আমাকে বলা হয়েছে যে, আলোচনার জন্য নির্দিষ্ট কোনো বিষয় নির্ধারিত নেই। তাই আমি ভাবলাম, আমার নিজের জন্য এবং আমার সব সাথীর জন্য দুটি কথা আরয করছি। যিন্দেগীতে তারাক্কীর ক্ষেত্রে এবং ঈমান-আমল-আখলাক ও চিন্তা-চেতনার তারাক্কীর ক্ষেত্রে বাধা তো অনেক। তন্মধ্যে দুটি বাধার কথা আমার যেহেনে বেশি আসে এবং আমার দেমাগকে তা আচ্ছন্ন করে রাখে। একটি বাধা যা আমি প্রায় বলেও থাকি। তা হল السطحية I التشمية যা الجديةএর বিপরীত।
মানুষের যিন্দেগী ‘জিদ্দ’ হওয়া উচিত অর্থাৎ সুচিন্তিত ও উদ্যমপূর্ণ হওয়া উচিত। অবহেলার যিন্দেগী, গাফলতের যিন্দেগী, মুর্দা যিন্দেগী আর লাগামহীন যিন্দেগী-এটা তালিবে ইলমের যিন্দেগী হতে পারে না; বরং তালিবে ইলমের যিন্দেগী হবে সুচিন্তিত ও ‘নশীত। নাশাতের যিন্দেগীর বিপরীত হল হাযলের যিন্দেগী।
ثلاثة جدهن جد وهزلهن جد
ছালাছাতুন এর মধ্যে এটা নেই। আমার হায়াতকে আমি হাযলের বানাব আর তা খোদ-বখোদ জিদ্দ হয়ে যাবে? আমার হায়াত যদি জিদ্দ হয় তাহলে তা জিদ্দ হবে। আর যদি একেবারে হাযলের হায়াত বানাই তাহলে তা জিদ্দ হবে না, হাযল হবে।
হাযলের যিন্দেগী মানে যে যিন্দেগীতে কোনো ফিকির নেই, মুহাসাবা নেই, মুরাকাবা নেই। মুহাসাবা, মুরাকাবা ও ফিকিরহীন যিন্দেগীর নাম হাযলের যিন্দেগী। আর জিদ্দিয়্যাত হল সব জিনিসকে গুরুত্বের সাথে গ্রহণ করা, নিজের মুহাসাবা করতে থাকা। সবকিছুকে গুরুত্বের সাথে নেওয়া ও মুহাসাবা জারি রাখা-এরই নাম জিদ্দিয়্যাতের যিন্দেগী। আর এর বিপরীত হল হাযলের যিন্দেগী।
আর এই হাযলের আছর হল, গতানুগতিকতা। তাই যার যিন্দেগীতে জিদ্দিয়্যাত আছে সে কখনো গতানুগতিকতা বরদাশত করতে পারে না। কারণ সেটাতো হাযলের ফলাফল।
জিদ্দিয়্যতের আছর হবে, মুহাসাবা-মুরাকাবা-নাশাত-আযীমত-হিম্মত ও মুনাফাসাত ফিল খায়র। এগুলো জিদ্দিয়্যতের ফলাফল।
আমার দরখাস্ত হল, আমরা এই হাযলের মারায বা ব্যাধিটি দূর করার চেষ্টা করি। হাযলের মারায দূর করি এবং হায়াতকে নাশাত ও জিদ্দিয়্যতের হায়াত বানাই। গাফলত ও উদাসীনতা পরিহার করি। খোদ রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামও গাফলত ও অলসতা থেকে পানাহ চেয়েছেন। তিনি উম্মতকে এই শিক্ষা দিয়েছেন, তারা যেন সকাল-সন্ধ্যায় এই দুআ করে-
اللّهُمَّ إِنّيْ أَعُوْذُ بِكَ مِنَ الْهَمِّ وَالْحُزْنِ، وَ أَعُوْذُ بِكَ مِنَ الْعَجْزِ وَالْكَسَلِ، وَأَعُوْذُ بِكَ مِنَ الْجُبْنِ وَالْبُخْلِ، وَأَعُوْذُ بِكَ مِنْ غَلَبَةِ الدَّيْنِ وَقَهْرِ الرِّجَالِ.
গাফলত ও অলসতা খুব বড় মারায, যা বান্দাকে তার মাওলার দিকে এবং তাঁর রেযামন্দির দিকে অগ্রসর হওয়াকে বাধাগ্রস্ত করে। তার রহমত ও মাগফিরাত থেকে বঞ্চিত করে।
চলুন, জীবনের সকল অঙ্গনে গাফলত ও অলসতা থেকে বেঁচে থাকি, হায়াতকে আযীমত-হিম্মত ও নাশাতের হায়াতে পরিণত করি। কবির এই কবিতা-পংক্তির প্রতিচ্ছবি হয়ে উঠি-
كن رجلا رجله في الثرى + وهامة همته في الثريا
যদি আমরা তা করতে পারি এবং পরীশীলিত ভাষা, পরিশুদ্ধ চিন্তায় অভ্যস্ত হই, উন্নত চিন্তা করি, গতানুগতিক চিন্তাধারা পরিহার করতে পারি তাহলেই আমরা ঐ সব নেয়ামতের কিছু শোকরিয়া আদায় করলাম, যা আল্লাহ আমাদের দান করেছেন।
আর এর জন্য মুহাসাবা খুবই জরুরি। আমাদের সালাফ তো বলতেন-
من استوى يوماه فهو مغبون
আমরা কমপক্ষে এতটুকু তো চেষ্টা করতে পারি, আমাদের দু’ সপ্তাহ যেন এক বরাবর না হয়। বিগত সপ্তাহ থেকে আমার কোনো না কোনো তারাক্কী যেন হয়। মুহাসাবা-মুরাকাবার মাধ্যমে আমরা তা করতে পারি।
এই মুহাসাবাও খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। প্রত্যেকের জন্য বিশেষত যাদেরকে আল্লাহ ইলমের সম্পদ দান করেছেন তাদের জন্য মুহাসাবা করা অবশ্যই জরুরি। সালাফ আমাদের বলেছেন-
حاسبوا أنفسكم قبل أن تحاسبوا، وزنوا أعمالكم قبل أن توزنوا
তোমাদের হিসাব নেওয়ার পূর্বে তোমরা নিজেরাই নিজেদের মুহাসাবা কর, তোমাদের আমল ওযন করার পূর্বে নিজেরাই ওযন করে নাও।
ইলম, আমল ও আখলাকসহ দুনিয়া-আখিরাতের যে কোনো বিষয়ে অগ্রগতির জন্য মুহাসাবা জরুরি। যে নিজেকে লাগামহীন ছেড়ে দিল তার কোনো উন্নতি নেই। উন্নতি ও অগ্রগতির চাবিকাঠি হল মুহাসাবা ও মুরাকাবা। নফসের মুহাসাবা ও আল্লাহ তাআলার মুরাকাবা।
অতএব নিজেরাই নিজেদের মুহাসাবা করি, নিজেদের দোষ-ত্রুটি ও বিচ্যুতিগুলোর দিকে তাকাই। কারো গীবত না করি। অন্যের দোষ-ত্রুটির দিকে না তাকাই। এই খাসলত আল্লাহ পছন্দ করেন না।
এই অভ্যাস আল্লাহকে খুবই নারায করে যে, নিজের ব্যাপারে গাফেল আর পরের ব্যাপারে সচেতন। নিজের ইসলাহ নিয়ে বেখবর আর অন্যকে নিয়ে ফিকিরমন্দ, অন্যকে নিয়ে মাতামাতি।
আল্লাহ আমাদেরকে তার নেয়ামত নিয়ে ফিকির করার এবং নিজেকে নিয়ে ফিকির করার জন্যই সৃষ্টি করেছেন। এক্ষেত্রে দাওয়াত, তালীম, তরবিয়ত ও ইসলাহে নফসের যে বিষয়, তাতো একমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্যই এবং মুসলিহ মাশায়েখদের নির্দেশনার আলোকেই করা যাবে। এসব কিছু এই জন্য নয় যে, এর দ্বারা মানুষের মুহাসাবা করা হবে, তাদেরকে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করা হবে; বরং এর পূর্বে নিজেদের নফসের এই এতটুকু ইসলাহ করতে হবে যেন আমরা ইসলাহ ও তাচ্ছিল্যের মধ্যে পার্থক্য অনুভব করতে পারি। সংশোধন ও সম্মান হরণের মাঝে পার্থক্য বুঝতে পারি।
অতএব আমাদের উচিত নিজেদের মুহাসাবা করা, নিজের নফসের তাযকিয়া ও কলবের ইসলাহের ফিকির করা। ইসলামী আদাব নিজেদের জীবনে বাস্তবায়ন করা। সালাফের আখলাকে নিজেদের সজ্জিত করা এবং সর্বোপরি নিজেদের জাহের-বাতেনকে আল্লাহর রঙে রঙ্গীন করা, যা ছিল সালাফে সালেহীনের রঙ।
صِبْغَةَ اللهِ، وَمَنْ اَحْسَنُ مِنَ اللهِ صِبْغَةً
আমরা আল্লাহর রঙে রঙ্গিন হব। আর এমন কে আছে, যার রঙ আল্লাহ অপেক্ষা অধিক রঙ্গিন হবে।-সূরা বাকারা : ১৩৮
যদি আমরা নিজেদের নিয়ে ফিকির করি, তাহলে এটিই আমাদেরকে অনেক অহেতুক কাজকর্ম থেকে বিরত রাখবে। আমাদের ইসলাম হবে মুহাসাবাপূর্ণ ইসলাম। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন-
مِنْ حُسْنِ إِسْلاَمِ الْمَرْءِ تَرْكُهُ مَا لاَ يَعْنِيْهِ
আলাহ তাআলাও বলেন,
قَدْ اَفْلَحَ الْمُؤْمِنُوْنَ الَّذِيْنَ هُمْ فِىْ صَلَاتِهِمْ خشِعُوْنَ، وَالَّذِيْنَ هُمْ عَنِ اللَّغْوِ مُعْرِضُوْنَ
নিশ্চয় ঐ মুসলমানগণ সফলতা লাভ করবে, যারা নিজেদের নামাযের মধ্যে বিনয়ী, যারা অনর্থক কথা ও কাজ হতে দূরে থাকে।-সূরা মুমিনুন : ১-৩
মুহাসাবা ও নিজেদের নিয়ে ফিকিরে থাকা ব্যাতীরেকে সব ধরনের অনর্থক ও অহেতুক কাজকর্ম থেকে বিরত থাকা সম্ভব নয়। তা না করে যদি আমরা অন্যকে নিয়ে ব্যস্ত থাকি, তাহলে আমরা নিজেদের নিয়ে বে খবর হয়ে যাব। আর এটাতো সুস্পষ্ট ক্ষতি।