মুহাম্মাদ ইলিয়াছ খান
আজ থেকে অনেক দিন আগের ঘটনা। ইতিহাসের পাতায় শোভা বর্ধন করে আছে যুগ যুগ ধরে। ইতিহাসের পথ ধরে আজ আমরা ফিরে যাব তেরো শত বছর আগে। আজ যার ঘটনা বলব তিনি অবশ্য সব যুগেই ছিলেন সমানভাবে পরিচিত। সময়ের আস্তরণ তার পরিচয়সত্তায় কোন আবরণ ফেলতে পারেনি। তাই তার কর্ম ও কীর্তির গুণে তিনি আজও সবার কাছে পরিচিত ও সর্বমহলে আলোচিত।
তিনি হলেন ইমাম আবু হানিফা রহ.। যুগে যুগে শত শত কোটি মুসলমান তাকে অনুসরণ করেছে দ্বীন ও শরিয়ত অনুসরণের ক্ষেত্রে। নিজ যুগে তিনি ছিলেন দুনিয়াবিখ্যাত। সমকালীন আলেমগণ তাকে খুব বড় চোখে দেখতেন। তাই তো আরেকজন বিখ্যাত মনীষী ইমাম মালেক রহ. বলেছিলেন, ইমাম আবু হানীফা তো হলেন এমন প্রখর মেধাবী মানুষ যে, তিনি যদি কোনো স্বর্ণকে কাঠ প্রমাণ করতে চান তাহলে তিনি তা করে ফেলবেন। যুক্তি দিয়ে অন্যরা তার যুক্তি খণ্ডন করতে পারবে না। তারই খুব ছোট্ট একটি ঘটনা নিয়ে আজ আমরা কথা বলব।
আজকের এই যুগ হল সেলফিস্ট যুগ। মানুষ এখন অনেক বেশি আত্মকেন্দ্রিক। নিজের সুবিধার কথা, প্রেস্টিজের কথা ভাবার মানসিকতা এখন ব্যাপক। তাই এমন মানুষ খুব কম যারা কোনো ধরনের স্বার্থ ছাড়াই, এমনকি নাম ও সুখ্যাতির চিন্তা ছাড়াই অন্যের পাশে দাঁড়াবে। আজকের বস্তুবাদী পৃথিবীতে এটি চরম বাস্তবতা।
ইমাম আবু হানিফা রহ. কিন্তু এমন ছিলেন না। যুগের সেরা আলেম হয়েও তিনি খুব সাধারণ মানুষের কাছে যেতেন। তাদের বিপদে পাশে দাঁড়াতেন।
একবার এক লোক এল ইমাম সাহেবের কাছে। এসে বলল, আমি অনেক কঠিন একটি বিপদে পড়ে গেছি। আমার একটু সহযোগিতা দরকার।
ইমাম সাহেব তার সমস্যার কথা জানতে চাইলেন। লোকটি বলল, একজন ব্যক্তি আমার কাছে পনের দিরহাম পায়। কিন্তু আমি তার টাকা পরিশোধ করতে পারছি না। আমার এখন খুব অর্থ সঙ্কট। আপনি যদি আমাকে একটু সহযোগিতা করেন…
আপনি যদি তাকে একটু বলে দেন। সে আমার ঋণ পরিশোধের সময় কিছুদিন বাড়িয়ে দিলে আমার জন্য বড় সুবিধা হতো। আমি একটু স্বস্তির সাথে তার ঋণ পরিশোধ করতে পারতাম।
ঘটনার এই অংশে এসে আমরা একটু বিরতি নিতে চাই। ছোট একটি প্রশ্ন রাখতে চাই আপনার বিবেকের কাছে। মনে করুন, বাংলাদেশের সচিবালয়ের একজন বড় অফিসার। তার কাছে এমন কোন আবদার নিয়ে গেল এলাকার সাধারণ একজন মুদি দোকানদার। কী ঘটতে পারে তখন? কী বলতে পারে অফিসার লোকটি?
কল্পনার ক্যানভাসে দৃশ্যটি ধারণ করুন। এরপর ঘটনার সামনের অংশ পড়ুন।
ইমাম আবু হানিফা রহ. তার কথা মনোযোগ দিয়ে শুনলেন। তাকে সান্ত্বনা দিলেন। এরপর প্রেস্টিজের চিন্তা না করে সত্যি সত্যি লোকটির সাথে চলে গেলেন। পাওনাদারের কাছে গিয়ে উপস্থিত হলেন।
আজকের যুগে কেউ কাউকে সুপারিশ করার জন্য বললে সে বিরক্ত হয়। এটিকে উটকো ঝামেলা মনে করে। কিন্তু ইমাম সাহেব এভাবে ভাবেননি। তিনি ভেবেছেন, এই মুসলিম ভাইয়ের বিপদে পাশে দাঁড়াতে পারলে আমি আল্লাহর কাছে অনেক বেশি সম্মান পাব। অনেক সওয়াব পাব। আর আল্লাহ আমার প্রতি খুশি হবেন।
তিনি ওই ব্যক্তিকে গিয়ে বললেন, আপনি তো তার কাছে পনের দিরহাম পান। সে একটু বিপদে আছে। আপনি যদি তাকে একটু সময় দিতেন তাহলে তার জন্য সুবিধা হত। আপনিও আল্লাহর কাছে অনেক বেশি সওয়াব পেতেন।
তিনি তো ছিলেন অনেক বড় ব্যক্তি। সবাই তাকে চিনত। সবাই তাকে জানত। তিনিই তার কাছে অনুরোধ করেছেন ওইসাধারণ লোকটির জন্য। তখন সাথে সাথেই সেই ব্যক্তিটি বললেন, ঠিক আছে। আমি বরং তার পুরো ঋণ মাফ করে দিলাম। আমাকে আর কিছুই পরিশোধ করতে হবে না।
এভাবেই তিনি একজন আদর্শ মুসলিম পাওনাদারের পরিচয় দিলেন। খুব সহজেই অন্যের ঋণ মাফ করে দিলেন। আজকের পৃথিবী অনেক অগ্রসর হয়েছে ঠিক। কিন্তু ব্যক্তির সত্তাগত গুণ ও যোগ্যতার দিক থেকে আমরা আসলে অনেক পিছিয়ে গেছি। তাই এমন গুণের মানুষের দেখা পাওয়া আজ বিরল।
ঘটনা এখানেই শেষ নয়। যুগের আবর্তনে আমাদের মাঝে যে কত ব্যবধান তৈরি হয়েছে! সে যুগের মানুষের মাঝেও ছিল প্রচণ্ড আত্মমর্যদাবোধ। অন্যের অনুগ্রহ গ্রহণ করতে তারা সহজে প্রস্তুত হতেন না।
এরপর কী হলো! ঋণগ্রস্ত ব্যক্তি বললেন, না, মাফ করে দেওয়ার প্রয়োজন আমার নেই। আমার বরং কিছু সময় দরকার। কিছুদিন পরই যখন আল্লাহ আমাকে সামর্থ্য দেবেন আমি আপনার ঋণ পরিশোধ করে দেব।
সূত্র: তারিখে বাগদাদ, ইমাম আবূ হানিফার জীবনী। সৌজন্যে: ইসলাম টাইমস ।