মুফতী মাওলানা শাঈখ মুহাম্মাদ উছমান গনী
ইসলাম পরিপূর্ণ জীবন বিধান। তাই মানুষের জীবনের সকল বিষয়ে এতে দিক নির্দেশনা রয়েছে। তা পূর্ণাঙ্গরূপে অনুসরণ করাই দুনিয়ার শান্তি ও পরকালে মুক্তির সঠিক ও সহজ সরল পথ। পবিত্র কুরআনের ঘোষণা: “নিশ্চয় আল্লাহ তাআলা তোমাদের নির্দেশ দিচ্ছেন তোমরা যেনো আমানত তার প্রকৃত অধিকারীর নিকট অর্পন করো; আর যখন তোমরা মানুষের মাঝে বিচার ফায়সালা করো, তখন যেনো ন্যায়সঙ্গতভাবে বিচার ফায়সালা করো।
এবিষয়ে আল্লাহ তোমাদের কতইনা উত্তম উপদেশ দেন! নিশ্চয় আল্লাহ সর্বশ্রোতা সর্বদ্রষ্টা।” (সূরা-৪ নিসা, আয়াত: ৫৮)। সরকার বা রাষ্ট্র পরিচালনায় জনগণের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করণে নির্বাচন একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। নাগরিকগণ ভোটাধিকার প্রয়োগের মাধ্যমে তাদের পছন্দের প্রতিনিধি বাছাই করার সুযোগ পান নির্বাচনে অংশ গ্রহণ করে। কাউকে ভোট দেওয়ার অর্থ অত্যন্ত ব্যাপক ও সুদূর প্রসারী। ইসলামের খেলাফত ও শূরাপদ্ধতি অনন্য বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন একটি ব্যবস্থা।
ইসলামের দৃষ্টিতে ভোট হচ্ছে তিনটি বিষয়ের সমষ্টি। সাক্ষ্য প্রদান, সুপারিশ করা ও প্রতিনিধিত্বের দায়িত্ব প্রদান করা। শরীয়তে উপরোক্ত তিনটি বিষয়ের গুরুত্ব অপরিসীম। কুরআন কারীমের ভাষায়- “যে ভালো সুপারিশ করবে সে তার নেকীর ভাগীদার হবে, আর যে মন্দ সুপারিশ করবে সেও মন্দের হিস্যা পাবে।” (সূরা-৪ নিসা, আয়াত: ৮৫)।
ভোটের মধ্যে যে তিনটি বিষয় রয়েছে এর মধ্যে ‘শাহাদত’ বা সাক্ষ্যের বিষয়টি প্রধান। অর্থাৎ কাউকে ভোট দেওয়ার অর্থ হলো, তার ব্যাপারে এ সাক্ষ্য প্রদান করা যে, লোকটি ভালো এবং যোগ্য। এখন যদি যথাযথ জায়গায় সীল দিয়ে এ সাক্ষ্য প্রদান করা হয় তবে তা হবে সত্য সাক্ষ্য অন্যথায় সেটি হবে মিথ্যা সাক্ষ্য; আর মিথ্যা সাক্ষ্য হলো জঘন্য কবীরা গুনাহ ও হারাম কাজ। মানবতার মুক্তির দূত রাসূলে কারীম (স.) অত্যন্ত কঠিন ভাষায় মিথ্যা সাক্ষ্যের নিন্দা করেছেন।
বুখারী শরীফে একটি বর্ণনায় হজরত আবু বকর সিদ্দীক (রা.) বলেন- রসূলুল্লাহ (স.) একদা এক জায়গায় হেলান দিয়ে বসা অবস্থায় তিনবার সাহাবীদেরকে জিজ্ঞাসা করলেন: ‘আমি কি তোমাদেরকে কবীরা গুনাহগুলোর মধ্যে বড় কবীরা গুনাহের কথা বলবো? সাহাবীগণ হ্যাঁ সূচক উত্তর দেওয়ার পর তিনি বললেন: আল্লাহর সাথে কাউকে শরিক করা, পিতা-মাতার অবাধ্যতা (এ দুটি কথা বলার পর তিনি সোজা হয়ে বসলেন) এবং বললেন, শুনে নাও! মিথ্যা সাক্ষ্য অনেক বড় কবীরা গুনাহ।
হজরত আয়িশা সিদ্দীকা (রা.) বলেন, ‘আমার এ ঘরে রাসুল (স.) কে দোয়া করতে শুনেছি- আয় আল্লাহ! যে ব্যক্তি আমার উম্মতের যেকোনো কাজের দায়িত্বশীল নিযুক্ত হয় এবং লোকদের সঙ্গে ন¤্র ব্যবহার করে আপনিও তার সঙ্গে ন¤্র ব্যবহার করুন।’ (মুসলিম: ৪৭২২)।
যিনি একটি দল, একটি সমাজ বা একটি রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্বে থাকেন তার ধ্যান-ধারণা, চিন্তা-চেতনা জাতির জন্য অনেক গুরুত্বপূর্ণ। নেতা যদি দয়ার্দ হন তবেই সমাজে শান্তি বিরাজ করবে; তাই নেতা নির্বাচনের ক্ষেত্রে বিচক্ষণ হতে হবে জনগণকে। নেতার গুণগুলো যাচাই করে নেতা নির্বাচন করতে হবে। নেতার গুণগুলোর মধ্যে রয়েছেÑ নেতা কঠিন হবে না। আল্লাহ তাআলা বলেন: “‘হে নবী! আপনি যদি কর্কশভাষী, রূঢ় প্রকৃতির ও কঠোর স্বভাবের হতেন তবে লোকেরা আপনার আশপাশ ছেড়ে চলে যেতো।” (সূরা-৩ আলে ইমরান, আয়াত: ১৫৯)।
নেতাকে স্নেহশীল হতে হবে। নবী করিম (স.) এর বৈশিষ্ট্যের কথা উল্লেখ করে আল্লাহ তাআলা বলেন: “তোমাদের কাছে এসেছে তোমাদের মধ্য থেকেই একজন রাসুল। তোমাদের দুঃখ-কষ্ট তাঁর পক্ষে দুঃসহ, তিনি তোমাদের কল্যাণকামী, বিশ^াসীদের প্রতি স্নেহশীল, দয়ালু।” (সূরা-৯ তওবা, আয়াত: ১২৮)। নেতাকেকে ধৈর্যশীল হতে হবে। পবিত্র কুরআনে এসেছে: “তবে যারা ঈমান আনে, সৎকাজ করে এবং পরস্পরকে সত্যের উপদেশ দেয় ও ধৈর্যধারণে উৎসাহিত কওে (তারা ক্ষতিগ্রস্ত নয়)।” (সূরা-১০৩ আসর, আয়াত: ৩)।
নেতাকে দলমত নির্বেশেষে সকলের হিতাকাঙ্খী হতে হবে। হজরত জাবের (রা.) বলেন- ‘সাহাবাগণ (রা.) আরজ করলেন, ইয়া রসুলাল্লাহ (স.)! সাকিফ গোত্রের তিরগুলো আমাদের শেষ করে দিলো। আপনি তাদের জন্য বদদোয়া করুন। তিনি বলেন: ‘আয় আল্লাহ! সাকিফ গোত্রকে হিদায়াত দান করুন।’ (তিরমিজি: ৩৯৪২)। সকলের সাথে পরামর্শ করে কাজ করতে হবে। হজরত আবু হুরায়রা (রা.) বলেন- ‘রসুলুল্লাহ (স.) অপেক্ষা অধিক নিজের সাথিদের সঙ্গে পরামর্শ করতে আমি কাউকে দেখিনি।’ (তিরমিজি: ১৭১৪)।
রসূলুল্লাহ (স.) বলেন: ‘আমার উম্মতের মধ্যে যে ব্যক্তি পরামর্শ করে সে সোজা পথের ওপর থাকে, আর যে ব্যক্তি পরামর্শ করে না সে চিন্তাযুক্ত থাকে।’ (বায়হাকী, খ-: ৬, পৃষ্ঠা: ৭৬)। নেতা সুসংবাদ শুনাবেন। হজরত আনাস (রা.) বর্ণনা করেন, রসূলুল্লাহ (স.) বলেছেন: ‘মানুষের সঙ্গে সহজ আচরণ করো এবং কঠিন আচরণ করো না; সুসংবাদ শুনাও বিমুখ করো না।’ (বোখারি: ৬৯)।
সৎ কাজের আদেশ ও অসৎ কাজের নিষেধ করা সবারই দায়িত্ব। হজরত জারির ইবনে আবদুল্লাহ (রা.) বর্ণনা করেন, রসূলুল্লাহ (স.) বলেন: ‘যদি কোনো কওম বা জামাতের মধ্যে কোনো ব্যক্তি কোনো গোনাহের কাজে লিপ্ত হয় এবং ওই কওম বা জামাতের মধ্যে শক্তি থাকা সত্ত্বেও তাকে বাধা না দেয়, তাহলে মৃত্যুর আগে দুনিয়াতেই তাদের ওপর আল্লাহর আজাব এসে যায়।’ (সুনানে আবু দাউদ)।
রসূল (স.) বলেন, ‘যে ব্যক্তি কোনো মুসলমান জনগোষ্ঠীর নেতা হয়, অতঃপর তাদের সঙ্গে প্রতারণামূলক কাজ করে এবং ওই অবস্থায় মৃত্যুবরণ করে; তবে আল্লাহ তাআলা তার জন্য জান্নাত হারাম করে দেবেন।’ (বোখারী শরীফ)। ‘যে ব্যক্তিকে আল্লাহ তাআলা মুসলমানদের কোনো কাজের নেতা বানিয়েছেন, আর সে মুসলমানদের অবস্থা, প্রয়োজনগুলো ও তাদের অভাব অনটন থেকে মুখ ফিরিয়ে রাখে, কেয়ামতের দিন আল্লাহ তাআলা তার অবস্থা ও প্রয়োজনগুলো এবং অভাব অনটন থেকে মুখ ফিরিয়ে নেবেন।’ (সুনানে আবু দাউদ: ২৯৪৮)।
হজরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) বর্ণনা করেন- রসূলুল্লাহ (স.) বলেছেন: ‘যে ব্যক্তি কাউকে দলের নেতা নিযুক্ত করলো; কিন্তু দলে তার চেয়ে বেশি আল্লাহ তাআলাকে সন্তুষ্টকারী ব্যক্তি রয়েছে, সে আল্লাহ তাআলার সঙ্গে খেয়ানত করলো, রসূলুল্লাহ (স.) এর সঙ্গে খেয়ানত করল এবং ঈমানদারদের সঙ্গে খেয়ানত করলো।’ (মুসতাদরাকে হাকিম, খ-: ৪, পৃষ্ঠা: ৯২)।
মুফতী মাওলানা শাঈখ মুহাম্মাদ উছমান গনী
যুগ্ম-মহাসচিব: বাংলাদেশ জাতীয় ইমাম সমিতি
সহকারী অধ্যাপক: আহ্ছানিয়া ইনস্টিটিউট অব সূফীজম
E-Mail: smusmangonee@gmail.com