বিপিএল : কোটি কোটি টাকার এত অপচয়, নির্লজ্জতা ও অনৈতিকতা কীসের স্বার্থে?

মুহাম্মাদ আনসারুল্লাহ হাসান

একটি বছর শেষ হতে না হতেই আবার এই মুসলিম দেশটির মানুষগুলোকে ক্রিকেটের আবরণে মোড়া সীমাহীন অনৈতিকতা ও নির্লজ্জতার শিকার হতে হলো। গত বছরের এই দিনগুলোতে বিশ্বকাপ ক্রিকেটকে কেন্দ্র করে যে অবর্ণনীয় পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছিল, শত শত কোটি টাকা বিনষ্ট করে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসহ সকল কর্মক্ষেত্রের কার্যক্রম ব্যাহত করে জনসাধারণের মধ্যে, বিশেষত শিশু-কিশোর তরুণ-যুবকদের মধ্যে যে উন্মাদনার ঢেউ ছড়িয়ে দেয়া হয়েছিলো, তার রেশ কাটতে না কাটতেই ফের শুরু করা হলো আর একটি উন্মাদনা।

ভারতীয় আইপিএল এর আদলে আবারো বাংলাদেশে শুরু হয়েছে বিপিএল নামে আর একটি ক্রিকেট টুর্নামেন্ট।  ইতোমধ্যে এ টুর্নামেন্টের উদ্বোধনী অনুষ্ঠান করা হয় ভারতীয় নায়ক নায়িকা ও গায়ক গায়িকাদের অর্ধনগ্ন দেহের নাচ ও গান পরিবেশনের মাধ্যমে।

ইসলামপূর্ব জাহেলী যুগের মুশরিকদের মত তারাও এ দেশের মানুষকে দেখিয়ে গেছে আধুনিক জাহেলিয়াতের প্রতিচিত্র। মুসলমানদের জীবনে বিজাতীয় সভ্যতা-সংস্কৃতির আগ্রাসন কত ভয়ঙ্কর রূপ ধারণ করেছে তা উক্ত অনুষ্ঠান থেকেই অনুমান করা যায়। কিছু মুনাফাখোর পুঁজিবাদী চক্রের পাল্লায় পড়ে ক্রিকেট এখন আর শুধু খেলা নেই, টি-টোয়েন্টির রঙিন মোড়কে ঢাকা রমরমা বাণিজ্যে পরিণত হয়েছে। ফলে জাহেলী যুগের সমাজপতিদের ন্যায় তারা এটাকে বানিয়েছে এক রঙ্গশালা।

তাদের কুৎসিত মানসিকতায় ক্রিকেট মানে নাচ গান আর লাস্যময়ী চিয়ারলিডার, হরেক রকম পার্টি, ফুর্তি। তারা দেখেও দেখে না, বোঝেও বোঝে না এতে কার কী ক্ষতি হলো, কার কী ধ্বংস হলো, কে মরলো কে বাঁচলো।  তাদের স্বার্থের রসায়ন পরিপূর্ণরূপে অর্জিত হলেই কেল্লা ফতে। সেই রসায়নে গলে যাক নীতি নৈতিকতা লাজ-লজ্জা ও মানবতা।

কিন্তু সবচেয়ে অবাক করার বিষয় হলো এই সর্বগ্রাসী ক্রিকেট উন্মাদনা নিয়ে এসব টুর্নামেন্টের ক্ষতিকর দিক নিয়ে, সরকার থেকে শুরু করে সুশীল সমাজ, শিক্ষক সমাজ, লেখক, চিন্তাবিদ ও বুদ্ধিজীবী মহল কোন কথা বলছে না। এসব সাংস্কৃতিক আগ্রাসন, নৈতিক অবক্ষয়, অর্থনৈতিক অপচয় নিয়ে তাদের কোনো মাথাব্যথা নেই, এ নিয়ে চিন্তা করারও যেন সময় নেই তাদের। মনে হয়, তাদের বিবেক-বুদ্ধি, শিক্ষা-দীক্ষা ও দেশপ্রেম কোনো কিছুতেই তারা এসবের মধ্যে কোনো ধরনের ক্ষতিকর দিক খুঁজে পান না।

অর্থ অপচয়ের এক বিশাল আয়োজন

বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লীগ বা বিপিএল টুর্নামেন্টকে সাধারণ ও নৈতিকভাবে মূল্যায়ন করা হলে বলতে হবে, এটা অর্থ অপচয়ের এক বিশাল আয়োজন। অন্তত বাংলাদেশের মতো একটি দরিদ্র দেশের প্রেক্ষাপটে এ কথা শতভাগ সত্য। এ টুর্নামেন্টের জন্য অর্থনৈতিক জোগান বিচার করলেই অনুমান করা যাবে কী পরিমাণ অর্থ অপচয় করা হয়েছে। গত ১০ জানুয়ারি টুর্নামেন্টের দলগুলো বেচাকেনার নিলাম অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে কেনা দলগুলোর মূল্য এই রূপ : চিটাগাং ১.২০ মিলিয়ন ডলার, খুলনা ১.১০ মিলিয়ন ডলার, ঢাকা ১.০৫ মিলিয়ন ডলার, বরিশাল ১.০১ মিলিয়ন ডলার। তারপর অনুষ্ঠিত হয় দেশি বিদেশী খেলোয়াড়দের নিলাম। সাত লাখ ডলার থেকে শুরু করে ৫০ হাজার ডলারে একেকজন খেলোয়াড় কেনা হয়। এভাবে একেকটি দল কোটি কোটি টাকা খরচ করে এই ক্রিকেট খেলার পেছনে। তারপর দলের বিভিন্ন কোচ, ম্যানেজার, ফিজিও, ব্র্যান্ড এম্বাসেডর, চিয়ার লিডারদের পেছনে ব্যয় করে আরো কোটি কোটি টাকা।

কোটি কোটি টাকার এই ক্রিকেট টুর্নামেন্টের আয়োজন এমন একসময় অনুষ্ঠিত হচ্ছে যখন এ দেশের মানুষ চরম দারিদ্রসীমার নীচে বসবাস করছে, সর্বপ্রকার দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির ফলে সংসার চালাতে মানুষের সীমাহীন কষ্ট হচ্ছে, ২০ টাকার পেঁয়াজ কিনতে হচ্ছে ২০০ টাকায়, মানুষের ক্রয়ক্ষমতা কমে যাওয়ায় চরম অস্থিরতার মধ্যে দিন কাটাচ্ছে।

এই ছয়টি ক্রিকেট দলের মালিক তাদের লগ্নি করা অর্থের অর্ধেকও যদি তাদের ছয়টি বিভাগের গরীব-মিসকীনদের মধ্যে দান করত তাহলে সেটাই হত সময়ের সেরা মানবকল্যাণমূলক কাজ। একদম বদলে যেতে পারত আমাদের ঘুণে ধরা সমাজ।  হজ্ব ও কুরবানির মওসুমে যেসব বাক্যবাজ ও কলমবাজ তৎপর হয়ে ওঠেন তারা এখন কী ভাবছেন জানতে ইচ্ছে করে।

এই টুর্নামেন্ট যখন চালু হয়েছে, তার আগেই শুরু হয়েছে লাখ লাখ পরীক্ষার্থীর এসএসসি ও দাখিল পরীক্ষা। ফলে তাদের জন্য তা হয়ে উঠেছে এক মানসিক যন্ত্রণা।

আরো বহু কারণে এ টুর্নামেন্ট এদেশ ও জাতির জন্য ক্ষতির এবং অস্বস্তিকর। দেশের নীতি নির্ধারকদের এই নীরবতা সমাজের অবক্ষয়ে পরোক্ষ সমর্থন ও সহযোগিতা বলা যায় কি না? আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে হেফাযত করুন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *