মসজিদে মহিলাদের নামাযের ব্যবস্থা: শরীয়ত কী বলে?

 


 লিখেছেন: মুফতী নূর মুহাম্মদ


আজ পৃথিবীতে অশ্লীলতা ও বেহায়াপনার ছড়াছড়ি। ইসলামের শত্রুরা বিভিন্ন কৌশলে মুসলমানদের ঈমান, আকীদা, কৃষ্টি-কালচার ধ্বংসের ষড়যন্ত্রে লিপ্ত। তাদের একটি বড় ষড়যন্ত্র মুসলিম নারীদের ঘর থেকে বের করে ইসলামী চিন্তা-চেতনাকে সমূলে বিনাশ করা। তাদের রাষ্ট্রবিরোধী, সমাজবিরোধী বিভিন্ন অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে ইসলামও মুসলমানদের সুনাম ক্ষুণ্ণ করা। ইসলাম ও মুসলমানদের বিরুদ্ধে চতুর্মুখী ষড়যন্ত্রের এই যুগে বন্ধুবেশী বিশেষ একটি মহল সরলমনা মুসলিম নারীদের দ্বীনের দোহাই দিয়ে ঘর থেকে বের করার নতুন কৌশল অবলম্বন করেছে। তা হচ্ছে, সাওয়াবের লোভ এবং বিভিন্ন যুক্তি দেখিয়ে নারীদের নামাযের জন্য মসজিদে এবং ঈদগাহে নিয়ে যাওয়া। প্রতারিত হয়ে নারী রাও অধিক সাওয়াবের আশায় গৃহকোণ ত্যাগ করে মসজিদ ও ঈদগাহে ছুটে চলছে।

অথচ নারীদের ওপর ঈদ ও জুমু’আর নামায কোনটাই ওয়াজিব নয়। পাঁচ ওয়াক্ত নামাযের জন্যও মহিলাদের মসজিদে না গিয়ে ঘরে পড়াতেই বেশি সাওয়াব বলে সহীহ হাদীসে প্রমাণিত। তাদের জামাতে নামায আদায়ের জন্য ঘর থেকে বের হওয়া শরীয়ত অনুমোদিত নয়। বিষয়টি স্পষ্ট হওয়ার জন্য কোরআন-হাদীসের আলোকে সামান্য আলোকপাত করা হলো।

নারীদের ঘর থেকে বের হওয়ার বিধান পবিত্র কোরআনের অনেক আয়াতে এবং রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-এর অসংখ্য হাদীসে মহিলাদের নিজ নিজ ঘরে অবস্থান করার প্রতি অত্যধিক তাগিদ দেওয়া হয়েছে। সেসব আয়াত ও হাদীসসমূহ পর্যালোচনা করলে বুঝে আসে, যতদূর সম্ভব নারীদের স্বীয় গৃহে অবস্থান করা এবং একান্ত অপারগতা ব্যতীত ঘর থেকে বের না হওয়া জরুরি। মহান আল্লাহ তা’আলা ইরশাদ করেন,

“আর তোমরা নিজ গৃহে অবস্থান করবে এবং প্রাক-জাহেলী যুগের মতো সৌন্দর্য প্রদর্শন করো না। আর তোমরা নামায কায়েম করো, যাকাত প্রদান করো এবং আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের আনুগত্য করো। হে নবী পরিবার! আল্লাহ তো কেবল চান তোমাদের থেকে অপবিত্রতাকে দূরীভূত করতে এবং তোমাদের সম্পূর্ণরূপে পবিত্র করতে। আর তোমাদের ঘরে আল্লাহর যে আয়াতসমূহ ও হিকমত পঠিত হয়, তা তোমরা স্মরণ রেখো। নিশ্চয়ই আল্লাহ অতি সূক্ষ্মদর্শী, সম্যক অবহিত।” (সূরা আহজাব, আয়াত ৩৩, ৩৪) হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেন,

“নারীগণ আপাদমস্তক ঢেকে রাখার বস্তু। যখনই সে ঘর থেকে বের হয় শয়তান তার প্রতি উঁকি ও কুদৃষ্টি দিতে থাকে।” (জামে তিরমিযী, হা. ১১৭৩)

অন্য বর্ণনায় রয়েছে, “নিঃসন্দেহে তখনই সে আল্লাহর পছন্দনীয় থাকে, যখন স্বীয় বাড়ির সবচেয়ে গোপন স্থানে অবস্থান করে।” (সহীহ ইবনে খুযাইমা, হা. ১৬৮৬) ইমাম তিরমিযী (রহ.) বলেন, হাদীসটি হাসান ও সহীহ।

আরেক হাদীসে রাসূলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেন, “নারীদের সৌন্দর্যের দিকে তাকানো ইবলিস শয়তানের বিষাক্ত তীরসমূহ থেকে একটি তীর।” (মুস্তাদরাকে হাকেম , হা. ৭৮৭৫, হিলয়াতুল আওলিয়া ৬/১০১)

হাকেম (রহ.) বলেন, হাদীসটি সহীহ।

সবার জানা আছে যেকোনো তীর ভয়ঙ্কর মারণাস্ত্র, আর বিষাক্ত তীর আরো ভয়ঙ্কর প্রাণঘাতী। মানুষের ঈমান-আমল নষ্ট করার এবং তাদের পথভ্রষ্ট করার অসংখ্য হাতিয়ার শয়তানের রয়েছে। তন্মধ্যে সর্বাধিক ভয়ঙ্কর নারী। এ ব্যাপারে শয়তানের বক্তব্য চিন্তাশীল ব্যক্তিদের চিন্তাশক্তিকে আরো গতিশীল করবে।

বিভিন্ন কিতাবে উল্লেখ আছে: যখন আল্লাহ তা’আলা নারী জাতিকে সৃষ্টি করেন, তখন ইবলিস বলল, তুমি (হে নারী) একাই আমার বাহিনীর অর্ধেকের সমতুল্য। তুমি আমার রহস্য ভেদের স্থান। তুমি আমার সেই তীর, যা কখনো লক্ষ্যভ্রষ্ট হয় না। (মাকাইদুশ শয়তান, ইবনে আবিদ্দুনিয়া, পৃ : ৫৯)

উপর্যুক্ত আয়াত ও হাদীসসমূহ থেকে বোঝা গেল, নারীদের ঘরে অবস্থান করার মধ্যেই তাদের নিজেদের এবং অন্য সকলের মঙ্গল নিহিত। নারীদের নামায একজন ব্যক্তি নারী হোক, পুরুষ হোক ঈমান আনয়ন করার পর সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ যে ইবাদতটি করতে হবে তা হলো নামায। নামায আদায় জামাতের সাথেও করা যায়, একাকীও করা যায়। নামায আদায়ের স্থান মসজিদও হতে পারে, আবার ঘর বা অন্য কোনো স্থানও হতে পারে। এসব বিষয়ে নারী-পুরুষের মধ্যে বিধানগত দিক দিয়ে যথেষ্ট পার্থক্য রয়েছে। দুজনের বিধান এক ও অভিন্ন মনে করার অবকাশ নেই। কোরআন – হাদীস ও শরীয়তের বিধিবিধান সম্পর্কে অজ্ঞ, অনভিজ্ঞ ও অপরিণামদর্শীরাই এসব বিষয়ে নারী-পুরুষকে এক কাতারে দাঁড় করানোর অপচেষ্টায় লিপ্ত।

রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) যেখানে যথেষ্ট ছাড় দিয়ে শিথিলতা প্রদর্শন করে নারীদের একাকী ঘরে নামায আদায়ের নির্দেশ ও উৎসাহ দিয়েছেন, সেখানে কিছু অপরিণামদর্শী লোক রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-এর দেওয়া ছাড়কে উপেক্ষা করে কথিত দ্বীন ও সাওয়াবের নামে তাদের ঘর থেকে বের করে পুরুষের কাতারে দাঁড় করানোর জন্য উঠেপড়ে লেগেছে। তাদের পক্ষে শরীয়তের মেজাজ বোঝা কঠিন ও অসম্ভব হওয়ারই কথা। দু’আ করি, আল্লাহ তা’আলা সকলকে দ্বীনের সহীহ বুঝ দান করুক। এখানে নারীদের নামায প্রসঙ্গে কিছু আলোচনা করার প্রয়াস পাব ইনশাআল্লাহ।

জামাতের বিধান নারীদের জন্য নয় :

ফরয নামায জামাতের সহিত আদায় করা পুরুষদের জন্য ওয়াজিবের পর্যায়ের। অসংখ্য হাদীস দ্বারা এটা প্রমাণিত। কিন্তু মসজিদের জামাতে নারীদের অংশগ্রহণ ওয়াজিব, সুন্নাত, মুস্তাহাব, নফলÑকোনটাই নয়। বিভিন্ন হাদীসের আলোকে এটাই স্পষ্ট প্রমাণিত। নমুনাস্বরূপ কয়েকটি হাদীস উদ্ধৃত হলো।

১.

যেসব পুরুষ জরুরতবিহীন মসজিদে না এসে ঘরে নামায পড়ে তাদের বিষয়ে রাগান্বিত হয়ে রাসূল (সা.) ধমকিস্বরূপ বলেন, “যদি ঘরগুলোতে নারী ও শিশুসন্তান না থাকত তাহলে আমি এশার নামাযের ইমামতির দায়িত্ব অন্যজনকে দিয়ে কিছু যুবক দলকে দিয়ে ঘরের সব কিছু জ্বালিয়ে দিতাম।” (মুসনাদে আহমাদ, হা. ৮৭৯৬, মুসনাদে আবী দাউদ ত্বায়ালিসি, হা. ২৪৪৩)

উক্ত হাদীসে নারী ও শিশু না থাকলে ঘর জ্বালানোর কথা এ জন্যই বলা হয়েছে যেহেতু মহিলা ও শিশুর ওপর মসজিদের জামাত নেই, তাই এখানে বালেগ পুরুষদেরই উক্ত ধমকি দেওয়া হয়েছে। এতে সুস্পষ্ট প্রমাণিত হয় যে মসজিদের জামাতের বিধান নারীদের জন্য নয়।

২.

হযরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেন,  “ওই সত্ত্বার কসম, যার হাতে আমার জীবন! আমার ইচ্ছা হয় কাউকে জ্বালানি কাঠ সংগ্রহ করার নির্দেশ প্রদান করি। আর কাউকে আযান দেওয়ার হুকুম করি। অতঃপর একজনকে ইমামতি করার আদেশ করে স্বয়ং নিজে গিয়ে সেসব পুরুষের ঘর জ্বালিয়ে দিই, যারা জামাতে অংশগ্রহণ করেনি।” (বোখারী হা. ৭২২৪)

এই হাদীসে শুধুমাত্র পুরুষদের ঘর জ্বালিয়ে দেওয়ার ধমকি দেওয়া হয়েছে। বোঝা গেল নারীদের জামাতে অংশগ্রহণ করার বিধান শরীয়তে নেই।

৩.

ইবনে উমর (রা.)-এর সূত্রে বর্ণিত আরেক হাদীসে রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) ইরশাদ করেন, নারীদের জামাতে কোনো কল্যাণ নেই।……কারণ তারা কোনো স্থানে সমবেত হলে স্ব ভাবসুলভ আলাপচারিতায় মত্ত হয়। (আল মুজামুল কাবীর, হা. ১৩২২৮)

মুসলমান মাত্রই এ কথা জানে যে মসজিদ  ইবাদতের জায়গা। আলাপচারিতার স্থান নয়। আর এটাও বাস্তব সত্য যে, নারীদের স্বভাবসুলভ ব্যাপার হলো, তারা কোনো স্থানে একত্রিত হলে পরস্পর রে বিভিন্ন আলাপচারিতায় মগ্ন হয়, যা মসজিদের পবিত্রতার পরিপন্থী কোনো সন্দেহ নেই।

এ কারণেই রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) তাদের সমবেত হওয়ার মধ্যে কোনো কল্যাণ নেই মর্মে ঘোষণা করেছেন। এর পরও কি দ্বীন ও সাওয়াবের দোহাই দিয়ে নারীদের  জামাতে অংশগ্রহণের প্রতি উদ্বুদ্ধ করা, কল্যাণকর বলার অবকাশ আছে? নাকি সরলমনা মুসলিম নারীদের নামাযের নামে মসজিদে একত্রিত করে তাদের দ্বারা রাষ্ট্রবিরোধী এবং বিভিন্ন অপরাধমূলক কাজ করিয়ে তাদের উজ্জ্বল ভবিষ্যৎকে ধূলিস্যাৎ করে দেওয়াই কোনো কুচক্রী মহলের অভীষ্ট লক্ষ্য। দৈনিক খবরের কাগজে নজর বোলালেও এর সত্যতার প্রমাণ মেলে।

জুমুআর নামাযে নারীদের অংশগ্রহণ :

নারীদের জুমু’আর নামায আদায় করার জন্য মসজিদে আলাদা সুব্যবস্থা রাখার জন্য অনেকে নিজেদের সবটুকু দিয়ে চেষ্টা করে। তারা মনে করে, এটা অনেক বড় সাওয়াব ও পুণ্যের কাজ। কথিত এই দ্বীনি কাজের জন্য তাদের মাতম চোখে পড়ার মতো।

কারো মাতমে প্রভাবিত না হয়ে আমাদের দেখতে হবে, বুঝতে হবে ইসলামী শরীয়ত নারীদের ওপর জুমু’আর নামায পড়ার বিধান রেখেছে কি না? হাদীসের বিশাল ভাণ্ডার অনুসন্ধান করে দেখা যায়, নারীদের ওপর জুমু’আ ওয়াজিব নয়। তাদের কোনো জুমু’আ নেই। এখানে কিছু হাদীস প্রদত্ত হলো।

১.

হযরত আবু মূসা (রা.) থেকে বর্ণিত, নবী করীম (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেন, “জামাতে জুমু’আর নামায পড়া প্রত্যেক মুসলমানের ওপর অকাট্য ওয়াজিব, তবে ক্রীতদাস, নারী, শিশু ও অসুস্থ ব্যক্তির ওপর ওয়াজিব নয়। (সুনানে আবী দাউদ, হা. ১০৬৭, মুস্তাদরাকে হাকেম, হা. ১০৬২)

ইমাম হাকেম (রহ.) বলেন, হাদীসটি ইমাম বোখারী ও মুসলিম (রহ.)-এর শর্ত অনুযায়ী সহীহ। হাফেয যাহাবি (রহ.)ও হাদীসটি সহীহ বলেছেন। (আল মুস্তাদরাক-টীকাসহ-১/২৮৮)

২.

হযরত মুহাম্মদ ইবনে কা’ব আল কুরাযী (রহ.) বলেন, রাসূল (সা.) ইরশাদ করেন, “যে ব্যক্তি আল্লাহর ওপর ঈমান রাখে তার ওপর জুমু’আ ফরয, তবে ক্রীতদাস, নারী, শিশু ও অসুস্থ ব্যক্তির ওপর ওয়াজিব নয়।” (মুসান্নাফে আবদুর রাযযাক, হা. ৫২০০)

হাদীসটির বিশুদ্ধতায় কোনো সন্দেহ নেই। (দেখুন, মা’রিফাতুস সুনানী ওয়াল আসার, হা. ৬৩৬৩)

সাহাবায়ে কেরামের পদক্ষেপ :

সাহাবায়ে কেরামের যুগে কোনো নারী জুমু’আর নামায আদায় করার জন্য মসজিদে চলে এলে তাঁরা তাদের সাথে কিরূপ আচরণ করতেন? কী পদক্ষেপ নিতেন? নিম্নের বর্ণনাসমূহ দ্বারা বিষয়টি অনুধাবন করা যায়।

১.

হযরত আবু আমর শায়বানী (রহ.) থেকে বর্ণিত, হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.) জুমু’আর দিন নারীদের মসজিদ থেকে বের করে দিতেন এবং বলতেন, আপনারা মসজিদ থেকে বের হয়ে ঘরে চলে যান। কারণ আপনাদের ঘরই আপনাদের জন্য নামাযের উত্তম স্থান। (আল মু’জামুল কাবীর, হা. ৯৪৭৫)

আল্লামা হাইসামী (রহ.) বলেন, এর সকল বর্ণনাকারী নির্ভরযোগ্য। (মাজমাউয যাওয়াইদ ২/৩৫)

২.

আব্দুল্লাহ ইবনে উমর (রা.)-এর ব্যাপারে বর্ণিত আছে, আব্দুল্লাহ ইবনে উমর (রা.) জুমু’আর নামায পড়ার জন্য কোনো নারী মসজিদে এলে তার দিকে পাথর ছুড়ে মারতেন এবং তাদের মসজিদ থেকে বের করে দিতেন। (উমদাতুল কারী ৬/১৫৭)

৩.

আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.)-এর ব্যাপারে বর্ণিত আছে, তিনি জুমু’আর দিন নারীদের পাথর মেরে মেরে মসজিদ থেকে বের করে দিতেন। (মুসান্নাফে ইবনে আবি শায়বা : ৭৬১৭)

উপর্যুক্ত বর্ণনাসমূহ থেকে বোঝা গেল, সাহাবায়ে কেরাম নারীদের জুমু’আর নামায আদায় করার জন্য মসজিদে ব্যবস্থা রাখা তো দূরের কথা, কেউ চলে এলে তাকে বারণ করতেন এবং বের করে দেওয়ার মতো কঠিন পদক্ষেপ গ্রহণ করতেন। উল্লেখ্য, তাঁদের এই পদক্ষেপ নারী জাতিকে অপমান করার উদ্দেশ্যে নয়। বরং আল্লাহর আজাব থেকে তাদের এবং মুসলিম উম্মাহকে বাঁচানোর জন্য ছিল। এই হলো ইসলামের সোনালি যুগের ঘটনা। যে যুগের লোকদের সর্বশ্রেষ্ঠ ও সর্বোত্তম হওয়ার স্বীকৃতি স্বয়ং রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) নিজের মোবারক যবানে দিয়েছেন। প্রায় সাড়ে চৌদ্দ শত বছর পর আজও সাহাবাদের আমল থেকে বিচক্ষণ, দূরদর্শী ও অন্তর্দৃষ্টিসম্পন্ন ব্যক্তিদের শিক্ষণীয় অনেক কিছুই আছে।

নারীদের নামাযের সর্বোত্তম স্থান :

মুসলমান মাত্রই তার ভেতর এই আবেগময় প্রশ্নের উদ্রেক হতে পারে যে পুরুষরা তো মসজিদে জামাতের সহিত নামায আদায় করে অসংখ্য নেকী অর্জনে সক্ষম। দ্বীনদার মুসলিম নারীরা মসজিদে যেতে না পারলে এই নেকী কিভাবে অর্জন করবে? এই আবেগ অবশ্যই প্রশংসার দাবি রাখে। কিন্তু সব কাজ আবেগের বশীভূত হয়ে করা যায় না। বিপদ ডেকে আনতে পারে।

বিশেষ করে নামাযের মতো একটি ইবাদত আবেগ দিয়ে নয় বরং দলিল ও প্রমাণের আলোকে সম্পাদন করতে হবে। রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) উম্মতের নারী সদস্যদের এই আবেগের যথার্থ মূল্যায়ন করে মসজিদে গিয়ে নামায পড়ার চেয়ে বেশি সাওয়াব অর্জনের পথ ও স্থান নির্দিষ্ট করে দিয়েছেন এবং ঘোষণা করেছেন, নারীগণের ঘরের নির্জন কক্ষের নামায মসজিদের নামাযের তুলনায় বেশি ফজীলতপূর্ণ। এ মর্মে কয়েকটি হাদীস উদ্ধৃত হলো।

১.

হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.) সূত্রে বর্ণিত,  “রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেন, নারীদের ক্ষুদ্র কক্ষের নামায বড় কামরার নামাযের তুলনায় উত্তম। ঘরের নির্জন কোণের নামায ক্ষুদ্র কক্ষের নামাযের তুলনায় উত্তম।” (আবু দাউদ, হা. ৫৭০)

অপর বর্ণনায় হাদীসটি হযরত উম্মে সালামা (রা.)-এর সূত্রে রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লা) থেকে আরো বর্ধিতভাবে বর্ণিত হয়েছে, “এবং নারীদের বাড়িতে নামায পড়া বাড়ির বাইরে নামায পড়ার চেয়ে উত্তম।” (আল মু’জামুল আওসাত, হা. ৯১০১) ইমাম নববী (রহ.) বলেন, হাদীসটির সূত্র ইমাম মুসলিমের শর্ত অনুযায়ী সহীহ। (খুলাসাতুল আহকাম ২/৬৭৮)

ইমাম হাকেম (রহ.) বলেন, হাদীসটি ইমাম বোখারী ও মুসলিম (রহ.)-এর শর্ত অনুযায়ী সহীহ। হাফেয যাহাবী (রহ.)-ও তাঁর সমর্থন করেছেন। (আল মুস্তাদরাক-টীকাসহ-১/২০৯)

২.

হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ থেকে আরো বর্ণিত আছে, “নারীদের কোনো নামায আল্লাহর নিকট তার ওই নামায অপেক্ষা পছন্দনীয় নয়, যা সে তার ঘরের অন্ধকার কক্ষে আদায় করে। (মাজমাউয যাওয়ায়েদ : ২১১৫)

নারীদের সর্বোত্তম মসজিদ :

রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) ঘরের নির্জন কক্ষকে নারীদের সর্বোত্তম মসজিদ আখ্যায়িত করেছেন এবং সেখানে আদায়কৃত নামাযের সাওয়াব শুধু সাধারণ মসজিদই নয় বরং মসজিদে নববীতে আদায়কৃত নামাযের সাওয়াবের চেয়েও বেশি বলে স্পষ্ট ঘোষণা দিয়েছেন। হযরত উম্মে সালামা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেন, নারীদের সর্বোত্তম মসজিদ তাদের ঘরের নির্জন কক্ষ। (মুসনাদে আহমাদ, হা. ২৬৫৪২)

প্রসিদ্ধ মুহাদ্দিস আল্লামা বুসিরী (রহ.) বলেন, হদীসটির সূত্র সহীহ। (ইতহাফুল খিয়ারাতিল মাহারা ২/৬৪)

৩.

আব্দুল্লাহ ইবনে সুয়াইদ আনসারী (রা.) থেকে বর্ণিত, একদা উম্মে হুমাইদ (নামক একজন মহিলা সাহাবী), যিনি আবু হুমাইদ সা-ইদি (রা.)-এর স্ত্রী, তিনি রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর নিকট গিয়ে বললেন, হে আল্লাহর রাসূল! আমি আপনার সাথে নামায আদায় করতে আগ্রহী। রাসূলুল্লাহ (সা.) বললেন, “আমি জানি তুমি আমার সাথে নামায আদায় করতে পছন্দ করো। কিন্তু তোমার জন্য গৃহের অন্দরমহলে নামায পড়া উত্তম; বড় কামরার তুলনায়। বড় কামরায় নামায পড়া উত্তম বারান্দার চেয়ে। বারান্দা উত্তম তোমার পাড়ার মসজিদের চেয়ে। নিজ পাড়ার মসজিদ উত্তম আমার মসজিদ থেকে।” এ কথা শোনার পর উম্মে হুমাইদ (রা.) তাঁর গৃহের নির্জন স্থানে একটি নামাযের স্থান বানানোর নির্দেশ দিলেন এবং সেখানেই মৃত্যু পর্যন্ত নামায আদায় করেন। (মুসনাদে আহমাদ, হা. ২৭০৯০, সহীহ ইবনে খুজাইমা, হা. ১৬৮৯)

হাফেজ ইবনে হাজার (রহ.) বলেন, হাদীসটি হাসান। (ফাতহুল বারী ২/২৯০)

এই হাদীসে মুসলিম নারীদের জন্য শিক্ষণীয় অনেক কিছুই আছে। মসজিদে নববীতে নামাযের ফজীলত : হযরত আবু হোরায়রা (রা.) সূত্রে বর্ণিত বোখারী শরীফের বর্ণনা অনুযায়ী, “মসজিদে নববীর এক নামাযে অন্য মসজিদের এক হাজার নামাে যর সাওয়াব পাওয়া যায়।” (বোখারী, হা. ১১৯০)

অপর হাদীসে রয়েছে, “একাকী নামাযের তুলনায় জুমু’আর মসজিদের নামাযে পাঁচ শত গুণ সাওয়াব বেশি।”

এতে প্রমাণিত হলো, একাকী নামাযের তুলনায় মসজিদে নববীর নামাযে পাঁচ লক্ষ গুণ সাওয়াব বেশি। তাহলে এবার চিন্তা করে দেখুন, রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর ঘোষণা থেকে বোঝা যায়, নারীদের “ঘরের নির্জন কক্ষে” আদায়কৃত নামাযের সাওয়াব মসজিদে নববীতে আদায়কৃত নামাযের চেয়ে পাঁচ লক্ষ গুণ বেশি উত্তম !!!

রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-এর সাথে বিরোধিতা :

পরিতাপের বিষয় হলো, আজকাল কিছু লোক সরলমনা মুসলিম নারীদের মসজিদে গিয়ে জামাতে অংশগ্রহণ করতে উদ্বুদ্ধ করে সুন্নাত মনে করে। সুন্নাত জিন্দা করার নাম দিয়ে তারা এই মিশনকে বাস্তবায়ন করার জন্য পুরোদস্তুর যুদ্ধ ঘোষণা করেছে।

শুধু মুসলিম উম্মাহর বিরুদ্ধেই নয় বরং স্বয়ং রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-এর বিরুদ্ধেও। যদি মসজিদে এসে নারীদের নামায আদায় ওয়াজিব সুন্নাত, মুস্তাহাব, নফল কোনো একটি বিধানের আওতায় পড়ত তবে রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) নারীদের ঘরের নির্জন কক্ষে আদায়কৃত নামাযকে মসজিদে নববীতে আদায়কৃত নামাযের তুলনায় বেশি ফজীলতপূর্ণ কেন বললেন?

তবে কি তাদের ভাষায় রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) মুসলিম নারীদের সুন্নাত পরিপন্থী কাজের প্রতি উৎসাহিত করেছেন? নাউযুবিল্লাহ।

মনে রাখতে হবে, একজন রাসূলপ্রেমিক সাচ্চা মুমিনের দৃঢ়বিশ্বাস এটাই হতে হবে যে মসজিদে হারাম এবং বায়তুল মুকাদ্দাসের পর সর্বোত্তম মসজিদ মসজিদে নববী। পৃথিবীর সমস্ত মসজিদের সমন্বিত ফজীলত মসজিদে নববীর সমমানের কস্মিনকালেও হবে না। বরং কোনো মসজিদকে মসজিদে নববীর সাথে তুলনা করাটাই চরম ধৃষ্টতা এবং চূড়ান্ত মূর্খতা।

রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-এর ইচ্ছার প্রতিফলন :

হাদীসের সঠিক মর্ম বোঝার জন্য সাহাবায়ে কেরাম রাদিয়াল্লাহু তা’আলা আনহুম-এর আমলকেও সামনে রাখতে হবে। বস্তুত সাহাবায়ে কেরাম থেকে রাসূল (সা.)-এর আদর্শবিরোধী কোনো কাজ প্রকাশ পাবেÑসেটা কল্পনাও করা যায় না।

তাই হাদীস শরীফের পাশাপাশি সাহাবীগণের আমলও দলিলরূপে গণ্য। কারণ তাঁরা ছিলেন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-এর সহচর। তাঁরা রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-এর মেজাজ বুঝতেন। রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-এর কথা ও কাজের মর্ম অন্তর্দৃষ্টি দ্বারা উপলব্ধি করতে পারতেন। তাই তো অনেক চাওয়া-পাওয়ার প্রতিফলন বাস্তবায়ন সাহাবীগণের যুগে ঘটবে বলে সহীহ হাদীসে রাসূল (সা.) সুস্পষ্ট বলে গিয়েছেন, “তোমরা আমার পরে খোলাফায়ে রাশেদীনের সুন্নাতকে দৃঢ়ভাবে আঁকড়ে ধরবে যেমন মাড়ির দাঁত দিয়ে কোনো জিনিস মজবুতভাবে ধরা হয়।” (সুনানে আবী দাউদ, হা. ৪৬০৭)

অপর হাদীসে হযরত হুযাইফা (রা.) বলেন, রাসূল (সা.) বলেছেন “জানি না আমি কত দিন তোমাদের মধ্যে থাকব। আমার পরে তোমরা আবুবকর ও উমরের অনুসরণ করবে।” (তিরমিযী, হা. ৩৬৬৩, মুস্তাদরাকে হাকেম, হা. ৪৪৫১, ৪৪৫৫)

ইমাম হাকেম (রহ.) হাদীসটি সহীহ বলেছেন।

হাফেয যাহাবী (রহ.)ও হাদীসটি সহীহ বলেছেন। (আল মুস্তাদরাক-টীকাসহ-৩/৭৯, ৮০)

রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) দুনিয়া ছেড়ে চলে যাওয়ার পর আমীরুল মু’মিনীন হযরত উমর ইবনুল খাত্তাব (রা.) স্বীয় খিলাফত আমলে যখন নারীদের বিগড়ে যাওয়ার অবস্থা উপলব্ধি করলেন এবং ফেতনার আশঙ্কাও দিন দিন বাড়তে লাগল তখন তিনি এবং উম্মুল মু’মিনীন আয়েশা ছিদ্দীকা, ইবনে মাসউদ ও ইবনুয যুবায়ের (রা.)সহ বড় বড় সাহাবায়ে কেরাম রাদিয়াল্লাহু আনহুম নারীদের মসজিদে না আসার আদেশ জারি করলেন।

অন্যান্য সাহাবায়ে কেরামও এ সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানালেন। কেননা তাঁরা জানতেন যে নারীদের মসজিদে আসতে নিষেধ করার মধ্যে রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর নির্দেশের বিরোধিতা করা হয়নি, বরং তাঁর ইচ্ছারই প্রতিফলন হয়েছে। সাহাবায়ে কেরামের পক্ষে রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর কোনো হুকুমের বিরোধিতা করার কল্পনাও করা যায় না। এতদসত্ত্বেও তাঁরা এ পদক্ষেপ গ্রহণ করেছিলেন এ জন্য যে রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-এর মনোবাসনা এটাই ছিল।

উম্মুল মুমিনীন হযরত আয়েশা (রা.), যিনি রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-এর মেজাজ বুঝতেন, চাহিদা উপলব্ধি করতেন তাঁর উক্তি থেকেই বিষয়টি প্রতিভাত হয়। তিনি বলেন, “নারীরা যে অবস্থার সৃষ্টি করেছে তা যদি রাসূল (সা.) দেখতেন, তবে বনী ইসরাঈলের নারীদের যেমন নিষেধ করা হয়েছিল, তেমনি এদেরও মসজিদে আসা নিষেধ করে দিতেন।” (সহীহ বোখারী, হা. ৮৬৯)

বোখারী শরীফের বিখ্যাত ব্যাখ্যাকার আল্লামা বদরুদ্দীন আইনি (রহ.) উক্ত হাদীসের ব্যাখ্যায় বলেন, “বর্তমান যুগে নারীরা শরীয়তবিরোধী যেসব পথ অবলম্বন করছে , পোশাক-পরিচ্ছদ আর রূপচর্চায় তারা যে নিত্যনতুন ফ্যাশন আবিষ্কার করছে, যদি উম্মুল মু’মিনীন আয়েশা (রা.) এই দৃশ্য দেখতেন তাহলে আরো কঠোরভাবে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করতেন।” (উমদাতুল কারী ৬/১৫৮)

আল্লামা আইনি (রহ.) আরো বলেন, “হযরত আয়েশা ছিদ্দীকা (রা.)-এর উক্ত মন্তব্য তো রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর দুনিয়া থেকে বিদায়ের কিছুদিন পরের নারীদের সম্বন্ধে। অথচ এ যুগের নারীদের বেহায়াপনার হাজার ভাগের এক ভাগও সেকালে ছিল না। তাহলে এ অবস্থা া দেখলে তিনি কী মন্তব্য করতেন?” (উমদাতুল কারী ৬/১৫৯)

এখানে চিন্তার বিষয় হলো, আল্লামা বদরুদ্দীন আইনি (রহ.) স্বীয় যুগ তথা হিজরি নবম শতাব্দীর নারীদের সম্বন্ধে এ কথা বলেছেন। তাহলে আজ হিজরি পঞ্চদশ শতাব্দীর এ যুগে সারা বিশ্ব যে অশ্লীলতা আর উলঙ্গপনার দিকে ছুটে চলেছে। বেপর্দা আর বেহায়াপনার আজ যে ছড়াছড়ি, মেয়েরা যখন পুরুষের পোশাক পরছে, পেট-পিঠ খুলে রাস্তা-ঘাটে বেড়াচ্ছে, সমানাধিকারের স্লোগান দিয়ে শরীয়তের বিধানাবলির লঙ্ঘন করছে। বোরকার মতো পবিত্র পোশাকের পবিত্রতা নষ্ট করছে। ঠিক সেই মুহূর্তে এই ফেতনা-ফ্যাসাদের মধ্যে অবলা মা-বোনদের সাওয়াবের রঙিন স্বপ্ন দেখিয়ে মসজিদে আর ঈদগাহে টেনে আনার অপচেষ্টা বোকামি বৈ কিছু নয়। অথচ দলিল-প্রমাণ হিসেবে দাঁড় করানো হচ্ছে রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর যুগের নারীদের।

প্রশ্ন হলো, এ যুগের নারীরা কি সে যুগের নারীদের মতো? কস্মিনকালেও না। তা সত্ত্বেও সে যুগেই মহিলাদের মসজিদে যেতে নিষেধ করা হয়েছে। তাহলে কিভাবে এ যুগের মহিলাদের মসজিদে ও ঈদগাহে গিয়ে নামাযের জন্য উৎসাহিত করা হবে?

ইমাম ইবনে আব্দিল বার (রহ.) স্বীয় কিতাব ‘আততামহীদ’-এ উল্লেখ করেন, স্ত্রী আতেকা বিবাহের সময় স্বামী উমর (রা.)-কে মসজিদে নববীতে গিয়ে নামাযের অনুমতি দেওয়ার শর্ত করেছিলেন, এ জন্য উমর (রা.) অপছন্দ করা সত্ত্বেও স্ত্রীকে নিষেধ করতে পারছিলেন না। কিন্তু উমর (রা.)-এর ইন্তেকালের পর হযরত যোবায়ের (রা.)-এর সাথে আতেকার বিবাহের পর স্বামী হযরত যোবায়ের (রা.)ও তাঁর মসজিদে যাওয়া অপছন্দ ও নিষেধ করতেন। তারপর কৌশলে তাঁর বের হওয়া বন্ধ করেন।

একদিন যখন আতেকা এশার সময় বের হলেন যোবায়ের (রা.) লুকিয়ে তাদের পশ্চাৎদেশে খোঁচা দিলেন। ওই দিন আতেকা (রা.) ঘরে ফিরে এসে বললেন, আল্লাহর পানাহ! মানুষ বিগড়ে গিয়েছে। অতঃপর আর কোনো দিন নামাযের জন্য ঘর থেকে বের হননি। (আল ইসাবাহ ৮/২২৮)

হাদীসের ভুল ব্যাখ্যা :

অনেকে একটি হাদীসের অপব্যাখ্যার আশ্রয় নিয়ে মসজিদে গিয়ে নারীদের নামায আদায় সুন্নাত বা সাওয়াবের কাজ প্রমাণ করার অপচেষ্টা করে থাকে। হাদীসটি হযরত ইবনে উমর (রা.)-এর সূত্রে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) ইরশাদ করেন, আল্লাহর বান্দিদের আল্লাহর মসজিদ থেকে নিষেধ করো না। (বোখারী, হা. ৪৪২)

এক শ্রেণীর লোক হাদীসের শাব্দিক অনুবাদ থেকে এটাই বোঝে যে মসজিদে গিয়ে নারীদের নামায পড়া সুন্নাত। তাদের মসজিদে যেতে বাধা দেওয়া যাবে না। এটা অন্যায়-গোনাহের কাজ।

সঠিক ব্যাখ্যা :

হাদীসটির সঠিক ব্যাখ্যা জানার আগে হাদীসটির মতন ‘মূল ভাষ্য’ জেনে নেওয়া সমীচীন। হাদীসের কিতাবপত্র অধ্যয়ন করলে হাদীসটির মতনে ‘মূল ভাষ্যে’ কিছুটা ভিন্নতা পরিলক্ষিত হয়। তবে সূত্র, অর্থাৎ বর্ণনাকারী সাহাবী একজন। তিনি হলেন আব্দুল্লাহ ইবনে উমর (রা.)। নি¤েœ বর্ণনাগুলোর ভিন্নতা তুলে ধরা হলো। এক বর্ণনায় আছে। রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেন, অন্য এক বর্ণনায়ও আছে।

উভয় হাদীসের শাব্দিক অর্থ একই। অর্থাৎ তোমাদের কোনো স্ত্রী লোক তোমাদের কাছে মসজিদে যাওয়ার অনুমতি প্রার্থনা করলে তাকে নিষেধ করো না। (বোখারী, মুসলিম) আরেক বর্ণনায় এসেছে, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেন, তোমাদের স্ত্রী লোকদের মসজিদে যেতে নিষেধ করো না। তবে তাদের ঘরই তাদের জন্য ইবাদতের সর্বোত্তম স্থান। (আবু দাউদ : ৫৬৭)

পর্যালোচনা :

ওপরে আমরা ইবনে উমর (রা.)-এর সূত্রে একই বিষয়ে বর্ণিত হাদীসের চার ধরনের মতন তথা মূল ভাষ্য পেলাম। যার থেকে কয়েকটি বিষয় স্পষ্ট বুঝে আসে।

এক. নামাযের জন্য নারীদের মসজিদে গমন করা ওয়াজিব, সুন্নাত, মুস্তাহাব বা নফল কোনো বিধানের আওতায় পড়ে না।

কেউ এই হাদীস দ্বারা কোনো একটি বিধানের প্রমাণ করার চেষ্টা করলে সেটা হবে তার দ্বীনি জ্ঞানের ব্যাপারে দৈন্যতার প্রমাণ। কারণ কেউ যদি কাউকে বলে, তুমি অমুককে অমুক স্থানে যেতে বাধা দিয়ো না। এর অর্থ এই নয় যে অমুকের জন্য সেখানে যাওয়া জরুরি বা অন্য কিছু।

চিন্তা করলে দেখা যাবে, বাধা দেওয়ার যথেষ্ট কারণ থাকতে পারে। তবুও বিশেষ কোনো কারণে বাধা না দেওয়ার জন্য বলা হচ্ছে। আর সেই বিশেষ কারণটি হলো সরাসরি রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) থেকে শরীয়তের বিধিবিধান শেখা ও জানা। রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-এর ইন্তেকালের সঙ্গে সঙ্গে এ কারণটিও রহিত হয়ে যায়।

দুই.

স্বামী বা অভিভাবকের অনুমতি ছাড়া কোনো নারী ধর্মীয় কাজের জন্যও ঘর থেকে বের হতে পারবে না।

তিন.

কোনো নারী নামাযের জন্য ঘর থেকে বের হওয়ার অনুমতি প্রার্থনা করলে স্বামী বা অভিভাবক তাকে অনুমতি দিতে বাধ্য নয়। বরং যথাসাধ্য বোঝানোর চেষ্টা করবে যে নারীদের জন্য ঘরে অবস্থান করা এবং ঘরের নির্জন কক্ষে নামায আদায় করা মসজিদে গিয়ে আদায় করার চেয়ে অনেক বেশি ফজীলতপূর্ণ।

রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) হাদীসটির দ্বিতীয় অংশে ‘তাদের ঘরই ইবাদতের সর্বোত্তম স্থান’ বলে স্বামী ও অভিভাবকদের এই দিকনির্দেশনাই দিয়েছেন এবং নারীদের এ কথা বোঝানোর চেষ্টা করেছেন যে মসজিদ নয়, ঘরই হলো তাদের নামাযের সর্বোত্তম স্থান। হাদীসের মূল ভাষ্যে সামান্য চিন্তা করলেই এই বিষয়টি দিবালোকের ন্যায় স্পষ্ট হয়ে যায়। এ ছাড়া এ মর্মে আরো কিছু হাদীস ওপরে উল্লেখ করা হয়েছে।

চার.

শরীয়তের একটি মূলনীতি হলো, হাদীসের বর্ণনাকারী সাহাবী যদি নিজেই তার সূত্রে বর্ণিত হাদীসের বিপরীত আমল করেন, তাহলে ওই হাদীসটি আমল ও প্রমাণযোগ্য থাকে না। বরং বুঝতে হবে হাদীসটির বিধান রহিত হয়ে গেছে অথবা সাধারণ মানুষ বাহ্যিকভাবে যা বোঝে হাদীসের প্রয়োগ ক্ষেত্র তা নয়, অন্য কিছু। বা বুঝতে হবে হাদীসটি ব্যাখ্যাসাপেক্ষ।

ইবনে উমর (রা.)-এর আমল :

পূর্বেই উল্লেখ করেছি যে হাদীসটি ইবনে উমর (রা.)-এর সূত্রে বর্ণিত। আরো উল্লেখ করা হয়েছে, তিনি জুমু’আর নামায আদায় করার জন্য আগত নারীদের প্রতি পাথর নিক্ষেপ করতেন এবং তাদের মসজিদ থেকে বের করে দিতেন। অন্য আরেক বর্ণনায় উল্লেখ করা হবে, তিনি পরিবারের নারী সদস্যদের ঈদের নামাযে অংশগ্রহণ করার জন্য ঘর থেকে বের হতে দিতেন না।

এ ছাড়া তাঁর সূত্রে এই হাদীসও উল্লেখ করা হয়েছে যে নারীদের জামাতে কল্যাণ বলতে কিছু নেই। ইবনে উমর (রা.)-এর বাস্তব আমল তার সূত্রে বর্ণিত হাদীসের বিপরীত হওয়াটা কি এই বার্তা বহন করে না যে হাদীসটির বিধান রহিত হয়ে গেছে বা প্রয়োগ ক্ষেত্র বাহ্যিকভাবে যা বুঝে আসে তা নয় বরং অন্য কিছু। এর পরও একটি মহল মসজিদে নারীদের নামাযের ব্যবস্থার জন্য মরিয়া হয়ে উঠেপড়ে লাগা সরলমনা মুসলমানদের সাথে প্রতারণা ও গভীর ষড়যন্ত্রের অংশবিশেষ।

পাঁচ.

রাষ্ট্রপ্রধান, ইমাম ও অভিভাবকদের দায়িত্ব।

এই হাদীসের ব্যাখ্যায় বিদগ্ধ হাদীস বিশারদ আল্লামা ইবনে হজর মক্কী (রহ.) বলেন, “যখন মসজিদে বা পথে পুরুষের সাথে মেলামেশা অথবা নারীদের অত্যধিক রূপচর্চা বেহায়াপনা ও উলঙ্গপনার কারণে ফিতনার আশঙ্কা হয় তখন তাদের জন্য ঘর থেকে বের হয়ে মসজিদে যাওয়া হারাম এবং তারা মসজিদে যাওয়ার অনুমতি প্রার্থনা করলে স্বামী বা অভিভাবকদের অনুমতি প্রদান করাও হারাম। আর রাষ্ট্রপ্রধান, ইমাম বা তাঁদের প্রতিনিধিগণের ওপর নারীদের মসজিদে আসা নিষেধ করা ওয়াজিব।” (মিরকাতুল মাফাতীহ ৩/৮৩৬)

এই দায়িত্ব শুধু রাষ্ট্রপ্রধান, ইমাম, খতীব ও অভিভাবকদের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয় বরং মসজিদের প্রতিষ্ঠাতাগণ ও ব্যবস্থাপকগণকেও এ ব্যাপারে কোনো প্রকার ছাড় না দিয়ে কঠিন পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। ঈদের নামাযে নারীদের অংশগ্রহণ : জুমু’আ ও পাঁচ ওয়াক্ত নামাযের ন্যায় ঈদের নামাযের জন্যও নারীদের ঘর থেকে বের করে আনার অপতৎপরতা চোখে পড়ার মতো।

এ ব্যাপারে সাহাবা, তাবেঈগণের অবস্থান নিম্নে তুলে ধরা হলো।

১.

হযরত ইবনে উমর (রা.) তাঁর স্ত্রীগণকে ঈদগাহে বের হতে দিতেন না। (মুসান্নাফে ইবনে আবী শায়বা হা. ৫৭৯৫)

সনদের বিচারে হাদীসটি হাসান।

২.

হযরত ইবরাহীম নাখঈ (রহ.) দুই ঈদে নারীদের বের হওয়াকে অপছন্দ করতেন। (মুসান্নাফে ইবনে আবী শায়বা হা. ৫৭৯৪)

সূত্রের দিক থেকে হাদীসটি সহীহ।

৩.

আব্দুর রহমান ইবনে কাসেম (রহ.) বলেন, ইমাম কাসেম ইবনে মুহাম্মাদ (রহ.) নারীদের ব্যাপারে অনেক কঠোর ছিলেন, নারীদেরকে কখনো ঈদুল ফিতর ও আজহার সময় বের হতে দিতেন না। (মুসান্নাফে ইবনে আবী শায়বা হা. ৫৭৯৭)

৪.

হজরত হিশাম ইবনে ওরওয়া (রহ.) বলেন, তাঁর পিতা ওরওয়া ইবনে যুবায়ের পরিবারের কোনো নারীকে ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আজহার নামাযে যেতে দিতেন না। (মুসান্নাফে ইবনে আবী শায়বা হা. ৫৭৯৬)

সূত্রের দিক থেকে হাদীসটি সহীহ।

৫.

হজরত নাফে (রহ.) তাঁর ঘরের নারীদেরকে ঈদগাহে বের হতে দিতেন না। (মুসান্নাফে আব্দুর রায্যাক হা. ৫৭২৪)

সূত্রের বিচারে হাদীসটি সহীহ।

দুটি সন্দেহ ও তার নিরসন :

সন্দেহ : ১.

কেউ প্রশ্ন করতে পারেন, যদি বর্তমান যুগে নারীদের মসজিদে যাওয়া ফেতনার আশঙ্কায় নিষেধই হয় তাহলে রাসূল (সা.) স্পষ্ট এ কথা বলে যাননি কেন যে আমার যুগের পর নারীদের মসজিদে আসা নিষেধ?

নিরসন :

এর নিরসন হলো, রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) শরীয়তের অসংখ্য বিধানাবলির ক্ষেত্রেই এরূপ করে গিয়েছেন যে তা স্পষ্ট করে বলে যাননি। তিনি জানতেন ও বুঝতেন যে প্রিয় সাহাবীগণ তাঁর সকল কথার মর্ম ও উদ্দেশ্য বুঝেই পরবর্তীতে আমল করবেন। তাই সব কথা স্পষ্ট করে বলে দেওয়ার প্রয়োজন মনে করেননি। যেমন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম )-এর পরে আবুবকর (রা.)-কে খলিফা বানানোর কথা স্পষ্ট বলে যাননি।

কেননা তিনি বুঝেছেন যে তাঁর সাহাবীগণ বিভিন্ন আকার-ইঙ্গিতে তাঁর উদ্দেশ্য বুঝে নিয়েছেন, এখন আর তাঁদের তা স্পষ্ট বলে দেওয়ার প্রয়োজন নেই। আমাদের আলোচিত বিষয়টিও তদ্রূপ। নারীদের ফেতনা ও নারীদের পর্দাসংক্রান্ত শত শত হাদীস থাকা সত্ত্বেও সাহাবীগণ এ বিষয়ে রাসূল (সা.)-এর ইচ্ছা বুঝবেন না, তা অসম্ভব।

সন্দেহ : ২.

অনেক ভাই বলে থাকেন যে মক্কা-মদীনার হারামাইন শরীফে নারীগণ মসজিদের জামাতে অংশগ্রহণ করে থাকেন।

নিরসন :

আসলে হারামাইনে কিছু জরুরতের ভিত্তিতে নারীগণের জামাতে অংশগ্রহণের অনুমতি দেওয়া হয়েছে, তা হলো, নারীগণ যেহেতু মক্কার মসজিদে হারামে তাওয়াফের জন্য আসতে হয় এবং মদীনার মসজিদে নববীতে জিয়ারতের জন্য এসে থাকেন। এমতাবস্থায় নামাযের আযান হয়ে গেলে বের না হয়ে মসজিদের জামাতে অংশগ্রহণ করে থাকেন। উলামায়ে কেরাম এ ক্ষেত্রে অনুমতি দিয়েছেন। তবে শুধুমাত্র জামাতে অংশগ্রহণের উদ্দেশ্যে নারীগণ হারামাইনে যাওয়ারও অনুমতি নেই। বর্তমানে না জেনে অনেক নারী শুধু নামাযের জন্যই হারামাইনে উপস্থিত হয়ে থাকেন, তা ঠিক নয়। (দেখুন : ই’লাউস সুনান ৪/২৩১) তাঁরা নিজেদের হোটেলে নামায আদায় করলে মসজিদে হারামে নামায পড়ার চেয়ে বেশি সাওয়াব পাবে। যা হাদীসে ইতিপূর্বে উল্লেখ করা হয়েছে।

 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *