শবে বরাত ও শবে মেরাজের আমল : যা কিছু জানা আবশ্যক

লুৎফুর রহমান ফরায়েজী
——————————-

শবে বরাত পালন করা জায়েজ কি?

শবে বরাত পালন বলতে আতশবাজি করা, হালুয়ারুটির আয়োজন করা, বিশেষ পদ্ধতির নামায পড়াকে জরুরী মনে করা। এ রাতে গোসল করা ফযীলতপূর্ণ মনে করা, এ রাতে মসজিদে গিয়েই ইবাদত করাটা বাধ্যতামূলক মনে করা, ইত্যাদি বিদআত। শরীয়ত গর্হিত আক্বিদা ও কাজ। এসব করা জায়েজ নয়।

তবে এ রাতে বেশি বেশি ইস্তিগফার করা, আল্লাহর কাছে স্বীয় গোনাহের মাফীর জন্য কান্নাকাটি করা, দুআ করা, কুরআন তিলাওয়াত করা। অনির্ধারিতভাবে নফল নামায পড়া, জিকির করা ইত্যাদি ইবাদত করা উত্তম ও ফযীলতপূর্ণ। এসবই নফল ইবাদত। করলে সাওয়াব হবে না করলে কোন গোনাহ নেই।

শবে বরাত কেন গুরুত্বপূর্ণ?

শবে বরাত ফযীলতপূর্ণ নয় বা এ রাতে গুরুত্ব দিয়ে ইবাদত করা বেদআত এ মর্মে কোন হাদীস বিদ্যমান নেই। এমন কোন হাদীস রাসূল সা: থেকে নেই যে, শবে বরাতের রাতে বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে ইবাদত করা যাবে না। বরং রাসূল সা: থেকে বিভিন্ন সূত্রে বর্ণিত আছে শবে বরাতের ফযীলত সম্পর্কে। যদিও কিছু কিছু হাদীসের ব্যাপারে মুহাদ্দিসীনে কিরাম কালাম করেছেন। তবে যেহেতু এ মতের বিপরীত কোন হাদীসই বিদ্যমান নেই। তাই শবে বরাতকে হাদীস দ্বারা প্রমাণিত হওয়ার পরও বিদআত বলাটা হাদীস সম্পর্কে অজ্ঞতার পরিচায়ক। আর জেনে এমনটি বলে থাকলে রাসূল সা: এর হাদীস অস্বীকারের মত মারাত্মক অপরাধে অপরাধী সে ব্যক্তি। রাসূল সা: এর হাদীসের প্রতি বিদ্বেষী হওয়া ছাড়া হাদীস দ্বারা প্রমাণিত এ ফযীলতপূর্ণ রাতকে কেউ অস্বীকার করতে পারে না।

নিম্নে কয়েকটি হাদীস উল্লেখ করা হল-

عن علي بن أبي طالب قال قال رسول الله صلى الله عليه و سلم ( إذا كانت ليلة النصف من شعبان فقوموا ليلها وصوموا نهارها . فإن الله ينزل فيها لغروب الشمس إلى سماء الدنيا . فيقول ألا من مستغفر لي فأغفر له ألا من مسترزق فأرزقه ألا مبتلى فأعافيه ألا كذا ألا كذا حتى يطلع الفجر )

হযরত আলী বিন আবু তালীব রা: থেকে বর্ণিত। রাসূল সা: ইরশাদ করেছেন-যখন শাবান মাসের অর্ধেকের রজনী আসে [শবে বরাত] তখন তোমরা রাতে নামায পড়, আর দিনের বেলা রোযা রাখ। নিশ্চয় আল্লাহ এ রাতে সূর্য ডুবার সাথে সাথে পৃথিবীর আসমানে এসে বলেন-কোন গোনাহ ক্ষমাপ্রার্থী আছে কি আমার কাছে? আমি তাকে ক্ষমা করে দিব। কোন রিজিকপ্রার্থী আছে কি? আমি তাকে রিজিক দিব। কোন বিপদগ্রস্ত মুক্তি পেতে চায় কি? আমি তাকে বিপদমুক্ত করে দিব। আছে কি এমন, আছে কি তেমন? এমন বলতে থাকেন ফজর পর্যন্ত। {সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদীস নং-১৩৮৮, শুয়াবুল ঈমান, হাদীস নং-৩৮২২, }

عن عائشة : قالت فقدت رسول الله صلى الله عليه و سلم ليلة فخرجت فإذا هو بالبقيع فقال أكنت تخافين أن يحيف الله عليك ورسوله ؟ قلت يا رسول الله إني ظننت أنك أتيت بعض نساءك فقال إن الله عز و جل ينزل ليلة النصف من شعبان إلى السماء الدنيا فيفغر لأكثر من عدد شعر غنم كلب

অনুবাদ-হযরত আয়শা রা: বলেন-এক রাতে রাসূল সা: কে না পেয়ে খুঁজতে বের হলাম। খুঁজতে খুঁজতে জান্নাতুল বাকীতে [মদীনার কবরস্থান] গিয়ে আমি তাঁকে দেখতে পেলাম। তিনি বললেন-কি ব্যাপার আয়শা? [তুমি যে তালাশে বের হলে?] তোমার কি মনে হয় আল্লাহ এবং তাঁর রাসূল তোমার উপর কোন অবিচার করবেন? [তোমার পাওনা রাতে অন্য কোন বিবির ঘরে গিয়ে রাত্রিযাপন করবেন?] হযরত আয়শা রা: বললেন- আমার ধারণা হয়েছিল আপনি অন্য কোন বিবির ঘরে গিয়েছেন। রাসূল সা: তখন বললেন-যখন শাবান মাসের ১৫ই রাত আসে অর্থাৎ যখন শবে বরাত হয়, তখন আল্লাহ পাক এ রাতে প্রথম আসমানে নেমে আসেন। তারপর বনু কালব গোত্রের বকরীর পশমের চেয়ে বেশী সংখ্যক বান্দাদেরকে ক্ষমা করে দেন। {সুনানে তিরমিযী, হাদীস নং-৭৩৯, মুসনাদে আহমাদ, হাদীস নং-২৬০২৮, মুসনাদে আব্দ বিন হুমাইদ, হাদীস নং-১৫০৯}

عن معاذ بن جبل عن النبي صلى الله عليه و سلم قال : ( يطلع الله إلى خلقه في ليلة النصف من شعبان فيغفر لجميع خلقه إلا لمشرك أو مشاحن

অনুবাদ-হযরত মুয়াজ বিন জাবাল রা: থেকে বর্ণিত। রাসূল সা: ইরশাদ করেছেন-অর্ধ শাবানের রাতে [শবে বরাতে]আল্লাহ তাআলা তাঁর সমস্ত মাখলুকের প্রতি মনোযোগ আরোপ করেন এবং মুশরিক ও বিদ্বেষ ভাবাপন্ন ব্যক্তি ছাড়া সকলকে ক্ষমা করে দেন। {সহীহ ইবনে হিব্বান, হাদীস নং-৫৬৬৫, মুসনাদুল বাজ্জার, হাদীস নং-২৭৫৪, মুসনাদে ইসহাক বিন রাহওয়াই, হাদীস নং-১৭০২, আল মুজামুল আওসাত, হাদীস নং-৬৭৭৬, আল মুজামুল কাবীর, হাদীস নং-২১৫, সুনানে ইবনে মাজা, হাদীস নং-১৩৯০, মুসনাদুশ শামীন, হাদীস নং-২০৩, মুসন্নাফে ইবনে আবী শাইবা, হাদীস নং-৩০৪৭৯, শুয়াবুল ঈমান, হাদীস নং-৬২০৪}

গায়রে মুকাল্লিদ তথা কথিত আহলে হাদীসদের ইমাম শায়েখ আলবানী রহঃ তার সিলসিলাতুস সাহিহাহর ৩ নং খণ্ডের ১৩৫ নং পৃষ্ঠায় বলেন। “এই হাদিসটি সহীহ” এটি সাহাবাদের এক জামাত বর্ণনা করেছেন বিভিন্ন সূত্রে যার একটি অন্যটিকে শক্তিশালী করেছে। তাদের মাঝে রয়েছেন # মুয়াজ বিন জাবাল রা: # আবু সা’লাবা রা: # আব্দুল্লাহ বিন আমর রা: # আবু মুসা আশয়ারী রা: # আবু হুরায়রা রা: # আবু বকর সিদ্দীক রা: # আউফ বিন মালিক রা: # আয়েশা রা: প্রমুখ সাহাবাগণ।

উপরে বর্ণিত সবক’টি বর্ণনাকারীর হাদিস তিনি তার কিতাবে আনার মাধ্যমে সুদীর্ঘ আলোচনার পর শেষে তিনি বলেন-

و جملة القول أن الحديث بمجموع هذه الطرق صحيح بلا ريب و الصحة تثبت بأقل منها

عددا ما دامت سالمة من الضعف الشديد كما هو الشأن في هذا الحديث ، فما نقله

الشيخ القاسمي رحمه الله تعالى في ” إصلاح المساجد ” ( ص 107 ) عن أهل التعديل

و التجريح أنه ليس في فضل ليلة النصف من شعبان حديث صحيح ، فليس مما ينبغي

الاعتماد عليه ، و لئن كان أحد منهم أطلق مثل هذا القول فإنما أوتي من قبل

التسرع و عدم وسع الجهد لتتبع الطرق على هذا النحو الذي بين يديك . و الله تعالى هو الموفق

অর্থাৎ সারকথা হল এই যে, নিশ্চয় এই হাদিসটি এই সকল সূত্র পরম্পরা দ্বারা সহীহ, এতে কোন সন্দেহ নেই। আর সহীহ হওয়া এর থেকে কম সংখ্যক বর্ণনার দ্বারাও প্রমাণিত হয়ে যায়, যতক্ষণ না মারাত্মক কোন দুর্বলতা থেকে বেঁচে যায়, যেমন এই হাদিসটি হয়েছে। আর যা বর্ণিত শায়েখ কাসেমী থেকে তার প্রণীত “ইসলাহুল মাসাজিদ” গ্রন্থের ১০৭ নং পৃষ্ঠায় জারাহ তা’দীল ইমামদের থেকে যে, “শাবানের অর্ধ মাসের রাতের কোন ফযীলত সম্পর্কে কোন হাদিস নেই মর্মে” সেই বক্তব্যের উপর নির্ভর করা যাবেনা। আর যদি কেউ তা মেনে নেয় সে হবে ঝাঁপিয়ে পড়া(ঘাড়ত্যাড়া) স্বভাবের, আর তার ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ ও গবেষণা-উদ্ভাবনের কোন যোগ্যতাই নেই এরকমভাবে যেমন আমি করলাম।

আল্লামা শায়েখ আলবানী রহঃ এর বিশ্লেষণ থেকে একথা নির্দ্বিধায় আমরা বলতে পারি হাদিস দ্বারা শবে বারাআত প্রমাণিত।

শবে বরাতে নির্ধারিত আমল কি?

উপরোক্ত শবে বরাতের হাদীস দ্বারা আমরা শবে বরাতে আমল পাই-

১- ইস্তিগফার তথা আল্লাহর কাছে ক্ষমাপ্রার্থনা করা।

২- আড়ম্বরপূর্ণ না হয়ে বরং স্বাভাবিকভাবে কবর যিয়ারত করা।

৩- অনির্ধারিতভাবে নফল ইবাদত করা।

৪- পরদিন রোযা রাখা।

শবে বরাতে বর্জনীয় কাজ

১- হালুয়া রুটির আয়োজন।

২- আলোকসজ্জা।

৩- আতশবাজি।

৪- দলবদ্ধ ইবাদতকে আবশ্যক মনে করে মসজিদে বা কোথাও একত্র হওয়া। তবে এটাকে এ রাতের বিশেষ আমল মনে না করে এমনিতে একত্র হতে সমস্যা নেই।

শবে বরাতের উৎপত্তি কবে থেকে?

রাসূল সা: শবে বরাতের ফযীলত বলে নিজে আমল করেই এ রাতে আমলের ফযীলত জারি করে গেছেন। তাই শবে বরাতের উৎপত্তি রাসূল সা: থেকে শুরু হয়েছে।

শবে মেরাজ কেন ইবাদতের জন্য গুরুত্বপূর্ণ রাত নয়?

কারণ শবে মেরাজ ইবাদতের বিশেষ ফযীলতের ব্যাপারে কোন হাদীস বিদ্যমান নেই। তাই শবে মেরাজের কোন গুরুত্বপূর্ণ আমল ইসলামী শরীয়তে নেই।

রজব মাসের ১ম তারিখ ও ১ম শুক্রবার, ১০ ও ১৫ এবং ২৭ তারিখ শবে মেরাজে রোযা রাখা, সালাতুর রাগায়েব নামক বিশেষ প্রকৃতির নামায পড়া সংক্রান্ত সকল হাদীসই জাল ও বানোয়াট।

فلم يصح في شهر رجب صلاة مخصوصة تختص به و الأحاديث المروية في فضل صلاة الرغائب في أول ليلة جمعة من شهر رجب كذب و باطل لا تصح و هذه الصلاة بدعة عند جمهور العلماء و من ذكر ذلك من أعيان العلماء المتأخرين من الحفاظ أبو إسماعيل الأنصاري و أبو بكر بن السمعاني و أبو الفضل بن ناصر و أبو الفرج بن الجوزي و غيرهم إنما لم يذكرها المتقدمون لأنها أحدثت بعدهم و أول ما ظهرت بعد الأربعمائة فلذلك لم يعرفها المتقدمون و لم يتكلموا فيها و أما الصيام فلم يصح في فضل صوم رجب بخصوصه شيء عن النبي صلى الله عليه و سلم و لا عن أصحابه (لطائف المعارف، ذكر ما يتعلق برجب من أحكام-131)

অনুবাদ- মাহে রজবে বিশেষ কোন নামায প্রমাণসিদ্ধ নয়, রজবের প্রথম শুক্রবারে সালাতুর রাগায়েবের ফযীলত সম্পর্কীয় হাদীসসমূহ বাতিল, মিথ্যা ও বানোয়াট। বিজ্ঞ ওলামায়ে কিরামের মতে এটি একটি নব আবিষ্কৃত নামায। পরবর্তী যুগের অগাধ জ্ঞানের অধিকারী বিদগ্ধ ওলামায়ে কিরাম যারা এটি বিদআত আখ্যা দিয়েছেন, তাদের মধ্যে রয়েছেন আবু ইসমাঈল আনসারী, আবু বকর ইবনে সামআনী, আবুল ফযল ইবনে নাসের ও আবুল ফারায বিন জাওযী রহঃ প্রমুখ।

পূর্ববর্তীরা এ নিয়ে আলোচনা করেননি। কেননা তাদের [ইন্তেকালের বেশ] পরে তা আবিষ্কৃত হয়েছে। চারশত হিজরীরও পরে এটির প্রকাশ ঘটে। তাই পূর্ববর্তীদের নিকট এটি পরিচয় ঘটেনি এবং তারা এ ব্যাপারে কিছু বলে যাননি।

আর রোযা! রজব মাসের রোযার বিশেষ ফযীলতের কথা রাসূল সা: থেকে প্রমাণিত নয়, সাহাবীদের থেকেও নয়। (লাতায়েফুল মাআরিফ-১৩১)

আল্লামা ইমাম নববী রহঃ রজব মাসের সালাতুর রাগায়েব ও শবে বরাতের রাতে বিশেষ পদ্ধতির নামাযকে বিদআত আখ্যা দেওয়ার পর বলেন-

ولا يغتر بذكرهما فى كتاب قوت القلوب، وإحياء عليوم الدين، ولا بالحديث المذكور فيهما فإن كل ذلك باطل، (المجموع شرح المهذب-3/549

অনুবাদ-আবু তালেব মক্কী রহঃ কুতূল কুলূব এ এবং ইমাম গাজ্জালী রহঃ ইহইয়াউ উলূমিদ্দীন গ্রন্থে এ নামায দু’টি এবং সাথে এ সংক্রান্ত হাদীস উল্লেখ করার কারণে ধোঁকায় পড়বেন না। কেননা এ সবগুলোই বাতিল ও ভিত্তিহীন।{আল মাজমাউ শরহুল মুহাযযাব-৩/৫৪৯)

রজব মাস এবং শবে মেরাজের নামায-রোযা সম্পর্কে জাল বর্ণনাসমূহের অসারতা আরো বিস্তারিত জানার জন্যে দেখা যেতে পারে-

  • তাবয়ীনুল আজব-
  • মাসাবাতা বিস সুন্নাহ ফী আয়্যামিস সানা্হ
  • আল মওযূয়াত-২/৪৬-৪৯
  • আল মানারুল মুনীফ-৯৫-৯৭
  • তাখরীজে ইহইয়া ইহইয়াউ উলূমিদ্দীন-১/২৯৬
  • আল লাআলিল মাসনূআ-২/৫৫-৫৯
  • তানযীহুশ শরীয়া-২/৮৯-৯০
  • ইতহাফুস সাদাতিল মুত্তাকীন-৩/৪২২-৪২৫
  • আল ফাওয়ায়েদুল মাজমূআ-১/৭৩-৭৫
  • আল আসারুল মারফূআ-৫৮-৭০

তবে রজব মাস সম্পর্কিত নিম্নের হাদীসটি দুর্বল হলেও জাল তথা বানোয়াট নয়।

عن أنس قال كان رسول الله صلى الله عليه وسلم إذا دخل رجب قال اللهم بارك لنا في رجب وشعبان وبلغنا رمضان

হযরত আনাস রা: থেকে বর্ণিত। রাসূল সা: রজব মাস আসলে পড়তেন-আল্লাহুম্মা বারিক লানা ফি রাজাবা ওয়া শা’বানা ওয়া বাল্লিগনা রামাদ্বান। {মু’জামে ইবনে আসাকীর, হাদীস নং-৩০৯, মুসনাদুল বাজ্জার, হাদীস নং-৬৪৯৪, শুয়াবুল ঈমান, হাদীস নং-৩৫৩৪, মুসনাদে আহমাদ, হাদীস নং-২৩৪৬}

শবে মেরাজে কোন আমল নেই কেন?

রাসূল সা: শবে মেরাজে বিশেষ কোন আমল করেন নি, তাই শবে মেরাজে বিশেষ আমল নেই। রাসূল সা: যা করেন নি, সেটাকে দ্বীন মনে করার নামই হল বিদআত। আর বিদআত পথভ্রষ্টতা। আর পথভ্রষ্টতা জাহান্নামে নিক্ষিপ্ত করে।

 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *