নাম রাখার ক্ষেত্রে ইসলামের নির্দেশনা

মূল : মুফতী আবুল কাসেম নোমানী
ভাষান্তর : শাহাদাত সাকিব


কোনো মানুষের পরিচয়ের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও মৌলিক মাধ্যম হচ্ছে তার নাম। এজন্য ইসলামে নাম রাখার গুরুত্ব অপরিসীম। নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এ ব্যাপারে উম্মতকে স্পষ্ট দিকনির্দেশনা প্রদান করেছেন। ভালো নাম চিহ্নিত করার পাশাপাশি মন্দ ও অসুন্দর নাম রাখা থেকে বাঁচার জন্য সতর্ক করেছেন এবং অসুন্দর নাম পরিবর্তন করে ভালো নাম রাখার মাধ্যমে বাস্তব জীবনে এর আমলী নমুনা পেশ করেছেন।

নাম মানুষের ব্যক্তিত্বের দর্পণ

নাম শুধু পরিচয়েরই বাহন নয়; বরং ব্যক্তির চিন্তা-চেতনা ও রুচি-অভিরুচিরও আয়না স্বরূপ। সুন্দর নাম মন-মানসিকতার উপর প্রভাব ফেলে এবং মন্দ নামেরও কিছু না কিছু প্রভাব ব্যক্তির উপর থাকে।

একটু কল্পনা করুন- এক ব্যক্তির নাম হচ্ছে কালু। উচ্চশিক্ষা লাভ করে সে বড় ডাক্তার বা প্রফেসর হয়ে গেলেন। এখন তাকে ডাকা হচ্ছে ডাক্তার কালু বা প্রফেসর কালু বলে। তাহলে ব্যাপারটা কেমন দেখাবে? তার নাম ও পদের মধ্যে কি কোনো সামঞ্জস্য থাকবে? এধরনের নাম দ্বারা ব্যক্তিত্বের মানহানি হয়। পাশাপাশি ব্যক্তির ধর্ম ও জাতীয় পরিচয়ও থাকে অস্পষ্ট।

তাই ঘরের ফুলবাগানে যখন কোনো শিশু কলি হয়ে আসবে তখন সতর্কতার সাথেই তার নাম নির্বাচন করা উচিত। যেন নামটা হয় ইসলামী, সুন্দর ও ভাবগম্ভীর।

ভালো নাম রাখা পিতা-মাতার সর্বপ্রথম দায়িত্ব। আমরা এভাবেও বলতে পারি যে, পিতা-মাতার উপর সন্তানের সর্বপ্রথম হক হচ্ছে, তার জন্য সুন্দর নাম নির্বাচন করা। আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা. ও আয়েশা রা. থেকে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন-

من حق الولد على الوالد أن يحسن اسمه ويحسن أدبه.

অর্থ : সন্তানের সুন্দর নাম রাখা ও তার উত্তম তারবিয়াতের ব্যবস্থা করা বাবার উপর সন্তানের হক। -মুসনাদে বাযযার (আলবাহরুয যাখখার), হাদীস ৮৫৪০

মানসিকতার উপর নামের প্রভাব

মানসিকতা ও স্বভাবের উপরও নামের একটা প্রভাব থাকে।

أَخْبَرَنِي عَبْدُ الحَمِيدِ بْنُ جُبَيْرِ بْنِ شَيْبَةَ، قَالَ: جَلَسْتُ إِلَى سَعِيدِ بْنِ المُسَيِّبِ، فَحَدّثَنِي: أَنّ جَدّهُ حَزْنًا قَدِمَ عَلَى النّبِيِّ صَلّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلّمَ فَقَالَ: مَا اسْمُكَ؟ قَالَ: اسْمِي حَزْنٌ، قَالَ: بَلْ أَنْتَ سَهْلٌ. قَالَ: مَا أَنَا بِمُغَيِّرٍ اسْمًا سَمّانِيهِ أَبِي قَالَ ابْنُ المُسَيِّبِ: فَمَا زَالَتْ فِينَا الحُزُونَةُ بَعْدُ.

আবদুল হুমাইদ বিন শায়বা বলেন, আমি হযরত সাঈদ ইবনুল মুসায়্যিবের কাছে বসা ছিলাম। তিনি তখন বললেন, আমার দাদা ‘হাযান’ একবার নবীজীর দরবারে উপস্থিত হলেন। নবীজী তাকে জিজ্ঞেস করলেন, তোমার নাম কী? দাদা বললেন, আমার নাম হাযান। (হাযান অর্থ শক্তভূমি) নবীজী বললেন- না, তুমি হচ্ছ ‘সাহল’ (অর্থাৎ তোমার নাম হাযানের পরিবর্তে সাহল রাখো; সাহল অর্থ, নরম জমিন।) দাদা বললেন, আমার বাবা আমার যে নাম রেখেছেন আমি তা পরিবর্তন করব না। সাইদ ইবনুল মুসায়্যিব বলেন, এর ফল এই হল যে, এরপর থেকে আমাদের বংশের লোকদের মেযাজে রুঢ়তা ও কর্কশভাব রয়ে গেল। -সহীহ বুখারী, হাদীস ৬১৯৩

কারো নাম অসুন্দর হলে নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তা পরিবর্তন করে সুন্দর নাম রাখতেন। হাদীস শরীফে এ ধরনের অনেক ঘটনা বর্ণিত আছে। উদাহরণ স্বরূপ নিম্নোক্ত কয়েকটি ঘটনা উল্লেখ করা হল-

মুহাম্মাদ ইবনে আমর ইবনে আতা বলেন, আমি আমার মেয়ের নাম রাখলাম- বাররা (নেককার, ভালো মানুষ)। তখন যয়নব বিনতে আবি সালামা বললেন-

سُمِّيتُ بَرّةَ، فَقَالَ رَسُولُ اللهِ صَلّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلّمَ: لَا تُزَكّوا أَنْفُسَكُمْ، اللهُ أَعْلَمُ بِأَهْلِ الْبِرِّ مِنْكُمْ فَقَالُوا: بِمَ نُسَمِّيهَا؟ قَالَ: سَمّوهَا زَيْنَبَ.

আমার নাম ছিল, বাররা। নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, তোমরা নিজেরা নিজেদের পবিত্রতা ঘোষণা কোরো না। (কারণ, বাররা অর্থ, ভালো, নেককার, পূত-পবিত্র) আল্লাহই জানেন তোমাদের মধ্যে ভালো ও পূত-পবিত্র কারা। জিজ্ঞেস করা হল, তাহলে আমরা তার কী নাম রাখতে পারি? তখন নবীজী বললেন, তার নাম যয়নাব রাখ। (নবীজীর আদেশে তখন বাররা নাম পরিবর্তন করে তার নাম যয়নাব রাখা হল।) -সহীহ মুসলিম, হাদীস ২১৪২

যয়নাব হচ্ছে উম্মুল মুমিনীন হযরত উম্মে সালামা রা.-এর মেয়ে। আবু সালামার ইন্তেকালের পর উম্মে সালামা রা. নবীজীর সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। এজন্য উম্মে সালামা রা.-এর সন্তানগণ নবীজীর কাছে থেকে তারবিয়াত লাভের সৌভাগ্যে ধন্য হন। যয়নাব রা. ছিলেন অনেক বুদ্ধিমান এবং নেককার নারী। হাদীসের কিতাবে তার থেকে অনেক রেওয়ায়েত বর্ণিত আছে। যয়নাবের পাশাপাশি তার ভাই ওমর ইবনে আবী সালামাও নবীজীর তারবিয়াত লাভে ধন্য হন।

যয়নাব বিনতে আবী সালামার মত উম্মুল মুমিনীন হযরত জুওয়াইরিয়া রা.-এর নামও ছিল বাররা। এ নাম পরিবর্তন করে নবীজী তার নাম রাখেন জুওয়াইরিয়া।

عَنِ ابْنِ عَبّاسٍ، قَالَ: ” كَانَتْ جُوَيْرِيَةُ اسْمُهَا بَرّةُ فَحَوّلَ رَسُولُ اللهِ صَلّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلّمَ اسْمَهَا جُوَيْرِيَةَ، وَكَانَ يَكْرَهُ أَنْ يُقَالَ: خَرَجَ مِنْ عِنْدِ بَرّةَ.

হযরত ইবনে আব্বাস রা. বলেন, জুওয়াইরিয়া রা.-এর নাম ছিল বাররা। নবীজী তার নাম পরিবর্তন করে জুওয়াইরিয়া রাখেন (জুওয়াইরিয়া অর্থ ছোট্ট বালিকা)। কেউ যদি বলত- “বাররা এর কাছ থেকে বের হয়েছে” তাহলে নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এটা অপছন্দ করতেন। -সহীহ মুসলিম, হাদীস ২১৪০

এ রেওয়ায়েতে নাম পরিবর্তন করার অন্য একটি কারণ উল্লেখ করা হয়েছে। তা হল, “বাররা-এর কাছ থেকে এ বের হয়ে এসেছে”- নবীজী এ বাক্যটিকে নেকফালির বিপরীতে মনে করতেন। কারণ, বাররা অর্থ নেক, ভালো। সুতরাং বাররা (নেক)-এর কাছ থেকে বের হওয়া কেমন যেন ভালো কাজ থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়ার নামান্তর। তাই এমন নাম রাখা উচিত নয়, যার কারণে এরূপ নেতিবাচক বাক্য ব্যবহার করতে হয়।

নেকফালির (শুভ লক্ষণ গ্রহণের) সাথে সাংঘর্ষিক হওয়ার দরুন অন্য আরো কিছু নামও নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অপছন্দ করেছেন।

عَنْ سَمُرَةَ بْنِ جُنْدُبٍ، قَالَ: قَالَ رَسُولُ اللهِ صَلّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلّمَ: لَا تُسَمِّيَنّ غُلَامَكَ يَسَارًا، وَلَا رَبَاحًا، وَلَا نَجِيحًا، وَلَا أَفْلَحَ، فَإِنّكَ تَقُولُ: أَثَمّ هُوَ؟ فَيَقُولُ: لَا …

হযরত সামুরা ইবনে জুনদুব রা. বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, সন্তানের নাম ইয়াসার, রাবাহ, নাজীহ, আফলাহ রেখো না। কারণ তুমি জিজ্ঞেস করবে সে কি ঘরে আছে? অনুপস্থিত থাকলে উত্তর দেয়া হবে- না। -সুনানে আবু দাউদ, হাদীস ৪৯৫৮

এ হাদীসের ব্যাখ্যা হল, ইয়াসার অর্থ-সহজ, সুখ ও প্রাচুর্য। রাবাহ-অর্থ উপকার, লাভ। নাজিহ অর্থ সফল। আর যে ব্যক্তি সফলতার চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছেছে তাকে বলা হয় আফলাহ। তো কোনো ব্যক্তির নাম যদি এ চারটি থেকে কোনো একটি রাখা হয়, আর কেউ জানতে চাইল- ঘরে কি ইয়াসার আছে? বা রাবাহ, নাজিহ অথবা আফলাহ আছে? উত্তর দেয়া হল- না, নেই। তো যেন ঘরে সুখ, প্রাচুর্য ও কল্যাণের উপস্থিতিকে অস্বীকার করে বলা হচ্ছে, ঘরে কল্যাণ নেই, সুখ ও প্রাচুর্য নেই। এজন্যই নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এ ধরনের নাম অপছন্দ করতেন।

কিছু নাম অপছন্দনীয় হওয়ার কারণ

অহংকার ও নিজের বড়ত্বের দিকে ইঙ্গিত থাকায় নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কিছু কিছু নাম অপছন্দ করতেন।

عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ، قَالَ: قَالَ رَسُولُ اللهِ صَلّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلّمَ: أَخْنَى الأَسْمَاءِ يَوْمَ القِيَامَةِ عِنْدَ اللهِ رَجُلٌ تَسَمّى مَلِكَ الأَمْلاَكِ.

হযরত আবু হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, কিয়ামতের দিন আল্লাহ তাআলার কাছে সবচেয়ে অপছন্দনীয় হবে ঐ ব্যক্তির নাম, যে মালিকুল আমলাক (রাজাধিরাজ) নাম ধারণ করেছে। -সহীহ বুখারী, হাদীস নং ১৪০৩

وفي رواية مسلم : أَغْيَظُ رَجُلٍ عَلَى اللهِ يَوْمَ الْقِيَامَةِ، وَأَخْبَثُهُ وَأَغْيَظُهُ عَلَيْهِ، رَجُل كَانَ يُسَمّى مَلِكَ الْأَمْلَاكِ، لَا مَلِكَ إِلّا اللهُ.

মুসলিম শরীফের বর্ণনায় আছে, কিয়ামতের দিন ঐ ব্যক্তি আল্লাহ তাআলার অনেক বেশি গোস্বার পাত্র হবে, যাকে মালিকুল আমলাক (বাদশাহদের বাদশাহ) নামে ডাকা হত। আল্লাহ ছাড়া প্রকৃত বাদশাহ আর কেউ নেই। -সহীহ মুসলিম, হাদীস ২১৪৩

এ হাদীস দ্বারা বুঝা যায়, শাহজাহান, আলমগীর, জাহাঙ্গীর, শাহ আলম ইত্যাদি নাম রাখা উচিত নয়।

عَنِ ابْنِ عُمَرَ: أَنّ ابْنَةً لِعُمَرَ كَانَتْ يُقَالُ لَهَا عَاصِيَةُ فَسَمّاهَا رَسُولُ اللهِ صَلّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلّمَ جَمِيلَةَ.

হযরত ইবনে ওমর রা. থেকে বর্ণিত, হযরত ওমর রা.-এর এক মেয়ের নাম ছিল আছিয়া। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার নাম পরিবর্তন করে রাখলেন জামীলা। -সহীহ মুসলিম, হাদীস ২১৩৯

কারণ, আছিয়া শব্দের একটি অর্থ, নাফরমান, অবাধ্যচারিনী। এ নামের মধ্যে আল্লাহ তাআলার অবাধ্যাচরণের ইঙ্গিত রয়েছে। তাই কোনো মুসলমানের জন্য এ ধরনের নাম রাখা উচিত নয়।

এ মূলনীতির ভিত্তিতে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিম্নোক্ত নামগুলো পরিবর্তন করে দিয়েছেন-

আছ (অবাধ্য), উতলাহ (রুঢ়), শয়তান, শিহাব (উল্কাপিন্ড)। -মিশকাত শরীফ, ২/৪০৮

নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অসুন্দর ও মন্দ নাম পরিবর্তন করে দিতেন।

عَنْ عَائِشَةَ، أَنّ النّبِيّ صَلّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلّمَ كَانَ يُغَيِّرُ الاِسْمَ القَبِيحَ.

হযরত আয়েশা রা. বলেন, নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মন্দ ও অসুন্দর নাম পরিবর্তন করে দিতেন। -জামে তিরমিযী, হাদীস ২৮৩৯

সুন্দর নামের গুরুত্ব

সুন্দর নাম রাখার আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ হল, হাশরের ময়দানে- সেখানে পূর্বাপর সকল মানুষ একত্রিত হবে এবং ব্যক্তিকে তার নাম ও তার বাবার নামসহ ডাকা হবে।

হযরত আবুদ দারদা রা. বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন-

إِنّكُمْ تُدْعَوْنَ يَوْمَ الْقِيَامَةِ بِأَسْمَائِكُمْ، وَأَسْمَاءِ آبَائِكُمْ، فَأَحْسِنُوا أَسْمَاءَكُمْ.

কিয়ামতের দিন তোমাদেরকে ডাকা হবে তোমাদের ও তোমাদের বাবার নাম নিয়ে (অর্থাৎ এভাবে ডাকা হবে- অমুকের ছেলে অমুক)। তাই তোমরা নিজেদের জন্য সুন্দর নাম রাখ। -সুনানে আবু দাউদ, হাদীস ৪৯৪৮

একজন অপরজনের নাম সম্পর্ক অবগত হওয়া ঈমানী ভালোবাসা এবং মুসলিম ভ্রাতৃত্বেরও দাবি। তাই এমন নাম রাখা উচিত নয়, যা বলতে মানুষ লজ্জাবোধ করে।

ইয়াযীদ ইবনে নাআমা বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন-

إِذَا آخَى الرّجُلُ الرّجُلَ فَلْيَسْأَلْهُ عَنْ اسْمِهِ وَاسْمِ أَبِيهِ وَمِمّنْ هُوَ، فَإِنّهُ أَوْصَلُ لِلْمَوَدّةِ.

কেউ যখন অন্যের সাথে ভ্রাতৃত্বের বন্ধন গড়ে তুলতে চায় তাহলে সে যেন তার নাম, তার বাবার নাম ও বংশের কথা জিজ্ঞেস করে। এর দ্বারা ভালোবাসার বন্ধন আরো গভীর হয়। -জামে তিরমিযী, হাদীস ২৩৯২

উপরের রেওয়ায়েতসমূহ দ্বারা এটা স্পষ্ট প্রতীয়মান হয় যে, সন্তানের সুন্দর নাম রাখা পিতা-মাতার অবশ্যকর্তব্য। এটা পিতা-মাতার উপর সন্তানের সর্বপ্রথম হক। কখনো কোনো কারণে মন্দ ও অসুন্দর নাম রেখে ফেললে তা পরিবর্তন করে সুন্দর নাম রাখা উচিত। এটাই নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সুন্নত।

সুন্দর নামের মাপকাঠি

যেসকল নাম নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অপছন্দ করেছেন উপরে তার কিছু বিবরণ দেয়া হয়েছে। এর পাশাপাশি নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যেসকল নাম পছন্দ করতেন এবং সেগুলো রাখতে উৎসাহিত করতেন- সে সম্পর্কেও জানা থাকা দরকার। কেমন নাম রাখা উচিত। কোন্ ধরনের নাম আল্লাহ তাআলা পছন্দ করেন এ ব্যাপারে নিম্নোক্ত হাদীস স্পষ্ট দিকনির্দেশনা দেয়া হয়েছে।

قَالَ رَسُولُ اللهِ صَلّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلّمَ: تَسَمّوْا بِأَسْمَاءِ الْأَنْبِيَاءِ، وَأَحَبّ الْأَسْمَاءِ إِلَى اللهِ عَبْدُ اللهِ، وَعَبْدُ الرّحْمَنِ، وَأَصْدَقُهَا حَارِثٌ، وَهَمّامٌ، وَأَقْبَحُهَا حَرْبٌ وَمُرّةُ. رواه أبو داود في سننه، برقم ৪৯৫০

এ হাদীসে চারটি অংশ। প্রথম অংশ-

تَسَمَّوْا بِأَسْمَاءِ الْأَنْبِيَاءِ

(তোমরা নবীগণের নামে নাম রাখ।)

নবীগণ হচ্ছেন সৃষ্টির মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ এবং আল্লাহ তাআলার সর্বাধিক নৈকট্যপ্রাপ্ত। রিসালাতের মহান দায়িত্ব অর্পণ করা হয়েছে তাঁদের উপর। মানুষকে অন্ধকার ছেড়ে সত্যের আলোকিত পথ তারা প্রদর্শন করেন। তাদের প্রতিটি আচরণ ও উচ্চারণ মানব জাতির জন্য অনুপম আদর্শ। এজন্য তাদের নামও হয়ে থাকে সুন্দর ও অনুকরণীয়। আম্বিয়ায়ে কেরামের সংখ্যা অনেক। কিন্তু তাদের সবার নাম ও অবস্থা আমাদের জানা নেই।

পবিত্র কুরআনে ইরশাদ হয়েছে-

وَ رُسُلًا قَدْ قَصَصْنٰهُمْ عَلَیْكَ مِنْ قَبْلُ وَ رُسُلًا لَّمْ نَقْصُصْهُمْ عَلَیْكَ وَ كَلَّمَ اللهُ مُوْسٰی تَكْلِیْمًا.

অনেক রাসূলের বৃত্তান্ত আমি আপনাকে জানিয়েছি। আর অনেক রাসূলের বৃত্তান্ত জানাইনি। আল্লাহ তাআলা মূসার সাথে কথা বলেছেন। -সূরা নিসা (৪) : ১৬৪

সে সকল আম্বিয়ায়ে কেরামের নাম ও বিস্তারিত বিবরণ জানা যায় তাদের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ ও সর্বাধিক সম্মানিত হচ্ছেন হযরত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম।

যে সকল নবীর নাম পবিত্র কুরআনে উল্লেখ আছে তারা হলেন- আদম, ইদরীস, নূহ, হূদ, সালেহ, শুয়াইব, ইবরাহীম, ইসমাঈল, ইসহাক, ইয়াকুব, মূসা, হারুন, ঈসা, যাকারিয়া, ইয়াহইয়া, ইলিয়াস, আলইয়াসা‘, ইউনুস, সোলাইমান, দাউদ, আইয়ূব, যুলকিফল আলাইহিমুস সালাম।

এগুলো আম্বিয়ায়ে কেরামের ব্যক্তিগত নাম। এ ছাড়াও বিভিন্ন নবীর গুণবাচক নাম ও উপাধি পবিত্র কুরআন-হাদীসে উল্লেখিত হয়েছে। উদাহরণস্বরূপ হযরত ইবরাহীম আ.-এর উপাধি খলিলুল্লাহ ও খলিলুর রহমান। ইসমাঈল আ.-এর উপাধি যাবিহুল্লাহ। মূসা আ.-এর উপাধি কালীমুল্লাহ। ঈসা আ.-এর উপাধি রুহুল্লাহ ও কালীমুল্লাহ।

তবে সর্বাধিক গুণবাচক নাম ও উপাধি হচ্ছে সর্বশেষ ও সর্বশ্রেষ্ঠ রাসূল হযরত মুহাম্মাদ মুস্তফা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের। নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কয়েকটি উপাধি নিম্নোক্ত উল্লেখ করা হলো-

হযরত যুবাইর ইবনে মুতইম রা. বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলতে শুনেছি-

إِنّ لِي أَسْمَاءً، أَنَا أَحْمَدُ، وَأَنَا مُحَمّدٌ، وَأَنَا الْمَاحِي الّذِي يَمْحُو اللهُ بِي الْكُفْرَ، وَأَنَا الْحَاشِرُ الّذِي يُحْشَرُ النّاسُ عَلَى قَدَمِي، وَأَنَا الْعَاقِبُ قَالَ مَعْمَرٌ: قُلْتُ لِلزّهْرِيِّ: مَا الْعَاقِبُ؟ قَالَ: الّذِي لَيْسَ بَعْدَهُ نَبِيّ.

আমার অনেক নাম আছে। আমি মুহাম্মাদ, আমি আহমাদ, আমি মাহী-যার মাধ্যমে আল্লাহ মিটিয়ে দেবেন কুফরকে। আমি হাশের, আমার পর সমস্ত মানুষের হাশর হবে। (অর্থাৎ কিয়ামতের দিন সর্বপ্রথম আমি কবর থেকে উঠব। এরপর অন্যান্য লোক উঠবে।) আমি আকীব-শেষে আগমনকারী। তিনি সর্বশেষ নবী। যার পর আর কোনো নবী নেই। -মুসনাদে আহমাদ, হাদীস ১৬৭৭১

হযরত আবু মূসা আশআরী রা.-এর সূত্রে অন্য হাদীসে বর্ণিত আছে-

كَانَ رَسُولُ اللهِ صَلّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلّمَ يُسَمِّي لَنَا نَفْسَهُ أَسْمَاءً، فَقَالَ: أَنَا مُحَمّدٌ، وَأَحْمَدُ، وَالْمُقَفِّي، وَالْحَاشِرُ، وَنَبِيّ التّوْبَةِ، وَنَبِيّ الرّحْمَةِ.

আবু মূসা আশআরী রা. বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদেরকে তাঁর নাম বর্ণনা করে বলেছেন- আমি মুহাম্মাদ, আহমাদ, মুক্কাফী (পরবর্তীতে আগমনকারী) হাশের। নাবীয়্যুত তাওবা (তাওবার নবী। যার হাতে অসংখ্য মানুষ তাওবা করেছে এবং অন্যদের জন্য তাঁর তাওবা কবুল হয়েছে) নবীয়্যুর রাহমাহ্ (দয়ার নবী, রহমতের নবী)। -সহীহ মুসলিম, হাদীস ২৩৫৫

উপরোক্ত বর্ণনাদ্বয়ের উল্লেখিত নাম ছাড়াও নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আরো অনেক নামের উল্লেখ কুরআন ও হাদীসে পাওয়া যায়। যেমন বাশীর, নাযীর, শাহীদ, শাফী‘, মুশাফফা‘, মুযযাম্মিল, মুদ্দাসসির, সিরাজুম মুনীর, রাহমাতুল লিল আলামিন। মুসতাফা, মুজতাবা।

হাদীসের দ্বিতীয় অংশ হল-

وَأَحَبّ الْأَسْمَاءِ إِلَى اللهِ عَبْدُ اللهِ، وَعَبْدُ الرّحْمَنِ.

(আল্লাহ তাআলার কাছে সবচেয়ে প্রিয় নাম হচ্ছে আবদুল্লাহ ও আবদুর রহমান।)

অর্থাৎ আল্লাহ তাআলার কাছে সে সকল নাম সর্বাধিক প্রিয়, যেগুলোর মধ্যে বন্দেগী ও দাসত্বের প্রকাশ রয়েছে। অর্থাৎ ‘আব্দ’ শব্দটিকে নামের অংশ বানিয়ে আল্লাহ তাআলার কোনো নামের দিকে সম্বন্ধযুক্ত করা হয়েছে। যেমন, আব্দুল্লাহ, আব্দুর রহমান, আবদুর রহীম, আবদুর রাযযাক, আবদুল খালেক, আবদুস সাত্তার, আবদুর রব ইত্যাদি।

আবদুল্লাহ ও আবদুর রহমানকে বিশেষভাবে উল্লেখ করার কারণ হল, আল্লাহ ও রহমান আল্লাহ তাআলার ঐসকল গুণবাচক নামের অন্তর্ভুক্ত, যেগুলোকে কোনোভাবেই আল্লাহ ভিন্ন অন্যের ক্ষেত্রে ব্যবহার করা বৈধ নয়।

আল্লাহ তাআলার নিরানব্বইটি নাম রয়েছে। এর যে কোনো একটির শুরুতে ‘আব্দ’ শব্দটি যোগ করে নাম রাখা যেতে পারে। হাদীস শরীফে আছে-

عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ، رِوَايَةً، قَالَ: لِلهِ تِسْعَةٌ وَتِسْعُونَ اسْمًا، مِائَةٌ إِلَّا وَاحِدًا، لاَ يَحْفَظُهَا أَحَدٌ إِلَّا دَخَلَ الجَنَّةَ، وَهُوَ وتْرٌ يُحِبُّ الوتْرَ

হযরত আবু হুরায়রা রা. বলেন, আল্লাহ তাআলার নিরানব্বইটি নাম রয়েছে। এক কম একশ। যে ব্যক্তি তা মুখস্থ করবে সে জান্নাতে যাবে। আল্লাহ তাআলা একক-অদ্বিতীয় (বেজোড়), তাঁর কোনো শরীক (জোড়) নেই। তিনি বেজোড় ভালোবাসেন। -সহীহ বুখারী, হাদীস ৬৪১০

পবিত্র কুরআনে সংখ্যা উল্লেখ করা ছাড়াই আসমায়ে হুসনার আলোচনা করা হয়েছে। ইরশাদ হয়েছে-

وَ لِلهِ الْاَسْمَآءُ الْحُسْنٰی فَادْعُوْهُ بِهَا وَ ذَرُوا الَّذِیْنَ یُلْحِدُوْنَ فِیْۤ اَسْمَآىِٕهٖ سَیُجْزَوْنَ مَا كَانُوْا یَعْمَلُوْن.

আল্লাহর রয়েছে সুন্দর সুন্দর নাম। তোমরা এগুলোর মাধ্যমে তাঁকে ডাক এবং যারা তাঁর নামের মাঝে বক্রতা সৃষ্টি করে তাদেরকে পরিত্যাগ কর। তাদেরকে তাদের কৃতকর্মের প্রতিদান দেয়া হবে। -সূরা আ‘রাফ (৭) : ১৮০

এ আয়াতে বলা হয়েছে, আল্লাহ তাআলার সুন্দর সুন্দর নাম আছে, যা তাঁর বড়ত্ব ও মহত্বে পূর্ণতার প্রমাণ বহন করে। এ সুমহান নামসমূহের মাধ্যমে আল্লাহকে ডাকা ও স্মরণ করার আদেশ আমাদেরকে দেয়া হয়েছে। সেই সাথে যারা আল্লাহর নামের মধ্যে বক্রতা অবলম্বন করে তাদের সংস্পর্শ ত্যাগ করার প্রতিও গুরুত্বারোপ করা হয়েছে।

উপমহাদেশের বিখ্যাত আলেম হযরত মাওলানা মুফতী মুহাম্মাদ শফী রাহ. তার সহজবোধ্য তাফসীরগ্রন্থ মাআরেফুল কুরআনে এ আয়াতের ব্যাখ্যায় গুরুত্বপূর্ণ কথা লিখেছেন, যার দ্বারা অনুমতি হয়- ইচ্ছায় বা অনিচ্ছায় অধিকাংশ মুসলমানই আল্লাহ তাআলার নামের মধ্যে বক্রতা করার গুনাহে লিপ্ত হয়ে পড়ে। সূরা আরাফের উপরোক্ত আয়াতের ব্যাখ্যায় তিনি লিখেন-

“আল্লাহ তাআলার নামের মধ্যে বক্রতা সৃষ্টির ব্যাপারে নিষেধাজ্ঞা এবং তার বিভিন্ন সূরত, বিভিন্ন রূপ আল্লাহ তাআলার নামের অপব্যাখ্যা ও বিকৃতির কয়েকটি পন্থা হতে পারে। আর এগুলোর সবগুলোই এ আয়াতে বর্ণিত নিষেধাজ্ঞার অন্তর্ভুক্ত।

প্রথমত : আল্লাহ তাআলার জন্য এমন কোনো নাম ব্যবহার করা, যা কুরআন-হাদীস দ্বারা প্রমাণিত নয়। উলামায়ে কেরাম এ ব্যাপারে একমত যে, আল্লাহর নাম ও গুণাবলীর ব্যাপারে কারো এমন অধিকার নেই যে, যে যা ইচ্ছা নাম রাখবে। কিংবা যে গুণে ইচ্ছা তার গুণকীর্তন করবে। শুধুমাত্র সেসমস্ত শব্দই প্রয়োগ করা আবশ্যক, যা কুরআন ও সুন্নাহতে আল্লাহ তাআলার নাম কিংবা গুণ-ছিফাত হিসাবে উল্লেখ করা হয়েছে। যেমন আল্লাহকে ‘কারীম’ বলা যাবে, তবে সাখী (দাতা) বলা যাবে না। নূর বলা যাবে, কিন্তু ‘জ্যোতি’ বলা যাবে না। ‘শাফি’ বলা যাবে, কিন্তু ‘তবীব’ (ডাক্তার) বলা যাবে না। কারণ, এই দ্বিতীয় শব্দগুলো প্রথম শব্দের সমার্থক হলেও কুরআন-হাদীসে বর্ণিত হয়নি।

বিকৃতি সাধনের দ্বিতীয় পন্থা হল, আল্লাহর যে সমস্ত নাম কুরআন-হাদীসে উল্লেখ রয়েছে সেগুলোর মধ্যে কোনো নামকে অশোভন মনে করে পরিহার করা। এতে সে নামের প্রতি বেআদবী বা অবজ্ঞা প্রদর্শন করা হয়।

কোনো লোককে আল্লাহ তাআলার জন্য নির্ধারিত নামে সম্বোধন করা জায়েয নয়।

তৃতীয় পন্থা হল, আল্লাহর জন্য নির্ধারিত নাম অন্য কোনো লোকের জন্য ব্যবহার করা। তবে এখানে ব্যাখ্যা আছে। আসমায়ে হুসনার মধ্যে কিছু নাম এমন আছে, যেগুলো স্বয়ং কুরআন ও হাদীসে অন্যান্য লোকের ক্ষেত্রে ব্যবহার করা হয়েছে। আর কিছু নাম রয়েছে, যেগুলো আল্লাহ ব্যতীত অন্যের জন্য ব্যবহার করা প্রমাণিত। সেসব নাম অন্যের জন্য ব্যবহার করা যেতে পারে। যেমন- রাহীম, রাশীদ, আলী, কারীম, আযীয প্রভৃতি।

পক্ষান্তরে আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো জন্য যেসব নামের ব্যবহার কুরআন-হাদীসে প্রমাণিত নয় সেগুলো একমাত্র আল্লাহর জন্য নির্দিষ্ট। আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো জন্য ব্যবহার করাই উল্লেখিত ‘ইলহাদ ফী ইসমিল্লাহ’ তথা আল্লাহর নামে বিকৃতি সাধনের অন্তর্ভুক্ত এবং নাজায়েয ও হারাম। যেমন-, রহমান, সুবহান, রাযযাক, খালেক, গাফফার, কুদ্দুস ইত্যাদি। এই নির্দিষ্ট নামগুলো যদি আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো ক্ষেত্রে কোনো ভ্রান্ত বিশ্বাসের ভিত্তিতে হয় যে, যাকে এসব শব্দের দ্বারা সম্বোধন করা হচ্ছে তাকেই যদি খালেক (সৃষ্টিকর্তা) কিংবা রাযযাক (রিযিকদাতা) মনে করা হয় তাহলে তা সম্পূর্ণ কুফর। আর যদি ভ্রান্তবিশ্বাসের বশীভূত না হয়ে শুধুমাত্র অসচেতনতা কিংবা না বোঝার দরুন কাউকে খালেক, রাযযাক, রহমান কিংবা সুবহান বলে ডাকে তাহলে তা কুফরী না হলেও শিরকসুলভ শব্দ হওয়ার কারণে কবীরা গুনাহের অন্তর্ভুক্ত।

আফসোসের বিষয়, বর্তমানে অনেক মুসলিম এ গুনাহে লিপ্ত। কিছু কিছু লোক তো ইসলামী নাম রাখাও ছেড়ে দিয়েছে। আকার ও অবয়বে এবং স্বভাব ও চরিত্রে তাদেরকে মুসলমান বলে বোঝা এমনিতেই কঠিন ছিল। যাও নামের বদৌলতে চেনা যেত তাও ইংরেজি কায়দায় নাম রাখায় কষ্টকর হয়ে যাচ্ছে।

মেয়েদের নাম মহীয়সীদের পবিত্র সুন্দর নাম যেমন খাদীজা, আয়েশা, ফাতেমার অনুকরণে রাখা বাদ দিয়ে শাহনাজ, নাজমা, পারভীন ইত্যাদি উদ্ভট নাম রাখা হচ্ছে। আরো আফসোসের বিষয় হল, যাদের নাম আবদুর রহমান, আবদুর রাযযাক, আবদুল গাফফার, আবদুল কুদ্দুস প্রভৃতি রাখা হয়েছে বা হচ্ছে তাদের নামকে সংক্ষেপ করে বলা হচ্ছে- রহমান, রাযযাক, গাফফার, কুদ্দুস ইত্যাদি। এ সবই নাজায়েয, হারাম ও কবীরা গুনাহ। যতবার এগুলো উচ্চারণ করা হয় ততবারই কবীরা গুনাহ হয়। এবং শ্রোতাও পাপমুক্ত থাকে না। এ সমস্ত অহেতুক গুনাহে আজ অধিকাংশ মুসলমান লিপ্ত। অথচ চিন্তাও করছে না যে, এ সামান্য বিষয়টির পরিণতি কত ভয়াবহ। এ দিকেই উক্ত আয়াতের

سَیُجْزَوْنَ مَا كَانُوْا یَعْمَلُوْنَ.

বাক্যের দ্বারা সতর্ক করা হয়েছে। এখানে শাস্তির বিষয়টি অস্পষ্ট রাখা হয়েছে। যা কঠিন আযাবের প্রতি ইঙ্গিত বহন করে।” (তাফসীরে মাআরেফুল কুরআন ৪/১৩১)

হযরত মুফতী ছাহেবের ব্যাখ্যার আলোকে আসুন আমরা একটু আমাদের সমাজের দিকে তাকাই। বর্তমান সমাজে যে ভুলটা ব্যাপকভাবে দেখা যাচ্ছে তা হল, অনেকের নামের প্রথম অংশ বাদ দিয়ে শুধুমাত্র দ্বিতীয় অংশটি উচ্চারণ করা। যেমন আবদুর রহমান, হাবীবুর রহমান, মুজীবুর রহমান নামের প্রথম অংশ ফেলে দিয়ে শুধু রহমান বলে ডাকা এবং কোনো সংকোচ ছাড়াই মিস্টার রহমান বলে একে অন্যকে সম্বোধন করা। এমনিভাবে আবদুস সাত্তার, আবদুর রাযযাক ইত্যাদি নামের মধ্যে ‘আবদ’ শব্দটি ফেলে দিয়ে শুধু সাত্তার, জাব্বার, রাযযাক, কুদ্দুস, কাইউম বলে ডাকে।

একটু ভাবা দরকার, যদি আবদুল্লাহকে সংক্ষেপ করে আল্লাহ ডাকা না যায় তাহলে আবদুর রহমানকে কীভাবে রহমান ডাকা যাবে। অথচ আল্লাহ ও রাহমান উভয় নামই এমন, যা আল্লাহ ভিন্ন অন্য কারো ক্ষেত্রে ব্যবহার করা জায়েয নেই। এমনিভাবে রাযযাক, খালেক, কাইয়ূম, কুদ্দূস, গাফফার, মুহয়ী, মুমিত, রব, গফুর ইত্যাদি গুণবাচক নামও শুধু আল্লাহ তাআলার সাথেই বিশেষিত। আবদিয়্যাতের প্রকাশ ছাড়া এ নামগুলো সরাসরি অন্য কোনো বান্দার ক্ষেত্রে ব্যবহার করা বৈধ নয়। তাই এসকল নামের ক্ষেত্রে সবার সতর্কতা কাম্য।

হাদীসের সর্বশেষ বাক্যদুটি হল-

وَأَصْدَقُهَا حَارِثٌ، وَهَمّامٌ، وَأَقْبَحُهَا حَرْبٌ وَمُرَّةُ.

সবচেয়ে সত্য নাম হচ্ছে হারেস এবং হাম্মাম আর সবচেয়ে খারাপ নাম হচ্ছে হারব এবং মুররাহ। -সুনানে আবু দাউদ, হাদীস ৪৯৫০

হারেস অর্থ, উপার্জনকারী, কাজে নিয়োজিত, কর্মব্যস্ত, আর হাম্মাম অর্থ- ইচ্ছাপোষণকারী। আর প্রতিটি মানুষই কোনো না কোনো কাজে ব্যস্ত থাকে, কিছু না কিছু ইচ্ছা পোষণ করে। এজন্য প্রতিটি মানুষই হারেস এবং হাম্মাম। এর বিপরীতে হারব অর্থ যুদ্ধ। আর মুররাহ অর্থ তিক্ত। উভয় নামের মাঝেই অর্থগত ও স্বভাবগত দুর্বলতা বিদ্যমান। এজন্য প্রথম দুটি নামকে সবচে সত্য এবং শেষ দুটি নামকে সবচেয়ে খারাপ নাম হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে।

মোটকথা, এ হাদীসে আমাদেরকে এ দিকনির্দেশনা প্রদান করা হয়েছে যে, নাম রাখার সময় আমরা যেন অর্থের দিকেও খেয়াল রাখি। ষ

 

2 thoughts on “নাম রাখার ক্ষেত্রে ইসলামের নির্দেশনা

  1. মুসলিম ছেলে মেয়ের নামসহ লিখলে আরো ভালো হতো

    1. পোস্ট বড় হয়ে যাওয়ায় সম্ভব হয়নি। আমরা সুন্দর কিছু ইসলামী নাম সহকারে ভিন্ন একটি পোস্ট পাবলিশ করব ইনশা আল্লাহ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.