ফিতনা ফাসাদ থেকে বাঁচতে নারীদের দায়িত্ব-কর্তব্য

মুফতী মনসূরুল হক দা.বা.


মহিলাদের দায়িত্ব-কর্তব্য

আল্লাহ তা‘আলা ইরশাদ করেন: (তরজমা) নারী পুরুষের যে কেউ ঈমান অবস্থায় নেক আমল করবে আমি অবশ্যই তাকে শান্তিময় জীবন দান করব, এবং আখেরাতে তার কৃতকর্মের উত্তম প্রতিদান দিবো। (সূরা নাহল-৯৭)

আলোচ্য আয়াতে আল্লাহ তা‘আলা দুনিয়ার উত্তম জীবন এবং পরকালের উত্তম প্রতিদান দেয়ার ব্যাপারে যেমন পুরুষদের সাথে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ, তদ্রূপ মহিলাদের সাথেও অঙ্গীকারবদ্ধ। এক্ষেত্রে নারী পুরুষের কোন পার্থক্য করেননি। তবে শর্ত হল, প্রত্যেকের নিজ নিজ দায়িত্ব পালনে যত্নবান হতে হবে। সুতরাং মহিলারাও যদি ঈমানকে পরিশুদ্ধ করে নেককাজ তথা ইবাদাত-বন্দেগী, স্বামীর খেদমত ও তার আমানতের হেফাযত এবং সন্তান লালন-পালন করে তাহলে একদিকে যেমন তারা দুনিয়াতে উত্তম জীবন প্রাপ্ত হবে, সুখময় দাম্পত্য জীবনের অধিকারী হবে এবং আত্মার প্রশান্তি লাভ করবে, অপরদিকে আখেরাতেও তারা উত্তম প্রতিদান পাবে, চির সুখ-শান্তিসমৃদ্ধ জান্নাত লাভ করবে এবং অভাবনীয়, অকল্পনীয় ও অপূর্ব নেয়ামত ভোগ করবে।

কিন্তু বর্তমানে আধুনিকতার সয়লাবে ভেসে যাওয়া সমাজ এই বাস্তবতাকে অস্বীকার করে সহশিক্ষা এবং চাকুরির লোভ দেখিয়ে নারীদেরকে রাস্তায় নামিয়ে তাদেরকে কামাতুর পুরুষের লোলুপতার শিকার বানাচ্ছে। কোন কোন ক্ষেত্রে তাদেরকে বাজারী বানিয়ে প্রকাশ্যে বেইজ্জত করছে। নারী স্বাধীনতার নামে মাতৃজাতির সরলতা, অনাড়ম্বরতা, সতীত্ব, হায়া-শরম ছিনিয়ে নিচ্ছে। ফলে প্রতিটি ঘর আজ ফেতনা-ফাসাদের আখড়ায় পরিণত হচ্ছে, স্বামী-স্ত্রীর মাঝে দ্বন্ধ, ছেলে-মেয়েতে দ্বন্ধ, ভাই-ভাইয়ে মনমালিন্য। কোথাও ছেলে মেয়ে পিতা-মাতার অবাধ্য, কোথাও পিতা-মাতা সন্তানের হক আদায় থেকে উদাসীন, সামান্য সামান্য কারণে তালাকের ঘটনা ঘটে সুখের সংসার দোযখে পরিণত হচ্ছে। গভীরভবে লক্ষ্য করলে বুঝা যাবে এর কারণ হল মহিলাদের দীনী তা‘লীমের অভাব এবং দায়িত্ব বহির্ভূত অঙ্গনে বিচরণ। নিম্নে মহিলাদের দায়িত্ব-কর্তব্য সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত আলোচনা করা হচ্ছে, যাতে প্রত্যেক মুসলিম মহিলা তা আদায় করে দুনিয়া ও আখেরাতের কামিয়াবির পথ খুঁজে পায় এবং বর্তমানে সৃষ্ট বিভিন্ন ফেতনা-ফাসাদ থেকে হেফাযতে থাকতে পারে।

নারীর দায়িত্ব ও কর্তব্য

১. ঈমান-আক্বীদা পরিশুদ্ধ করা:

ঈমান শব্দের অর্থ হচ্ছে বিশ্বাস করা ও স্বীকার করা, আর আক্বীদার অর্থ হচ্ছে দৃঢ় বিশ্বাস। কুরআন হাদীসে যে সব বিষয়গুলোকে বিশ্বাস করতে বলা হয়েছে, সেগুলোকে অন্তরে দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করা এবং মুখে স্বীকার করার নামই ঈমান। আর আমল-ইবাদত হচ্ছে ঈমানের পূর্ণতা। যার ঈমান নেই তার কোন আমল আল্লাহ পাকের দরবারে গ্রহণযোগ্য নয়। রূহ ছাড়া যেমন শরীরের কোন মূল্য নেই, তদ্রূপ ঈমান ছাড়া আমলের কোন মূল্য নেই। আল্লাহ তা‘আলা ইরশাদ করেন, (তরজমা) ‘যারা কাফের তথা যাদের ঈমান নেই তাদের আমলসমূহ মরুভূমির মরিচিকার মত।’ (সূরা নূর : ৩৯)

সুতরাং ঈমান দুরস্ত করা সকলের বুনিয়াদী ফরয। আর যেসব বিষয়ের উপর ঈমান আনতে হয়, তন্মধ্যে ছয়টি হল রুকন বা মূল। যা ঈমানের মুফাসসালের মধ্যে বর্ণিত হয়েছে :

أمِنْتُ بِاللهِ وَمَلَائِكَتِهِ وَكُتُبِهِ وَرُسُلِهِ وَِالْيَوْم الْآخِر وَالْقَدْرِ خَيْرِهِ وَشَرِّهِ مِنَ اللهِ تَعَالَى وَالْبَعْثِ بَعْدَ الْمَوْتِ

অর্থ: আমি ঈমান আনলাম বা বিশ্বাস করলাম আল্লাহ তা‘আলাকে, তাঁর ফেরেশতাগণকে, তাঁর প্রেরিত সকল আসমানী কিতাবকে, তাঁর প্রেরিত সকল নবী-রাসূলকে, ক্বিয়ামত দিবসকে, তাক্বদীরকে অর্থাৎ, জগতে ভাল-মন্দ যা কিছুই হয় সবই আল্লাহ তা‘আলার সৃষ্টি, তাঁরই পক্ষ হতে নির্ধারিত এবং মৃত্যুর পর ক্বিয়ামতের দিন পুনরায় জীবিত হওয়াকে।

এছাড়াও ঈমানের আরো ৭৭টি শাখা রয়েছে যেগুলোর উপর ঈমান আনাও জরুরী। সহীহ ঈমানের এ ছয়টি আরকান এবং তার শাখা-প্রশাখাগুলোকে যে মনে-প্রাণে বিশ্বাস করবে, মুখে স্বীকার করবে এবং এগুলোর দাবী অনুযায়ী নেক আমল করবে- সে পরিপূর্ণ মুমিন হবে। আর যে এগুলোকে অবিশ্বাস করবে অথবা এগুলো থেকে মাত্র কোন একটি বিষয়কে অবিশ্বাস করবে কিংবা তাতে সন্দেহ পোষণ করবে অথবা তুচ্ছ তাচ্ছিল্য ও ঠাট্টা-বিদ্রূপ করবে কিংবা এগুলোর মধ্যে কোন দোষ-ত্রুটি বের করবে সে কাফের হয়ে যাবে। আগে মুমিন থাকলে মুরতাদ তথা ধর্মত্যাগী হয়ে যাবে। তার বিবাহ বিচ্ছেদ হয়ে যাবে এবং পিছনের সকল নেক আমল নষ্ট হয়ে যাবে। (রদ্দুল মুহতার-৩/১৯৩)

মনে রাখা উচিৎ মহিলারা অনেক সময় এমন এমন কথা বলে বা এমন এমন মন্তব্য করে, যার দ্বারা ঈমান চলে যাওয়ার উপক্রম হয়ে যায়। যেমন, বিপদে পড়ে বলে যে, ‘আল্লাহ আর কাউকে চোখে দেখলে না, যত সব বিপদ আমার উপরই’! ইত্যাদি। এজন্য এ বিষয়ে সচেতন থাকা একান্ত জরুরী। আল্লাহ না করুন কেউ বেঈমান হয়ে গেলে তার জন্য নতুন ভাবে কালেমা পড়ে মুসলমান হওয়া এবং বিবাহ দোহরায়ে নেয়া জরুরী।

বি: দ্র: এ ব্যাপারে হযরতওয়ালা শাইখুল হাদীস মুফতী মাওলানা মনসূরুল হক (দাঃবাঃ) এর “কিতাবুল ঈমান” নামক গ্রন্থের তা‘লীম করা যেতে পারে।

২. ইবাদত বন্দেগী করা:

প্রত্যেক বালেগা মহিলার উপর ফরয যে পাঁচ ওয়াক্ত নামায পড়া, কুরআন সহীহ শুদ্ধভাবে তেলাওয়াত করা, রমাযান মাসে রোযা রাখা, ধন-সম্পদ থাকলে যাকাত আদায় করা এবং হজ্ব করা। এসব বিষয়ের মাসআলা-মাসাইল উপযুক্ত ব্যক্তি বা সহীহ কিতাব থেকে শিখে নিবে। এগুলো অস্বীকার করলে ঈমান চলে যায়। আর এগুলো বিশ্বাস করা সত্ত্বেও আমল না করলে কাফের তো হয় না, তবে ফাসেক সাব্যস্ত হয়। সেক্ষেত্রে তাওবা করা জরুরী। এবং নামায রোযার উমরী কাযা করে নিতে হবে। যাকাত আদায় বাকী থাকলে তাও আদায় করে দিতে হবে। নতুবা আখেরাতে এর দরুন নির্ধারিত সময়ের জন্য জাহান্নামী সাব্যস্ত হবে।

উল্লেখ্য যে মহিলাদের নামায আদায়ের জন্য মসজিদে বা ঈদগাহে যাওয়া নাজায়েয। কতিপয় বিভ্রান্ত আলেম জায়েয বলছে বটে, তাদের কথায় কর্নপাত করবে না।

عَنْ يَحْيَى بْنِ سَعِيدٍ عَنْ عَمْرَةَ عَنْ عَائِشَةَ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهَا قَالَتْ لَوْ أَدْرَكَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ مَا أَحْدَثَ النِّسَاءُ لَمَنَعَهُنَّ كَمَا مُنِعَتْ نِسَاءُ بَنِي إِسْرَائِيلَ.   [صحيح البخاري حـ:٨٦٩]

হযরত আয়েশা সিদ্দীকা রাযি. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন : প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লামের ইন্তিকালের পর মহিলাদের মধ্যে যে ধরনের পরিবর্তন এসেছে সেটা যদি তিনি দেখতেন তাহলে নিঃসন্দেহে তিনি তাদেরকে মসজিদে আসতে নিষেধ করতেন। যেভাবে নিষেধ করা হয়েছিল বনী ইসরাঈলের মহিলাদেরকে। (বুখারী শরীফ হাদীস নং-৮৬৯)

৩. স্বামীর খেদমত করা:

মহান আল্লাহ তা‘আলা দুনিয়াতে স্বামীকে স্ত্রীর উপর বিশেষ মর্যাদা প্রদান করেছেন এবং স্বামীর জন্য স্ত্রীর প্রতি বিরাট হক নির্ধারণ করে দিয়েছেন। স্বামীকে সন্তুষ্ট রাখা, তার মনরঞ্জনে সচেষ্ট থাকা অনেক সওয়াবের কাজ। এ সম্পর্কিত কয়েকটি হাদীস নিম্নে পেশ করা হল :

১.রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, যে নারী এমন অবস্থায় মৃত্যুবরণ করবে যে, স্বামী তার প্রতি সন্তুষ্ট, তার জন্য জান্নাত অনিবার্য হয়ে যায়। (তিরমিযী হাঃ নং-১১৬১)

২. রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, যদি আমি আল্লাহ ব্যতীত অন্য কাউকে সিজদা করার অনুমতি দিতাম, তাহলে স্ত্রীকে আদেশ দিতাম সে যেন স্বামীকে সিজদা করে। (তিরমিযী হাঃ নং-১১৫৯)

৩. রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, স্বামী যদি স্ত্রীকে ডাকে তখন তার ডাকে সাড়া দেয়া তার উপর ওয়াজিব হয়ে যায়, যদিও সে চুলার উপর থাকে। অর্থাৎ, স্ত্রীর যত কাজই থাকুক না কেন, স্বামীর ডাকা মাত্র সবকিছু পরিত্যাগ করে তার ডাকে সাড়া দেয়া একান্তভাবে জরুরী। (তিরমিযী হাঃ নং-১১৬০)

৪. রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, যদি স্বামী স্ত্রীকে তার শয্যাসঙ্গিনী হওয়ার জন্য আহ্বান করা সত্ত্বেও সে তার আহ্বানে সাড়া না দেয় এবং এ অবস্থায় স্বামী অসন্তুষ্ট হয়ে রাত অতিবাহিত করে তাহলে এ স্ত্রীর প্রতি ফেরেশতাগণ ভোর পর্যন্ত লা‘নত করতে থাকেন। (বুখারী হাঃ নং ৩২৩৭)

৫. রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, কোন স্ত্রী যখন পৃথিবীতে তার স্বামীকে কষ্ট দেয় তখন জান্নাতে এ স্বামীর জন্য নির্ধারিত হুরগণ বলতে থাকে: আল্লাহ তোমাকে ধ্বংস করুন, তুমি তাকে কষ্ট দিও না। সে তো তোমার কাছে অস্থায়ী মেহমান মাত্র। অচিরেই সে তোমাকে পরিত্যাগ করে আমার সান্নিধ্যে চলে আসবে। (তিরমিযী হাঃ নং-১১৭৪)

উল্লেখ্য: স্ত্রীদেরও স্বামীর নিকট হক পাওনা আছে। সেগুলো আদায় করা পুরুষদের দায়িত্ব।

সুতরাং প্রত্যেক মুসলিম নারীর জন্য অন্তরে স্বামীর প্রতি মুহব্বত রাখা, তার খেদমত করা, তার হকসমূহ আদায় করা একান্ত অপরিহার্য। বলা বাহুল্য: স্ত্রীর জন্য অফিস-আদালতে চাকুরী করা, গার্মেন্টসে শ্রম দেয়া ইত্যাদি ঘরের বাইরের কাজে আত্মনিয়োগ করা স্বামী ও সন্তানদের হক বিনষ্ট করারই নামান্তর। উপরন্তু তাতে নানাবিধ ফিতনা-ফাসাদের আশংকা তো আছেই। এজন্য সামান্য পয়সার লোভে না পড়ে এ বিষয়ে একটু সুস্থ মস্তিষ্কে ভেবে দেখা উচিৎ। রিযিকদাতা তো একমাত্র আল্লাহ। তিনি স্বামী বা সন্তানের মাধ্যমে সংসারের সকলের রিযিক দিতে সক্ষম। তাহলে কেন রিযিকের জন্য আল্লাহর নাফরমানী করবে? তবে যাদের স্বামী বা খোরপোষ দেওয়ার মত কেউ নেই এবং অভাবের কারণে জীবন ও মান বাচানো কষ্টকর হয়ে যায় তারা ঘরোয়া পরিবেশে থেকে বৈধ উপার্জনের কোন পন্থা যেমন সেলাইয়ের কাজ, বাচ্চাদের পড়ানো ইত্যাদি অবলম্বন করবে।

৪. নিজের সতীত্ব ও স্বামীর মালের হেফাযত করা:

স্ত্রীর নিজের ইজ্জত এবং স্বামীর মাল তার নিকট আমানত হিসাবে থাকে। নিজের সতীত্বের হেফাযতের লক্ষ্যে নিজেকে পর্দায় রাখা ফরয। এটাই আল্লাহর নির্দেশ। (সূরা আহযাব: ৩৩)

সুতরাং দেবর-ভাশুর, চাচাতো ভাই, খালাতো ভাই, ফুফাতো ভাই, মামাতো ভাই, খালু, নিজ শ্বশুর ছাড়া বিভিন্ন রকম শ্বশুর, উকিল বাপ, ধর্ম যাপ, ধর্ম ভাই ইত্যাদি থেকে পর্দা করা ফরয। বেপর্দা হওয়া হারাম। একান্ত প্রয়োজনে পর্দার আড়াল থেকে কর্কষ ভাষায় কথা বলা জায়েয। শরী‘আতে এ আমানতের অপব্যবহার তথা পরপুরুষের সাথে দেখা-সাক্ষাত, কথা-বার্তা বা অন্য কোন অবৈধ আচরণ করলে কিংবা তার অনুমতি ছাড়া স্বামীর মাল খরচ করলে তা খিয়ানত বলে গণ্য হবে। আর আমানতের খিয়ানত করা কবীরাহ গুনাহ। রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, যে নারী পাঁচ ওয়াক্ত নামায পড়বে, রমাযানের রোযা আদায় করবে, নিজের ইযযত তথা পর্দা পালন করবে এবং স্বামীর পূর্ণ আনুগত্য করবে সে জান্নাতের যে কোন দরজা দিয়ে ইচ্ছা প্রবেশ করতে পারবে। (হিলয়াতুল আউলিয়া হাদীস নং-৬/৩০৮)

অন্যত্র ইরশাদ করেন, মুমিন বান্দা খোদা ভীতির পরে নেক বিবি অপেক্ষা উত্তম কোন জিনিষ পেতে পারে না, যে নেক বিবিকে স্বামী কোন কাজের আদেশ করলে সে সাথে সাথে তা পালন করে, তার দিকে তাকালে সে তাকে খুশী করে, স্বামী কোন কাজ করার অঙ্গীকার করলে সে তাকে তা পুরণে সাহায্য করে, এবং স্বামী অনুপস্থিত থাকলে সে নিজের ইজ্জত এবং স্বামীর মালের হিফাযত করে। (ইবনে মাজা হাদীস নং-১৮৫৭)

তদ্রূপ অন্য এক হাদীসে রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম উক্ত গুনাবলীর অধিকারীনী নারীকে সবচেয়ে উত্তম বলে অবিহিত করেছেন। (নাসায়ী হাদীস নং-৩২৩১)

উল্লেখ্য যে বেগানা পুরুষের সাথে পর্দার ক্ষেত্রে মহিলাদের মাথা থেকে পা পর্যন্ত গোটা শরীর পর্দার অন্তর্ভুক্ত, বিশেষ ঠেকা ছাড়া চেহারা হাত বা পা ইত্যাদি খোলা রাখা জায়েয নেই। (সূরায়ে আহযাব আয়াত নং-৫৯)

৫. সন্তান লালন-পালন ও তার শিক্ষা-দীক্ষা:

একজন আদর্শ মা একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের মত। অপর দিকে রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন: প্রতিটি শিশুই ফিতরাতে ইসলামের উপর জন্মগ্রহণ করে। কিন্তু তার মাতা-পিতা তাকে ইহুদী খৃষ্টান বা অগ্নিপূজক বানায়। (তিরমিযী হাঃ নং-২১৪৩)

অর্থাৎ, প্রত্যেকটি শিশুই মুসলমান হয়ে জন্মগ্রহণ করে এবং তার মাঝে সুন্দর চরিত্রে চরিত্রবান হওয়ার যোগ্যতা বিদ্যমান থাকে। কিন্তু শিশুর মাতা-পিতা যদি এ ব্যাপারে যত্নবান হয় এবং তাকে গড়ার জন্য শরী‘আত কর্তৃক বর্ণিত পন্থায় যথাযথ মেহনত করে তাহলে তার মাঝে উত্তম চরিত্রের বিকাশ ঘটে। অন্যথায় তা বিনষ্ট হয়ে যায়।

সুতরাং প্রত্যেক পিতা-মাতার জন্য নিজের সন্তানকে আদর্শ সন্তান হিসাবে গড়ে তোলার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করা একান্ত জরুরী। পিতা যেহেতু অধিকাংশ সময় বাইরের কাজে ব্যস্ত থাকে। অপর দিকে সন্তান ৮/১০ বছর পর্যন্ত মায়ের আঁচলের নীচেই প্রতিপালিত হয় এজন্য সন্তানের শিক্ষা-দীক্ষার ব্যাপারে তাকে বেশী যত্নশীল হতে হয়। এজন্য ইসলাম মাতা-পিতাকে কতগুলো দায়িত্ব দিয়েছে। যেমন আল্লাহ তা‘আলা ইরশাদ করেন, (তরজমা) তোমরা নিজের পরিবারবর্গ তথা সন্তান-সন্তুতিকে নামাযের আদেশ দিতে থাক এবং নিজেও নামাযের পাবন্দী করতে থাক। (সূরা ত্ব-হা-১৩২)

রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, কোন পিতা-মাতা তার সন্তানকে উত্তম শিষ্টাচারের তুলনায় শ্রেষ্ঠ কোন উপহার দিতে পারে না। (তিরমিযী শরীফ হাদীস নং-১৯৫৭)

তাছাড়া পিতা-মাতার সাথে সন্তানের রক্তের সম্পর্কের কারণে পিতা-মাতার নসীহত তারা সহজে এবং তাড়াতাড়ি গ্রহণ করে। পিতা-মাতার কথা-বার্তা, নিয়ম-নীতি, জীবন পদ্ধতি সন্তানের জন্য পাথেয় হয়।

সুতরাং পিতা-মাতা তার সন্তানকে আচার-আচরণে, জীবন চলার পদে পদে ইসলামী শিক্ষায় সুশিক্ষিত করে আদর্শ সন্তান হিসাবে গড়ে তুলতে পারে। প্রতিদিন যদি একটি করে সুন্নাতও শিখায় তাহলে দেখা যাবে কিছু দিনের মধ্যেই তার গুরুত্বপূর্ণ সব সুন্নাত শেখা হয়ে গেছে।

মনে রাখা দরাকার! মনোবিজ্ঞানের আলোকে দেখা গেছে ছোট ছোট শিশুরা সোহবত বা সংশ্রব দ্বারা বড়ই প্রভাবিত এবং তাদের মাঝে-দেখে দেখে হুবহু নকল করার যোগ্যতা অধিক পরিমাণে বিদ্যমান। সুতরাং তারা যদি নেক লোকদের নিকট থেকে নেক কাজ দেখতে থাকে তাহলে সেও ছোট থেকেই নেককার হয়ে উঠে। পক্ষান্তরে যদি তারা বদকারদের নিকট থেকে শুধু মন্দ কাজ দেখতে থাকে তাহলে সে ছোট থেকেই চরিত্রহীন এবং বখাটে হয়ে উঠে এবং বড় হয়ে মাস্তানের আকার ধারণ করে।

বর্তমান সমাজে ছেলে-মেয়েরা যে, চরিত্রহীন, বখাটে, এবং মাস্তান হচ্ছে, পিতা-মাতার অবাধ্য হচ্ছে, তাদেরকে অবজ্ঞা করছে ফলে তারা মাতা-পিতার অশান্তির কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে। মা নিজ সন্তানদের শান্তির জন্য পয়সা রোজগার করছে। অপরদিকে তার সন্তান দীনী শিক্ষার অভাবে নেশাখোর ও চরিত্রহীন হয়ে নেশার জন্য টাকা না পেয়ে মাকে যবাই করছে। কী আজব দুনিয়া! বর্তমান যে আমাদের সন্তানগণ নেশায় ডুবে দ্রুত ধ্বংসের দিকে এগিয়ে যাওয়ায় পিতা-মাতা থেকে আরম্ভ করে সমাজ, গ্রাম বরং পুরো দেশটা আতংকিত হয়ে পড়ছে- তার মূল কারণ হল পিতা-মাতার গাফলতী, পশ্চিমাদের ষড়যন্ত্রে শিকার হয়ে মা চাকুরির নামে অফিস-আদালতে ঘুরে বেড়াচ্ছে। অথচ কলিজার টুকরা, আদরের দুলাল নিজ সন্তানকে দীনী শিক্ষা থেকে বঞ্চিত করছে এবং তাদেরকে কাজের বুয়ার হাতে রেখে আসছে। তারা মায়ের তা‘লীম ও মমতা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে এবং কাজের বুয়া ও বখাটে ছেলেদের সাহচর্য পেয়ে বড় হচ্ছে। ফলে তাদের স্বভাব সে সন্তানদের মাঝেও বিস্তার লাভ করছে। এটা একটা ভেবে দেখার বিষয় যে আমাদের ভাবিষ্যত কি? সকলেই জানেন যে, আমাদের সন্তানগণ আমাদের নিজেদের এবং দেশ ও জাতির ভবিষ্যৎ। আজকের শিশু আগামী দিনের ভবিষ্যৎ তারাই ভবিষ্যতে দেশ ও জাতিকে পরিচালনা করবে। আজ যদি তারা নিজেরাই ধ্বংসের পথে চলে যায় তাহলে এ জাতির ভবিষ্যৎ সম্পূর্ণ অন্ধকার। এ নিশ্চিত ধ্বংস থেকে বেঁচে ভবিষ্যৎকে সুন্দর করতে হলে এখনই আমাদের আল্লাহর বিধানে ফিরে আসতে হবে এবং আমাদের সন্তানকে দীনী শিক্ষা তথা আল্লাহ ও রাসূলের শিক্ষায় সুশিক্ষিত করতে হবে। দীনী শিক্ষাই জাতির মেরুদন্ড। যদি আমরা এভাবে মেহনত করে আমাদের সন্তানদেরকে গড়তে পারি তাহলে ক্রমান্বয়ে পরিবার, সমাজ, এবং গোটা দেশ সন্ত্রাস-দুর্নীতিমুক্ত আদর্শবান হয়ে উঠবে। ফিরে আসবে শান্তি এবং স্থিতিশীলতা। আর এ পদ্ধতি পরিহার করে যতই মেহনত করা হোক না কেন কোন দিন শান্তি ফিরে আসতে পারে না। কারণ দেশের সুন্দর, সন্ত্রাস ও দুর্নীতিমুক্ত আদর্শবান হওয়া ব্যক্তি-পরিবার সংশোধনের উপর নির্ভরশীল।

বিঃ দ্রঃ স্বামীর খেদমত ও সন্তানের হকের জন্য হযরতওয়ালা শাইখুল হাদীস মুফতী মাওলানা মনসূরুল হক (দাঃবাঃ) এর “ইসলামী বিবাহ” নামক গ্রন্থ দ্রষ্টব্য।

৬. মহিলাদের মধ্যে দীনী দাওয়াত ও তা‘লীম:

শরী‘আত পিতা-মাতাকে দায়িত্ব দিয়েছে যে তারা তাদের মেয়েকে দীনী তা‘লীম দিয়ে এমন চরিত্রবতী করে গড়ে তুলবে যে, বিবাহের পর তার স্বামী যেন মনে করে যে আমার বিবি আমার শ্রেষ্ঠ সম্পদ। (মুসনাদে আহমাদ : হা: নং-১৯৬২)

অপর দিকে প্রত্যেক মহিলাকে শরী‘আত কর্তৃক দায়িত্ব দেয়া হয়েছে তারা নিজ সন্তান এবং মহল্লার অশিক্ষিতা বালিকাদেরকে নিয়মিত দীনের তা‘লীম দিবেন। সহীহ শুদ্ধ করে কুরআন শিখাবেন। এ ছাড়া যেসব মহিলা কোন কাজে বা দেখা সাক্ষাত করতে তাদের নিকট যাতায়াত করবে তাদেরকেও দীনী দাওয়াত ও তা‘লীম দিতে থাকবেন। তাদের দীনদারির খোঁজ-খবর নিবেন। তাদের ঈমান-আকীদা নামায রোযা সম্পর্কে জানবেন। কোন ভুল-ভ্রান্তি দৃষ্টি গোচর হলে তা সংশোধন করে দিবেন। এমনকি তাদের বাচ্চাদের দীনী তা‘লীমের খোঁজ-খবরও নিবেন। এবং তাদের পিতা-মাতা, স্বামী ও শ্বশুর শ্বাশুড়ীদের দীনী হালাত জেনে নিয়ে সে বিষয়ে তাদের সৎ পরামর্শ দিবেন। তাদের পরিবারের পুরুষ সদস্যদেরকে হক্কানী উলামায়ে কেরামের সোহবতে এবং দাওয়াত তাবলীগের মেহনতে অংশ গ্রহণ করার নসীহত করবেন। এবং বুঝাবেন, এটাই দুনিয়া ও আখেরাতের কামিয়াবীর একমাত্র রাস্তা। এমন কি অনেক মহিলারা স্বামী, সন্তান, শ্বশুর-শ্বাশুড়ী কর্তৃক অনেক নির্যাতিত হয়ে থাকে। তার থেকে বাঁচারও এটা একটা রাস্তা। (সূরা তওবা-৭১, মুসনাদে আহমাদ : হাঃ নং-৬৪৯৩)

আফসোস! আজ যদি মহিলাদের আসল দায়িত্ব-কর্তব্য এবং তা পালনের উপকারিতা জানা থাকত তাহলে তারা চাকুরির নামে অফিস-আদালতে ঘুরে বেড়াতো না এবং সৃষ্ট ফিতনা ফাসাদে নিপতিত হতো না।

আল্লাহ তা‘আলা সকল মুসলিম মহিলাকে তাদের দায়িত্ব ও কর্তব্যসমূহ পালন করার তাওফীক দান করুন। আমীন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *