কুরআনে বর্ণিত তাওবার বিস্ময়কর উপকারিতা

মুফতি মুহাম্মদ ইমদাদুল্লাহ

فوائد التوبة الغالية من القرآن الكريم

আল্লাহ তাআলা তাঁর পবিত্র কালাম কুরআন মজিদকে তাওবা ও ইস্তেগফারের আলোচনায় পূর্ণ করে রেখেছেন। বহু সূরা ও আয়াতে তিনি বারংবার এর কথা উল্লেখ করেছেন। পূর্ববর্তী নবী-রাসূলগণ কিভাবে তাঁদের উম্মতকে দরদমাখা কণ্ঠে তাওবার দাওয়াত দিয়েছেন তা-ও বর্ণনা করেছেন। তাওবার ফায়দা ও উপকারিতা এবং তাওবা না করার ক্ষতি ও অপকারিতার কথাও বিশদভাবে তুলে ধরেছেন।

তাওবা আল্লাহর সঙ্গে বান্দার সম্পর্ক নবায়ন করে এবং সুদৃঢ় করে। এর মাধ্যমে বান্দা রবের কাছে তার দীনতা হীনতা এবং মুখাপেক্ষিতার স্বীকারোক্তি দান করে। ফলে সে আল্লাহর অফুরন্ত ভালোবাসা ও সন্তুষ্টি লাভ করে। যার দ্বারা সে ইহকাল ও পরকালের যাবতীয় কল্যাণ ও সফলতার হক্বদার হয়।

‘তাওবা’ শব্দটি আরবি। শাব্দিক অর্থ ফিরে আসা, প্রত্যাবর্তন করা। ইসলামী শরীয়তের পরিভাষায় তাওবা বলা হয়, কোনো পাপকাজ করে ফেললে আল্লাহর ভয়ে তা পরিহার করা। এরপর অনুতপ্তচিত্তে ভবিষ্যতে তা না করার দৃঢ় প্রতিজ্ঞা করা এবং সংশোধিত জীবনে ফিরে আসা।

আমাদের মনে রাখতে হবে, তাওবা দ্বারা শুধু বান্দার গুনাহই মাফ হয় না; বরং কুরআন ও হাদীসে তাওবার বিস্ময়কর আরো অনেক ফায়দা ও উপকারিতার কথা উল্লেখিত হয়েছে। এখানে শুধু কুরআনে বর্ণিত তাওবার কিছু ফায়দা ও উপকারিতা উল্লেখ করছি।

১. তাওবা দ্বারা গুনাহ মাফ হয়:

গুনাহের একমাত্র প্রতিকার হচ্ছে, তাওবা ও ইস্তেগফার। মানুষ যত গুনাহই করুক না কেন, সঠিক পন্থায় তাওবা করলে আল্লাহ তাআলা তার সব গুনাহই মাফ করবেন। আল্লাহ তাআলা স্বয়ং কুরআন মাজিদে ইরশাদ করেছেন-

قُلۡ يَٰعِبَادِيَ ٱلَّذِينَ أَسۡرَفُواْ عَلَىٰٓ أَنفُسِهِمۡ لَا تَقۡنَطُواْ مِن رَّحۡمَةِ ٱللَّهِۚ إِنَّ ٱللَّهَ يَغۡفِرُ ٱلذُّنُوبَ جَمِيعًاۚ إِنَّهُۥ هُوَ ٱلۡغَفُورُ ٱلرَّحِيمُ

‘আপনি বলে দিন, [আল্লাহ বলেন] হে আমার বান্দাগণ! তোমরা যারা নিজেদের প্রতি অবিচার করেছ; আল্লাহর রহমত থেকে নিরাশ হয়ো না। নিশ্চয় আল্লাহ সমস্ত গুনাহ ক্ষমা করে দিবেন। নিশ্চয় তিনি ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু।’ [সূরা যুমার: ৫৩]

 

২. তাওবা দ্বারা আল্লাহর ভালোবাসা লাভ হয়:

তাওবা দ্বারা আল্লাহর সঙ্গে বান্দার মহব্বত ও ভালোবাসার সম্পর্ক কায়েম হয়। আল্লাহ তা’আলা বলেন-

إِنَّ ٱللَّهَ يُحِبُّ ٱلتَّوَّٰبِينَ وَيُحِبُّ ٱلۡمُتَطَهِّرِينَ

‘নিশ্চয় আল্লাহ তাওবাকারীদের ভালবাসেন এবং তাদেরকেও ভালবাসেন যারা পবিত্র থাকে।’
[সূরা বাক্বারা: ২২২]

 

৩. তাওবা দ্বারা সফলতা লাভ হয়:

তাওবার মাধ্যমে মানুষ ইহকাল ও পরকালের সফলতা অর্জন করে। আল্লাহ তা’আলা বলেন-

وَتُوبُوٓاْ إِلَى ٱللَّهِ جَمِيعًا أَيُّهَ ٱلۡمُؤۡمِنُونَ لَعَلَّكُمۡ تُفۡلِحُونَ

‘হে মুমিনগণ! তোমরা সবাই আল্লাহর নিকট তাওবা করো, যাতে তোমরা সফলকাম হতে পার।’ [সূরা নূর: ৩১]

 

৪. গুনাহগুলো নেকী দ্বারা পরিবর্তিত হয়:

গুনাহ করার পর বান্দা যখন নিজের অপরাধ বুঝতে পেরে সত্যিকার তাওবা করে তখন আল্লাহ তা’আলা শুধু তার সেই গুনাহকেই ক্ষমা করেন না; বরং তার গুনাহকে নেকী দ্বারা পরিবর্তন করে দেন। আল্লাহ তা’আলা ইরশাদ করেন-

إِلَّا مَن تَابَ وَءَامَنَ وَعَمِلَ عَمَلٗا صَٰلِحٗا فَأُوْلَٰٓئِكَ يُبَدِّلُ ٱللَّهُ سَيِّ‍َٔاتِهِمۡ حَسَنَٰتٖۗ وَكَانَ ٱللَّهُ غَفُورٗا رَّحِيمٗا

‘তবে যে তাওবা করে, ঈমান আনে এবং সৎকর্ম করে, ফলে আল্লাহ্ তাদের গুণাহসমূহ নেকি দ্বারা পরিবর্তন করে দিবেন। আর আল্লাহ অতীব ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু।’ [সূরা ফুরকান: ৭০]

 

৫. তাওবা দ্বারা জান্নাত লাভ হয়:

তাওবা জান্নাত লাভের একটি বিরাট মাধ্যম। আল্লাহ তাআলা তাওবার বিনিময়ে জান্নাত দান করার ওয়াদা করেছেন। ইরশাদ হয়েছে-

يَٰٓأَيُّهَا ٱلَّذِينَ ءَامَنُواْ تُوبُوٓاْ إِلَى ٱللَّهِ تَوۡبَةٗ نَّصُوحًا عَسَىٰ رَبُّكُمۡ أَن يُكَفِّرَ عَنكُمۡ سَيِّ‍َٔاتِكُمۡ وَيُدۡخِلَكُمۡ جَنَّٰتٖ تَجۡرِي مِن تَحۡتِهَا ٱلۡأَنۡهَٰرُ

‘হে ঈমানদারগণ! তোমরা আল্লাহর কাছে তাওবা কর, খাঁটি তাওবা; আশা করা যায় তোমাদের রব তোমাদের পাপসমূহ মোচন করে দিবেন এবং তোমাদেরকে এমন জান্নাতে প্রবেশ করাবেন, যার পাদদেশে নহরসমূহ প্রবাহিত।’ [সূরা তাহরীম: ৮]

 

৬. দুনিয়াতে উত্তম জীবনোপকরণ লাভ হয়:

আল্লাহ তা’আলা তাওবাকারীকে দুনিয়াতেই নগদ পুরষ্কার স্বরূপ জীবন ধারণের উত্তম উপায় উপকরণ দান করবেন। ইরশাদ হয়েছে-

وَأَنِ ٱسۡتَغۡفِرُواْ رَبَّكُمۡ ثُمَّ تُوبُوٓاْ إِلَيۡهِ يُمَتِّعۡكُم مَّتَٰعًا حَسَنًا إِلَىٰٓ أَجَلٖ مُّسَمّٗى وَيُؤۡتِ كُلَّ ذِي فَضۡلٖ فَضۡلَهُ

‘আর তোমরা তোমাদের রবের কাছে ক্ষমা চাও। তারপর তার কাছে তাওবা কর (ফিরে যাও), তাহলে তিনি তোমাদেরকে নির্ধারিত সময় পর্যন্ত উত্তম ভোগ-উপকরণ দান করবেন। এবং তিনি প্রত্যেক গুণীজনকে তার প্রাপ্য মর্যাদা দান করবেন।’[সূরা হূদ: ৩]

 

৭. প্রয়োজনের সময় বৃষ্টি ও শক্তি বৃদ্ধি হয়:

তাওবার অসীলায় আল্লাহ তা’আলা প্রয়োজনের সময় বৃষ্টি দান করেন এবং ঈমান আমল ও দুনিয়াবি কাজের শক্তিও বৃদ্ধি করে দেন। হযরত হুদ আ. এর ঘটনার বর্ণনা দিতে গিয়ে আল্লাহ তাআলা বলেন, হুদ তার সম্প্রদায়ের লোকদের উদ্দেশ্যে বলেছিল-

وَيَٰقَوۡمِ ٱسۡتَغۡفِرُواْ رَبَّكُمۡ ثُمَّ تُوبُوٓاْ إِلَيۡهِ يُرۡسِلِ ٱلسَّمَآءَ عَلَيۡكُم مِّدۡرَارٗا وَيَزِدۡكُمۡ قُوَّةً إِلَىٰ قُوَّتِكُمۡ

‘হে আমার সম্প্রদায়! তোমরা তোমাদের রবের কাছে ক্ষমা চাও অতঃপর তার কাছে তাওবা কর, তাহলে তিনি তোমাদের উপর মুষলধারে বৃষ্টি প্রেরণ করবেন এবং তোমাদের শক্তির সাথে আরো শক্তি বৃদ্ধি করবেন।’ [সূরা হূদ: ৫২]

 

৮. তাওবা দ্বারা দু’আ কবুল হয়:

বান্দার তাওবার অসীলায় আল্লাহ তা’আলা তার দু’আ কবুল করেন। হযরত সালেহ আ. এর ঘটনার বর্ণনা দিতে গিয়ে আল্লাহ তাআলা বলেন, সালেহ তার সম্প্রদায়ের লোকদের বলেছিল-

يَٰقَوۡمِ ٱعۡبُدُواْ ٱللَّهَ مَا لَكُم مِّنۡ إِلَٰهٍ غَيۡرُهُۥۖ هُوَ أَنشَأَكُم مِّنَ ٱلۡأَرۡضِ وَٱسۡتَعۡمَرَكُمۡ فِيهَا فَٱسۡتَغۡفِرُوهُ ثُمَّ تُوبُوٓاْ إِلَيۡهِۚ إِنَّ رَبِّي قَرِيبٞ مُّجِيبٞ
‘হে আমার কওম! তোমরা আল্লাহর ইবাদাত কর। তিনি ছাড়া তোমাদের কোনো (সত্য) মাবুদ নেই। তিনি তোমাদেরকে সৃষ্টি করেছেন মাটি থেকে এবং সেখানে তোমাদের জন্য আবাদের ব্যবস্থা করেছেন। সুতরাং তোমরা তাঁর কাছে ক্ষমা চাও, অতঃপর তাঁরই কাছে তাওবা কর। নিশ্চয় আমার রব অতি নিকটে এবং(বান্দার আহ্বানে) সাড়া দানকারী।’ [সূরা হূদ: ৬১]

 

৯. আল্লাহর আজাব ও বালা-মুসিবত দূরীভূত হয়:

তাওবা ও ইস্তেগফারের অসীলায় আল্লাহ তাআলা স্বীয় আজাব ও বালা-মুসিবত দূর করে দেন। ইরশাদ হয়েছে-

وَمَا كَانَ ٱللَّهُ لِيُعَذِّبَهُمۡ وَأَنتَ فِيهِمۡۚ وَمَا كَانَ ٱللَّهُ مُعَذِّبَهُمۡ وَهُمۡ يَسۡتَغۡفِرُونَ

‘আর আল্লাহ এমন নন যে, তাদেরকে আজাব দিবেন এ অবস্থায় যে, তুমি তাদের মাঝে বিদ্যমান এবং আল্লাহ তাদেরকে আজাব দানকারী নন এমতাবস্থায় যে, তারা ক্ষমা প্রার্থনা করছে।’ [সূরা আনফাল: ৩৩]

 

১০. পার্থিব ধনসম্পদ ও সন্তান-সন্ততি লাভ হয়:

তাওবা ও ইস্তেগফারের বরকতে আল্লাহ তা’আলা বান্দার পার্থিব প্রয়োজনাদি পূরণ করেন। তাকে ধন-সম্পদ ও সন্তান-সন্ততিতে সমৃদ্ধি দান করেন। হযরত নূহ আ. এর ঘটনার বর্ণনা দিতে গিয়ে আল্লাহ তাআলা বলেন, নূহ তার সম্প্রদায়ের লোকদের বলেছিল-

اسۡتَغۡفِرُوۡا رَبَّکُمۡ ؕ اِنَّہٗ کَانَ غَفَّارًا. یُّرۡسِلِ السَّمَآءَ عَلَیۡکُمۡ مِّدۡرَارًا. وَّ یُمۡدِدۡکُمۡ بِاَمۡوَالٍ وَّ بَنِیۡنَ وَ یَجۡعَلۡ لَّکُمۡ جَنّٰتٍ وَّ یَجۡعَلۡ لَّکُمۡ اَنۡہٰرًا

‘তোমরা তোমাদের রবের নিকট ক্ষমা প্রার্থনা কর, নিশ্চয় তিনি মহাক্ষমাশীল। তিনি তোমাদের জন্য প্রচুর বৃষ্টিপাত করবেন। এবং তোমাদেরকে সমৃদ্ধ করবেন ধন-সম্পদ ও সন্তান-সন্ততিতে। আর তোমাদের জন্য স্থাপন করবেন উদ্যান ও প্রবাহিত করবেন নদী-নালা।’
[সূরা নূহ: ১০-১২]

 

১১. পেরেশানি ও বিপদ থেকে মুক্তি মেলে:

তাওবা ও ইস্তেগফার দ্বারা পেরেশানি দূর হয়, বিপদ থেকে মুক্ত লাভ হয় এবং রিযিক বৃদ্ধি পায়। হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রাযি. হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন-

مَنْ لَزِمَ الاِسْتِغْفَارَ جَعَلَ اللهُ لَهُ مِنْ كُلِّ ضِيقٍ مَخْرَجًا وَمِنْ كُلِّ هَمٍّ فَرَجًا وَرَزَقَهُ مِنْ حَيْثُ لَا يَحْتَسِبُ

‘যে ব্যক্তি নিয়মিত ইস্তেগফার (আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থণা) করবে, আল্লাহ তাকে প্রত্যেক বিপদ হতে মুক্তির ব্যবস্থা করবেন, সকল দুশ্চিন্তা হতে মুক্ত করবেন এবং তাকে এমন উৎস থেকে রিযিক্ব দিবেন যা সে কল্পনাও করতে পারবে না।’
[সুনানে আবু দাউদ, হাদীস: ১৫১৮]

আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে নিয়মিত তাওবা ও ইস্তেগফারের মাধ্যমে সমূহ কল্যাণ লাভ করার এবং পাকসাফ জিন্দেগী বানানোর তাওফিক দান করুন।


লেখক, ফতোয়া বিভাগ
জামেয়া হাকিমুল উম্মত, কেরানীগঞ্জ, ঢাকা।

3 thoughts on “কুরআনে বর্ণিত তাওবার বিস্ময়কর উপকারিতা

  1. এসতেগফার কি ভাবে করব, কোন টাইমে কত বার..?

    1. It is said that Muhammdur Rasulullah said the aforementioned dua 100 or 70 times each day.

      Rabb-ighfir li, wa tubb `alayya, innaka Antat-Tawwabur-Rahim.
      رَبِّ اغْفِرْ لِي وَتُبْ عَلَيَّ إنَّكَ أَنْتَ التَّوَّابُ الرَّحِيمُ
      My Rubb! Forgive me and pardon me. Indeed, You are the Oft-Returning with compassion and Ever Merciful.”

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *