কী আছে আল জাজিরার সেই প্রতিবেদনে? সরকার ও বিশিষ্টজনেরা কী বলছেন? (ভিডিও)

দেশে ও দেশের বাইরে তুমুল আলোচনা সৃষ্টিকারী সাম্প্রতিক ঘটনাটি হচ্ছে বাংলাদেশকে নিয়ে আল-জাজিরার একটি প্রতিবেদন।

কাতার-ভিত্তিক আন্তর্জাতিক সংবাদ মাধ্যম আল জাজিরা গত সোমবার বাংলাদেশ নিয়ে এক অনুসন্ধানী প্রামান্যচিত্রে ক্ষমতাবান ব্যক্তিদের ঘিরে দুর্নীতির অভিযোগ তোলার পরই শুরু হয় নানামুখী আলোচনা-সমালোচনা।

এরই মধ্যে বাংলাদেশ সরকারের পররাষ্ট্রমন্ত্রণালয় ও আইএসপিআর প্রতিবেদনটির তীব্র প্রতিবাদ জানিয়েছে।

আল জাজিরার এই অনুসন্ধানে মূলত সেনাপ্রধান জেনারেল আজিজ আহমেদের পরিবারের সদস্যদের অতীত এবং বর্তমান বিভিন্ন কর্মকান্ড তুলে ধরা হয় এবং নানা ধরণের দুর্নীতির অভিযোগ করা হয়।

‘অল দ্য প্রাইম মিনিস্টার’স মেন’ নামের এই প্রতিবেদনটি গতকাল প্রথম প্রচার করার পর থেকে এটি নিয়ে সোশ্যাল মিডিয়ায় ব্যাপক আলোচনা চলছে।

তবে বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বেশ কঠোর ভাষায় এর প্রতিবাদ জানিয়েছে।

আল জাজিরার প্রায় এক ঘণ্টার এই প্রতিবেদনে মূলত বাংলাদেশের সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল আজিজ আহমেদ এবং তার তিন ভাই এর কার্যক্রম দেখানো হয়েছে।

সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল আজিজ আহমেদের আপন তিন ভাই ২০০৪ সালে একটি হত্যাকাণ্ডের অপরাধে আদালতে দণ্ডিত হয়েছিল।

এই ভাইদের মধ্যে আনিস আহমেদ এবং হারিস আহমেদ বর্তমানে পলাতক রয়েছেন।

তৃতীয় ভাই, তোফায়েল আহমেদ জোসেফ, যিনি হত্যার অপরাধে কারাদণ্ডে দণ্ডিত ছিলেন, রাষ্ট্রপতির ক্ষমা নিয়ে কারাগার থেকে মুক্ত হন।

কী আছে আল জাজিরার সেই প্রতিবেদনে? সরকার ও বিশিষ্টজনেরা কী বলছেন? (ভিডিও) 5
লাল গোল চিহ্নিত ব্যক্তি আনিস আহমেদ, তার বা পাশে হারিস আহমেদ। আল জাজিরার প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে ঢাকাতে বিয়ের অনুষ্ঠানে তাদের দেখা গেছে (আল-জাজিরার প্রতিবেদন থেকে নেয়া ছবি)।
যদিও দুই ভাই হারিস আহমেদ এবং আনিস আহমেদ পলাতক, কিন্তু আল জাজিরার অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে হারিস আহমেদ এবং আনিস আহমেদকে জেনারেল আজিজ আহমেদের ছেলের বিয়েতে বাংলাদেশে দেখা গেছে। প্রতিবেদনে দেখানো হয় আনিস আহমেদ থাকেন কুয়ালা লামপুরে আর হারিস আহমেদ আছেন হাঙ্গেরির রাজধানী বুদাপেস্টে।

কী ধরণের দুর্নীতি তুলে ধরেছে আল-জাজিরা

কী আছে আল জাজিরার সেই প্রতিবেদনে? সরকার ও বিশিষ্টজনেরা কী বলছেন? (ভিডিও) 6
কুয়ালালামপুরে হারিস আহমেদ এবং আনিস আহমেদের বাড়ীর তথ্য (আল-জাজিরার প্রতিবেদন থেকে নেয়া ছবি)।

প্রতিবেদনে গোপন রেকর্ডিংয়ের মাধ্যমে বুদাপেস্ট-এ হারিস আহমেদের ব্যবসায়িক কার্যকলাপ নিয়ে অনুসন্ধান চালানো হয়।

তিনি নাম পরিবর্তন করে হাসান মোহাম্মদ নাম নিয়ে বিভিন্ন দেশে একাধিক ব্যবসা প্রতিষ্ঠান করেছেন সেটা দেখানো হয়েছে।

বুদাপেস্টে একজন বাংলাদেশি ব্যবসায়ীর সাথে এক কথোপকথনে তাকে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর জন্য বুলেট সরবরাহের কথা বলতে দেখা যাচ্ছে।

আল জাজিরার ঐ প্রতিবেদনে হারিস আহমেদকে বলতে শোনা গেছে পুলিশের চাকরি, যেমন থানার ওসির পদ, পেতে কত টাকা নেয়া হয় ।

তিনি সেখানে বলছেন, এক্ষেত্রে ৫ কোটি টাকা পর্যন্ত নেয়া হয়।

কী আছে আল জাজিরার সেই প্রতিবেদনে? সরকার ও বিশিষ্টজনেরা কী বলছেন? (ভিডিও) 7
হারিস আহমেদর ব্যবসায়ের নথিপত্র (আল-জাজিরার প্রতিবেদন থেকে নেয়া ছবি)।

এই কাজে সরকারের শীর্ষ স্থানের লোক জড়িত থাকেন বলে হারিস আহমেদ উল্লেখ করেন।

এছাড়া, নিরাপত্তা বাহিনী ইন্টারনেট এবং মোবাইল ফোন নজরদারী করার প্রযুক্তি ইসরায়েল থেকে আমদানি করেছে এমন কিছু নথিপত্র দেখানো হয়েছে।

তবে এই ক্রয়ের সাথে হারিস আহমেদের কোন যোগাযোগের কথা এই প্রতিবেদনে বলা হয় নি।

বাংলাদেশ সরকার, সেনাবাহিনী ও বিশিষ্টজনদের প্রতিক্রিয়া

আইএসপিআর

প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের আন্ত:বাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তর থেকে পাঠানো এক বিবৃত্তিতে কঠোর ভাবে নিন্দা জানানো হয়েছে এই প্রতিবেদনের।

বিবৃতিতে বলা হয়েছে ” এটা পরিষ্কার না যাদের পূর্বে অপরাধমূলক কাজে জড়িত থাকার রেকর্ড রয়েছে তাদের সঙ্গে কীভাবে আল জাজিরার মত আন্তর্জাতিক নিউজ চ্যানেল যুক্ত হল। প্রযুক্তি ব্যবহার করে ভিডিওটি তৈরি করা হয়েছে বিভিন্ন অফিসিয়াল, সামাজিক, ব্যক্তিগত অনুষ্ঠানের ক্লিপ ব্যবহার করে। বেশ কিছু বিচ্ছিন্ন অনুষ্ঠানের দৃশ্য একত্রিত করে সম্পাদনা করে কণ্ঠ দেয়া হয়েছে”।

পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়

বাংলাদেশ সরকার এই প্রতিবেদনটিকে মিথ্যা ও অবমাননাকর হিসেবে বর্ণনা করেছে ।

কী আছে আল জাজিরার সেই প্রতিবেদনে? সরকার ও বিশিষ্টজনেরা কী বলছেন? (ভিডিও) 8
বুদাপেস্টে হারিস আহমেদ (আল-জাজিরার প্রতিবেদন থেকে নেয়া ছবি)।

 

পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের থেকে গতকাল মঙ্গলবার এক বিবৃতিতে ,একে লন্ডন ও অন্যান্য জায়গায় সক্রিয় উগ্রপন্থী ও তাদের সহযোগীদের উসকানিতে বেপরোয়া ও নোংরা অপপ্রচার বলে উল্লেখ করা হয়।

বিবৃতিতে বলা হয়, বাংলাদেশ সরকার এটি প্রত্যাখ্যান করছে। আরও বলা হয়, এতে অবাক হওয়ার কিছু নেই যে জামায়াতে ইসলামীর মদদ-পুষ্ট কতিপয় সাজাপ্রাপ্ত পলাতক অপরাধী এবং কুখ্যাত ব্যক্তি তাদের চিরাচরিত ছকে যে ধরনের বাংলাদেশ-বিরোধী অপপ্রচার চালায়, এই রিপোর্টটিও সেই শ্রেণির। এরা বিভিন্ন উগ্রপন্থী আন্তর্জাতিক গোষ্ঠী ও সংবাদমাধ্যম, বিশেষ করে আল জাজিরার সঙ্গে হাত মিলিয়ে বিভিন্ন সময় ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়েছে।

বিবৃতিতে বলা হয়, আল জাজিরার প্রতিবেদনের অভিযোগগুলোর মূল সূত্র একজন সন্দেহভাজন আন্তর্জাতিক অপরাধী, যাকে আল জাজিরা নিজেই ‘সাইকোপ্যাথ’ আখ্যা দিয়েছে।

‘প্রধানমন্ত্রী বা বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় কোনো প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে ওই বিশেষ ব্যক্তির সংশ্লিষ্টতার সামান্যতম প্রমাণও নেই। আর মানসিক ভারসাম্যহীন কারও কথার ভিত্তিতে চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে পৌঁছা একটি আন্তর্জাতিক নিউজ চ্যানেলের জন্য চরম দায়িত্ব-হীনতা’ বিবৃতিতে বলা হয়।

স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল

এদিকে বাংলাদেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল আজ বুধবার সাংবাদিকদের সামনে বলেছেন, ‘কাতারভিত্তিক সংবাদ মাধ্যম আল-জাজিরা প্রতিবেদনটি তথ্যভিত্তিক নয়। এটা হলুদ সাংবাদিকতা। এগুলো সাংবাদিকতার নীতির ভেতরে পড়ে না।

স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ‘আমি মনে করি আল-জাজিরা যেটা করেছে। তাদের একটা উদ্দেশ্য ছিল। সে উদ্দেশ্য নিয়েই এ ধরনের ঘটনা ঘটিয়েছেন। আমরা মনে করি, এগুলো ভিত্তিহীন এবং দেশবিরোধী একটি ষড়যন্ত্রের বহিঃপ্রকাশ।’

ড. আসিফ নজরুল

এদিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক, বিশিষ্ট লেখক, ঔপন্যাসিক, রাজনীতি-বিশ্লেষক, সংবিধান বিশেষজ্ঞ ড. আসিফ নজরুল এ বিষয়ে প্রতিক্রিয়া জানিয়ে সরকারের উদ্দেশে বলেছেন, ‘আল-জাজিরাকে মিথ্যে প্রমান করুন।’

বুধবার নিজের ফেসবুক পেজে তিনি বলেন, সেনাপ্রধানের ভাইদের কাজকর্ম এবং তাদের সাথে উনার যোগাযোগ নিয়ে আল-জাজিরার সচিত্র প্রতিবেদন বহু মানুষ দেখেছে, দেখছে। এর উত্তরে সরকারীভাবে দুটো প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করা হয়েছে। কিন্তু এসবে আল-জাজিরার প্রতিবেদনে পরিবেশিত তথ্যের উত্তর তেমনভাবে নাই। আছে প্রতিবেদনকারীদের বিরুদ্ধে অভিযোগ। বলা হচ্ছে আল-জাজিরার প্রতিবেদন অপপ্রচার ও ষড়যন্ত্রমূলক।’

তিনি প্রশ্ন রেখে বলেছেন, এটি যে অপপ্রচার ও ষড়যন্ত্রমূলক তা আমরাও বিশ্বাস করতে চাই। কিন্তু এজন্য প্রতিবেদনে পরিবেশিত বিষয়গুলোর উপযুক্ত উত্তর দেশবাসীকে জানানো দরকার। যেমন: প্রতিবেদনে দেখানো হয়েছে সেনাপ্রধানের একজন ভাই খুনের দায়ে ফেরারী আসামী হয়ে আছেন। এ অবস্থায় তিনি সরকারের কিছু কর্ম্কর্তার সহায়তায় জালিয়াতি করে বাংলাদেশ থেকে ভূয়া পরিচয়পত্র ও পাসপোর্ট করেছেন, নিজের নাম পর্য্ন্ত বদল করেছেন। আল-জাজিরার এসব তথ্য কি মিথ্যে?

ড. আসিফ নজরুল বলেন, প্রতিবেদনে দেখানো হয়েছে, ফেরার আসামী হয়েও সেনাপ্রধানের ভাই বাংলাদেশে এসে এসএসএফ, পুলিশ, গোয়েন্দা এবং প্রেসিডেন্টের উপস্থিতিতে সেনাপ্রধানের সন্তানের বিয়েতে উপস্থিত ছিলেন। এই তথ্য কি মিথ্যে? এর প্রমাণ হিসেবে আল জাজিরার প্রতিবেদনে দেখানো ছবি ও ভিডিও গুলো কি কারসাজি করে করা? সেনাপ্রধানের কোন ভাই যদি সত্যি সত্যি আইনের উর্ধ্বে থাকেন, তাহলে এর পেছনে যুক্তিগুলো কি কি?

এরকম এবং এরচেয়েও সেনসেটিভ কিছু বিষয়ে অনেকের মনে প্রশ্ন আসতে পারে। সরকারের তরফ থেকে তাই প্রতিবেদনটির জবাব থাকলে তা আরো স্পস্ট করে বলা উচিত। দেশের পাশাপাশি আন্তর্জাতিক মহলকে আরো ভালো করে বলা উচিত।

তিনি বলেন, কিশোরদের কার্টুন না, দেশের ভাবমূর্তি ক্ষুন্ন হয় বাংলাদেশে মাফিয়াতন্ত্র চলছে আল জাজিরার এমন প্রতিবেদনে। এই প্রতিবেদন মিথ্যে হলে, তা প্রমান করার সব ব্যবস্থাও তাই সরকারের নেয়া উচিত। আল জাজিরায় প্রতিবাদলিপি পাঠানো উচিত। তাদেরকে ক্ষমা প্রার্থ্না এবং প্রতিবেদন প্রত্যাহার করতে বলা উচিত। এটি করতে ব্যর্থ হলে তাদের বিরুদ্ধে ক্ষতিপুরনের মামলা করা উচিত। সেই সৎসাহসের প্রত্যাশায় থাকলাম।

সূত্র: বিবিসি


আল জাজিরার সেই প্রতিবেদন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *