আলিমদের মাঝে মতভেদ হলে আম মানুষ কী করবে?

মাওলানা মুহাম্মাদ আব্দুল মালেক হাফিযাহুল্লাহ

এই প্রশ্ন এখন মানুষের মুখে মুখে। আমল থেকে গা বাঁচানোর জন্য এবং ভুল থেকে ফিরে আসার সংকল্প না থাকলে অতি নিরীহভাবে এই অজুহাত দাঁড় করানো হয় যে, আমাদের কী করার আছে? আলিমদের মাঝে এত মতভেদ, আমরা কোন দিকে যাব? কার কথা ধরব, কার কথা ছাড়ব?
আমার আবেদন এই যে, আমরা যেন এই অজুহাত দ্বারা প্রতারিত না হই। এটি একটি নফসানী বাহানা এবং শয়তানের ওয়াসওয়াসা। নিচের কথাগুলো চিন্তা করলে এটা যে শয়তানের একটি ধোঁকামাত্র তা পরিষ্কার বুঝে আসবে।

১. জরুরিয়াতে দ্বীন, অর্থাৎ দ্বীনের ঐ সকল বুনিয়াদী আকীদা ও আহকাম এবং বিধান ও শিক্ষা, যা দ্বীনের অংশ হওয়া স্বতঃসিদ্ধ ও সর্বজনবিদিত, যেগুলো মুসলিম উম্মাহর মাঝে সকল যুগে সকল অঞ্চলে ব্যাপকভাবে অনুসৃত, যেমন আল্লাহর উপর ঈমান, তাওহীদে বিশ্বাস, আখিরাতের উপর ঈমান, কুরআনের উপর ঈমান, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এবং তাঁর হাদীস ও সুন্নাহর উপর ঈমান, মুহাম্মাদ মুস্তফা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর আখেরী নবী ও রাসূল হওয়ার উপর ঈমান; পাঁচ ওয়াক্ত ফরয নামায, জুমার নামায, যাকাত, রোযা, হজ্ব ও পর্দা ফরয হওয়া, শিরক, কুফর, নিফাক, কাফির-মুশরিকদের প্রতীক ও নিদর্শন বর্জনীয় হওয়া, সুদ, ঘুষ, মদ, শূকর, ধোঁকাবাজি, প্রতারণা, মিথ্যাচার ইত্যাদি হারাম হওয়া এবং এ ধরনের অসংখ্য আকীদা ও বিধান, যা জরুরিয়াতে দ্বীনের মধ্যে শামিল তাতে আলিমদের মাঝে তো দূরের কথা, আম মুসলমানদের মাঝেও কোনো মতভেদ নেই। যারা দ্বীনের এই সকল স্বতঃসিদ্ধ বিষয়কেও বিশ্বাস ও কর্মে অনুসরণ করে না তারাও বলে; বরং অন্যদের চেয়ে বেশিই বলে যে, আলিমদের মাঝেই এত মতভেদ তো আমরা কী করব!

২. অসংখ্য আমল, আহকাম ও মাসাইল এমন আছে, যেগুলোতে আলিমদের মাঝে কোনো মতভেদ নেই। এগুলোকে ইজমায়ী আহকাম বা সর্বসম্মত বিধান হিসেবে গণ্য করা হয়। কিছু মানুষ এসব বিষয়েও নতুন মত ও পথ আবিষ্কার করে, এরপর আলিমদের অভিযুক্ত করে যে, তারা এখানে দ্বিমত করছেন!

৩. আল্লাহ তাআলা যাকে বিচার-বিবেচনার সামান্য শক্তিও দিয়েছেন তিনি যদি আল্লাহকে হাজির-নাজির জেনে সত্য অন্বেষণের নিয়তে জরুরিয়াতে দ্বীন (স্বতঃসিদ্ধ বিষয়াদি) এবং মুজমা আলাইহ (সর্বসম্মত বিষয়সমূহ) সামনে নিয়ে চিন্তা করেন তাহলে খুব সহজেই বুঝতে পারবেন যে, বাতিলের পক্ষাবলম্বনকারীরা ‘আলিম’ (জ্ঞানী) নন; বরং হাদীসের ভাষায় عليم اللسان اللسان ‘বাকপটু’। এই শ্রেণীর লোকদের প্রভাব থেকে মুক্ত থাকলে আহলে হক্ব আলিমদেরকে, যারা ‘আসসুন্নাহ’ ও ‘আলজামাআ’র নীতি-আদর্শের উপর আছেন, চিনে নিতে দেরি হবে না। এরপর তাঁদের সাহচর্য অবলম্বন করলে তিনি তো নিন্দিত মতভেদ থেকে বেঁচেই গেলেন। আর বৈধ মতভেদপূর্ণ বিষয়াদিতে তিনি যদি তার দৃষ্টিতে বিশ্বস্ত ও নির্ভরযোগ্য আলিমদের নির্দেশনা অনুসরণ করেন তাহলে কোনো অসুবিধা নেই। ইনশাআল্লাহ আখিরাতে তিনি দায়মুক্ত থাকবেন।

৪. কুরআন-হাদীসের বাণী ও ভাষ্য থেকে প্রাপ্ত কিছু চিহ্ন ও আলামত আছে, যেগুলোর সাহায্যে ঈমানদারির সাথে চিন্তা-ভাবনা করে কেউ কোনো আলিমকে নির্বাচন করতে পারেন, যার সাহচর্য তিনি গ্রহণ করবেন এবং যার সাথে দ্বীনী বিষয়ে পরামর্শ করবেন।
সময় করে আলিমদের মজলিসে যান, তাঁদের কাছে বসুন এবং লক্ষ করুন, যেসব আমল সর্বসম্মত, যে বিষয়গুলো সর্বসম্মতভাবে সুন্নত এমন বিষয়ের অনুসরণ আর যে বিষয়গুলো সর্বসম্মতভাবে নাজায়েয ও বিদআত তা বর্জনের বিষয়ে কে বেশি ইহতিমাম করেন, কার সাহচর্যের দ্বারা আখিরাতের ফিকির পয়দা হয়, ইবাদতের আগ্রহ বাড়ে, আল্লাহ তাআলার নাফরমানী সম্পর্কে অন্তরে ভয় ও ঘৃণা সৃষ্টি হয় এবং কার সঙ্গীদের অধিকাংশের অবস্থা এসব ক্ষেত্রে ভালো; কে পূর্ণ সতর্কতার সাথে গীবত থেকে বেঁচে থাকেন এবং প্রতিপক্ষের সাথেও ভালো ব্যবহারের আদেশ দেন; কার কথা থেকে বোঝা যায় কুরআন-হাদীসের ইলম তার বেশি, কার কথায় নূর ও নূরানিয়াত বেশি; তেমনি যে আলিমগণ সর্বসম্মতভাবে হক্বের উপর প্রতিষ্ঠিত তাঁরা কাকে সমর্থন করেন। এ ধরনের নিদর্শনগুলোর আলোকে বিচার করার পর কেউ যদি সালাতুল হাজত পড়েন, আল্লাহর দরবারে দুআ করেন, ইসতিখারা করেন, এরপর নেক নিয়তের সাথে কোনো আলিমকে নির্বাচন করেন তাহলে ইনশাআল্লাহু তিনি দায়মুক্ত হবেন।
তবে এক্ষেত্রেও জরুরি মনে করা যাবে না যে, সবাইকে ঐ আলিমের কাছেই মাসআলা জিজ্ঞাসা করা উচিত এবং তাঁরই কাছে পরামর্শ নেওয়া উচিত। তদ্রূপ মতভেদপূর্ণ বিষয়াদিতে ঐসব লোকদের সাথে তর্ক-বিতর্কে লিপ্ত হওয়া যাবে না, যারা অন্য আলিমের ফতোয়া ও নির্দেশনা অনুযায়ী আমল করেন। অন্য কেউ যদি আল্লাহর রেযামন্দির জন্য চিন্তা-ভাবনা করে অন্য কোনো আলিমকে তার দ্বীনী রাহনুমা বানান তাহলে আপনার আপত্তি না থাকা উচিত, না তার সাথে আপনার তর্ক-বিতর্ক করা সমীচীন আর না আপনার সাথে তার।

যে আলিমদেরকে আপনি নির্বাচন করেননি তাদের সম্পর্কে কুধারণা পোষণ করা কিংবা তাঁদের সম্পর্কে কটূক্তি করা কোনোটাই জায়েয নয় এবং বিনা দলীলে তাদের কাউকে বাতিল মনে করাও বৈধ নয়। আপাতত এ কয়েকটি কথাই নিবেদন করলাম। আল্লাহ তাআলা যদি তাওফীক দান করেন আগামীতে এ বিষয়ে বিস্তারিত লেখার ইচ্ছা আছে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *