ভ্যালেন্টাইনস ডে : ইতিহাস, ইসলাম ও বাস্তবতার নিরিখে

মুফতী মুহিউদ্দীন কাসেমী


প্রতি বছর ১৪ ফেব্রুয়ারী ভ্যালেন্টাইন ডে বা ভালোবাসা দিবস নামে বাংলাদেশে কয়েক বছর ধরে একটি নতুন দিবস পালনের অপসংস্কৃতি শুরু হয়েছে। এটি এখন বিশেষ স্বার্থকামী মহলে খুব জোরেসোরে পালন করা হচ্ছে। ব্যবসায়িক স্বার্থ ও মুনাফা অর্জনের প্রত্যাশায় একটি ব্যবসায়িক মহল এবং হোটেল ব্যবসায়ীরা এর সাথে যুক্ত হয়ে এটি পালনকে উৎসাহিত করছে। কিন্তু ভ্যালেন্টাইন ডে’র ইতিহাস ও ভিত্তি কী–তা অনেকেই জানেন না।

আজকাল অনেক মুসলিম প্রকৃত বিষয়টি না জেনে নানারকম বিজাতীয় সংস্কৃতির চর্চা করে থাকে। তারা কেবল তাদের সাংস্কৃতিক নেতাদের মতোই এসব ক্ষেত্রে অন্ধ-অনুসারী। তারা এটি খুবই কম উপলব্ধি করে যে, তারা যা নির্দোষ বিনোদন হিসেবে করে , তার শিকড় আসলে পৌত্তলিকতায় এবং যা তারা লালন করে, তা হলো অবিশ্বাসেরই প্রতীক। বস্তুত তাদের সেই ধারণা কুসংস্কার থেকেই জন্ম লাভ করেছে।

‘ভালোবাসা দিবস’ আমেরিকা ও বৃটেন বাদে গোটা ইউরোপে মৃত ও পরিত্যাক্ত হলেও হঠাৎ করেই তা মুসলিম দেশগুলোয় নির্বিচারে অনুপ্রবেশ করেছে। কিন্তু এটা কার ভালোবাসার দিবস–কেন এ দিবস পালন করা হবে–এ সম্পর্কে তারা অজ্ঞতায় নিমজ্জিত।

কথিত আছে, খ্রিস্টপূর্ব চতুর্থ শতাব্দীতে উর্বরতা ও পশুর দেবতা বলে খ্যাত লুপারকাসের (Lupercus) সম্মানে পৌত্তলিক রীতিনীতির একটি অংশ হিসেবে রোমানরা ভ্যালেন্টাইনস ডে উদযাপন শুরু করে। এর মূল আকর্ষণ হলো–পরবর্তী বছরের লটারীর আগ পর্যন্ত বর্তমান বছরে লটারীর মাধ্যমে যুবকদের মাঝে যুবতীদের বণ্টন করে দেয়া। এ দিন উদযাপনে অন্যান্য ঘৃণ্য অনুষ্ঠানের মধ্যে একটি ছিল, এক টুকরো ছাগলের চামড়ায় আবৃত যুবতীদেরকে দু’জন যুবক কর্তৃক উৎসর্গকৃত ছাগল ও কুকুরের রক্তে ভেজা চাবুক দিয়ে প্রহার করা। মনে করা হতো– ‘পবিত্র যুবক’দের প্রতিটি পবিত্র (?) আঘাত দ্বারা ওই সব যুবতী ভালোভাবে সন্তান ধারণে সক্ষম হবে।

খ্রিস্টান সম্প্রদায় যথারীতি লুপারকালিয়ার (Lupercalia) এ ঘৃণ্য রীতিকে বন্ধ করার বৃথা চেষ্টা করল। প্রথমে তারা মেয়েদের নামে লটারির বদলে ধর্মযাজকদের নামে লটারির ব্যবস্থা চালু করল। এর উদ্দেশ্য হলো, যে যুবকের নাম লটারিতে ওঠবে, সে যেন পরবর্তী একটি বছর যাজকের মতো পবিত্র হতে পারে। কিন্তু খ্রিস্টানরা খুব কম স্থানেই এ কাজে সফল হলো।

একটি জনপ্রিয় খারাপ কাজকে কিছু পরিবর্তন করে তাকে ভালো কাজে লাগানোর প্রবণতা বহু পুরোনো। তাই খ্রিস্টানরা শুধু লুপারকালিয়া থেকে এ উৎসবের নাম সেন্ট ভ্যালেন্টাইন উৎসব করতে পারল। পোপ গ্যালাসিয়াস (Gellasius) ৪৯৬ খ্রিস্টাব্দে সেইন্ট ভ্যালেন্টাইনের সম্মানে এটি করল।

তদুপরি খ্রিস্টান কিংবদন্তিতে ৫০-এরও বেশি বিভিন্ন রকম ভ্যালেন্টাইন আছে। এদের মধ্যে মাত্র দু’জন সবচেয়ে বেশি পরিচিত, যদিও তাদের জীবন ও চরিত্র এখনো রহস্যাবৃত। একটি কিংবদন্তি হলো, যেটি বেশি প্রকৃত ভ্যালেন্টাইন দিবসের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ, সেইন্ট ভ্যালেন্টাইন হলেন ‘প্রেমিকদের যাজক’- যে নিজেকে কারাগারপ্রধানের মেয়ের প্রেমে জড়িয়ে ফেলেন।

পূর্বোল্লিখিত ভ্যালেন্টাইন লটারি কিছু মারাত্মক অসুবিধার জন্য বাধাপ্রাপ্ত হয়। ফ্রান্স সরকার উল্লিখিত লটারি ১৭৭৬ সালে নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। কালপরিক্রমায় এটি ইতালি, অস্ট্রিয়া, হাঙ্গেরি ও জার্মানি থেকেও উঠে যায়।

এর আগে সপ্তদশ শতাব্দীতে পিউরিটানরা যখন শক্তিশালী ছিল, সে সময় ইংল্যান্ডে এটি নিষিদ্ধ করা হয়। কিন্তু রাজা দ্বিতীয় চার্লস এটি ১৬৬০ সালে পুনরুজ্জীবিত করেন। ইংল্যান্ড থেকেই এটি নতুন বিশ্বে আগমন করে যেখানে এটিকেই টাকা বানানোর ভালো মাধ্যম হিসেবে নিতে ইয়াংকিরা (আমেরিকানরা) উদ্যোগী হয়। ১৮৪০ সালের দিকে ইস্টার এ হল্যান্ড ‘হোয়াট এলস ভ্যালেন্টাইন’ (What else Valentine) নামে প্রথম বাণিজ্যিকভাবে আমেরিকান ভ্যালেন্টাইন ডে কার্ড বানায় এবং প্রথম বছরই ৫০০০ ডলারের কার্ড বিক্রি হয় (তখন ৫০০০ ডলার অনেক)। সেখান থেকে ভ্যালেন্টাইন ডে ফুলে-ফেঁপে ওঠে।

এটি হ্যালোইনের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। সাধারণ মানুষ ভূত এবং অপদেবতার মতো পোশাকে সজ্জিত হয়ে পৌত্তলিকদের একটি প্রাচীন শয়তানপূজার পুনঃপ্রচলন করে। পৌত্তলিকেরা এর নাম দেয় সামহাইন (Samhain) যা সোয়েন (Sowen) হিসেবে উচ্চারিত হয়। যেমনটি ভ্যালেন্টাইনস ডে’র ক্ষেত্রে ঘটেছিল। খ্রিস্টানরা এর নাম পরিবর্তন করে ঠিকই, কিন্তু পৌত্তলিক শিকড় পরিবর্তন করতে পারেনি।

দৃশ্যত নির্দোষ অনুষ্ঠানেরও পৌত্তলিক শিকড় থাকতে পারে। পূর্বকালে মানুষ ভূতপ্রেতকে ভয় পেত, বিশেষভাবে বছরের শুরুতে বা তাদের জন্মদিনে। একটি প্রচলিত বিশ্বাস ছিল, মন্দ প্রেরণা একজন ব্যক্তির জন্য অধিক বিপজ্জনক যখন কেউ প্রাত্যহিক জীবনে একটি পরিবর্তনের অভিজ্ঞতা অর্জন করে। কাজেই সে ব্যক্তির পরিবার ও চার পাশের বন্ধুবান্ধব হাসি-আনন্দের মাধ্যমে জন্মদিনে বা বছরের শুরুতে তাকে মন্দ থেকে রক্ষা করতে সচেষ্ট হতো, যাতে তার কোনো ক্ষতি না হয়।

কিন্তু কী করে একজন সচেতন মানুষ ভাবতে পারে, ইসলাম অনৈসলামিক ধারণা ও বিশ্বাসের ওপর প্রতিষ্ঠিত অযৌক্তিক আচার অনুষ্ঠানের ব্যাপারে উদাসীন থাকবে? অথচ বাস্তবতা হলো, এটি একটি বিশাল ট্র্যাজেডি যে, মিডিয়ার মাধ্যমে নিত্যবাণিজ্যিক ও সাংস্কৃতিক অপপ্রচারে মুসলমানেরা ভালোবাসা দিবস (Valentine day) হেলোইন (Halloween) এবং এমনকি সান্তাক্লজকেও (Sant claus) আলিঙ্গন করে নেয়।’’ (ইম্প্যাক্ট ইন্টারন্যাশনাল, লন্ডন, মার্চ ২০০১)

আমাদের করণীয়

ভ্যালেন্টাইনস ডে বা ভালোবাসা দিবসের ইতিহাস উপরে বর্ণনা করা হয়েছে। এ রকম একটি পৌত্তলিকতা ও কুসংস্কারভিত্তিক অনুষ্ঠান বাংলাদেশের মতো একটি ধর্মপ্রাণ মুসলিম দেশে যেখানে জনগণের শতকরা ৯০জন মুসলমান সেখানে কিভাবে পালিত হতে পারে?

ইসলাম আমাদেরকে প্রকৃত ও অকৃত্রিম ভালোবাসাই শিক্ষা দেয়, যা এ ধরনের অনুষ্ঠানের ওপর নির্ভর করে না। আমাদের দেশে এটি বর্তমানে অত্যন্ত নোংরা কালচারে পরিণত হয়েছে। এটি লাগামহীন অশ্লীলতা, তরুণ-তরুণীদের অবাধ মেলামেশা এবং ব্যভিচারের একটি মাধ্যমে পরিণত হয়েছে। সুতরাং এটি কিছুতেই মুসলমানদের এবং বাংলাদেশীদের সংস্কৃতির অংশ হতে পারে না।

পাশ্চাত্য সংস্কৃতির এমন কোনো অংশ যা অশ্লীল ও অশালীন, আমাদের দেশে তা পালন করা কিছুতেই উচিত নয়। উপরন্তু বর্তমানের কর্পোরেট দুনিয়া লাগামহীন বিত্তের পেছনে ছুটছে। যে কাজে অর্থ উৎপাদন হবে, সেটাই তাদের কাছে পূজনীয়। সে কাজকেই তারা বাণিজ্য ও পণ্য বাজারজাতের মাধ্যম হিসেবে গ্রহণ করে। কখনো বিনোদনের নামে পণ্যের বিজ্ঞাপন দেয়, কখনো সংস্কৃতির নামে। কিন্তু সবকিছুর মূলে থাকে বাণিজ্য। এই যে বিভিন্ন ধরনের খেলা, ক্রিকেট, ফুটবল আরও যত খেলা আছে; এগুলো দ্বারা পণ্য বাজারজাত করাই মূল উদ্দেশ্য। যেমন ধরুন, কোমল পানীয়ের কোম্পানীগুলো কোটি কোটি টাকা বিজ্ঞাপনের পেছনে খরচ করছে। এ উদ্দেশ্যে তারা নানা বিজাতীয় অসংস্কৃতি এদেশের আমদানী করতে প্রয়াস পায়।

শফিক রেহমানের মতো সেরূপ কিছু অপসংস্কৃতির দোসর আমাদের দেশে ‘ভালোবাসা দিবস’-এর মতো ঘৃণ্য ও নিন্দিত সংস্কৃতি আমদানী করেছে। এ কুসংস্কৃতি আমাদের দেশের মানুষের ধর্মবিশ্বাস ও রীতি-নীতির সঙ্গে মানায় না। বিবাহ-বহির্ভূত যে কোনো প্রেম-ভালবাসা বা আদান-প্রদান ইসলামে ও আমাদের সমাজে নিষিদ্ধ। অথচ আজ সেই নিষিদ্ধ সংস্কৃতি পালন করে দেশ ও সমাজকে কলুষিত করা হচ্ছে।

এ ঘৃণ্য ও অশ্লীল অপসংস্কৃতি বন্ধ করতে আমাদের সোচ্চার হতে হবে। এ জন্য এদেশের আলেম-উলামা, ইমাম-খতীব, ওয়ায়েজ, শিক্ষক, সাংবাদিক, চিন্তাবিদ ও সামাজিক কর্মীগণ সকলের কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণের জন্য এগিয়ে আসতে হবে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *