মুফতী আবুল হাসান শামসাবাদী
অনেকে ছোঁয়াচে বা সংক্রামক রোগের ব্যাপারে বিভ্রান্তিতে ভুগছেন বলে তাদের কথাবার্তা দ্বারা বুঝা যায়। আসলে এ নিয়ে কারো বিভ্রান্তিতে থাকা উচিত নয়। কেননা, এটা ঈমানের প্রশ্ন। যা অত্যন্ত নাজুক বিষয়।
আমরা পৃথিবীকে সৃজিত দেখছি। এটা বাস্তবতা। বাস্তব বিষয়কে কেউ অস্বীকার করতে পারে না। তেমনি ইসলামও কোন বাস্তবতাকে অস্বীকার করে না। কিন্তু প্রশ্ন হলো, এ বাস্তব পৃথিবীকে যাকে আমরা প্রত্যক্ষ করছি, তাকে কে সৃজন করেছেন? মুমিনগণ বলেন, তাকে মহান আল্লাহ সৃজন করেছেন। কিন্তু ঈমানহীনগণ বলেন–এগুলো একটির দ্বারা অন্যটির রূপায়ন হয়ে (বিগ-ব্যাং থিউরিতে) স্বয়ংক্রিয়ভাবে অস্তিত্বে এসেছে।
তদ্রূপ বাস্তবে আমরা দেখছি, কিছু রোগ এমন রয়েছে–যেগুলোর সংস্পর্শে এলে অনেক সুস্থ মানুষ সেই রোগে আক্রান্ত হয়। কিন্তু এক্ষেত্রে প্রশ্ন হলো–এ আক্রান্ত ব্যক্তির রোগ কোত্থেকে এসেছে। ঈমানহীনগণ বলেন, এ রোগ প্রথমজন থেকে স্বয়ংক্রিয়ভাবে অতিক্রম করে আক্রান্ত ব্যক্তির মধ্যে গিয়েছে। এ বিষয়টিকে তারা তাদের ভাষায় “সংক্রমণ” নামে অভিহিত করেন। কিন্তু ইসলাম বলে–সেই আক্রান্ত ব্যক্তির রোগ প্রথমজন থেকে স্বয়ংক্রিয়ভাবে অতিক্রম করে তার মধ্যে যায়নি, বরং মহান আল্লাহ যেমন প্রথমজনকে সেই রোগ দিয়েছেন, তেমনি সেই সংস্পর্শের আক্রান্তজনকেও নতুন করে সেই রোগ দিয়েছেন।
এদিকে ইঙ্গিত করেই হাদীস শরীফে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন– لاَ عَدْوَى… “কোন রোগের সংক্রমণ বলতে কিছু নেই…।” (সহীহুল বুখারী, হাদীস নং ৫৭০৭) এবং যখন এ হাদীস শুনে জনৈক গ্রাম্য সাহাবী প্রশ্ন করলেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! তাতে সেই উটপালের অবস্থা কী–যেখানকার উটগুলো সুস্থ-সবল ছিলো, কিন্তু খুঁজলি-পাঁচড়ায় আক্রান্ত উট সেখানে প্রবেশ করার পর তা সেখানকার সব উটকে খুঁজলি-পাঁচড়ায় করে দেয়, তখন তার উত্তরে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন–“তাহলে প্রথমটাকে কে সংক্রমণ করলো?” (সহীহু মুসলিম, হাদীস নং ২২২০) অর্থাৎ এ কথার মাধ্যমে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বুঝিয়েছেন, সেই অবস্থায় প্রথম উটটিকে যেমন আল্লাহ তা‘আলা কোনকিছুর সংক্রমণ ব্যতিরেকে নতুনভাবে রোগাক্রান্ত করেছেন, ঠিক তেমনি পরের উটগুলোকেও আল্লাহ তা‘আলাই নতুনভাবে রোগাক্রান্ত করেছেন। সেই খুঁজলি-পাঁচড়ায় আক্রান্ত প্রথম উট থেকে সেই রোগ অতিক্রম করে পরের উটগুলোতে সংক্রমিত হয়নি।
বস্তুত কোন রোগের স্বয়ংক্রিয়ভাবে সংক্রামক বা ছোঁয়াচে হওয়ার ঈমানহীন কুফরী থিউরির বিপক্ষে এটাই ইসলামের অকাট্য ঈমানী বিশ্বাস। সুতরাং প্রত্যেক ঈমানদারের এ বিশ্বাস রাখতে হবে যে, ছোঁয়াচে বা সংক্রামক রোগ বলতে কিছু নেই। বরং এ রকম রোগের সংক্রমণের নামে যে বাস্তবতার কথা ঈমানহীন স্বাস্থ্যবিজ্ঞানীগণ বলে থাকেন, মূলত তার হাকীকত হলো–আল্লাহ তা‘আলাই প্রথম রোগীকে সেই রোগ দ্বারা রোগাক্রান্ত করার মতো তার সংস্পর্শে আসা অন্যদের মধ্যেও একইভাবে সেই রোগ দিয়ে তাদেরকে রোগাক্রান্ত করেন সেসব বান্দাকে পরীক্ষা করার জন্য। এ সম্পর্কে “কিতাবুস সুনানিল কাবীর” গ্রন্থে আল্লামা আবু বকর বাইহাকী (রহ.) বলেন–
فَقَدْ يَجْعَلُ اللَّهُ تَعَالَى بِمَشِيئَتِهِ مُخَالَطَتَهُ إِيَّاهُ سَبَبًا لِمَرَضِهِ
“কখনো আল্লাহ তা‘আলা স্বীয় ইচ্ছায় অসুস্থের সাথে সুস্থের মেলামেশাকে তার সেই রোগে আক্রান্ত হওয়ার কারণ বানিয়ে দেন।” (দ্রষ্টব্য : আস-সুনানুল কাবীর, ১৬৩ পৃষ্ঠা)
আর এ ভিত্তিতেই পূর্বোক্ত لاَ عَدْوَى হাদীসের শেষাংশে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন–
فِرَّ مِنَ الْمَجْذُومِ كَمَا تَفِرُّ مِنَ الأَسَدِ
“তুমি কুষ্ঠ রোগী থেকে পলায়ন করো সেভাবে যেভাবে সিংহ থেকে পলায়ন কর।” (সহীহুল বুখারী, হাদীস নং ৫৭০৭)
আসলে এক্ষেত্রে দুর্বল ঈমানদারদের ঈমানী অবস্থার সুরক্ষার জন্য সেরূপ পরীক্ষায় অবতীর্ণ হতে নিষেধ করা হয়েছে। কেননা, সেই ব্যক্তি সেই রোগীর সংস্পর্শে গিয়ে রোগাক্রান্ত হলে হয়তো তার মনে কোনভাবে এ ধারণার উদ্রেক হতে পারে যে, সেই রোগীর নিকট যাওয়ায় সেই ব্যক্তি থেকে সেই রোগ স্বয়ংক্রিয়ভাবে তার মধ্যে সংক্রামিত হয়েছে। অথচ এ ধারণা সম্পূর্ণ ভুল ও ঈমানের পরিপন্থী।
এ জন্যই অপর হাদীসে এটা নিষেধ করা হয়েছে যে, কেউ তার সুস্থ জন্তুকে কোন রোগাক্রান্ত জন্তুর সাথে মেলাবে। যাতে এ ব্যাপারে তাকে সেরূপ কঠিন পরীক্ষার সম্মুখীন হতে না হয়। এ সম্পর্কে সাবধান করে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন–
لاَ يُورِدُ مُمْرِضٌ عَلَى مُصِحٍّ.
“রোগগ্রস্ত উট যেন সুস্থ উটের উপরে উপনীত না হয়।” (সহীহু মুসলিম, হাদীস নং ৫৯০৫)
এভাবে এ বিশ্বাস থেকেই হাদীস শরীফে মহামারি কবলিত স্থানে কেউ থাকলে তাকে সেখান থেকে বের হয়ে আসতে নিষেধ করা হয়েছে। কেননা, কোন রোগের স্বয়ংক্রিয়ভাবে সংক্রমণের ক্ষমতা নেই। আবার বাহিরের কাউকে মহামারি কবলিত স্থানে যেতে নিষেধ করা হয়েছে। যাতে সেখান গিয়ে সেই রোগে আক্রান্ত হলে তার মনে এ বিশ্বাস স্থান না পায় যে, সেখান থেকে স্বয়ংক্রিয়ভাবে সেই রোগ তার মধ্যে প্রবেশ করেছে। সেরূপে এ সম্পর্কে সতর্ক করে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন–
إذَا سمِعْتُمْ الطَّاعُونَ بِأَرْضٍ، فَلاَ تَدْخُلُوهَا، وَإذَا وقَعَ بِأَرْضٍ، وَأَنْتُمْ فِيهَا، فَلاَ تَخْرُجُوا مِنْهَا
“যখন তোমরা শুনবে যে, কোন স্থানে প্লেগ-রোগ হয়েছে, তাহলে সেখানে প্রবেশ করো না। আর যখন কোন স্থানে সেই রোগের প্রাদুর্ভাব হয় এবং তোমরা সেখানে থাকো, তাহলে সেখান হতে বের হয়ে যেয়ো না।” (সহীহুল বুখারী, হাদীস নং ৫৭২৮/ সহীহু মুসলিম, হাদীস নং ৫৯০৫)
অবশ্য যারা মজবুত ঈমানের অধিকারী এবং যারা কোন রোগীর সংস্পর্শে গিয়ে সেই রোগে আক্রান্ত হলেও ছোঁয়াচের বা সংক্রমণের কুফরী বিশ্বাসে তাদের আক্রান্ত হওয়ার আশংকা নেই, সেরূপ উচ্চ স্তরের মুমিনগণের সে ধরনের কোন রোগীর সংস্পর্শে গেলে কোন অসুবিধা নেই। এ হিসেবেই হাদীস শরীফে রয়েছে–
أَنَّ رَسُولَ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ أَخَذَ بِيَدِ مَجْذُومٍ فَأَدْخَلَهُ مَعَهُ فِي الْقَصْعَةِ ثُمَّ قَالَ كُلْ بِسْمِ اللَّهِ ثِقَةً بِاللَّهِ وَتَوَكُّلًا عَلَيْهِ
“রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একজন কুষ্ঠরোগীর হাত ধরলেন, অতঃপর তার হাতকে তাঁর সাথে (খাবার খাওয়ানোর জন্য) স্বীয় বরতনে প্রবিষ্ট করলেন। তারপর বললেন–“আল্লাহর নামে খাও। আল্লাহর উপরে অবিচল নির্ভরতা এবং তাঁর উপরে অনড় ভরসা।” (জামি‘উত তিরমিযী, হাদীস নং ১৮১৭/ সুনানে আবূ দাউদ, হাদীস নং ৩৯২৫)
তেমনিভাবে অপর হাদীসে রয়েছে, হযরত আয়িশা (রা.) বলেন–
كَانَ لَنَا مَوْلَى مَجْذُومٌ فَكَانَ يَأْكُلُ فِي صِحَافِي وَيَشْرَبُ فِي أَقْدَاحِي وَيَنَامُ عَلَى فِرَاشِي
“আমাদের একজন আযাদকৃত গোলাম ছিলো–যে কুষ্ঠরোগী ছিলো। সে আমার বরতনে খাবার খেতো, আমার গ্লাসে পানি পান করতো এবং আমার বিছানায় ঘুমাতো।” (তুহফাতুল আহওয়াযী শারহু জামি‘ তিরমিযী, ৫ম খণ্ড, ৪৩৮ পৃষ্ঠা)
অধিকন্তু এক হাদীসে মজবুত ঈমানের অধিকারী মুসলিমদেরকে এভাবে সে ধরনের রোগীর সংস্পর্শে গিয়ে মহান আল্লাহর প্রতি বিনয়াবনত হওয়ার জন্য নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। এ সম্পর্কে হযরত আবু যর (রা.) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন–
كُلْ مَعَ صَاحِبِ الْبَلَاءِ تَوَاضُعًا لِرَبِّك وَإِيمَانًا
“রোগ-বালাইগ্রস্ত ব্যক্তির সাথে খাও তোমার প্রতিপালকের প্রতি বিনয়াবনত হয়ে এবং তাঁর প্রতি অকুণ্ঠ ঈমান প্রকাশ করে।” (আল-জামি‘উস সগীর, হাদীস নং ৬৩৮৯)
এ জাতীয় হাদীসের নির্দেশনা তাদের জন্য যারা মজবুত ঈমানের অধিকারী–যাদের ঈমান ও ইয়াকীনে কোন অবস্থাতেই চিড় ধরতে পারে না। এ মর্মে উক্ত হাদীসের ব্যাখ্যায় ফাইজুল কাদীর কিতাবে বলা হয়েছে–
وَهَذَا خِطَابٌ لِمَنْ قَوِيَ يَقِينُهُ، أَمَّا مَنْ لَمْ يَصِلْ إِلَى هَذِهِ الدَّرَجَةِ فَمَأْمُورٌ بِعَدَمِ أَكْلِهِ مَعَهُ كَمَا يُفِيدُهُ خَبَرُ: (فِرِّ مِنَ الْمَجْذُومِ)
“উক্ত হাদীসের এ সম্বোধন ঐ ব্যক্তির জন্য যার ঈমান ও ইয়াকীন মজবুত। কিন্তু যে ব্যক্তি সেই পর্যায়ে পৌঁছতে পারে নি, তার জন্য হুকুম হলো–সে সেরূপ রোগীর সাথে খাবে না। যেমন সে ব্যাপারে অপর হাদীসে নির্দেশনা দেয়া হয়েছে যে, তুমি কুষ্ঠরোগী থেকে পলায়ন করো।” (দ্রষ্টব্য : ফাইজুল ক্বাদীর শরহু জামিউস সগীর, ৫ম খণ্ড, ৪৩ পৃষ্ঠা)
সুতরাং অকাট্যভাবে প্রমাণিত গেলো–কোন রোগী থেকে স্বয়ংক্রিয়ভাবে সেই রোগ অন্যের মধ্যে ছড়ায় না। বরং কোন রোগীর সংস্পর্শে কারো সেই রোগ এভাবে হতে পারে যে, আল্লাহ তা‘আলা প্রথম জনকে যেভাবে সেই রোগ দিয়েছেন, অন্যজনকেও সেভাবে নতুন করে সেই রোগ দেন। এ বিশ্বাসই সকল মুমিনের অন্তরে পোষণ করতে হবে।
তাই যারা ঈমানহীন চিকিৎসাবিজ্ঞানীদের কথা শুনে ঠুনকো বাস্তবতার দোহাই দিয়ে হাদীসের স্পষ্ট বর্ণনাকে ভিন্নখাতে নিয়ে বলেন–“ছোঁয়াচে বা সংক্রামক রোগ বলতে কিছু নেই”–এ কথা ইসলাম বলে না, তাদের কথা সম্পূর্ণ ভ্রান্ত ও ঈমানের পরিপন্থী। কেননা, ইসলাম কখনো এ বিশ্বাস সমর্থন করে না যে, প্রথম জন থেকে সেই রোগ অতিক্রম করে তার সংস্পর্শে আসা অন্য ব্যক্তির মধ্যে প্রবেশ করে। বরং ইসলাম বলে–প্রথম জনের যেভাবে নতুন করে সেই রোগ হয়েছে, তার সংস্পর্শে আসা অন্য ব্যক্তিদেরও সেই রোগ সেভাবেই নতুন করে হয়। সুতরাং এক্ষেত্রে “একজন থেকে অন্যজনের মধ্যে রোগের সংক্রমণ” বা “সংক্রামক রোগ” কিংবা “রোগ কারো থেকে কারো মধ্যে সংক্রামিত হওয়া” প্রভৃতি শব্দসমূহের ব্যবহারই ভুল এবং এগুলো কুফরী শব্দ।
সার কথা, ইসলাম কোন রোগীর সংস্পর্শে এসে কারো সেই রোগে আক্রান্ত হওয়াকে অস্বীকার করে না। তবে এ কথা বলে যে, সেই আক্রান্ত ব্যক্তির মধ্যে সেই রোগটি অন্য জন থেকে সংক্রমণ করেনি, বরং মহান আল্লাহর ইচ্ছায় নতুনভাবে সেই রোগ তার মধ্যে পয়দা হয়েছে। মূলত এভাবে কোন রোগীর সংস্পর্শে আসা সুস্থ মানুষকে সেই রোগে আক্রান্ত করে আল্লাহ তা‘আলা পরীক্ষা করেন যে, তারা কি সেই রোগকে আল্লাহর হুকুমে তাদের মধ্যে নতুনভাবে সৃষ্টি হওয়াকে বিশ্বাস করে তাদের ঈমানের প্রমাণ দিয়ে সেই পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়, নাকি প্রথমজন থেকে অতিক্রম করে সেই রোগ তাদের মধ্যে গিয়েছে বলে বিশ্বাস করার দ্বারা তারা তাদের ঈমানের পরীক্ষায় ফেল করে। এভাবে পরীক্ষা করে মহান আল্লাহ তাঁর অনুগত উত্তীর্ণ বান্দাদেরকে উত্তমরূপে পুরস্কৃত করে থাকেন। যা বান্দাদের জন্য দুনিয়াতে কাঙ্ক্ষিত কল্যাণ ও আখিরাতে অনন্য কামিয়াবী লাভের ওসীলা হয়।
আলহামদুলিল্লাহ
জাযাকাল্লাহ খাইর