মুফতী আবুল হাসান শামসাবাদী
‘শহীদগণের কবরে জীবিত থাকা’ ও ‘হায়াতুন্নবী (সা.)’ প্রসঙ্গে ডাক্তার জাকির নায়েকের মতবাদ হলো–
ডাক্তার জাকির নায়েক বলেন–
“ পবিত্র কুরআনের সূরাহ বাক্বারায় আছে–‘আল্লাহর পথে যারা নিহত হয়, তাদের মৃত বলো না। বরং তারা জীবিত।’ অনেকে বলবে–তাহলেতো তারা বেঁচে আছেন। তাদের সাথে কথা বলতে পারবো। এখন এই শহীদরা যদি জীবিত হন, তাহলে আমাদের নবীজীও বেঁচে আছেন। খুব সুন্দর যুক্তি। কিন্তু সাহাবীগণ এটা কীভাবে বুঝেছিলেন? তারা কি ধরে নিয়েছিলেন যে, নবীজী বেঁচে আছেন? নবীজীকে তারাই কবর দিয়েছেন। তারা নবীজীর জানাযার নামাযও পড়েছেন। যুদ্ধের ময়দানে যখন মুসলিমরা শহীদ হয়েছেন, সাহাবীগণ তাদের জানাযার নামাযও পড়েছেন। জীবিত কারো জানাযার নামায কি পড়া যায়? না। বরং এখানে কুরআনের আয়াত বলছে–শত্রুরা যখন উল্লাস করে বলে–তোমাদের লোকদের মেরেছি, তবে তাদের সাথে পরকালে দেখা হবে। তারাই সবচেয়ে লাভবান। সুতরাং এখানে শারীরিক বেঁচে থাকার কথা বলা হচ্ছে না। যদি শারীরিকভাবে বেঁচে থাকতেন, সাহাবীগণ তাদেরকে কবর দিবেন কেন? ”
(দ্রষ্টব্য : ডা. জাকির নায়েক লেকচার সমগ্র, ভলিয়াম নং ৫, পৃষ্ঠা নং ৯৫ ॥ প্রকাশনায় : পিস পাবলিকেশন–ঢাকা)
ডাক্তার জাকির নায়েকের উক্ত বক্তব্যের ভিডিও ইন্টারনেটের ইউটিউবে “FULL – Unity of the Muslim Ummah – Dr. Zakir Naik” নামে রয়েছে। ইউটিউবে তার উক্ত বক্তব্য সরাসরি শুনতে নিম্নোক্ত লিঙ্কে লগইন করুন (উল্লেখ্য, এ ভিডিওটির ১ ঘন্টা ২২ মিনিট ১৬ সেকেন্ড থেকে সেই বক্তব্যটি পাবেন) –
এ ছাড়াও ডাক্তার জাকির নায়েকের উক্ত বক্তব্য ইউটিউবে বাংলা ভার্সনে “Bangla! Unity of the Muslim Ummah By Dr.Zakir Naik (Full)” নামে রয়েছে। তার উক্ত বক্তব্য বাংলা ভার্সনে শুনতে ইউটিউবের নিম্নবর্ণিত লিঙ্কে লগইন করুন (উল্লেখ্য, এ ভিডিওটির ১ ঘন্টা ২১ মিনিট ১৪ সেকেন্ড থেকে সেই বক্তব্যটি রয়েছে) –
♦ পর্যালোচনা ♦
হায়াতুন নবী (সা.) ও হায়াতুশ শুহাদা তথা হযরত রাসূলুল্লাহ (সা.) ও ইসলামের জন্য জীবন-প্রাণ উৎসর্গকারী শহীদগণের কবরে সশরীরে বিশেষ হায়াতের সাথে জীবিত থাকা ইসলামের একটি গুরুত্বপূর্ণ আকীদা। তাদের এ জীবিত থাকার অর্থ এটা নয় যা ডাক্তার জাকির নায়েক বলেছেন যে, তারা মারা যাননি। বরং দুনিয়ার হিসেবে তো তারা পরপারে চলে গিয়েছেন, যে জন্য তাদের জানাযা পড়া হয়েছে এবং তাদেরকে কবর দেয়া হয়েছে। এক্ষেত্রে হায়াতুন্নবী ও হায়াতুশ শহীদ-এর অর্থ হলো, তারা মৃত্যুর পর কবরের বারযাখী জীবনে সাধারণ মুমিনদের চেয়ে পৃথক বিশেষ মর্যাদাপূর্ণ বৈশিষ্ট্যের হায়াতের সাথে জীবিত আছেন।
পবিত্র কুরআনের বহু আয়াত ও অসংখ্য হাদীস দ্বারা এ হায়াতুন্নবী ও হায়াতুশ শহীদ আকীদা অকাট্যভাবে প্রমাণিত হয়েছে। শহীদগণের কবরে বিশেষ হায়াতের সাথে জীবিত থাকা সম্পর্কে পবিত্র কুরআনে মহান আল্লাহ ইরশাদ করেন–
وَلَا تَحۡسَبَنَّ الَّذِیۡنَ قُتِلُوۡا فِیۡ سَبِیۡلِ اللّٰہِ اَمۡوَاتًا ؕ بَلۡ اَحۡیَآءٌ عِنۡدَ رَبِّہِمۡ یُرۡزَقُوۡنَ
“যারা আল্লাহর পথে নিহত (শহীদ) হয়েছে, তোমরা তাদেরকে মৃত জ্ঞান করো না। বরং তারা জীবিত, তারা তাদের রব-প্রতিপালকের নিকট রিযিকপ্রাপ্ত হয়।”
(সূরাহ আলে ইমরান, আয়াত নং ১৬৯)
তেমনি নবীগণের (আ.) কবরে জীবিত থাকা সম্পর্কে বহু হাদীস বর্ণিত হয়েছে। যেমন, সহীহ হাদীস শরীফে বর্ণিত হয়েছে–
عَنْ أَنَسِ بْنِ مَالِکٍ رضي الله عنه قَالَ : قَالَ رَسُوْلُ اﷲِ صلي الله عليه وآله وسلم : الْأَنْبِيَاءُ أَحْيَاءٌ فِي قُبُوْرِهِمْ يُصَلُّوْنَ
হযরত আনাস ইবনে মালিক (রা.) হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেন–“নবীগণ তাদের কবরে জীবিত–তারা নামায আদায় করেন।”
(বাইহাকী–হায়াতুল আম্বিয়া, ১৫ শ খণ্ড, ১৪৮ পৃষ্ঠা/ সুনানে আবু ইয়ালা, হাদীস নং ৩৪২৫)
অনুরূপভাবে হায়াতুন্নবী (সা.) তথা রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর স্বীয় রওজা মুবারকে সশরীরে অনন্য বৈশিষ্ট্যে জীবিত থাকার প্রমাণে বহু হাদীস রয়েছে। যেমন, একটি হাদীসে রয়েছে–
عَنْ أَبِي الدَّرْدَاءِ قَالَ: قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: أَكْثِرُوا الصَّلَاةَ عَلَيَّ يَوْمَ الْجُمُعَةِ فَإِنَّهُ مَشْهُودٌ تَشْهَدُهُ الْمَلَائِكَةُ، وَإِنَّ أَحَدًا لَنْ يُصَلِّيَ عَلَيَّ إِلَّا عُرِضَتْ عَلَيَّ صَلَاتُهُ حَتَّى يَفْرُغَ مِنْهَا، قَالَ:قُلْتُ: وَبَعْدَ الْمَوْتِ ؟! قَالَ: وَبَعْدَ الْمَوْتِ، إِنَّ اللَّهَ حَرَّمَ عَلَى الْأَرْضِ أَنْ تَأْكُلَ أَجْسَادَ الْأَنْبِيَاءِ. فَنَبِيُّ اللَّهِ حَيٌّ يُرْزَقُ.
হযরত আবুদ দারদা’ (রা.) হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেন–“তোমরা জুমু‘আর দিন আমার উপর বেশী করে দরূদ শরীফ পড়বে। কারণ, এটা উপস্থিতির দিন–এদিন ফেরেশতাগণ উপস্থিত হন। আর তোমাদের কেউ যখনই আমার প্রতি দরূদ পড়ে, তখনই সেই দরূদ আমার নিকট পেশ করা হয়–এ পর্যন্ত যে, সে দরূদ পড়া থেকে ফারেগ হয়।” হযরত আবুদ দারদা’ (রা.) বলেন, আমি বললাম–(আপনার) ওফাতের পরও এটা হবে? রাসূলুল্লাহ (সা.) বললেন–হ্যাঁ, ওফাতের পরও এটা হবে। আল্লাহ তা‘আলা যমিনের ওপর হারাম করেছেন যে, নবীগণের শরীর ভক্ষণ করবে। তাই আল্লাহর নবী জীবিত ও রিযিকপ্রাপ্ত হন।”
(সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদীস নং ১০৮৫)
কিন্তু ডাক্তার জাকির নায়েক এ অকাট্য ঈমানী বিষয়কে অস্বীকার করে পবিত্র কুরআন ও হাদীসের সে সকল স্পষ্ট বর্ণনার বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছেন (নাউযুবিল্লাহ)। এটা তার মারাত্মক পথভ্রষ্টতা ও গোমরাহী।
নবী (সঃ) জীবিত নাকি মৃত ?
আমাদের সমাজে কিছু আলেম এমন সব বিভ্রান্তি ছড়াচ্ছেন যা থেকে মানুষের মনে ইসলাম সম্পর্কে নেতিবাচত প্রভাব পড়বে। এই প্রবন্ধটি তার অন্যতম। এখানে জীবিত এবং মৃত শব্দ দুটি নিয়ে ধুম্রজাল সৃষ্টি করা হয়েছে। তার প্রধান কারণ হচ্ছে লেখক নিজেই এ নিয়ে বিভ্রান্ত। এই বিভ্রান্তির মূল কারণ হচ্ছে এ বিষয়ে জ্ঞানের স্বল্পতা।
আমরা যদি ইনাদের দাবি মানি অর্থাৎ আল্লাহর নবী (সঃ) এবং শহিদগণ মারা যান নাই, তাঁরা এখনও পৃথিবীর জীবনের মত জীবিত তাহলে পবিত্র কোরানের অনেক আয়াতকে অস্বীকার করা হবে বা ভুল বলতে হবে। আল্লাহ বলেন – প্রত্যেক আত্মা মরণশীল, মৃত্যু থেকে কেউ রক্ষা পাবে না …, হে মুহাম্মদ আপনিও মৃত্যুবরণ করবেন…., মুহাম্মদ যদি মারা যান বা নিহত হন তোমরা কি আবার পূর্বাবস্থায় ফেরত যাবে…? এখানেই মৃত্যুর অনিবার্যতার প্রমাণ।
যে সকল আয়াত দিয়ে এই বিভ্রান্তি ছড়ানো হচ্ছে তার অন্যতম দুইটি আয়াত হচ্ছে – “যারা আল্লাহর পথে নিহত (শহীদ) হয়েছে, তোমরা তাদেরকে মৃত জ্ঞান বলো না (২/১৫৪) … মৃত জ্ঞান করো না (৩/১৬৯)। এখানে ২য় আয়াতটি প্রথম আয়াতের ব্যাখ্যা। আয়াত দুটিতে মহান আল্লাহ প্রথমে নিহত বা মৃত্যু বরণ করার কথা ঘোষণা দিয়েছেন যেটি জীবের মরণশীলতার আয়াতগুলির সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ। সেটাই মৃত্যু বা ইহজাগতিক মৃত্যু। তাদেরকে ‘মৃত বলো না’ বা ‘মৃত জ্ঞান করো না’ হচ্ছে মৃত্যু পরবর্তী পরকালীন জীবনের একটি ভিন্ন আঙ্গিকের জীবন। খোলাসা করে বললে বলা যায় – মৃত্যুর পরে সকল মানুষকে পরকালীন জীবন দেয়া হবে সেই অর্থে সকল আত্মাই জীবিত কিন্তু তাদের কিছুই করার বা চাওয়ার ক্ষমতা থকবে না। নবী এবং শহিদগণের বেলায় তা ভিন্ন। তাদেরকে নির্দিষ্ট কিছু করা স্বাধীনতা দেয়া হবে। তার অর্থ এই নয় যে, তাঁরা পৃথিবীর জীবনের মতো জীবিত। মাটি কুড়লে জীবিত বের করা যাবে ইত্যাদি।
এই সব বিষয় মানুষের সীমিত জ্ঞানের বা বোধগম্যতার বাইরে। এ নিয়ে গবেষণা বা বিতর্ক করা যাবে না। সংক্ষেপে এর কারণ ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করছি: –
১ । নবীগণ তাঁদের কবরে সারাক্ষণ সালাত রত থাকেন, কেউ লিখেছেন নামাজ (!) আদায় করেন। ২। অন্য হাদিসে আছে – কোন উম্মত আল্লাহর নবীকে সালাম দিলে ফেরেশতাগণ তা তাঁর কাছে পেশ করেন, তিনি তাঁর জবাব দেন। তাঁর কবরের পাশে দাঁড়িয়ে সালাম দিলে তিনি শুনেন এবং জবাব দেন। নবী (সঃ) যদি নামাজে থাকেন তাহলে জবাব কিভাবে দেন কারণ ২৪ ঘণ্টায় এমন এক মুহুর্ত নাই যখন কোন উম্মত আল্লাহর নবীকে সালাম দেয় না ? অন্য এক প্রশ্ন হচ্ছে আল্লাহর নবী কি কবরে নাকি ‘ওয়াসীলা’ নামক জান্নাতের সর্বোচ্চ স্তরে? হাদিসে আছে – মেহরাজে যাওয়ার পথে মুসা (আঃ) কে সালাতরত দেখলেন, আবার ৪র্থ আসমানে দেখলেন, বাইতু মুক্বাদ্দিসে নামাজ পড়লেন। আদম (আঃ) কবরে? নাকি প্রথম আসমানে বাচ্চাদের নিয়ে খেলা করছেন?
অতএব শেষ কথা হচ্ছে একজন মুমিনের আক্বীদা হতে হবে এ রকম – আল্লাহর নবী জাগতিক জীবন শেষে মারা গেছেন, সকল মানুষ যেভাবে মারা যান। তাঁর জানায়া হয়েছে, কবরস্ত করা হয়েছে।। কবরে তাঁর শরীর অক্ষত আছে যা কেবল নবীগণের বেলায় আল্লাহ নিশ্চয়তা দিয়েছেন। তিনি (সঃ) মৃত্যু পরবর্তী বারযাখি জীবনে ভিন্ন আঙ্গিকে জীবনপ্রাপ্ত। সালাতরত, সালামের জবাব দেন, ফেরেশতাগণ সর্বক্ষন দরুদ সম্পর্কে তাঁকে অবগত করানো করা হয়…..। একই সাথে এতোসব কি করে সম্ভব ? সেটা আল্লাহই ভাল জানেন। এই জগতে থেকে ওই জগত সম্পর্কে বুঝার জ্ঞান কোন মানুষের নাই। এ নিয়ে বেশি তর্ক বা গবেষণা করলে বিভ্রান্তি বাড়বে বটে; কোন সমাধান পাওয়া যাবে না। আল্লাহু আ’লামু বিচ-ছাওয়াব………..।