দাঁড়িয়ে পানি পান করলে যেসব ক্ষতি হয়

মুফতি সাঈদ আল হাসান
———————————

পানি আল্লাহ তাআলার পক্ষ থেকে মানবজাতির জন্যে প্রদত্ত সবচে বড় নেয়ামতগুলোর অন্যতম। দেহের কোষ, কলা বা টিস্যু, বিভিন্ন অঙ্গ তথা মস্তিষ্ক, কিডনি, পাকস্থলী, ত্বক, চুল ইত্যাদির যথাযথ কার্যকারিতার জন্য পানি অত্যাবশ্যকীয়। । দেহের সকল কার্যাবলী সুষ্ঠুভাবে সম্পাদনের জন্য পর্যাপ্ত পরিমাণ পানি পান করা প্রয়োজন।

আমাদের নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সব সময় বসে পানি পান করতেন। কাজেই বসে পানি পান করা একটি গুরুত্বপূর্ণ সুন্নাত। সুন্নাতের খিলাফ কোন কাজে সাধারণত কল্যাণ থাকে না। অনেক সময় আমরা ভুল নিয়মে তথা শুয়ে, দাঁড়িয়ে, হেঁটে হেঁটে পানি পান করে নিজেকে ঝুঁকির মুখে ফেলে দেই। এ সবগুলোই পরিত্যাজ্য।

চলুন, বসে পানি পান সংক্রান্ত কিছু হাদীস জেনে নেয়া যাক-

أَبَا هُرَيْرَةَ، يَقُولُ: قَالَ رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: «لَا يَشْرَبَنَّ أَحَدٌ مِنْكُمْ قَائِمًا، فَمَنْ نَسِيَ فَلْيَسْتَقِئْ»

হযরত আবূ হুরায়রা রাঃ থেকে বর্ণিত। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন, তোমাদের কেউ যেন দাঁড়িয়ে পান না করে। তবে যদি ভুলে যায়, তাহলে যেন বমি করে দেয়। [সহীহ মুসলিম, হাদীস নং-২০২৬]

عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ، ” أَنَّ رَسُولَ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ، نَهَى أَنْ يَشْرَبَ الرَّجُلُ قَائِمًا

হযরত আবূ হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত। নিশ্চয় রাসূল সা. লোকদেরকে দাঁড়িয়ে পানি পান করতে নিষেধ করেছেন। [মুসনাদে আহমাদ, হাদীস নং-৮৩৩৫]

عَنْ عَمْرِو بْنِ شُعَيْبٍ، عَنْ أَبِيهِ، عَنْ جَدِّهِ، قَالَ: رَأَيْتُ رَسُولَ اللهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يَشْرَبُ قَائِمًا وَقَاعِدًا

আমর বিন শুয়াইব তিনি তার পিতা, তিনি তার দাদা থেকে বর্ণনা করেন, তিনি বলেন, আমি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে (যমযমের পানি) দাঁড়িয়ে ও (অন্যান্য পানি) বসে পান করতে দেখেছি। [সুনানে তিরমিজী, হাদীস নং-১৮৮৩]

عَنْ أَنَسٍ، عَنِ النَّبِيِّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ، «أَنَّهُ نَهَى أَنْ يَشْرَبَ الرَّجُلُ قَائِمًا»، قَالَ قَتَادَةُ: فَقُلْنَا فَالْأَكْلُ، فَقَالَ: «ذَاكَ أَشَرُّ أَوْ أَخْبَثُ

হযরত আনাস রাঃ থেকে বর্ণিত। নিশ্চয় রাসূল সাঃ লোকদের দাঁড়িয়ে পান করতে নিষেধ করেছেন।  কাতাদা বললেন, আমরা বললাম, তাহলে খাবার? তিনি জবাবে বললেন- (দাঁড়িয়ে খাবার খাওয়া তো) আরো জঘন্য ও খারাপ। [সহীহ মুসলিম, হাদীস নং-২০২৪]

عَنْ أَبِي سَعِيدٍ الْخُدْرِيِّ، «أَنَّ النَّبِيَّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ زَجَرَ عَنِ الشُّرْبِ قَائِمًا

হযরত আবূ সাঈদ খুদরী রা. থেকে বর্ণিত। নিশ্চয় রাসূল সা. দাঁড়িয়ে পানি পানকারীকে তিরস্কার করেছেন। [সহীহ মুসলিম, হাদীস নং-২০২৫]

এরকম আরো অসংখ্য বিশুদ্ধ হাদীস রয়েছে, যাতে পরিস্কার বর্ণনা রয়েছে যে, রাসূল সাঃ দাঁড়িয়ে পানাহার করতে নিষেধ করেছেন।

 

তবে কিছু হাদীসে নবীজী সা. দাঁড়িয়ে পানি পান করেছেন মর্মে বর্ণনা পাওয়া যায়। এর ৩টি জবাব রয়েছে।

জবাব ১. সেখানে যমযমের পানির কথা বলা হয়েছে। ফুক্বাহায়ে কিরাম যমযমের পানি কিবলার দিকে ফিরে দাঁড়িয়ে পান করা মুস্তাহাব বলেছেন। তবে একদল ফুক্বাহায়ে কিরাম দাঁড়িয়ে যমযম পান করাকে মুস্তাহাব বলেন না, বরং জায়েজ বলে থাকেন। (ফাতওয়ায়ে শামী-১/২৫৪-২৫৫)

জবাব ২. দাঁড়িয়ে পানি পান করার বিধান রহিত হয়ে গেছে।

জবাব ৩. অপারগতার কারণে দাঁড়িয়ে পান করা জায়েয, যা দাঁড়িয়ে পান করা সম্বলিত হাদীস প্রমাণ বহন করে।

عَنْ عَبْدِ الرَّحْمَنِ بْنِ أَبِي عَمْرَةَ، عَنْ جَدَّةٍ لَهُ يُقَالُ لَهَا كَبْشَةُ الْأَنْصَارِيَّةُ، أَنَّ رَسُولَ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: «دَخَلَ عَلَيْهَا، وَعِنْدَهَا قِرْبَةٌ مُعَلَّقَةٌ، فَشَرِبَ مِنْهَا، وَهُوَ قَائِمٌ

কাবশাতুল আনছারিয়্যা রা. থেকে বর্ণিত। একদা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার নিকট প্রবেশ করলেন। তার নিকট একটি ঝুলন্ত পানির পাত্র ছিল। তখন রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তা থেকে দাঁড়িয়েই পান করলেন। [সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদীস নং-৩৪২৩]

কিন্তু দাঁড়িয়ে পানি পান করা উত্তম নয়। যা নিষেধাজ্ঞার হাদীস দ্বারা প্রমাণিত হয়। (আউনুত তিরমিজী-১/১৫০-১৫১, যাদুল মাআদ-১/১৪৯-১৫০)

তবে বসার সুযোগ থাকা সত্ত্বেও অথবা বসাতে কোন কষ্ট না হলে, দাঁড়িয়ে পানি পান করা মাকরূহ হবে। (তাকমিলাতু ফাতহুল মুলহিম- খন্ড-৪, মাআরেফুল হাদীস, খন্ড ৬)

এ তো গেল হাদীসের কথা। দাঁড়িয়ে পান করা বিজ্ঞানও সমর্থন করে না। এটি হতে পারে নানা ধরনের শারীরিক সমস্যার কারণ।

চলুন জেনে নেই দাঁড়িয়ে পানি পানের ক্ষতিকর দিকগুলো সম্পর্কে।

১. দাঁড়িয়ে পানি পান করলে তা সরাসরি পাকস্থলীতে গিয়ে ধাক্কা দেয়। ফলে স্টমাক থেকে নিঃসৃত পাচকরসের ক্ষরণ কমে যায়।  এতে বদহজমের আশঙ্কা দেখা দেয় এবং  তলপেটে যন্ত্রণাসহ একাধিক সমস্যা তৈরি হয়।

২. দাঁড়িয়ে পানি খেলে তা হৃদযন্ত্রের উপরেও অতিরিক্ত চাপ ফেলে। বুকের পেশির উপর এই চাপের ফলে বিষম খাওয়া থেকে শুরু করে শ্বাসরোধ পর্যন্ত হতে পারে।

৩. গ্যাস্ট্রো ইসোফেগাল রিফ্লাক্স ডিজিজ বা G.E.R.D সৃষ্টি হয়। দাঁড়িয়ে পানি পান করলে তা সরাসরি ইসোফেগাসে গিয়ে আঘাত করে। এর ফলে পাকস্থলীর ভেতরের সরু নালিটি মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হয়। যার ফলে গ্যাস্ট্রো ইসোফেগাল রিফ্লাক্স ডিজিজ বা G.E.R.D এর মতো রোগ শরীরে বাসা বাঁধে।

৪. পানি পান করার পরেই ছাঁকনিগুলো শরীর পরিশ্রুত করার কাজ শুরু করে দেয়। দাঁড়িয়ে পানি পান করলে শরীরের অন্দরে থাকা ছাঁকনিগুলো সংকুচিত হয়ে যায়। পরিশ্রুত করার কাজ বাধা পায়। শরীরে টক্সিনের মাত্রা বাড়তে থাকে।

৫. দাঁড়িয়ে পানি পান করলে স্নায়ু উত্তেজিত হয় ও বাড়ে রক্তচাপ। সাথে উদ্বেগ বাড়তে থাকে।

৬. দাঁড়িয়ে পানি পান করলে কিডনি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এতে কিডনির কর্মক্ষমতা কমে যায়। কিডনি ড্যামেজের আশংকা দেখা দেয়।

৭. দাঁড়িয়ে পানি পান করলে তা দ্রুত কোলন বা মলাশয়ে চলে যায়। ফলে পানির প্রয়োজনীয় পুষ্টি উপকরণ দেহ শোষণ করতে পারে না।

এ ছাড়াও আরও বহু সমস্যার সৃষ্টি হয়ে থাকে। কাজেই, আসুন, আজ থেকেই দাঁড়িয়ে পানি পান করার বদভ্যাস পরিত্যাগ করি। আল্লাহ আমাদের আমল করার তাউফিক দিন। আমীন, ইয়া রাব্বাল আলামীন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.