বিবাহ বিচ্ছেদের প্রধান ১০ কারণ

ফাতেমা ভিখু-শাহ; অনুবাদ: মুহাম্মদ আল-বাহলুল

মানুষের অন্যান্য সম্পর্কের মতই বৈবাহিক সম্পর্কও এমন একটি সম্পর্ক, যা শতভাগ নিখুঁত হওয়া সম্ভব নয়। এমনকি তীব্র ভালোবাসাপূর্ণ ও শান্তিপূর্ণ দাম্পত্য সম্পর্কেও এটি আশা করা যায়না। বিশেষজ্ঞদের মতে, সফল ও গভীর বৈবাহিক সম্পর্কের জন্য প্রয়োজন কঠোর পরিশ্রম, দৃঢ় অঙ্গীকার এবং পারস্পারিক প্রত্যাশাকে প্রতিনিয়ত নিরীক্ষণ ও মূল্যায়ন করা।পাশাপাশি পারস্পারিক যোগাযোগের বিষয়টিও পরস্পরের খেয়াল রাখা  জরুরী। বলা সহজ হলেও বাস্তবে এই কাজ খুবই কঠিন।

বিভিন্ন ম্যারেজ থেরাপিস্ট এবং মুসলিম কাউন্সিলরদের সাথে কথা বলে আমি জানতে চেয়েছিলাম, বিবাহ-বিচ্ছেদের পেছনে তারা প্রধান প্রধান কি কারণ লক্ষ্য করেছেন। অবশ্যই বিভিন্ন জটিল সমস্যা তথা নৈতিক  পতন ও মাদকাসক্তির মত সমস্যাগুলো বিবাহ বিচ্ছেদের পেছনে দায়ী, কিন্তু এমন কিছু নগন্য সমস্যাও বিবাহ বিচ্ছেদের শীর্ষ কারণ হিসেবে রয়েছে, যা আশ্চর্যজনক। এখানে এরূপ দশটি কারণ উল্লেখ করা হল।

 

১. পরিবর্তনের চেষ্টা

অধিকাংশ দম্পতি একটি বড় সমস্যার মুখোমুখি হয় যে, একজন অপরজনের বিভিন্ন বিষয় অপছন্দ করে। এই অপছন্দ থেকে একজন অপরজনকে এমন অবস্থায় পরিবর্তন করতে চায়, যা সম্ভবপর হয়ে উঠেনা। পারস্পরিক এই পীড়াপীড়ির ফলে একজন আরেকজনের উপর বিরক্ত ও অসন্তুষ্ট হয়ে উঠে।

আপনি চাইলেই আপনার সঙ্গীকে জোর করে রাতারাতি পরিবর্তন করে আপনার কাঙ্ক্ষিত নতুন মানুষে পরিণত করতে পারেন না। আপনি বরং আপনার নিজেকে পরিবর্তন করতে পারেন এবং আপনার সঙ্গীর ছোট ছোট কাজকে নিজের পছন্দমত ধীরে ধীরে সহমর্মিতার সাথে পরিবর্তন করতে পারেন।

 

২. কথাবার্তা বনাম যোগাযোগ

বর্তমানে বৈবাহিক সম্পর্কসমূহকে ঝুঁকির মধ্যে ফেলা অপর একটি বিষয় হচ্ছে দম্পতিদের এই ভুল ধারনা যে, পরস্পরের মধ্যে কথার আদান-প্রদানই যোগাযোগ। এরফলে তারা যখনই পরস্পর কথার আদান প্রদান করে, তখনই মনে করে তাদের মধ্যে যথার্থ যোগাযোগ হচ্ছে।

অভিযোগ বা সমালোচনায় কথার আদান-প্রদান করার মাধ্যমেই দম্পতির মধ্যে যোগাযোগ স্থাপিত হয়না। অভিযোগ বা সমালোচনার পরিবর্তে ইতিবাচকতার সাথে আপনার অনুভূতিকে প্রকাশের কায়দা রপ্ত করুন। আপনার বৈবাহিক সম্পর্কের দৃঢ়তাকে তা বরং রক্ষা করবে।

যথার্থ যোগাযোগ শুধু নিজের মনোভাবকে সঙ্গীর কাছে প্রকাশ করা নয় বরং যথার্থ যোগাযোগের অর্থ হল নিজের সঙ্গীর মনোভাব সম্পর্কেও জ্ঞাত হওয়া এবং তার অনুধাবনকে অনুভব করতে পারা। যদি আমরা আমাদের বলার সাথে সাথে সমানভাবে শোনার অভ্যাস করতে পারি, আমাদের বৈবাহিক সম্পর্কগুলো অনেকাংশেই ভাঙনের হাত থেকে রক্ষা পাবে।

 

৩. সময় ব্যবস্থাপনা

আধুনিক জীবনযাত্রা বিভিন্ন দিক থেকেই অনেক চাপের সমন্বয়। এতসব চাপ সামাল দিতে গিয়ে অনেক দম্পতিই হয়তো তাদের নিজেদের মধ্যে সময় দিতে ব্যর্থ হয়।

প্রতিদিন পাঁচ মিনিট হলেও নিজেদের মধ্যে একান্তে কিছু সময় কাটানো প্রতিটি দম্পতির জন্য প্রয়োজন। বৈবাহিক সম্পর্ককে টিকিয়ে রাখতে এটি আবশ্যিক একটি উপকরণ। নিজেদের সম্পর্ককে প্রতিদিন নিয়মিতভাবে মূল্যয়ন করা প্রয়োজন যে, তার কি উন্নতি না অবনতি ঘটেছে অথবা তা একই অবস্থানে রয়েছে। নিজেদের মধ্যকার সম্পর্ককে প্রতিদিন মূল্যয়নের জন্য তাই সকল দম্পতিরই পরস্পর নির্দিষ্ট একান্ত সময়ের প্রয়োজন। পরস্পরের একান্ত সময় কাটানোর মাধ্যমে দম্পতিসমূহের মধ্যে সম্পর্কের দৃঢ়তা প্রতিষ্ঠিত হয়।

 

৪. ঘনিষ্ঠতা

বিশিষ্ট গ্রন্থকার ও থেরাপিস্ট নাদিরাহ আনগেইল মনে করেন, ‘ঘনিষ্ঠতা’র অভাবে মূলত মুসলিমদের মধ্যকার বিবাহ-বিচ্ছেদের ঘটনাগুলো বেশী ঘটে। তিনি বলেন, “সহবাস ঘনিষ্ঠতার একটি ছোট অংশ মাত্র।” এটি মূলত দম্পতিসমূহের মধ্যকার গভীরতর সম্পর্ক। আধ্যাত্মিক, মানসিক, শারীরিক, আবেগগত ইত্যাদি সকল দিক থেকেই পরস্পরের মধ্যে সংযোগ থাকাই মূলত দম্পতিসমূহের মধ্যে পারস্পারিক ঘনিষ্ঠতা সৃষ্টি করে। এই ঘনিষ্ঠতা বজায় রাখতে অধিকাংশ দম্পতিকে প্রচন্ড পরিশ্রম করতে হয়।

দম্পতিসমূহের জন্য ঘনিষ্ঠতা অর্জন কোন লক্ষ্য নয়, বরং এটি তাদের একত্রে জীবনের দীর্ঘসময় চলার জন্য একটি আবশ্যিক উপাদান।

 

৫. পরস্পরের প্রতি লক্ষ্য রাখা

সন্তান হওয়ার পর দম্পতিসমূহের মধ্যে প্রায়ই দেখা যায়, পরস্পরের প্রতি মনোযোগ ও লক্ষ্য রাখার প্রবণতার কিছুটা পরিবর্তন ঘটে। ফলে অনেক সময় হয়তো নিজেদের মধ্যে দূরত্বের সৃষ্টি হয়। সন্তান জন্মের পরও সন্তানের পাশাপাশি পারস্পরিক মনোযোগ প্রদান বৈবাহিক সম্পর্ক টিকিয়ে রাখার জন্য গুরুত্বপূর্ণ।

তাছাড়া অনেকসময় দেখা যায়, নিজেদের মধ্যে সময় কাটানোর সময় সঙ্গীর প্রতি মনোযোগের পরিবর্তে আমরা বরং আমাদের স্মার্টফেনের স্ক্রিনে নতুন নোটিফিকেশন জানতে অধিক মনোযোগ দেই। সম্পর্কের দৃঢ়তাকে  ধ্বংস করতে এবং এর পরিণতিতে বৈবাহিক সম্পর্ককে বিচ্ছিন্ন করার জন্য এধরনের ছোট ছোট অভ্যাসই যথেষ্ট।

 

৬. টাকা, টাকা, টাকা

জীবনে চলার জন্য অর্থ একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। কিন্তু বর্তমানে বিবাহ বিচ্ছেদের পেছনে এটি গুরুত্বপূর্ণ একটি কারন হিসেবে রয়েছে। বৈবাহিক সম্পর্কের অবিশ্বস্ততায় বরং সেই সম্পর্ক টিকতে পারে, কিন্তু বিশ্বজুড়ে বৈবাহিক সম্পর্কসমূহকে নস্যাৎ করার জন্য অর্থ একটি বড় অনুঘটক হিসেবে কাজ করছে। নাদিরাহ বলেন, মুসলিম পরিবারগুলোও এর ব্যতিক্রম নয়। সামর্থ্যহীন পুরুষ ও নারীর সংসার বরং অধিক টিকে থাকে কিন্তু সংসারে স্বামী স্ত্রী যখন দুইজনই আয় করেন, তখন তাদের মধ্যে এক অলিখিত প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে যায় কে বেশি আয় করেন। এই প্রতিযোগিতা থেকে পারস্পারিক রেষারেষি এবং শেষে বিবাহ-বিচ্ছেদের দিকে দাম্পত্য সম্পর্ক ধাবিত হয়।

 

৭. ক্ষমাহীনতা

পারস্পারিক ভালোবাসার সহজ সম্পর্কে ক্ষমাশীলতার অবস্থান হয় সহজ। ভুলের জন্য পাছে মর্যাদা কমে যায় এই আশংকায় সঙ্গীর কাছে ক্ষমা না চাওয়া এবং ছোট ছোট অপরাধেও সঙ্গীকে ক্ষমা করতে না পারার ফলে বরং দাম্পত্য সম্পর্কে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। আধুনিক এই সময়ে ক্ষমাহীনতার এই অভ্যাস দম্পতিসমূহের মধ্যে বিবাহ বিচ্ছেদের একটি বড় কারণ।

 

৮. প্রশংসার অভাব

যখন পারস্পারিক প্রশংসার হার কমে যায়, তখন পরস্পরের মধ্যে সংঘাত বৃদ্ধি পায়। প্রশংসার অভাব বৈবাহিক সম্পর্কে মধ্যে পারস্পারিক অবিশ্বাসের সৃষ্টি করে। কিন্তু যখন দুইজন মানুষ তাদের পারস্পারিক কাজের ১০০% মূল্যয়ন করবে এবং উত্তম কাজের জন্য সঙ্গীর প্রশংসা করবে, তখন তাদের মধ্যে সংঘাতের সম্ভাবনা খুব কমই থাকবে এবং তাদের দাম্পত্য সম্পর্ক ভাঙনের হাত থেকে রক্ষা পাবে।

 

৯. আবেগগত সম্পর্ক

দক্ষিন আফ্রিকার দম্পতিসমূহের পরামর্শদানকারী সংস্থা ইসলামিক কেয়ার লাইন জানিয়েছে, আধুনিক তথ্যপ্রযুক্তির অগ্রসরতার ফলে ভার্চুয়াল জগতে বিভিন্ন প্রকার ভার্চুয়াল সম্পর্কে মানুষ জড়িয়ে পড়ছে। এসকল সম্পর্কে অনেকসময় মানুষ তার সঙ্গীর থেকে অধিক ঘনিষ্ঠ হয়ে পড়ছে। এরফলে দম্পতিসমূহের পারস্পারিক সম্পর্ক বিবাহ বিচ্ছেদের দিকে ধাবিত হচ্ছে।

এই বিষয়টি সম্পূর্ণভাবে এড়ানো যেতে পারে, যদি ব্যক্তি তার অনুভূতির কথা তার শুভাকাঙ্ক্ষী কারো কাছে শেয়ার করতে পারে এবং তার কাউন্সিলিং এর মাধ্যমে নিজেকে অনাকাঙ্ক্ষিত আবেগ থেকে মুক্ত করতে পারে।

 

১০. ক্ষমতার দ্বন্দ্ব

ইসলামিক কেয়ার লাইনের সাথে কাজ করা একজন সমাজকর্মী আনিসা মুসা জানান, বিবাহিত দম্পতির মধ্যে পারস্পারিক ক্ষমতার দ্বন্দ্বের ফলেও তাদের সম্পর্ক বিবাহ বিচ্ছেদের দিকে ধাবিত হয়। একজন অপরজনের উপর প্রভাব বিস্তার করতে চাওয়া এবং সঙ্গীকে নিজের মত করে চালাতে চাওয়ার ফলে দম্পতিসমূহের মধ্যে সংঘর্ষ সৃষ্টি হয়।

যদি নিজেদের মধ্যে ভালোবাসার সম্পর্কের তুলনায় নিজের মতকে প্রতিষ্ঠা করার গুরুত্ব অধিক হয়, তবে দম্পতির মধ্যকার সম্পর্ক আর স্থায়ী হয়না এবং কারো মত যদিও প্রতিষ্ঠিত হয়, সেখানে আর ভালোবাসা থাকেনা।

উপরিউক্ত সমস্যাসমূহ যে সকলের ক্ষেত্রেই একইভাবে কাজ করে তা নয়, বরং এগুলো বিবাহবিচ্ছেদের কয়েকটি প্রধান সমস্যা হিসেবে সাধারনভাবে দেখা যাচ্ছে। নিজেদের মধ্যকার সম্পর্ককে গভীর ও ভালোবাসা পূর্ণ দৃঢ় সম্পর্কে পরিণত করতে আমরা এই বিষয়গুলো সম্পর্কে সতর্ক হতে পারি। এর মাধ্যমে আমরা পৃথিবীর জীবনে নিজেদের সঙ্গীর সাথে সুন্দর সময় কাটানোর মাধ্যমে পরকালীন জীবনেও সাফল্য অর্জন করতে পারি।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *