রাখবে, অন্তত পাত্রগুলোর ওপর কোনো বস্তু আড়াআড়ি করে রেখে হলেও। আর শয্যাগ্রহণের সময় তোমরা তোমদের বাতিগুলো নিভিয়ে দাও।

 

ছয়. সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসলে শিশুদেরকে ঘর হতে বের না করা

রাত যখন আগমন করে এসময় শয়তান ও দুষ্টু জিনেরা সদলবলে যমীনে ছড়িয়ে পড়ে। এবং মানুষকে বিভিন্ন উপায়ে অনিষ্টতা পৌঁছানোর চেষ্টা করে থাকে। বিশেষত শিশুদেরকে। বদ নযর, বদ আছর ও ভয় ভীতি দ্বারা বিভিন্ন ক্ষতি করতে চেষ্টা করে। এসময়টা অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ। শিশুদেরকে এ সময় ঘর হতে বের হতে দেয়া ঠিক নয়। হাদীস শরীফে তা থেকে বারণ করা হয়েছে। হযরত জাবের ইবনে আবদুল্লাহ রা. হতে বর্ণিত তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন-

যখন রাতের আঁধার নেমে আসবে অথবা বলেছেন, যখন সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসবে তখন তোমরা তোমাদের শিশুদেরকে আটকে রাখবে। কেননা এ সময় শয়তানেরা ছড়িয়ে পড়ে। আর যখন রাতের কিছু অংশ অতিক্রান্ত হবে তখন তাদেরকে ছেড়ে দিতে পার। -সহীহ বুখারী, হাদীস ৩৩০৪

হাদীসের নির্দেশ না মানার কারণে অজান্তে আমরা শিশুদেরকে ক্ষতির মুখে ঠেলে দেই। এরপর আমরা বিভিন্ন তাবীজ তদবীরের পেছনে ছুটাছুটি করি। তবে একান্ত প্রয়োজনে বের হতে হলে হেফাযতের দুআ ইত্যাদি পড়ে আল্লাহ তাআলার ওপর ভরসা করে বের হওয়া যায়।

 

সাত. ঘর বাড়ীর দরজা বিসমিল্লাহ বলে বন্ধ করা

ঘর বাড়ীর দরজা বন্ধ করার সময় বিসমিল্লাহ বলা সুন্নত। আফিয়াত ও নিরাপত্তা বড় নিআমত। সকল মানুষই জান-মাল ও সহায়-সম্পদের নিরাপত্তা কামনা করে। এর জন্য পার্থিব বিভিন্ন উপায় অবলম্বন করে থাকে। বাহ্যিক নিরাপত্তা ব্যবস্থা গ্রহণ ইসলামে নিষেধ নয়; বরং তা কাম্য। কিন্তু জানা দরকার যে, প্রকৃত নিরাপত্তা আল্লাহ তাআলার হাতে। পার্থিব উপায় উপকরণ সবকিছু আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের হুকুমের অধীন। তাই এগুলো প্রকৃত নিরাপত্তা নয়। সুন্নাহর শিক্ষা হল বান্দার সবকিছু আল্লাহ তাআলার নিকট অর্পণ করে দেয়া। আমাদের  যত শক্তিশালী প্রাচীর ও দরজাই থাক না কেন এগুলো প্রকৃত নিরাপত্তা দিতে পারবে না। নিরাপত্তা কেবল নিরাপত্তার মালিকই দিতে পারেন। তাই তার নাম নিয়ে দরজা বন্ধ করতে হবে। আল্লাহর নাম নিয়ে যে দরজা বন্ধ করল সে তো তার ঘর পরিবার পরিজনের নিরাপত্তা আল্লাহর হাতে ন্যস্ত করে দিল। সাধ্য আছে কারো এ নিরাপত্তার বুহ্য ভেদ করার!

হাদীস শরীফে দরজা বন্ধ করতে বিসমিল্লাহ বলতে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। প্রিয় নবীজী বলেন-

তোমরা আল্লাহ্র নাম নিয়ে দরজা বন্ধ করবে। কেননা শয়তান বন্ধ দরজা খুলতে পারে না। -সহীহ বুখারী, হাদীস ৩৩০৪

 

আট. ঘুমের পূর্বে কিছু দুআ-আযকার

ঘুমের পূর্বে তিন কুল পড়া মুস্তাহাব। অত্যন্ত প্রয়োজনীয় ও উপকারী আমল। এতে বান্দা যেমন আল্লাহ্র ওয়াহদানিয়াত অর্থাৎ একত্বের স্বীকারোক্তি  এবং শিরক থেকে মুক্তির ঘোষণা প্রদান করে তেমনি আঁধার রাতের সবধরনের অনিষ্টতা ও ক্ষতি হতে আফিয়াত ও নিরাপত্তার জন্য বান্দা নিজেকে আল্লাহ্র হাতে সঁপে দেয়। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিয়মিত এ আমল করতেন। আয়েশা রা. হতে বর্ণিত তিনি বলেন-

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম প্রতি রাতে যখন বিছানায় গমন করতেন তখন তিনি সূরা ইখলাস সূরা ফালাক ও সূরা নাস পাঠ করে দুহাত একত্র করে তাতে ফুঁক দিতেন। অতঃপর যতদূর সম্ভব সমস্ত শরীরে হাত বুলাতেন। মাথা ও মুখ থেকে আরম্ভ করে তাঁর দেহের সম্মুখ ভাগের ওপর হাত বুলাতেন এবং তিনবার তিনি এরূপ করতেন। -সহীহ বুখারী, হাদীস ৫০১৭

নিজে এ আমল করা এবং শিশুদেরকে তা শিক্ষা দেয়া। শিশুরা এ সূরাসমূহ না জানলে পিতা মাতা নিজে পড়ে হাতে ফুঁক দিয়ে শিশুদের গায়ে হাত বুলিয়ে দিতে পারেন। এতে ইনশাআল্লাহ আমলের উপকারিতা তারাও লাভ করবে।

 

ঘুমের পূর্বে আয়াতুল কুরসী পাঠ করা

আয়াতুল কুরসী অত্যন্ত ফযীলতপূর্ণ একটি আয়াত। হাদীসের ভাষ্য অনুযায়ী কুরআন মাজীদের সর্বাধিক ফযীলতপূর্ণ আয়াত এটি। রাতে ঘুমানোর  পূর্বে আয়াতুল কুরসী পড়া হলে তার জন্য আল্লাহ তাআলা একজন ফিরিশতা নিযুক্ত করে দেন। যিনি পূর্ণ রাত তার নিরাপত্তায় নিয়োজিত থাকেন। সহীহ বুখারীতে আবু হুরায়রা রা. হতে একটি দীর্ঘ হাদীসে এসেছে-

যখন তুমি শয্যা গ্রহণ করবে তখন আয়াতুল কুরসী পাঠ করবে। তাহলে সর্বদা আল্লাহ্র পক্ষ হতে তোমার জন্য একজন হেফাযতকারী থাকবে এবং সকাল পর্যন্ত তোমার নিকট শয়তান আসতে পারবে না। -সহীহ বুখারী, হাদীস ৫০১০

সূরা কাফিরূন পাঠ করা

সুনানে আবী দাউদে হযরত নাওফাল আশজায়ী রা. হতে বর্ণিত তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাকে বলেছেন-

তুমি قُلْیٰۤاَیُّهَاالْكٰفِرُوْنَ সূরাটি পড়ে ঘুমাও। কেননা তা শিরক থেকে মুক্তকারী। -সুনানে আবী দাউদ, হাদীস ৫০৫৫

সূরা বাকারার শেষ দুই আয়াত পড়া

আবু মাসঊদ রা. হতে বর্ণিত তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন-

যে ব্যক্তি রাতে সূরা বাকারার শেষ দুটি আয়াত পাঠ করবে তার জন্য তা-ই যথেষ্ট হবে। -সহীহ বুখারী, হাদীস ৫০০৯

 

নয়. ডান কাত হয়ে শোয়া

ডান কাত হয়ে শোয়া সুন্নত। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ভালো ও তুলনামূলক উত্তম কাজে ডানকে প্রাধান্য দিতেন। শয্যা গ্রহণের ক্ষেত্রেও  তাই। বারা ইবনে আযেব রা. হতে বর্ণিত তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাকে বললেন:

যখন তুমি শোয়ার বিছানায় যেতে চাও তখন তুমি নামাযের ওযুর মত ওযু করো এরপর ডান পাশর্^দেশের ওপর কাত হয়ে শুয়ে পড়ো। আর এ দু‘আ পড়ো-

(‘হে আল্লাহ! আমি আমার নিজেকে তোমারই কাছে অর্পণ করছি। আমার চেহারাকে তোমার দিকে ফিরাচ্ছি। আমার সকল বিষয় তোমার নিকট সোপর্দ করছি এবং আমার পৃষ্ঠদেশ তোমার কাছে সঁপে দিচ্ছি। তোমার গযবের ভয়ে ভীত এবং তোমার রহমতের আশায় আশান্বিত হয়ে। তুমি ছাড়া কোনো আশ্রয়স্থল নেই এবং  নেই মুক্তি পাওয়ার স্থান। তুমি যে কিতাব অবতীর্ণ করেছ এবং নবী… করেছ আমি তার ওপর ঈমান এনেছি।)

নবীজী বলেন-

যদি তুমি এ রাতেই মৃত্যুবরণ করো তোমার সে মৃত্যু স্বভাবধর্ম ইসলামের ওপরই গণ্য হবে। আর যদি (জীবিত থেকে) তোমার ভোর হয় তুমি প্রতিদান পাবে। -সহীহ বুখারী, হাদীস ৭৪৮৮

অপর বর্ণনায় এসেছে-

অতএব তোমার এ দুআ গুলো যেন তোমার এ রাতের সর্বশেষ কথা হয়। -সহীহ বুখারী, হাদীস ৬৩১১

 

দশ. ঘুমের দুআ পড়া এবং ডান গালের নিচে ডান হাত রাখা

হাদীস শরীফে ঘুমের সময়ের বিভিন্ন দুআ যিকির-আযকার ও অযীফার কথা বর্ণিত হয়েছে। বিস্তারিত জানার জন্য আওরাদ আযকারের কিতাব দেখে নেয়া যেতে পারে।

হযরত হুযাইফা রা. হতে বর্ণিত তিনি বলেন- রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন শয্যা গ্রহণ করতেন তিনি তাঁর হাতকে গালের নিচে রাখতেন এরপর বলতেন-

হে আল্লাহ আপনার নামেই মৃত্যুবরণ করি আপনার নামেই জীবিত হই। আর যখন ঘুম থেকে উঠতেন তখন বলতেন-সহীহ বুখারী, হাদীস ৬৩১৪

মুসনাদে আহমাদ-এ বারা ইবনে আযিব রা. হতে বর্ণিত তিনি বলেন-  নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন শয়ন করতেন তখন তার ডান হাত গালের নিচে রেখে বলতেন-

হে আল্লাহ আপনি যখন আপনার বান্দাদেরকে কবর থেকে উঠাবেন সেদিন আমাকে আপনার আযাব থেকে রক্ষা করুন। -মুসনাদে আহমাদ, হাদীস ১৮৬৬০; সুনানে আবী দাউদ, হাদীস ৩৮৭৭

 

এগারো. উপুড় হয়ে না শোয়া

অনেকে উপুড় হয়ে শোয়। এভাবে পেটের ওপর উপুড় হয়ে শোয়া পছন্দনীয় নয়। আবু হুরায়রা রা. হতে বর্ণিত তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এক ব্যক্তিকে পেটের ওপর উপুড় হয়ে শুতে দেখে বললেন-

নিশ্চয় আল্লাহ তাআলা এরকম শোয়া পছন্দ করেন না। -জামে তিরমিযী, হাদীস ২৭৬৮

 

বারো. ঘুমের মাঝে দুঃস্বপ্ন দেখলে

ঘুমে অনেকে খারাপ বা ভীতিকর স্বপ্ন দেখে থাকে। এটা অস্বাভাবিক কিছু নয়। এ ধরনের স্বপ্ন দেখলে কী করণীয় তা হাদীস শরীফে সুন্দরভাবে বলে দেয়া হয়েছে। এ সম্পর্কিত সুন্নাহর  নির্দেশনাগুলো মানা হলে তা নিয়ে দুশ্চিন্তার কিছু নেই।

সহীহ মুসলিমে আবু কাতাদা রা.-এর সূত্রে বর্ণিত হয়েছে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন-

ভালো স্বপ্ন আল্লাহ্র তরফ থেকে আর মন্দ স্বপ্ন শয়তানের তরফ থেকে। সুতরাং যে ব্যক্তি কোনো স্বপ্ন দেখল আর এতে কোনো কিছু তার অপছন্দনীয় মনে হল তখন সে যেন তার বাম পাশে (সামান্য) থু থু ফেলে এবং শয়তানের অনিষ্ট হতে আল্লাহর আশ্রয় প্রার্থনা করে। তাহলে তা তার জন্য অনিষ্টকারী হবে না। আর কারো কাছে ঐ স্বপ্নের কথা বর্ণনা করবে না। আর যদি কোনো ভালো স্বপ্ন দেখে তাহলে সু-সংবাদ গ্রহণ করবে। আর যাকে সে পছন্দ করে এমন ব্যক্তি ছাড়া কারো নিকট তা বর্ণনা করবে না। -সহীহ মুসলিম, হাদীস ৫৭৯৫

সহীহ মুসলিমের অপর বর্ণনায় এসেছে-

দুঃস্বপ্ন দেখলে সে যেন পাশ পরিবর্তন করে নেয়। -সহীহ মুসলিম, হাদীস ২

হাদীস থেকে একটি বিষয় স্পষ্ট হয়ে গেল যে, ভালো স্বপ্ন আল্লাহ তাআলার পক্ষ থেকে হয় আর খারাপ বা দুঃস্বপ্ন শয়তানের পক্ষ থেকে হয়। আরো জানা গেলো দুঃস্বপ্ন দেখলে করণীয় কী। তা হল প্রথমত বাম পাশে থু থু নিক্ষেপ করা দ্বিতীয়ত শয়তান হতে আল্লাহ তাআলার আশ্রয় প্রার্থনা করা। এক্ষেত্রে আমরা আউযু বিল্লাহ (পুরোটা) পড়তে পারি। তৃতীয়ত এ সম্পর্কে কাউকে অবহিত না করা। চতুর্থত পাশর্^ পরিবর্তন করে নেয়া।

 

তেরো. ঘুম থেকে জাগ্রত হওয়ার পর দুআ

ঘুম থেকে জাগ্রত হয়ে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলতেন-

সকল প্রশংসা আল্লাহ্র জন্য যিনি মৃত্যুর পর আমাদের জীবন দান করলেন এবং আমরা পুনরুত্থিত হয়ে তাঁরই কাছে যাব। -সহীহ বুখারী, হাদীস ৬৩১৪

 

চৌদ্দ. নিশ্চিত কবুল দুআ ও নামায কবুলের আমল

উবাদা ইবনে সামেত রা. হতে বর্ণিত তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন যে ব্যক্তি রাতে ঘুম থেকে জাগ্রত হয়ে বলবে-

এরপর বলবে اللَّهُمَّ اغْفِرْلِي ‘হে আল্লাহ আমাকে মাফ করে দিন’ অথবা অন্য কোনো দুআ পড়বে তার দুআ কবুল করা হবে।

অতঃপর সে যদি ওযু করে এবং নামায আদায় করে তার নামায কবুল করা হবে। -সহীহ বুখারী, হাদীস ১১৫৪

উক্ত হাদীস থেকে নিশ্চিত কবুল দুআ ও নামায কবুল হওয়ার অতি মূল্যবান একটি আমল আমাদের জানা হল। ঘুম থেকে জাগ্রত হয়েই বান্দার পাপমুক্ত হওয়ার কত চমৎকার এক আমল। প্রথম আমলটির জন্য তো ওযুরও দরকার নেই। বরং

দুআটি পড়া। অতঃপর আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের কাছে পাপমুক্তির জন্য দুআ বা অন্য কোনো দুআ করা।

দ্বিতীয় কাজটি হলো ওযু করা এবং সুবহে সাদিকের পূর্বে দু চার রাকাত তাহাজ্জুদ আদায় করা। উক্ত আমলের পর এ নামাযও হাদীসের ভাষ্য অনুযায়ী নিশ্চিত কবুল।

 

যথাসময়ে ঘুম থেকে ওঠে ফজর নামায আদায় করা

হাদীস শরীফে এসেছে যে ব্যক্তি ইশা ও ফজরের নামায জামাতের সাথে আদায় করে তার পূর্ণ রাত ইবাদতে কাটানোর সওয়াব লাভ হয়। ইশাতো সাধারণত মসজিদেই আদায় করা  হয়ে থাকে। কিন্তু ফজরের জামাত কারো কারো ঘুমের কারণে ছুটে যায়। আল্লাহ মাফ করুন কখনো কাযাও হয়ে যায়। ফজর ঘুমে ছুটে যাওয়াটা খুবই অন্যায়। গোটা দিনের বরকত নষ্ট হয়ে যায়। শয়তানের ফাঁদে সে ফেঁসে যায়। হাদীস শরীফে এসেছে, এক ব্যক্তি সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সামনে আলোচনা করা হল যে, সে সকাল বেলা পর্যন্ত ঘুমিয়েই কাটিয়েছে নামাযের জন্য সে জাগ্রত হয়নি। তখন তিনি ইরশাদ করলেন-

শয়তান তার কানে পেশাব করে দিয়েছে। -সহীহ বুখারী, হাদীস ১১৪৪

অপর হাদীসে এসেছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন-

তোমদের কেউ যখন ঘুমিয়ে পড়ে তখন শয়তান তার ঘাড়ের পশ্চাদাংশে তিনটি গিঁঠ দেয়। প্রতি গিঁঠে সে এ বলে চাপড়ায় যে, তোমার সামনে রয়েছে দীর্ঘ রাত। অতএব তুমি শুয়ে থাক। অতঃপর সে যদি জাগ্রত হয়ে আল্লাহকে স্মরণ করে একটি গিঁঠ খুলে যায়। ওযু করলে আরেকটি গিঁঠ খুলে যায়। অতঃপর নামায আদায় করলে আরেকটি গিঁঠ খুলে যায়। তখন তার প্রভাত হয় উদ্যম ও আনন্দের সাথে। অন্যথায় সে প্রভাত করে অলস ও মনমরা হয়ে। -সহীহ বুখারী, হাদীস ১১৪২

আল্লাহ তাআলা আমাদের সবাইকে দ্বীনের প্রতিটি ক্ষেত্রে নাশীত ও উদ্যমী করুন। সবধরনের অলসতা ও কলুষতামুক্ত জীবন দান করুন। জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে সুন্নাহ অনুসরণের তাওফিক দিন-আমীন ইয়া রাব্বাল আলামীন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *