পুরুষ ও মহিলার নামাযের পার্থক্য

মুফতি ইউসুফ হোসাইন


শরীয়তে এমন কিছু হুকুম-আহকাম রয়েছে যেগুলো পুরুষ ও মহিলাদের মাঝে সমভাবে আরোপিত হয়েছে কিন্তু তা বাস্তবায়ন করার নিয়ম- নীতিতে কিছু পার্থক্য রয়েছে।

কোরআন-হাদিসে মহিলাদের পর্দা করার প্রতি বিশেষভাবে গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। আর এ পর্দার প্রতি লক্ষ্য করেই আজান, ইকামাত, ইমামতী ও জুমু’আর ও জামা’আতের নামায ইত্যাদি থেকে মহিলাদেরকে অব্যাহতি দেয়া হয়েছে।

নামায আদায় করার নির্দেশ যদিও পুরুষ ও মহিলা উভয়ের প্রতি সমভাবে আরোপিত হয়েছে, তথাপি পর্দার প্রতি লক্ষ্য রেখেই হাদীসে নামাযের কিছু আহকাম বা আরকান আদায় করার পদ্ধতি বা নীতিমালার ব্যাপারে পুরুষ ও মহিলাদের মাঝে কিছু পার্থক্য করা হয়েছে। নিম্নে উদাহরণস্বরূপ এমন কয়েকটি রোকন বা হুকুমের বর্ণনা উপস্থাপন করা হল,যে সকল রোকন আদায় করার পদ্ধতি বা নীতিমালায় হাদীস ও ফিকহের আলোকে পুরুষ ও মহিলাদের মাঝে পার্থক্য বিদ্যমান রয়েছে।

শরয়ী আহকামের উৎস শুধু কোরআন-হাদীস নয় বরং কোরআন-হাদীস স্বীকৃত আরও দু’টি উৎস রয়েছে। অন্যথায় শুধু কোরআন দ্বারা পুরুষের নামাযও পরিপূর্ণভাবে প্রমাণ করা অসম্ভব। সুতরাং, পুরুষ ও মহিলাদের নামাযের পার্থক্য প্রমাণের বিষয়ে একমাত্র কুরআন বা বুখারী শরীফের হাদীসের দাবি তুলে একশ্রেণীর লোক মূলত: কুরআন-হাদীসকে অস্বীকার করে। এ কথাটি মনে রেখেই নিম্নোক্ত পয়েন্টগুলো লক্ষ্য করুন-

(১) তাকবীরে তাহরীমার সময় হাত উঠানো:

পুরুষগণ উভয় হাতের বৃদ্ধাঙ্গুলি স্বীয় কর্ণদ্বয় পর্যন্ত উঠাবে। পক্ষান্তরে মহিলাগণ নিজের উভয় হাতের আঙ্গুল উভয় কাঁধ পর্যন্ত উঠাবে। এ ব্যাপারে হাদীস শরীফে বর্ণিত হয়েছে:

হযরত ওয়ায়িল ইবনে হুজর (রাযি.) হতে বর্ণিত রয়েছে যে, হযরত রাসূলুল্লাহ (সা:) তাকে ডেকে বললেন,”হে ইবনে হুজর! যখন তুমি নামায পড়বে তখন তোমার উভয় হাত স্বীয় কান বরাবর উঠাবে আর মহিলাগণ তাদের হাত কাঁধ বরাবর উঠাবে।”

[তাবরানী, মাজমাউয যাওয়ায়িদ,২ঃ১০৩ # ই’লাউস সুনান ২ঃ১৫৬]

এ প্রসঙ্গে মুসান্নাফে ইবনে আবী শাইবা নামক কিতাবের ১ম খণ্ড, ২৭০ নং পৃষ্ঠায় একাধিক তাবেয়ী ফকীহগণ থেকে ফাতাওয়া বিদ্যমান রয়েছে।

তাছাড়া এ ব্যাপারে ফকীহবিদগণ থেকেও অনুরূপ বর্ণনা বিদ্যমান রয়েছে। যেমন- “যখন কেউ নামাযে প্রবেশ করার ইচ্ছা করবে তখন উভয় হাত স্বীয় কর্ণদ্বয় পর্যন্ত উঠাবে, যেন হাতের বৃদ্ধাঙ্গুলদ্বয় উভয় কানের বরাবর হয় আর মহিলাগণ তাদের উভয় হাত কাঁধদ্বয় পর্যন্ত উঠাবে। তারপর তাকবীর বলে হাত বাঁধবে। এটাই সঠিক পদ্ধতি।”

[আলমগীরী ১ঃ৭৩]

(২) হাত বাঁধা:

পুরুষগণ নাভীর নিচে ডান হাত দ্বারা বাম হাতের কব্জা ধরে রাখবে পক্ষান্তরে মহিলাগণ বুকের উপর ডান হাত বাম হাতের উপরে রাখবে। সুতরাং, গ্রহণযোগ্য হাদীসের মাধ্যমে জানা গেল যে, হযরত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নামাযে নাভীর নিচে হাত বেঁধেছেন। সুতরাং, পুরুষদের জন্য নাভীর নিচে হাত বাঁধাই সুন্নাত। কিন্তু মহিলাদের ব্যাপারে ফুকাহায়ে কেরামের ইজমা হয়ে গেছে যে, তাদের বুকের উপর হাত রাখা সুন্নাত।

[সিআয়াহ ২ঃ১১৫৬]

যেহেতু এ ব্যাপারে উলামায়ে কেরাম ঐক্যমত পোষণ করেছেন, তাই এর উপর অবশ্যই আমল করতে হবে। কারণ, কোরআন ও হাদীসের আলোকে ইজমার বরখেলাফকারী জাহান্নামী হবে।

[মাজমূ’আয়ে রাসায়িল ১ঃ৩০৭]

 

(৩) রুকু ঃ

মহিলাগণ পুরুষের মত ঘাড় আর নিতম্ব সমান করে রুকু করবে না। বরং অত্যন্ত সংকোচিতভাবে সামান্য ঝুঁকবে।

*মহিলাদের রুকু করা সম্পর্কে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ঃ

১. রুকুতে পুরুষদের তুলনায় কম ঝুঁকা।  হাত দিয়ে উরু নাগাল পাওয়া যায় এ টুকু পরিমাণ ঝুঁকবে।
(মুসান্নাফে আব্দুর রাজ্জাক, হাদীস নং: ৫০৬৯)

২. রুকুতে উভয় বাহু পাঁজরের সঙ্গে পরিপূর্ণ মিলিয়ে রাখা।
(মুসান্নাফে আব্দুর রাজ্জাক, হাঃ নং ৫০৬৯)

৩. রুকুতে উভয় হাত হাঁটুর উপর স্বাভাবিক রাখা এবং হাতের আঙ্গুলসমূহ মিলিয়ে রাখা। পুরুষদের ন্যায় আঙ্গুল ছড়িয়ে হাঁটু না ধরা।
(ত্বাহত্বাবী, ২১৫)

৪. রুকুতে উভয় পায়ের গোড়ালী পরিপূর্ণ মিলিয়ে রাখা।
(শামী, ১ঃ ৫০৪)
 

(৪) সিজদা:

সিজদা করার ক্ষেত্রে পুরুষ ও মহিলাদের মাঝে অনেকটা পার্থক্য বিদ্যমান রয়েছে। যেমন- সিজদার সময় পুরুষগণ উভয় রান ও পেট পৃথক রাখবে এবং খুব খোলা-মেলা ভাবে সিজদা করবে। তেমনিভাবে উভয় কনুই ভূমি হতে উঁচু করে রাখবে এবং এক অঙ্গ অপর অঙ্গের সাথে মিলিয়ে রাখবে না ইত্যাদি।

পক্ষান্তরে মহিলাগণ পুরুষদের সম্পূর্ণ বিপরীত। অর্থাৎ, মহিলারা সিজদার সময় উভয় রান পৃথক রাখবে না, বরং পেট রানের সাথে মিলিয়ে রাখবে এবং খুব জড়সড় হয়ে সিজদা করবে, যাতে এক অঙ্গ অপর অঙ্গের সাথে মিলে যায়। এ প্রসঙ্গে নিম্নে কয়েকটি হাদীস পেশ করা হল।

হজরত যায়িদ (রাযি.) হতে বর্ণিত,হযরত রাসূলুল্লাহ (সা:) একবার দুজন মহিলার নিকট দিয়ে যাচ্ছিলেন, তখন তিনি তাদেরকে বললেন- “যখন তোমরা সিজদা করবে, তখন শরীর জমিনের সাথে মিলাবে। কেননা, সিজদার ক্ষেত্রে মহিলারা পুরুষের মতো নয়।”

[মারাসীলে আবি দাউদঃ৮ # ই’লাউস সুনান ৩ঃ১৯]

হযরত আলী (রাযি.) বলেন, মহিলাগণ খুব জড়সড় হয়ে সিজদা করবে এবং সিজদার সময় অবশ্যই পেট উভয় রানের সাথে মিলিয়ে রাখবে।

[মুসান্নাফে ইবনে আবী শাইবা ১ঃ৩০২]

হযরত লাইছ (রহঃ) প্রসিদ্ধ তাবেয়ী হযরত মুজাহিদ হতে বর্ণনা করে বলেন, তিনি সিজদায় মহিলাদের ন্যায় পুরুষদের পেট উভয় রানের উপর রাখাকে মাকরূহ মনে করতেন।

[মুসান্নাফে ইবনে আবী শাইবা ১ঃ৩০২]

হযরত মুগীরা (রাযি.) বর্ণনা করেন, মহিলারা সিজদার সময় উভয় রান অবশ্যই মিলিয়ে রাখবে এবং পেট অবশ্যই রানের উপর রাখবে।

[মুসান্নাফে ইবনে আবী শাইবা ১ঃ৩০২]

হযরত ইব্রাহিম (রাযি.) হতে বর্ণিত রয়েছে যে, মহিলারা সিজদা করার সময় পেটকে অবশ্যই রানের সাথে মিলিয়ে রাখবে এবং নিতম্ব উঁচু করবেনা এবং পুরুষদের মত খোলামেলা ভাবে সিজদা করবে না।

[মুসান্নাফে ইবনে আবী শাইবা ১ঃ৩০৩]

উপরোল্লিখিত হাদীস ও আ-সা-রে সাহাবা সমূহের আলোকে এটাই প্রতীয়মান হয় যে, সিজদার ক্ষেত্রে এমন অনেক বিষয় রয়েছে, যেগুলোতে পুরুষ ও মহিলাদের বিধান এক নয়, বরং ভিন্নতর।

(৫) দুই সিজদার মাঝে ও তাশাহহুদের সময় বসার পদ্ধতি:

এটা সর্বজন স্বীকৃত যে, পুরুষরা নামাযে বাম পায়ের উপর বসবে এবং ডান পা খাড়া রাখবে। কিন্তু এ ক্ষেত্রে মহিলারা পুরুষদের সম্পূর্ণ বিপরীত। অর্থাৎ, তারা নিতম্বের উপর বসবে এবং উভয় পা ডান দিকে বের করে কিবলামুখী করে রাখবে। যেমন, হাদীস শরীফে বর্ণিত হয়েছে-

হযরত ইবনে ওমর (রাযি.)-কে জিজ্ঞাসা করা হল, হযরত রাসূলুল্লাহ (সা:)-এর যুগে মহিলারা কিভাবে নামায পড়তেন? উত্তরে তিনি বললেন, মহিলারা নিতম্বের উপর বসতেন এবং তাদেরকে জড়সড় হয়ে সিজদা করার জন্য নির্দেশ দেয়া হয়।

[জামিউল মাসানীদ, ১ঃ৪০০ # ই’লাউস সুনান ৩ঃ২০]

হাদীসের আলোকে নামাযের উপরোল্লিখিত কয়েকটি বিষয় আলোচনা করার দ্বারা এ কথা দিবালোকের ন্যায় সুস্পষ্টরূপে জানা গেল যে, নামাযের অনেক বিষয়ই এমন রয়েছে, যেগুলো আদায় করার পদ্ধতিতে পুরুষ ও মহিলাদের মাঝে কিছু পার্থক্য বিদ্যমান রয়েছে। সুতরাং যারা হাদীসের কিতাব অধ্যয়ন না করে বা হাদীস না বুঝে বলে বেড়ায় যে, হাদীসে পুরুষ ও মহিলাদের নামায আদায় করার ব্যাপারে কোন পার্থক্য নেই, আশা করি তারা উপরোল্লিখিত আলোচনা পাঠ করার পর এ ধরনের মনগড়া বাক্য উচ্চারণ করতে আর প্রয়াস পাবে না।

-ফাতাওয়ায়ে রাহমানিয়া


লেখক – শিক্ষার্থী, ইফতা-দ্বিতীয় বর্ষ, মারকাযে আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাত, ঢাকা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *