লুৎফুর রহমান ফরায়েজী
ভূমিকা
রাসূল সা., সাহাবায়ে কেরাম রা., তাবেঈন, তাবে তাবেয়ীগণ এবং মুজতাহিদ ইমামগণের আমল দ্বারা ঐতিহাসিকভাবে প্রমাণিত যে, তারাবী নামায বিশ রাকাত।
কিন্তু ১২৮৪ হিজরীতে ভারতের আকবরাবাদ থেকে সর্বপ্রথম এক লা-মাযহাবী মৌলভী সাহেব আট রাকাত তারাবীর ফতওয়া প্রদান করেন। এরপর ১২৮৫ হিজরীতে পাঞ্জাব সীমান্তে মাওলানা মুহাম্মদ হুসাইন বাটালবী আট রাকাত তারাবী নামায পড়া সুন্নত হওয়ার দাবি করেন।
কিন্তু কুরআন ও হাদীস সম্পর্কে তৎকালীন প্রাজ্ঞ হক্কানী উলামায়ে কেরাম উক্ত আট রাকাত তারাবীর ফাতওয়াকে ভুল হিসেবে প্রমাণিত করে তা প্রত্যাখ্যান করেন।
১৩৭৭ হিজরীতে আরবে শায়েখ নসীব রেফায়ী ও শায়েখ নাসীরুদ্দীন আলবানী রহ. সর্বপ্রথম আট রাকাত তারাবীর মত প্রকাশ করেন। তখন শায়েখ আতিয়্যা সালিমসহ আরবের জমহুর উলামায়ে কেরাম তাদের উক্ত রায়কে প্রত্যাখ্যান করেন এবং সাহাবায়ে কেরাম রা. এর যুগ থেকে চলে আসা হারামাইন শরীফাইন তথা বাইতুল্লাহ শরীফ ও মসজিদে নববীতে বিশ রাকাত তারাবীর আমলকে অব্যাহত রাখেন। যা আজো অব্যাহত রয়েছে।
সুতরাং আট রাকাত তারাবী পড়ার মতকে অনুসরণের অর্থ হল, সাহাবা ও তাবেয়ীগণের অনুসৃত আমলকে প্রত্যাখ্যান করে নব্য সৃষ্ট বিদআতি দলের অনুসরণ করা।
তারাবীহ নামায বিশ রাকাতের প্রমাণ
১ عن ابن عباس ان رسول الله صلى الله عليه وسلم كان يصلى فى رمضان عشرين ركعة والوتر
হযরত আব্দুল্লাহ বিন আব্বাস রা: থেকে বর্ণিত। রাসূল সা: রমজান মাসে বিশ রাকাত এবং বিতির পড়তেন। {মুসান্নাফে ইবনে আবী শাইবা-৫/২২৫, হাদীস নং- ৭৬৯২, মুসনাদে আব্দ বিন হুমাইদ-২১৮, আল মুজামুল কাবীর, হাদীস নং-১২১০২, মাজমাউজ যাওয়ায়েদ, হাদীস নং-১৭২, সুনানে বায়হাকী কুবরা, হাদীস নং-৪৩৯১}
২ عن جابر بن عبد الله قال خرج النبى صلى الله عليه وسلم ذات ليلة فى رمضان فصلى الناس اربعة وعشرون ركعة واوتر بثلاثة
হযরত জাবের রা: বলেন: রমজান মাসের এক রাতে রাসূল সা: বাহিরে তাশরীফ নিয়ে এলেন। আর সাহাবায়ে কেরামকে ২৪ রাকাত [৪ রাকাত ঈশার, আর ২০ রাকাত তারাবীহের] নামায পড়ালেন। আর তিন রাকাত বিতির পড়ালেন। [তারীখে জুরজান-২৭}
যেহেতু কথিত আহলে হাদীস ভাইদের কাছে দলীল শুধু কুরআন ও সহীহ হাদীস। তথা আল্লাহ ও রাসূল সা: এর কথা। কোন ব্যক্তির মতামত তাদের কাছে গ্রহণযোগ্য নয়। আর এ দু’টি হাদীসকে আল্লাহ এবং রাসূল সা: না সহীহ বলেছেন, না জঈফ বলেছেন। তাই গায়রে মুকাল্লিদরা এ দু’টি হাদীসকে না সহীহ বলতে পারবে, না জঈফ বলতে পারবে। এবার দেখার বিষয় হল, উম্মতের ঐক্যমত্যের আমল এর উপর আছে কি নেই? যদি দেখা যায় যে, উম্মতের আমল এর উপরই। তাহলে আমল হিসেবে গ্রহণযোগ্য হওয়ার দ্বারা উক্ত হাদীস সহীহ হয়ে যায়।
ওমর রা: এর আদেশ
৩
عن يحيى بن سعيد ان عمر بن الخطاب امر رجلا يصلى بهم عشرين ركعة
হযরত ইয়াহইয়া বিন সাঈদ থেকে বর্ণিত। নিশ্চয় ওমর বিন খাত্তাব রা: এক ব্যক্তিকে বিশ রাকাত পড়ার হুকুম দিলেন। {মুসান্নাফে ইবনে আবী শাইবা-৫/২২৩}
হযরত ওমর রা: এর শাসনামল
৪
وروى مالك من طريق يزيد بن خصيفة عن السائب بن يزيد عشرين ركعة
হযরত সায়েব বলেন: হযরত ওমর রা: এর সময়কালে বিশ রাকাত তারাবীহ ছিল। {ফাতহুল বারী-৪/৪৩৬} যার সনদ বুখারীতে দুই স্থানে আছে।
৫
عن السائب بن يزيد ، قال : كنا نقوم في زمان عُمَر بن الخطاب رضي الله عنه بعشرين ركعة والوتر
হযরত সায়েব বিন ইয়াজিদ রা: বলেন: আমরা হযরত ওমর রা: এর শাসনামলে বিশ রাকাত তারাবীহ ও বিতির পড়তাম। {সুনানে সুগরা লিল বায়হাকী, হাদীস নং-৮৩৩, মারিফাতুস সুনান ওয়াল আসার, হাদীস নং-১৪৪৩}
ইমাম নববী রহঃ, সুবকী রহঃ [শরহুল মিনহাজ], মোল্লা আলী কারী রহঃ [শরহুল মুয়াত্তা] ও সুয়ুতী রহঃ এ বর্ণনাকে সহীহ বলেছেন।
৬
محمد بن كعب القرظى كان الناس يصلون فى زمان عمر بن الخطاب فى رمضان عشرين ركعة ويوترون بثلاث
মুহাম্মদ বিন কাব কুরজী বলেন: ওমর ফারুক রা: এর শাসনামলে লোকেরা রমজান মাসে বিশ রাকাত তারাবীহ ও তিন রাকাত বিতির পড়তো। [মুসান্নাফ ইবনে আবী শাইবা-৫/২২৩]
৭
عن يزيد بن رومان ، أنه قال : « كان الناس يقومون في زمان عمر بن الخطاب في رمضان بثلاث وعشرين ركعة »
হযরত ইয়াজিদ বিন রূমান বলেন: লোকেরা হযরত ওমর রা: এর শাসনামলে বিশ রাকাত তারাবীহ এবং তিন রাকাত বিতির রমজান মাসে আদায় করতো। {মারিফাতুস সুনান ওয়াল আসার, হাদীস নং-১৪৪৩, মুয়াত্তা মালিক, হাদীস নং-৩৮০, সুনানে বায়হাকী কুবরা, হাদীস নং-৪৩৯৪}
৮
عن الحسن ان عمر بن الخطاب جمع الناس على ابى بن كعب فكان يصلى بهم عشرين ركعة
হযরত হাসান রা: থেকে বর্ণিত। হযরত ওমর রা: লোকদেরকে হযরত উবায় বিন কাব রা: এর কাছে একত্র করে দিলেন। আর তিনি লোকদের বিশ রাকাত তারাবীহ পড়াতেন। {সুনানে আবু দাউদ-১/২০২, সিয়ারু আলামিন নুবালা-১/৪০০}
৯
عن ابى بن كعب ان عمر بن الخطاب امره ان يصلى باليل فى رمضان فصلى بهم عشرين ركعة
হযরত উবায় বিন কাব রা: বলেন: হযরত ওমর রা: আমাকে এই মর্মে আদেশ দিলেন যে, আমি যেন লোকদেরকে তারাবীহ পড়াই। তখন বিশ রাকাত পড়া হতো। {কানযুল উম্মাল-৮/২৬৪}
ইমাম বায়হাকী, আল্লামা বাজী, কাশতাল্লানী, ইবনে কুদামা, ইবনে হাজার মক্কী, তাহতাবী, ইবনে হুমাম, বাহরুর রায়েক প্রণেতা রহঃ প্রমুখগণ এ ব্যাপারে একমত হয়ে বলেন: হযরত ওমর ফারুক রা: এর শাসনামলে বিশ রাকাত তারাবীহের উপরই সকলের সিদ্ধান্ত স্থির হয়। এবং এভাবেই চলতে থাকে। ইংরেজ আমলের পূর্বে কোন একজন মুহাদ্দিস বা ফক্বীহ এটাকে অস্বীকার করেননি। আর সুন্নত হওয়ার জন্য সেটির নিরবচ্ছিন্ন হওয়া শর্ত। তাই এই বিশ রাকাত তারাবীহ সুন্নতে ফারূকী হয়েছে। এ সেই ওমর রা:, যার ব্যাপারে রাসূল সা: ইরশাদ করেছেন যে, যদি আমার পর কোন নবী হতো তাহলে নবী হতো ওমর। তিনি আরো বলেছেন: দ্বীনের ব্যাপারে সবচে’ মজবুত হলেন ওমর রা:। যদি বিশ রাকাত তারাবীহ নামায বিদআত হয়, তাহলে হযরত ওমর রা: সহ সে সময়কার সমস্ত আনসার ও মুহাজির সাহাবীগণের বিদআতি হওয়ার আবশ্যক হয়। ইমাম ইবনে তাইমিয়া রহঃ বলেন: উবাই বিন কাব রা: তারাবীহ মুহাজির ও আনসার সাহাবীদের মাঝে পড়াতেন। কোন একজনও এ ব্যাপারে আপত্তি উত্থাপন করেনি। {মাজমূআ ফাতাওয়া ইবনে তাইমিয়া-৩৩/১১২}
হযরত উসমান রা: এর শাসনামল
১০
হযরত সায়েব বিন ইয়াজিদ বলেন: হযরত ওমর রা: এর শাসনামলে লোকেরা বিশ রাকাত তারাবীহ পড়তেন। আর হযরত উসমান রা: এর শাসনামলে লম্বা কেরাতের কারণে লাঠির উপর ভর দিতেন। {বায়হাকী-৪/২৯৬}
হযরত উসমান রা: এর শাসনামলের একজন ব্যক্তির নামও বলা যাবে না, যে ব্যক্তি আট রাকাত পড়ে জামাত থেকে বেরিয়ে যেত। কিংবা কেউ বিশ রাকাত তারাবীহকে বিদআত বলেছে এমন একজন ব্যক্তিও পাওয়া যাবে না।
আলী রা: এর শাসনামল
১১
عن ابى عبد الرحمن السلمى عن على قال دعى القراء فى رمضان فامر منهم رجلا يصلى بالناس عشرين ركعة قال وكان على يوتر بهم
হযরত আবু আব্দুর রহমান সুলামী বলেন: হযরত হযরত আলী রা: রমজান মাসে কারীদের ডাকতেন। তারপর তাদের মাঝে একজনকে বিশ রাকাত তারাবীহ পড়াতে হুকুম দিতেন। আর বিতিরের জামাত হযরত আলী নিজেই পড়াতেন। {বায়হাকী-৪/৪৯৬}
عن ابى الحسناء ان عليا امر رجلا ان يصلى بالناس خمس ترويحات عشرين ركعة
হযরত আবুল হাসনা বলেন: হযরত আলী রা: এক ব্যক্তিকে পাঁচ তারাবীহ এর সাথে বিশ রাকাত পড়াতে হুকুম দিয়েছেন। {সুনানে কুবরা লিলবায়হাকী, হাদীস নং-৪৮০৫, ৪৩৯৭, কানযুল উম্মাল, হাদীস নং-২৩৪৭৪}
হযরত আলী রা: নিজেই রাসূল সা: থেকে বর্ণনা করেন যে, যে ব্যক্তি বিদআতের উৎপত্তি করবে তার ফরজ, নফল কিছুই কবুল হয় না। {বুখারী-২/১০৮৪, মুসলিম-১/১৪৪}
হযরত আলী রা: আজানের পর ইশার নামাযের জন্য আবার ডাকতে শুনে বললেন: এ বেদআতিকে মসজিদ থেকে বের করে দাও। {বাহরুর রায়েক}
তিনি এক ব্যক্তিকে ঈদগাহে ঈদের নামাযের আগে নফল পড়তে দেখে খুবই ধমক দিলেন লোকটিকে। যদি বিশ রাকাত তারাবীহ বিদআত হতো, তাহলে এর হুকুম কেন দিলেন তিনি?
ইংরেজ শাসনের আগে একজন মুহাদ্দিস বা ফক্বীহের নাম বলা যাবে না, যারা আলী রা: এর শাসনামলের বিশ রাকাত তারাবীহ পড়াকে অস্বীকার করেছেন। কোন ব্যক্তি সেই জমানার একজন ব্যক্তির নামও বলতে পারবে না, যে ব্যক্তি আট রাকাত তারাবীহ পড়ে মসজিদ থেকে বেরিয়ে যেত। এটাও মনে রাখতে হবে যে, এ হাদীস দ্বারা প্রমাণিত হল যে, বিশ রাকাতওয়ালী নামাযের নাম তারাবীহ হযরত আলী রা: বর্ণনা করেছেন। কোন খলীফায়ে রাশেদ বা কোন সাহাবী আট রাকাতের সাথে তারাবীহ শব্দ উচ্চারণ করেননি। হাদীস ভাণ্ডারে এর কোন প্রমাণ নেই।
১৩
عن زيد بن وهب قال كان عبد الله يصلي بنا في شهر رمضان فينصرف وعليه ليل قال الا عمش كان يصلى عشرين ركعة ويوتر بثلث
হযরত জায়েদ বিন ওহাব বলেন: হযরত আব্দুল্লাহ বিন মাসউদ রা: আমাদের তারাবীহ পড়িয়ে ফারিগ হতেন এমতাবস্থায় যে, তখনো রাত অনেক বাকি থাকতো, ইমাম আমাশ বলেন: তিনি বিশ রাকাত তারাবীহ আর তিন রাকাত বিতির পড়াতেন। {কিয়ামুল লাইল-১৫৭}
হযরত আব্দুল্লাহ বিন মাসউদ রা: খোদ বলেছেন যে, সুন্নত ছেড়ে দেয়া উত্তম বেদআতের উপর মেহনত করার চেয়ে। {হাকেম-১/১,৩} যদি বিশ রাকাত তারাবীহ বিদআত হতো, তাহলে তিনি কেন পড়ালেন?
জমহুর সাহাবাগণ রা:
১৪
ابو حنيفة عن حماد عن ابراهيم ان الناس كانوا يصلون خمس ترويحات فى رمضان
হযরত ইমাম আবু হানীফা রহঃ, হযরত ইবরাহীম [মৃত্যু-৯৬হিজরী] থেকে বর্ণনা করেন যে, নিশ্চয় লোকেরা [সাহাবী ও তাবেয়ীগণ] রমজান মাসে পাঁচ তারবীহার সাথে বিশ রাকাত তারাবীহ পড়তো। {কিতাবুল আসার লিআবী ইউসুফ}
১৫
عن عبد العزيز بن رفيع قال كان ابى بن كعب يصلى بالناس فى رمضان بالمدينة عشرين ركعة ويوتر بثلاثة
হযরত আব্দুল আজীজ বিন রফী থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন: হযরত উবায় বিন কাব রা: লোকদেরকে রমজান মাসে মদীনা মুনাওয়ারায় বিশ রাকাত তারাবীহ এবং তিন রাকাত বিতির নামায পড়াতেন। {মুসান্নাফ ইবনে আবী শাইবা-৫/২২৪}
১৬
عن عطاء قال ادركت الناس وهم يصلون ثلثة وعشرون ركعة بالوتر
হযরত আতা [মৃত্যু-১১৪হিজরী] থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন: আমি লোকদের [সাহাবী ও তাবেয়ীগণ] বিশ রাকাত তারাবীহ এবং তিন রাকাত বিতির পড়তে দেখেছি। {মুসান্নাফ ইবনে আবী শাইবা-৫/২২৪}
তাবেয়ীগণ রহঃ
হযরত সুয়াইদ বিন গাফালা যিনি বয়সে রাসূল সা: থেকে মাত্র তিন বছরের ছোট ছিলেন। তিনি ইমামতি করাতেন। হযরত আবুল হাজীব বলেন:
১৭
كان يؤمنا سويد بن غفلة فى رمضان فيصلى خمس ترويحات عشرين ركعة
হযরত সুইয়াইদ বিন গাফালা রমজান মাসে আমাদের জামাতের সাথে পাঁচ তারবিহায় বিশ রাকাত নামায পড়াতেন। {বায়হাকী-২/৪৯}
১৮
عن ابى البخترى انه كان يصلى خمس ترويحات فى رمضان ويوتر بثلاث
হযরত আবুল বুখতারী রহঃ বলেন: তিনি রমজানে পাঁচ তারবিহায় বিশ রাকাত ও তিন রাকাত বিতির পড়তেন। {মুসান্নাফ ইবনে আবী শাইবা, হাদীস নং-৭৬৮৬}
১৯
عن سعيد بن ابى عبيد ان على بن ربيعة كان يصلى بهم فى رمضان خمس ترويحات ويوتر بثلاث
হযরত সাঈদ বিন আবু উবায়েদ থেকে বর্ণিত। হযরত আলী বিন রাবীয়া পাঁচ তারবিহা তথা বিশ রাকাত তারাবীহ এবং তিন রাকাত বিতির জামাতের সাথে পড়তেন। {মুসান্নাফ ইবনে আবী শাইবা-৫/২২৫}
এ সকল হাদীস দ্বারা বুঝা যায় যে, বিশ রাকাতের সাথে তারাবীহ শব্দ এবং বিশ রাকাত তারাবীহের আমল তাবেয়ীগণের মাঝে বিনা প্রতিবাদে নির্বিঘ্নে প্রচলিত ছিল। আর পুরো খাইরুল কুরুনে কোন এক ব্যক্তির নাম উল্লেখ করা যাবে না, যে ব্যক্তি বিশ রাকাত তারাবীহকে অস্বীকার করেছেন বা অপছন্দ করেছেন। কিংবা বিশ রাকাত তারাবীহকে বিদআত বলেছেন, বা আট রাকাত জামাতের সাথে পড়ে মসজিদ থেকে বেরিয়ে গেছেন। পুরো খাইরুল কুরুনের মাঝে আট রাকাতের সাথে তারাবীহ শব্দ ব্যবহার করেছেন এরকম কোন প্রমাণ কোথাও বিদ্যমান নেই।
মসজিদে নববীতে বিশ রাকাত তারাবীহ
মদীনা তায়্যিবাহর মাঝে হযরত ওমর রা:, হযরত উসমান রা:, হযরত আলী রা: এর শাসনামলে বিশ রাকাত তারাবীহই পড়া হতো। আজো মদীনা মুনাওয়ারায় বিশ রাকাত তারবীহই পড়া হয়। হযরত আয়শা রা: ও মদীনা মুনাওয়ারায় অবস্থান করতেন। তিনিই রাসূল সা: এর এ ফরমান বলেছেন: যে ব্যক্তি আমার দ্বীনের মাঝে বেদআত বের করবে, তার কাজটি পরিত্যাজ্য। যদি বিশ রাকাত তারাবীহের নামায বিদআত ও নাজায়েজ হতো, তাহলে হযরত আয়শা রা: বছরের পর বছর এর উপর চুপ করে বসে থাকতেন না।
হযরত জাবের বিন আব্দুল্লাহ রা: ও মদীনায় অবস্থান করছিলেন। তিনি ঐ হাদীসের রাবী। যাতে বলা হয়েছে যে, প্রত্যেকটি বিদআত গোমরাহী আর প্রত্যেক গোমরাহী জাহান্নামে নিক্ষেপকারী।
অথচ তারই সামনে অর্থ শতাব্দী পর্যন্ত মসজিদে নববীতে বিশ রাকাত তারাবীহ জামাতের সাথে পড়া হচ্ছিল, অথচ তিনি এর বিরুদ্ধে কোন কথা বলেন নি। এটা হতে পারে না।
বাইতুল্লাহ শরীফে বিশ রাকাত তারাবীহ
মক্কা মুকাররমায় হযরত আতা বিন আবী রাবাহ রহঃ [মৃত্যু ১১৪হিজরী] বলেন: ادركت الناس وهم يصلون ثلاثة وعشرون ركعة بالوتر তথা আমি লোকদের [সাহাবা ও তাবেয়ীগণ] বেতের নামাযসহ ২৩ রাকাত পড়তে দেখেছি। {মুসান্নাফ ইবনে আবী শাইবা-২/৩৯৩}
আর ইমাম ইবনে আবী মালিকাহ [মৃত্যু ১১৭হিজরী] লোকদের মক্কায় বিশ রাকাত তারাবীহ পড়াতেন। {মুসান্নাফ ইবনে আবী শাইবা-২/৩৯৩}
ইমাম শাফেয়ী রহঃ [মৃত্যু ২০৪হিজরী] বলেন: আমি স্বীয় শহর মক্কায় লোকদের বিশ রাকাত তারাবীহ পড়া অবস্থায়ই পেয়েছি। {তিরমিযী-১/১৬৬}
আর আজ পর্যন্ত মক্কা মুকাররমায় বিশ রাকাত তারাবীহই পড়া হচ্ছে।
কুফায় বিশ রাকাত তারাবীহ
কুফায় হযরত আব্দুল্লাহ বিন মাসউদ রা: বিশ রাকাত তারাবীহ এবং তিন রাকাত বিতির পড়াতেন। {মুখতাসার কিয়ামুল লাইল-১৫৭}
ইমাম ইবরাহীম নাখয়ী রহঃ [মৃত্যু-৯৬হিজরী] বলেন: লোকেরা [সাহাবীগণ ও তাবেয়ীগণ] রমজান মাসে পাঁচ তারাবীহ [বিশ রাকাত] পড়তেন। {কিতাবুল আসার লিআবী ইউসুফ-৪১}
বসরায় বিশ রাকাত তারাবীহ
হযরত ইউনুস রহঃ থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন: আমি আবুল আশআস [মৃত্যু ৮৩হিজরী] এর ফেতনার পূর্বে জামে মসজিদ বসরাতে দেখেছি যে, হযুরত আব্দুর রহমান বিন আবী বাকরা [মৃত্যু ৯১হিজরী] হযরত সাঈদ বিন আবীল হাসান [মৃত্যু ১০০হিজরী] এবং হযরত ইমরানুল আব্দী লোকদের পাঁচ তারাবীহ [বিশ রাকাত] পড়াতেন। {কিয়ামূল লাইল-১৫৮}
মোটকথা, পুরো খাইরুল কুরুনের মাঝে বিশ রাকাত তারাবীহকে অস্বীকারকারী একজনও ছিল না। কোন ইসলামী রাজত্বে এটাকে অস্বীকার করা হয়নি। এটাকে অস্বীকার করে সর্ব প্রথম ইংরেজরা উপমহাদেশে আসার পর কতিপয় নামধারী আহলে হাদীস গায়রে মুকাল্লিদ গ্রুপ।
চার ইমাম রহঃ এর বক্তব্য
শাহ ওয়ালী উল্লাহ মুহাদ্দেসে দেহলবী রহঃ বলেন: আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাআত চার মাযহাবে সীমাবদ্ধ। এ চার ইমামের মাঝে প্রথম ইমাম হলেন ইমাম আবু হানীফা রহঃ [মৃত্যু ১৫০ হিজরী] ও বিশ রাকাত তারাবীহের প্রবক্তা। [ফাতাওয়া কাজীখান-১/১১২} ইমাম মালিক রহঃ এর একটি বক্তব্য বিশ রাকাতের পক্ষে, দ্বিতীয় বক্তব্য ৩৬ রাকাতের পক্ষে। [যাতে বিশ তারাবীহ আর ১৬ রাকাত নফল] হেদায়াতুল মুজতাহিদ-১/১৬৭}
ইমাম শাফেয়ী রহঃ বিশ রাকাতের প্রবক্তা। {আলমুগনী-২/১৬৭}
ইমাম আহমদ বিন হাম্বল রহঃ এর মুখতার বক্তব্যও বিশ রাকাতের পক্ষে। [আলমুগনী-২/১৬৭}
চার মাযহাবের ফিক্বহের ইবারতের মাঝে কোন একটি ইবারতেও শুধু আট রাকাত তারাবীহকে সুন্নত আর বিশ রাকাততে বিদআত বলা হয়নি।
সাহাবাগণের নিরবচ্ছিন্ন আমল ও ইজমার আলোকে
তারাবীহ নামায বিশ রাকাত। সাহাবায়ে কেরাম রা: থেকে এ আমলই সারা পৃথিবীতে চালু হয়েছে। যা আজো সারা পৃথিবীতে আমল হয়ে আসছে। নব্য ফিতনা কতিপয় আহলে হাদীস নামধারী ছাড়া মসজিদে নববী এবং বাইতুল্লাহসহ সারা পৃথিবীতে তা সকল মুসলমাগণ আমল করে আসছেন।
এ ব্যাপারে সাহাবায়ে কেরামের মাঝে আমলী ইজমা হয়েছিল।
ইবনে কুদামা হাম্বলী রহঃ [মৃত্যু ৫৯৫ হিজরী] আলমুগনী গ্রন্থের ২য় খণ্ডের ১৬৭ নং পৃষ্ঠায়, আল্লামা কাশতাল্লানী শাফেয়ী রহঃ [মৃত্যু ৯২৩ হিজরী] “ইরশাদুস সারী” এর ৩য় খণ্ডের ৫১৫ নং পৃষ্ঠায় বিশ রাকাতের উপর সাহাবাগণের ইজমার কথা উল্লেখ করেছেন।
মোল্লা আলী কারী হানাফী রহঃ [মৃত্যু ১০১৪হিজরী] “শরহুন নুকায়া” এর ২য় খণ্ডের ২৪১ পৃষ্ঠায় এবং আল্লামা সাইয়্যেদ মুরতাজা জুবাইদী [মৃত্যু-১২০৫ হিজরী] সাহেব “ইতহাফুল সাদাতুল মুত্তাকীন” কিতাবের ৩য় খণ্ডের ৭০০ নং পৃষ্ঠায় সাহাবাগণের এ ইজমাকে নকল করেছেন।
উম্মতে মুসলিমার ইজমা
১২৮৪ হিজরীর ইংরেজ আমলের আগে পৃথিবীর কোন মসজিদে রমজানের পুরো মাস মসজিদে আট রাকাত তারাবীহ জামাতের সাথে পড়ার কোন নজীর নেই। একটি মসজিদের নাম কোন কথিত আহলে হাদীস দেখাতে পারবে না। না মসজিদে নববীতে কোনদিন আট রাকাত তারাবীহ পড়া হয়েছে। না বাইতুল্লায়। না পৃথিবীর কোন মুসলিম পল্লিতে। রানী ভিক্টোরিয়ার আমলে সর্বপ্রথম এ বিদআতের সূচনা হয়।
এর আগে সমগ্র উম্মতে মুসলিমা ঐক্যমত্যের ভিত্তিতে ২০ রাকাত ও এর চেয়ে তারাবীহ পড়ে আসছেন। দেখুন-
১- মিরকাত-৩/১৯৪।
২- ইতহাফুল সাদাতিল মুত্তাকীন-৩/৪২২।
৩- আনারাতুল মাসাবীহ-১৮।
৪- হাশিয়ায়ে শরহে বেকায়া মাওলানা আব্দুল হাই লৌখনবী রহঃ।
৫- উমদাতুল কারী-৫/২৬৭।
৬- ফাতাওয়ায়ে কাজীখান-১১০।
৭- আলমুগনী-১/৮০৩।
৮- শরহে মুকান্না’-১/৮৫২।
৯- শরহুল বুখারী লিলকাসতাল্লানী।
১০- আওযাজুল মাসালেক-১/৩৯০।
১১- শরহে নুকায়া-১০৪।
১২- আউনুল বারী-২/৩০৭।
১৩- কিতাবুল আজকার-৮৩।
১৪- ফাতহুল কাদীর-১/৪০৭।
১৫- আরফুশ শাজী-২৩০।
১৬- আলবাহরুর রায়েক-২/৬৬।
১৭- ফাতাওয়ায়ে শামী-১/৫১১।
১৮- বাদায়েউস সানায়ে-১/২৮৮।
১৯- আলমাসাবীহ-১৬।
২০- হালবী শরহে মুনিয়্যা-৩৮৮।
৮ রাকাত তারবীহের কোন প্রমাণ সহীহ হাদীস নেই
৮ রাকাত তারাবীহের পক্ষে গায়রে মুকাল্লিদদের দলিলসমূহ
১নং দলিল
عن أبي سلمة بن عبد الرحمن أنه أخبره : أنه سأل عائشة رضي الله عنها كيف كانت صلاة رسول الله صلى الله عليه و سلم في رمضان ؟ فقالت ما كان رسول الله صلى الله عليه و سلم يزيد في رمضان ولا في غيره على إحدى عشرة ركعة يصلي أربعا فلا تسل عن حسنهن وطولهن ثم يصلي أربعا فلا تسل عن حسنهن وطولهن ثم يصلي ثلاثا . قالت عائشة فقلت يارسول الله أتنام قبل أن توتر ؟ . فقال يا عائشة إن عيني تنامان ولا ينام قلبي (صحيح البخارى- أبواب التهجد، باب قيام النبي صلى الله عليه و سلم بالليل في رمضان وغيره1/154
হযরত আবু সালমা বিন আব্দুর রহমান থেকে বর্ণিত তিনি আয়েশা রা: এর কাছে জানতে চান নবীজী সা: এর নামায কেমন হত রামাযান মাসে? তিনি বললেন-রাসূল সা: রামাযান ও রামাযান ছাড়া ১১ রাকাত থেকে বাড়াতেন না। তিনি ৪ রাকাত পড়তেন তুমি এর সৌন্দর্য ও দীর্ঘতা সম্পর্কে জানতে চেয়ো না। তারপর পড়তেন ৪ রাকাত তুমি এর সৌন্দর্য ও দীর্ঘতা বিষয়ে জানতে চেয়ো না, তারপর পড়তেন ৩ রাকাত। হযরত আয়েশা রা: বলেন-তখন আমি বললাম-হে আল্লাহর রাসূল! আপনি কি বিতর পড়ার পূর্বে শুয়ে যান? তিনি বললেন-হে আয়েশা! নিশ্চয় আমার দু’চোখ ঘুমায় আমার কলব ঘুমায় না। (সহীহ বুখারী-১/১৫৪)
জবাব
১-
এই হাদিসে ইযতিরাব তথা অস্পষ্টতা ও পরস্পর বিরোধিতা থাকায় এ দিয়ে দলিল দেয়া ঠিক নয়। আল্লামা কুরতুবী রহঃ বলেন-আমি আয়েশা রা: এর এই বর্ণনাটি অনেক আহলে ইলমদের কাছে জিজ্ঞাসা করেছি অনেকেই এতে অস্পষ্টতা ও পরস্পর বিরোধিতা আছে বলে মত প্রকাশ করেছেন। (ফাতহুল বারী শরুহুল বুখারী-৩/১৭)
২-
খোদ হযরত আয়েশা রা: থেকে ১৩ রাকাত তারাবীহের কথা সহীহ সনদে বর্ণিত আছে। সুতরাং হাফেজ ইবনে হাজার আসকালানী অস্পষ্টতা ও পরস্পর বিরোধিতা দূর করতে এই পদ্ধতি অবলম্বন করেছেন-“সঠিক কথা হল এ ব্যাপারে আমি যা উল্লেখ করেছি এগুলো সব ভিন্ন সময় ও ভিন্ন পরিস্থিতির উপর নির্ভরশীল” অর্থাৎ নবীজী একেক সময় একেক রাকাত নামায পড়েছেন তারাবীহের ক্ষেত্রে।(ফাতহুল বারী-৩/১৭)
এর মাধ্যমে কথিত আহলে হাদিসদের “৮ রাকাতের মাঝেই তারাবীহ নামায সীমাবদ্ধ এরচে’ বেশী তারাবীহ নামায নেই” এই দাবিটি বাতিল হয়ে যাচ্ছে। খোদ আহলে হাদিসদের আলেম মাওলানা আব্দুর রহমান মুবারকপুরী বলেন-নিশ্চয় একথা প্রমাণিত যে রাসূল সা: ১৩ রাকাত তারাবীহ পড়েছেন ফজরের দু’রাকাত সুন্নত ছাড়াই।(তুহফাতুল আহওয়াজী-২/৩)
৩-
এই হাদিস দ্বারা প্রমাণিত হল নবীজী সা: এক সালামে ৪, ৪ রাকাত করে তারাবীহ আর শেষে এক সালামে ৩ রাকাত বিতর পড়েছেন, অথচ কথিত আহলে হাদিসদের আমল এর বিপরীত। তারা তারাবীহ দুই দুই রাকাত করে পড়েন। আর বিতর এক রাকাত বা তিন রাকাত দুই সালামে পড়েন। সুতরাং যেই হাদিস দলিলদাতাদের কাছে আমলহীন এর দ্বারা দলিল দেয়া যায়?
৪-
আসল কথা হল এই যে, এই হাদিসটি তাহাজ্জুদ নামাযের সাথে সংশ্লিষ্ট। এতে তারাবীহের কথা বর্ণিত নয়। নিম্নে এ ব্যাপারে কিছু প্রমাণ উপস্থাপন করা হল।
হাদিসটিতে মূলত তাহাজ্জুদের বর্ণনা এসেছে একথার দলিল
১-
হাদিসের শব্দ ما كان رسول الله صلى الله عليه و سلم يزيد في رمضان ولا في غيره (নবীজী সা: রামাযান ও রামাযান ছাড়া অন্য সময় বাড়ান না) এটাই বোঝাচ্ছে যে, প্রশ্নটি করা হয়েছিল রামাযান ছাড়া অন্য সময়ে যে নামায নবীজী পড়তেন তা রমযানে বাড়িয়ে দিতেন কিনা? এই প্রশ্নটি এজন্য করা হয়েছে যেহেতু বিভিন্ন বর্ণনায় এসেছে রাসূল সা: রামাযানে আগের তুলনায় অনেক নামায পড়তেন ও ইবাদত করতেন, তাই এই প্রশ্নটি করাটা ছিল স্বাভাবিক। আর রমযান ছাড়া কি তারাবীহ আছে? যে রামাযানের আগেই তারাবীহ আর বিতর মিলিয়ে ১৩ রাকাত নবীজী পড়তেন? নাকি ওটা তাহাজ্জুদ? তাহাজ্জুদ হওয়াটাই কি সঙ্গত নয়? সুতরাং এটাই স্পষ্ট বুঝা যায় তারাবীহ নয় প্রশ্ন করা হয়েছে তাহাজ্জুদ নিয়ে যে, নবীজী তাহাজ্জুদের নামায রামাযান ছাড়া যে ক’রাকাত পড়তেন তা থেকে রামাযানে বাড়িয়ে পড়তেন কিনা? এর জবাবে আয়েশা রা: বললেন-১৩ রাকাত থেকে বাড়াতেন না তাহাজ্জুদ নামায।
২-
এই হাদিসের শেষাংশে এই শব্দ আছে যে قالت عائشة فقلت يارسول الله أتنام قبل أن توتر ؟ (তারপর আয়েশা রা: বললেন-হে আল্লাহর রাসূল! আপনি কি বিতর পড়ার আগে ঘুমান?) এই বিষয়টি তারাবীহ এর ক্ষেত্রে কল্পনাতীত যে নবীজী সা: তারাবীহ নামায পড়ে ঘুমিয়ে পড়েন আর সাহাবীরা বিতর পড়ার জন্য নবীর জন্য অপেক্ষমাণ থাকেন। বরং এটি তাহাজ্জুদ এর ক্ষেত্রে হওয়াটাই যুক্তিসঙ্গত নয়কি?
৩-
মুহাদ্দিসীনে কিরাম এই হাদিসকে তারাবীহ এর অধ্যায়ে উল্লেখ করেননি। বরং তাহাজ্জুদ অধ্যায়ে উল্লেখ করেছেন। ইমাম মুহাম্মদ বিন নসর মারওয়াজী তার কিতাব “কিয়ামুল লাইল” এর “عدد الركعات التى يقوم بها الامام للناس فى رمضان”(রমযানে ইমাম কত রাকাত তারাবীহ পড়বে) অধ্যায়ে অনেক হাদিস আনলেও আয়েশা রা: থেকে বর্ণিত এই হাদিসটি সহীহ হওয়া স্বত্বেও তিনি আনেন নি। সাথে এদিকে কোন ইশারাও করেননি।
৪-
মুহাদ্দিসীনে কিরাম এই হাদিসকে তারাবীহ এর রাকাত সংখ্যার অধ্যায়ের পরিবর্তে তাহাজ্জুদের অধ্যায়ে উল্লেখ করেছেন। যেমন ইমাম বুখারী রহঃ তার প্রণীত বুখারী শরীফে এই হাদিসটি নিম্ন বর্ণিত অধ্যায়ে উল্লেখ করেছেন-
(ক) বিতর অধ্যায়-(১/১৩৫)
(খ) নবীজী সা: এর রাতে (নামাযের উদ্দেশ্যে) দণ্ডায়মান হওয়াটা রমযানে ও রমযান ছাড়া-(১/১৫৪)
(গ) রমযানে (নামাযের উদ্দেশ্যে) দণ্ডায়মান হওয়া ফযীলত অধ্যায়-(১/২৬৯)
(ঘ) নবীজী সা: এর দু’চোখ ঘুমায় মন ঘুমায় না-(১/৫০৩)
প্রথম অধ্যায়ে বিতরের রাকাত সংখ্যা আর দ্বিতীয় অধ্যায়ে তাহাজ্জুদ রামাযানে বেশি পড়তেন কিনা তা জানা আর তৃতীয় অধ্যায়ে রামাযানে বেশি বেশি নামাযের ফযীলত আর চতুর্থ অধ্যায়ে নবীজী ঘুমালে যে তার অযু ভাঙ্গেনা তার কারণ বর্ণনা জন্য হাদিস আনা হয়েছে। তারাবীহের রাকাত সংখ্যা বুঝানোর জন্য কোথায় এসেছে এই হাদিস?
৫-
আল্লামা হাফেজ ইবনে হাজার আসকালানী এই হাদিসের ব্যাখ্যায় বলেন-আর আমার কাছে এটি প্রকাশিত হয়েছে যে, ১১ রাকাতের থেকে না বাড়ানোর রহস্য এটি যে, নিশ্চয় তাহাজ্জুদ ও বিতরের নামায রাতের নামাযের সাথে খাস। আর দিনের ফরয যোহর ৪ রাকাত আর আসর সেটাও ৪ রাকাত আর মাগরীব হল ৩ রাকাত যা দিনের বিতর। সুতরাং সাযুজ্যতা হল-রাতের নামায দিনের নামাযের মতই সংখ্যার দিক থেকে সংক্ষিপ্ত ও বিস্তারিতভাবে। আর ১৩ রাকাতের ক্ষেত্রে সাযুজ্যতা হল-ফযরের নামায মিলানোর মাধ্যমে কেননা এটি দিনের নামাযই তার পরবর্তী নামাযের জন্য।(ফাতহুল বারী শরহুল বুখারী-৩/১৭)
ইবনে হাজার রহঃ এর এই রহস্য বা হিকমত বর্ণনা কি বলছেনা এই হাদিস দ্বারা তাহাজ্জুদ উদ্দেশ্য তারাবীহ নামায নয়? এই বক্তব্যে তাহাজ্জুদের কথা স্পষ্টই উল্লেখ করলেন ইবনে হাজার রহঃ।
তাহাজ্জুদ ও তারাবীহের মাঝে পার্থক্য
কথিত আহলে হাদিসরা বলেন “তাহাজ্জুদ আর তারাবীহ একই” তাদের এই দাবিটি ভুল নিম্নবর্ণিত কারণে
১-
তাহাজ্জুদের মাঝে ডাকাডাকি জায়েজ নয় তারাবীহতে জায়েজ।
২-
তারাবীহের সময় ঘুমানোর আগে তাহাজ্জুদের সময় নির্ধারিত নয় তবে উত্তম ঘুমের পর।
৩-
মুহাদ্দিসীনে কিরাম তাহাজ্জুদ ও তারাবীহের অধ্যায় ভিন্ন ভিন্ন লিখেছেন।
৪-
তাহাজ্জুদ নামাযের হুকুম কুরআন দ্বারা প্রমাণিত যথা সূরা ইসারার ৭৯ নাম্বার আয়াতে আল্লাহ তায়ালা وَمِنَ اللَّيْلِ فَتَهَجَّدْ بِهِ نَافِلَةً لَّكَ عَسَى أَن يَبْعَثَكَ رَبُّكَ مَقَامًا مَّحْمُودًا অর্থাৎ আর রাতে তাহাজ্জুদ পড় এটি তোমার জন্য নফল, অচিরেই তোমাকে তোমার রব প্রশংসিত স্থানে অধিষ্ঠিত করবেন।
আর তারাবীহের ব্যাপারে আল্লাহর নবী বলেন-নিশ্চয় আল্লাহ তায়ালা রমযানের রোযা তোমাদের উপর ফরয করেছেন আর আমি তোমাদের উপর এতে কিয়াম করাকে সুন্নত করেছি (সুনানে নাসায়ী-১/৩০৮)
সুতরাং বুঝা গেল তাহাজ্জুদ আল্লাহর আয়াত আর তারাবীহ নবীজীর বক্তব্য দ্বারা প্রমাণিত।
৫-
তাহাজ্জুদের হুকুম মক্কায় হয়েছে আর তারাবীহের হুকুম মদীনায় হয়েছে।
৬-
ইমাম আহমাদ রহঃ ও তারাবীহ তাহাজ্জুদ আলাদা বিশ্বাস করতেন(মাকনা’-১৮৪)
৭-
ইমাম বুখারী রহঃ এর ক্ষেত্রে বর্ণিত তিনি রাতের প্রথমাংশে তার সাগরীদদের নিয়ে তারাবীহ পড়তেন আর শেষ রাতে একাকী তাহাজ্জুদ পড়তেন। (ইমাম বুখারী রহঃ এর জীবনী)
৮-
তাহাজ্জুদ এর নির্দিষ্ট রাকাত সংখ্যা রাসূল সা: থেকে প্রমাণিত অর্থাৎ বিতরসহ বেশি থেকে বেশি ১৩ রাকাত আর কমপক্ষে ৭ রাকাত। আর তারাবীহ এর রাকাত সংখ্যার ক্ষেত্রে খোদ আহলে হাদিস ইমামদের সাক্ষ্য যে এর কোন নির্দিষ্ট সংখ্যা নবীজী সা: থেকে স্পষ্টভাবে প্রমাণিত নয়।
স্মর্তব্য
তারীখুল খুলাফা তথা খুলাফায়ে রাশেদীনের ইতিহাস অনুযায়ী হযরত ওমর রা: ১৫তম হিজরীতে তারাবীহ নামাযের জামাতের শুরু করেন। আর হযরত সাইয়্যেদা আয়শা রা: ৫৭হিজরীতে ইন্তেকাল করেছেন। পুরো ৪২ বছর আম্মাজান আয়শা রা: হুজরার নিকটবর্তী মসজিদে নববীতে ২০ রাকাত তারাবীহের বেদআত জারী হল, অথচ যেই আম্মাজান আয়শা সিদ্দিকা রা: নিজেই রাসূল সা: থেকে হাদীস বর্ণনা করেছেন যে, যে ব্যক্তি দ্বীনের মাঝে দ্বীন হিসেবে নতুন বিষয় উদ্ভাবন করবে তার সে বিষয় পরিত্যাজ্য। [বুখারী, মুসলিম] সেই আয়শা রা: থেকে একথা প্রমাণিত নয় যে, তিনি ৪২ বছরের মাঝে কোন দিন তাহাজ্জুদওয়ালী হাদীসটিকে বিশ রাকাত তারাবীহের বিরুদ্ধে দলীল হিসেবে উপস্থাপন করেছেন। এখন পথ দুইটি। হয়তো এটা মানা হবে যে, এ হাদীসের সাথে তারাবীহ বিশ রাকাতের কোন সম্পর্ক নেই। যা আয়শা রা: ভাল করেই বুঝতে পেরেছেন। তাই তিনি কোন কথাই বলেননি মসজিদে নববীতে বিশ রাকাত তারাবীহ হতে দেখে। কিংবা আম্মাজান আয়শা রা: তার বর্ণিত হাদীসটিকে বিশ রাকাত তারাবীহের বিরোধী মনে করতেন, কিন্তু তার মনে সুন্নতের মোহাব্বত আর বিদআতের প্রতি এতটুকু ঘৃণা ছিল না, যতটুকু আজকালের কথিত আহলে হাদীস নামধারী অতি ধার্মিক গায়রে মুকাল্লিদদের রয়েছে। এমনটি কেবলমাত্র রাফেজী শিয়ারাই বলতে পারে। অন্য কেউ এমন কথা বলতে পারে না।
২ নং দলিল
عن جابر بن عبد الله قال : صلى بنا رسول الله صلى الله عليه و سلم في رمضان ثمان ركعات والوتر فلما كان من القابلة اجتمعنا في المسجد ورجونا أن يخرج إلينا فلم نزل في المسجد حتى أصبحنا فدخلنا على رسول الله صلى الله عليه و سلم فقلنا له : يا رسول الله رجونا أن تخرج إلينا فتصل بنا فقال : كرهت أن يكتب عليكم الوتر (قيام الليل-90)
হযরত জাবের রা: থেকে বর্ণিত তিনি বলেন-রাসূল সা: আমাদের সাথে রমযানে ৮ রাকাত নামায ও বিতর নামায পড়লেন, তারপর যখন পরদিন হল আমরা মসজিদে একত্রিত হলাম এবং আকাঙ্ক্ষা করলাম নবীজী সা: আমাদের কাছে আসবেন। আমরা মসজিদে অবস্থান করতে লাগলাম। প্রভাত হয়ে গেল। তখন আমরা গেলাম নবীজী সা: এর কাছে। তাকে বললাম-হে আল্লাহর রাসূল! আমরা আকাঙ্ক্ষী ছিলাম আপনি আমাদের কাছে যাবেন এবং আমাদের নিয়ে নামায পড়বেন, তখন তিনি বললেন-আমি এটি পছন্দ করছিলাম না যে, তোমাদের উপর বিতর ফরয হয়ে যাক।(কিয়ামুল লাইল-৯০)
জবাব
এই হাদিসটি নিয়ে কথিত আহলে হাদিসরা সবচে’ বেশি খুশি হতে দেখা যায়। অথচ আশ্চর্যের বিষয় হল এই হাদিসটি দুর্বল। শুধু একজন নয় এই হাদিসের তিনজন রাবীর ক্ষেত্রে মুহাদ্দিসীনে কিরাম বলেছেন তারা গ্রহণযোগ্য নয়। দেখুন মুহাদ্দিসীনে কিরাম কি বলে এই হাদিসের বর্ণনাকারীদের ব্যাপারে।
ইবনে হুমাইদ রাজী
১. হাফেজ জাহাবী রহঃ বলেন-তিনি দুর্বল
২. ইয়াকুব বিন শি’বা রহঃ বলেন-তিনি অনেক অগ্রহণীয় হাদিস বর্ণনা করেন।
৩. ইমাম বুখারী রহঃ বলেন-এতে আপত্তি আছে।
৪. আবু জুরআ রহঃ বলেন-তিনি মিথ্যাবাদী।
৫. ইসহাক কু’সজ রহঃ বলেন-আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি তিনি মিথ্যাবাদী।
৬. সালেহ জাযরাহ রহঃ বলেন-প্রত্যেক বিষয়ে সে হাদিস বর্ণনা করে। আল্লাহর উপর অধিক অপবাদ আরোপকারী আমি তাকে ছাড়া কাউকে দেখিনি। সে লোকদের হাদিস পরিবর্তন করে ফেলে।
৭. আল্লামা ইবনে খারাশ রহঃ বলেন-আল্লাহর কসম সে মিথ্যাবাদী
৮. ইমাম নাসায়ী রহঃ বলেন-সে গ্রহণযোগ্য নয়। (মিযানুল ই’তিদাল-৩/৪৯-৫০)
ইয়াকুব বিন আব্দুল্লাহ আশআরী
ইমাম দারা কুতনী রহঃ বলেন-সে শক্তিশালী নয় (মিযানুল ই’তিদাল-৩/৩২৪)
ঈসা বিন জারিয়া
১. আল্লামা ইয়াহইয়া বিন মায়ীন রহঃ বলেন-তার কাছে অগ্রহণীয় হাদিস আছে।
২. ইমাম নাসায়ী বলেন-তার হাদিস অগ্রহণীয়।
৩. ইমাম নাসায়ী বলেন-তার হাদিস পরিত্যাজ্য।
৪. আবু দাউদ রহঃ বলেন-তার হাদিস অগ্রহণীয়।
৫. আল্লামা জাহাবী বলেন-তিনি দুর্বলদের মাঝে শামীল (মিযানুল ই’তিদাল-২/৩১১)
এছাড়া এ হাদিসটি “বুলুগুল মারাম” কিতাবে হযরত জাবের রা: থেকেই বর্ণিত কিন্তু সেখানে রাকাত সংখ্যার কথা উল্লেখ নেই। দেখুন বুলুগুল মারাম-৪২-৪৩।
এছাড়াও এ হাদিসে আরেকটি সমস্যা আছে, তা হলো-এই হাদিসে বিতর ফরয হবার আশংকার কথা বলা হয়েছে অথচ অন্য সহীহ হাদিসে তারাবীহ ফরয হয়ে যাবার আশংকা উল্লেখ করা হয়েছে। (মিযানুল ই’তিদাল-২/৪২-৪৩)
আরেকটি বিষয় হল, এতে সর্বদা আট রাকাত পড়ার কোন কথা উল্লেখ নেই। যা সুন্নত হওয়ার জন্য শর্ত।
এছাড়া হযরত জাবের রা: ইন্তেকাল করেছেন ৭০ হিজরীর পর মদীনায়। কমপক্ষে ৫৫ বছর যাবত তার সামনে মদীনা মুনাওয়ারায় মসজিদে নববীতে বিশ রাকাতের কথিত বিদআত চালু ছিল। আর হযরত জাবের রা: নিজের জবানে রাসূল সা: থেকে হাদীস বর্ণিত যে, شر الأمور محداثاتها وكل محدثة بدعة وكل بدعة ضلالة وكل ضلالة فى النار তথা প্রত্যেক নব উদ্ভূত ধর্মীয় বিষয় বিদআত। আর প্রতিটি বিদআত পথভ্রষ্টতা, আর প্রতিটি পথভ্রষ্টতা জাহান্নামী। {নাসায়ী} কিন্তু তারপরও কমপক্ষে ৫৫ বছর যাবত হযরত জাবের রা: মসজিদে নববীতে এ বেদআত চলতে দেখেছেন। অথচ সুন্নতের হাদীস তার সামনে ছিল। যা তিনি প্রকাশ্যে না বলে কেবল ঈসা বিন জারিয়ার কানে কানে বলেছেন? আর তিনি এ আমানত এক শিয়া ইয়াকুব বিন আব্দুল্লাহর কাছে বলেছেন। ব্যস এতটুকুই?!
হযরত জাবের বিন আব্দুল্লাহ রা: এর জঈফ হাদীসটি দিয়ে কী প্রমাণিত হয়? এর দ্বারা একথা তো প্রমাণিত হয় না যে, হযরত জাবের রা: সকল লোকেরা যখন বিশ রাকাত তারাবীহ পড়তেন, তখন তিনি আট রাকাত পড়ে মসজিদ থেকে বেরিয়ে গেছেন। এরকম কোন বর্ণনা কি আছে? থাকলে গায়রে মুকাল্লিদ ভাইয়েরা পেশ করার সাহস রাখেন কি? সাহাবায়ে কেরাম রা: থেকে বড় আল্লামা হওয়ার দাবী করবেন না। আল্লাহ তাআলা রাসূল সা: এর সুন্নতের উপর আমল এবং তা প্রচারের তৌফিক সকলকে দান করুন। আমীন।
৩ নং দলিল
و حدثني عن مالك عن محمد بن يوسف عن السائب بن يزيد أنه قال أمر عمر بن الخطاب أبي بن كعب وتميما الداري أن يقوما للناس بإحدى عشرة ركعة ( موطأ مالك-98
মুহাম্মদ বিন ইউসুফ সায়েব বিন ইয়াজিদ রহঃ থেকে বর্ণনা করেন যে, নিশ্চয় ওমর রা: ওবাই বিন কাব রা: ও তামীমে দারী রা: কে মানুষের সাথে ১১ রাকাত নামায পড়ার নির্দেশ দিয়েছেন।(মুয়াত্তা মালিক-৯৮)
জবাব
এই হাদিস দিয়েও দলিল দেয়া ঠিক নয়। কারণ-
১-
হাদিসটির শব্দে পরস্পর বিরোধিতা রয়েছে। যেমন এই হাদিসের সূত্রের একজন বর্ণনাকারী মুহাম্মদ বিন ইউসুফ তার সাগরীদ ৫ জন। তার মধ্যে ৩জন ১১ রাকাত আর ১জন ১৩ রাকাত ও ১জন ২১ রাকাতের বর্ণনা নকল করেন। এছাড়া যারা ১১রাকাতের কথা বর্ণনা তাদের বর্ণনার শব্দেও রয়েছে বিস্তর ফারাক। যথা-
ক.
ইমাম মালিক এনেছেন ওমর রা: ওবাই বিন কাব রা: ও তামীমে দারী রা: কে মানুষের সাথ ১১ রাকাত নামায পড়ার নির্দেশ দিয়েছেন।
খ.
হযরত ইয়াহইয়া আল কাত্তান বর্ণনা করেন-ওমর রা: ওবাই বিন কাব ও তামীমে দারী এর কাছে লোকদের একত্র করেন আর তারা দু’জন ১১ রাকাত নামায পড়াতেন।
গ.
আব্দুল আজীজ বিন মুহাম্মদ রহঃ এর বর্ণনায় এসেছে-আমরা হযরত ওমর রা: এর আমলে ১১ রাকাত নামায পড়তাম।
বর্ণনাকারীর বর্ণনার ঠিক নেই, সেই সাথে এগার রাকাতের কথা বলেছেন তাদের বক্তব্যটিও পরস্পর বিরোধী। এমন বর্ণনা গ্রহণযোগ্য নয়, বরং পরিত্যাজ্য। (ইলাউস সুনান-৭/৪৮)
২-
এই বর্ণনাটি হযরত ওমর রা: থেকে আরেকটি সহীহ ও শক্তিশালী বর্ণনার বিপরীত। হযরত ওমর রা: থেকে ২০ রাকাত তারাবীহের কথা ইমাম মালিক রাহ. তার মুয়াত্তার ৪০ নং পৃষ্ঠায় ও হাফেজ ইবনে হাজার ফাতহুল বারীর ৪ নং খণ্ডের ২১৯ নং পৃষ্ঠায় বর্ণনা করেন। সুতরাং বুঝা গেল এই বর্ণনাটি আমলযোগ্য নয়।
৩-
ইমাম মালিক রাহ. নিজেই এই বর্ণনাটি আমলযোগ্য মনে করেননি, তাই তিনি নিজে ৮ রাকাতের কথা বলেন না।
৪-
যদি হযরত ওমর রা: থেকে ১১ রাকাতের বর্ণনাটি সহীহ হত তাহলে পরবর্তীতে হযরত উসমান রা: ও আলী রা: থেকে এরকম বর্ণনা ও আমল প্রমাণিত হত, অথচ তাদের থেকে এরকম বর্ণনা প্রমাণিত নয়।
৫
এটাও হতে পারে যে, প্রথমে হযরত ওমর রা: এর কাছে নবীজী থেকে ৮ রাকাতের বর্ণনা এসেছিল কিন্তু পরবর্তীতে ২০ রাকাতের বর্ণনাটি পৌঁছলে তিনি ৮ রাকাতের বর্ণনাটি পরিত্যাগ করেন।
এই সকল কারণে এই হাদিসটি আমলযোগ্য হিসেবে বাকি থাকেনা।
তারাবীহ বিষয়ে কথিত আহলে হাদিস ভাইদের কাছে মান্যবর ব্যক্তিদের মতামত
১-
শায়েখ ইবনে তাইমিয়া রহঃ বলেন-আর যারা ধারণা করে যে, নিশ্চয় রমযানের দন্ডায়মানতার নির্দিষ্ট সংখ্যা প্রমাণিত আছে নবীজী সা: থেকে যার উপর বাড়ানো কমানো যাবেনা সে ভুলের মাঝে আছে।(ফতওয়া ইবনে তাইমিয়া-২/৪০১)
২
আল্লামা ইবনে সুবকী রহঃ বলেন-জেনে রাখ! নিশ্চয় রাসূল সা: কি বিশ রাকাত তারাবীহ পড়েছেন না তার চে’ কম পড়েছেন তা তার থেকে বর্ণিত নেই (শরহুল মিনহাজ)
৩
আল্লামা জালালুদ্দীন সুয়ুতী রহঃ বলেন-নিশ্চয় ওলামায়ে কিরাম মতানৈক্য করেছেন এর সংখ্যার ক্ষেত্রে, যদি তা নবীজী সা: থেকে প্রমাণিত বিষয় হত তাহলে তাতে মতবিরোধ হতনা।(আল মিসবাহ-৭৪)
৪
মাওলানা ওয়াহীদুজ্জামান বলেন-তারাবীহ নামাযের নির্দিষ্ট রাকাত নেই।( নুজুলুল আবরার-১/১২৬)
৫
আবুল খায়ের নূরুল হাসান খাঁ বলেন-মোটকথা হল নির্দিষ্ট সংখ্যা নবী থেকে প্রমাণিত নয়।( আল আরফুল জাদি-৮৪)
৬
নওয়াব সিদ্দীক হাসান খান বলেন-নিশ্চয় তারাবীহ নামায সুন্নত মৌলিকভাবে। যেহেতু নবীজী সা: তা রাতে পড়তেন তার পর তা ছেড়ে দিয়েছেন উম্মতের প্রতি দরদে যেন তা ফরয না হয়ে যায়, আর এর কোন নির্দিষ্ট রাকাতের কথা সহীহ হাদিসে নেই, কিন্তু নবীজী সা: এর একথা জানা যায় যে, তিনি রামাযানে এত ইবাদত করতেন যা অন্য সময়ে করতেননা।(আল ইনতিকাদুর রাজী’-৬১)
ঠাণ্ডা মাথায় উল্লেখিত আলোচনা পড়লে আশা করি সবার কাছে স্পষ্ট হবে ৮ রাকাত তারাবীহের দাবিটি একটি ভুল দাবি। আল্লাহ তায়ালা আমাদের রামাযানের এই পবিত্র আমল তারাবীহ ২০ রাকাত আদায় করে তার নৈকট্য হাসিল করা তৌফিক দান করুন।
তারাবীহ নামায আট রাকাত দাবিদারদের কাছে আমাদের কয়েকটি প্রশ্ন
রমজানুল মুবারকের বরকত থেকে বঞ্চিত থাকা এবং অন্যদের বঞ্চিত রাখাকে হাদীসের উপর আমল নাম দিয়েছে। আপনি তাদের সাথে কথা বলে দেখুন, পরিষ্কার ভাষায় আপনাকে বলে দিবে যে, “আমরা নবীজী সা: কে ছাড়া কাউকে মানি না। আমরা শুধুমাত্র মুহাম্মদী, আমরা না আবু বকরী, না ওমরী, না হানাফী না শাফেয়ী। আমাদের প্রতিটি কাজের উপর রাসূল সা: এর সিল মারা আছে”। এরকম স্লোগানধারী আট রাকাত দাবিদার ভাইদের কাছে আমাদের জিজ্ঞাসা-
১
রাসূল সা: সারা জীবনের মাঝে শুধুমাত্র তিন রাত এবং তাও রমজানের শেষ দশদিনের মাঝে জামাতের সাথে তারাবীহ নামায পড়েছেন। এরপর আর পড়েননি। আপনারা রমজানের চাঁদ উঠা থেকে নিয়ে প্রতি বছর পুরো রমজান মাস তারাবীহ নামায আদায় করে থাকেন, এটা তো হাদীসের খেলাফ। এ বিষয়ে তো আপনারা মুহাম্মদী রইলেন না। কারণ, এর উপর সর্বদা আমল করার বিষয়টি সাহাবায়ে কেরাম থেকে প্রমাণিত। রাসূল সা: থেকে নয়। তাই আপনারা জীবনে শুধু তিন রাত তারাবীহ জামাতের সাথে পড়ে সারা জীবন ঘরে আরামে বসে থাকুন। যেন বাকি লোকেরা শান্তির সাথে রমজানের বরকত হাসিল করতে পারে। কিন্তু আপনারা এক্ষেত্রে রাসূল সা: এর অনুসরণ ছেড়ে দেন কেন?
২
আপনারা প্রত্যেক বছর পুরো মাস মসজিদে এসে তারাবীহ নামায পড়ে থাকেন। এটা তো আপনাদের তরীকা অনুযায়ী মুহাম্মদী পদ্ধতি নয়। কেননা, রাসূল সা: তারাবীহ নামায তিন দিন পড়ার পর তৃতীয় দিন বলেছেন:
অর্থাৎ লোকেরা: তোমরা নিজেদের ঘরে নামায পড়, নিশ্চয় ফরজ নামায ছাড়া বাকি নামায স্বীয় ঘরে পড়া উত্তম। {বুখারী-১/১০১, মুসলিম-১/২৬৬}
তাই ঘর রেখে আপনারা মসজিদে কেন?
৩
এ নামাযের নাম তারাবীহ বলে রাসূল সা: রেখেছেন না সাহাবায়ে কেরাম? এ নামাযকে তারাবীহ যারা বলে থাকেন, তারা কি মুহাম্মদী না অন্য কিছু?
৪
আপনারা সারা মাস ইশার নামাযের পরপরই তারাবীহ নামায পড়ে থাকেন। এর কোন প্রমাণ তো হাদীসে নেই। এ আমলের দ্বারাও আপনারা না মুহাম্মদী থাকেন, না আহলে হাদীস থাকেন। তাহলে আপনারা কি?
৫
পুরো রমজান মাসে আপনারা তারাবীহ নামাযের পর জামাতের সাথে বিতির নামায পড়ে থাকেন, এক্ষেত্রেও তো আপনারা না মুহাম্মদী না আহলে হাদীস। কারণ কি?
৬
রাসূল সা: তারাবীহ নামাযে না নিজে পুরো কুরআন খতম করেছেন, না অন্যদের হুকুম দিয়েছেন। আপনাদের কিছু মসজিদে যে, তারাবীহের মাঝে পুরো কুরআনের খতম হয়, শুধু তাই নয়, কিছু মসজিদে তো কুরআন খতমের জন্য নামাযে কুরআন শরীফ উঠিয়ে দেখে দেখে পর্যন্ত পড়া হয়, এ আমলের ক্ষেত্রে না আপনারা মুহাম্মদী, না আহলে হাদীস। কারণ কি?
৭
আপনারা যে রমজানের সারা মাস আট রাকাত তারাবীহ আর এক রাকাত বিতির পড়ে থাকেন এ নয় রাকাতের কোন হাদীস আছে?
৮
আপনারা যেহেতু বলে থাকেন যে, তারাবীহ আর তাহাজ্জুদ একই নামাযের দু’টি নাম। এ দুই নাম মূলত এক নামাযের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য এরকম বক্তব্য নির্ভর একটি সহীহ হাদীস পেশ করুন।
এক্ষেত্রে আপনারা না কোন হাদীস পেশ করেন, না রমজান ছাড়া এ তারাবীহ/তাহাজ্জুদ নামায এতটা গুরুত্ব দিয়ে পড়ে থাকেন। রমজান ও রমজান ছাড়া একই নামাযের এ পার্থক্য কোন সহীহ হাদীস দ্বারা প্রমাণিত?
৯
আপনারা যে বলে থাকেন যে, এগার মাস এ নামায নফল থাকে। আর ১২তম মাস তথা রমজানে এসে সেটা সুন্নতে মুআক্কাদা হয়ে যায়। এগার মাস এ নামাযের সময় হল শেষ রাত, আর ১২তম মাসে এর সময় শুরু রাতেও হয়।
এগার মাস এটাকে ঘরে পড়া উত্তম, আর ১২তম মাসে এসে এটাকে মসজিদে পড়া উত্তম। এগার মাসে এ নামায একা একা পড়া উত্তম আর রমজান মাসে এসে তা জামাতের সাথে পড়া উত্তম।
এসব বক্তব্য কি আপনাদের মনগড়া হাদীস থেকে প্রমাণিত না রাসূল সা: এর হাদীস থেকে?
এসব বক্তব্যকে যখন আপনারা রাসূল সা: এর হাদীস থেকে প্রমাণ করতে পারেন না, তাহলে আপনারা না মুহাম্মদী, না আহলে হাদীস। বরং আহলে নফস সাব্যস্ত হচ্ছেন না?
১০
আপনারা আট রাকাত তারাবীহকে জামাতের সাথে পুরো মাসে মসজিদের মাঝে ইশার পরপর পড়াকে যে সুন্নতে মুআক্কাদা বলে থাকেন, আর বিশ রাকাত তারাবীহকে বেদআত ও হারাম বলে থাকেন, এ ব্যাপারেও আপনাদের কাছে কোন হাদীস নেই। বরং আজ পর্যন্ত ‘সুন্নতে মুআক্কাদা’, ‘বিদআত’, ‘হারাম’, ‘সহীহ’, ‘হাদীসে সহীহ’, ‘হাদীসে জঈফ’ এর কোন পূর্ণাঙ্গ সংজ্ঞা আপনারা কুরআন ও হাদীস থেকে দেখাতে পারেননি। প্রয়োজনের সময় উম্মতীদের থেকে উসূলে ফিক্বহ বা উসুলে হাদীস থেকে চুরি করে নিয়ে থাকেন। তারপরও আপনারা কি করে মুহাম্মদী আর আহলে হাদীস বাকি থাকেন?
যদি একথা মেনেও নেই যে, আপনাদের কাছে বিশ রাকাত তারবীহ আদায় করা বিদআতি কর্ম ও হারাম কাজ হওয়ার উপর কোন দলীলও থাকে, তবুও প্রশ্ন হল, আপনারা যেখানে তারাবীহ বিষয়ে ৯/১০টি পয়েন্টে মুহাম্মদী নয়, ৯/১০টি পয়েন্টে আহলে হাদীস নয়। এ দশ দশটি বিষয়ে আপনারা নিজেরা মুহাম্মদী বা আহলে হাদীস বাকি থাকেন না, সেখানে নিজেদের নাম আহলে হাদীস রাখা বা হাদীসের উপর আমলকারী বলাটা একটি মিথ্যাচার হিসেবেই প্রকাশ পায়। হ্যাঁ, তবে আপনাদের যদি নফসের হাদীসের পূজারী বলা হয়, তবে একথা অবশ্য সঠিক হয়।
এই সকল ১০টি বিষয়ে রাসূল সা: থেকে একটি সহীহ হাদীস পেশ করে নিজেদের খাঁটি আহলে হাদীস হিসেবে প্রমাণ করুন।
যদি না পারেন, তাহলে ২০ রাকাত তারাবীহকে বিদআত বলার মিথ্যাচার থেকে বিরত থাকুন।
আল্লাহ তাআলা আমাদের ইবাদতের মাসে ধোঁকাবাজদের ধোঁকায় পড়ে ইবাদত থেকে গাফিল হয়ে আট রাকাত পড়ে মসজিদ থেকে বেরিয়ে যাওয়ার বে-আদবী কর্ম থেকে মুসলিম উম্মাহকে হিফাযত করুন। আমীন। ছুম্মা আমীন।
এ বিষয়ে বিস্তারিত তাহকীক জানতে পড়ুন-
হুজ্জাতুল্লাহি ফিল আরদ মুনাজিরে ইসলাম মাওলানা মুহাম্মদ আমীন সফদর ওকারবী রহঃ এর সংকলিত ‘তাযাল্লিয়াতে সফদর- ৩/১৫২-৩৪২, ৭/১৬৯-১৮০।
আলহামদুলিল্লাহ খুব সুন্দর ভাবে 20 রাকাত তারাবি দলিল দিছে। ধন্যবাদ
জাযাকাল্লাহ খাইর