বিশ্ব বিখ্যাত ইসলামী বিদ্যাপীঠ মদীনা ইউনিভার্সিটি, যেখানে বিশ্বের ১৮০টি দেশের প্রায় ২০,০০০ ছাত্র নিয়মিত পড়াশোনা করে।
হানাফি, শাফেয়ী, মালেকী, হাম্বলী, চার মাযহাবের ছাত্ররাই এখানে পড়াশোনা করেন।
ইউনিভার্সিটির ফিকহ সিলেবাসে চার মাযহাবের কিতাবাদীর উপর বেশ গুরুত্বারোপ করা হয়। বিশেষত : যেহেতু সৌদিতে হাম্বলী ফিকহ/ হাম্বলী মাযহাবের চর্চা বেশি, তাই উক্ত মাযহাবের মাসায়েলের উপর অত্যধিক গুরুত্ব দেয়া হয়।
মদীনাসহ অন্যান্য ইউনিভার্সিটিতেও ফিকহে হাম্বলী পড়ানো হয়। হাম্বলী মাযহাবের প্রসিদ্ধ ফিকহের কিতাব রাওজুল মুরবী, ও তুলনামূলক চার মাযহাবের উপর বেদায়াতুল মুজতাহিদ” কিতাবটি মদীনা ইউনিভার্সিটির পাঠ্যসূচির অন্তর্ভুক্ত এবং অনার্স, মাস্টার্সসহ সকল বিভাগেই তা পড়ানো হয়।
এছাড়া চার মাযহাবের প্রসিদ্ধ চারটি মতন / মূল-পাঠ কিতাবের হিফজের ব্যবস্থা রয়েছে। এগুলো কেউ মুখস্থ করলে তার উপর সার্টিফিকেটও দেয়া হয়।
আলহামদুলিল্লাহ, আমি মদীনায় এসেছি দুই বছর রানিং চলছে। কুল্লিয়াতুল হাদীস / হাদীসের উপর চার বছর মেয়াদী কোর্সে পড়াশোনা করছি।
এপর্যন্ত কোন একজন উস্তাদকেও মাযহাবের বিপরীতে কোন কথা বলতে শুনি নি।
সবাই মাযহাবের প্রতি শ্রদ্ধা-ভক্তি ও মাযহাবের গুরুত্ব নিয়েই কথা বলেন এবং একথাও বলে দেন, তোমাদের যে দেশে যে মাযহাব প্রসিদ্ধ সেই মাযহাবের বিপরীতে ফতওয়া দিতে যাবে না। কারণ, চার মাযহাবই হক, এবং চার মাযহাবই আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাতের অন্তর্ভুক্ত।
আজকের ঘটনা –
আজ আমাদের হাদীস ডিপার্টমেন্টের (مدخل الي الحديث التحليلي) হাদীস মুখস্তকরণ-এর ঘণ্টায় আমাদের উস্তাদ সৌদি শায়েখ হামদ হাসান হামদ (হাফি:) যিনি অত্যন্ত যোগ্য, দক্ষ ও মুহাক্কিক একজন আলেম, তিনি বুখারী শরীফের প্রথম হাদীস (انما الاعمال بالنيات) এর ব্যাখ্যা করতে গিয়ে ফিকহী এখতেলাফের বিভিন্ন দিক নিয়ে প্রায় দীর্ঘ আধা ঘণ্টা আলোচনা করেন।
শেষ পর্যায়ে বলেন যে, নিয়তের মাসআলায় ফুকাহায়ে কেরামের মধ্যে বেশ এখতেলাফ রয়েছে, প্রত্যেকের দলীল উপস্থাপন করে তিনি হাম্বলী মাযহাবকে প্রাধান্য দেন।
এক পর্যায়ে তিনি বলেন: তোমরা বিভিন্ন দেশ থেকে এখানে ইলম অন্বেষণ করতে এসেছ।
কে কোন্ মাযহাবের হাত উঁচু করে একটু পরিচয় দাও তো দেখি।
(আমাদের ব্যাচে আমরা বিভিন্ন দেশের নিয়মিত ৩০জন ছাত্র একসাথে পড়াশোনা করি।)
এবার শায়েখ বললেন তোমাদের মধ্যে কারা কারা হানাফি – হাত উঁচু করো।
একে একে ৯জন ভাই হাত উঁচু করে নিজেদের হানাফি বলে পরিচয় দিলেন ।
তারপর শায়েখ বললেন, কারা কারা মালেকী মাযহাব হাত উঁচু করো।
একে একে ১২জন ভাই হাত উঁচু করে নিজেদের মালেকী মাযহাবের বলে পরিচয় দেন।
এরপর বললেন, এবার দেখি শাফেয়ী মাযহাব কারা হাত উঁচু করো।
৬জন ভাই হাত উঁচু করে তারা নিজেদের শাফেয়ী মাযহাবের বলে পরিচয় দেন।
সর্বশেষ বললেন এবার দেখিত হাম্বলী মাযহাবের কারা কারা হাত উঁচু করো।
চীনের এক ভাই হাত উঁচু করে সে নিজেকে হাম্বলী মাযহাবের বলে পরিচয় দিল।
আমাদের ব্যাচের সর্বমোট ৩০ জনের মধ্যে
১/ হানাফি ৯ জন
২/ মালেকী ১২ জন
৩/ শাফেয়ী ৬ জন
৪/ হাম্বলী ১ জন।
মোট ৩০জনের ২৮জনই কোন না কোন ফিকহী মাযহাবের অনুসারী।
মাত্র দুজন ভাই হাত উঁচু করেনি।
শায়েখও তাদের হাত উঁচু না করাটা খেয়াল করেন নি, খেয়াল করলে হয়তো ধরতেন যে, তোমরা নিজেদের পরিচয় কেন গোপন করেছ ?
যাইহোক, এরপর শায়েখ মাযহাবের বিভিন্ন দিক নিয়ে আলোচনা করেন এবং বলেন যে, চার মাযহাবই সঠিক। চার মাযহাবই হাদীসের উপর রয়েছে। তাদের মধ্যকার ইখতেলাফ হচ্ছে ইজতেহাদী এখতেলাফ।
যারা ইজতেহাদের মাক্বামে পৌঁছে গেছে, তারা নিজেরা ইজতেহাদ করে আমল করবে। আর যারা ইজতেহাদের যোগ্যতা রাখে না তারা অবশ্যই তাকলীদ করবে।তবে মাযহাবের নামে বাড়াবাড়ি সেটাও কাম্য নয়।
তখন আমি উস্তাদ কে বললাম, শায়েখ আমাদের দেশে ইদানীং কিছু লোক দেখা যাচ্ছে (যাদের কেউ কেউ আবার মদীনা ইউনিভার্সিটির মুতাখাররিজ /ফারেগ) তারা নিজেদের আহলে হাদীস বলে পরিচয় দেয় এবং আমাদের দেশের স্বীকৃত হানাফি মাযহাবের বিপরীতে ফতওয়া দেয়। এবং তারা উম্মাহের মধ্যে বিভিন্নভাবে বিভাজন সৃষ্টি করে, যেমন তারা : আহলে হাদীস মসজিদ, আহলে হাদীস মাদ্রাসা এমনকি কোথাও আহলে হাদীস কবরস্থানও কায়েম করে উম্মাহের মধ্যে চরম বিভ্রান্তির সৃষ্টি করেছে।
একথা শুনে শায়েখ বললেন “ফিহি মুশকিলা” অর্থাৎ এদের মধ্যে সমস্যা রয়েছে।
এরপর শায়েখ সকল ছাত্রদের উদ্দেশ্যে বললেন পাকিস্তানসহ ভারতবর্ষে এই সমস্যাটা বেশি। এখানে নিয়মিত মাযহাব ও লা-মাযহাব নিয়ে সংঘাত হয়। কোন অবস্থাতেই ইসলামের মধ্যে বিভাজন পারস্পরিক সংঘাত করা ঠিক নয়।
ক্লাস শেষে- যে দুইজন ভাই হাত উঁচু করেনি, তাদের একজন আলবেনিয়া থেকে এসেছে- আমি তাকে বললাম
ভাই ! শায়েখ যখন পরিচয় জানতে চাইলেন, কে কোন মাযহাবের, আপনি হাত উঁচু করলেন না কেন?
সে বলল, আমি আহলুস সুন্নাহ।
আমি বললাম, এটি তো কোন মাযহাবের নাম নয়। তার মানে তুমি কি বুঝাতে চাচ্ছ যে, চার মাযহাব এরা কেউ আহলুস সুন্নাহ নয়?
সে সদুত্তর দিতে না পেরে সে বলল, আমি সহীহ হাদীসের উপর আমল করি।
আমি বললাম, তাহলে চার মাযহাবের সবাই কি হাদীসের বাইরে আমল করে?
উস্তাদ তো ক্লাসেই বলে দিলেন, চার মাযহাবের সবাই-ই হাদীসের উপর আমল করে, তাদের কেউ হাদীসের বাইরে নয়। আমার কথা শুনে কোন জবাব দিতে না পেরে সে একটু স্তম্ভিত হয়ে গেল।
আমি বললাম, আচ্ছা এবার তুমি সত্যি করে বল তোমার দেশে কোন মাযহাব বেশী প্রসিদ্ধ ?
উত্তরে সে বলল -হানাফি।
আমি বললাম, আলহামদুলিল্লাহ, ভাই একটি কথা শুনো। পৃথিবীতে কেউ মাযহাবের বাইরে নয়। যারা বলে আমরা মাযহাব মানি না, তারাও কিন্তু কোন না কোন শায়েখের ফতওয়া অনুসরণ করে, অতএব সবাই মুকাল্লিদ। সুতরাং স্বীকৃত মাযহাব ছেড়ে অন্য কোন পথে যাওয়াকে আমি বিপজ্জনক মনে করি।কারণ, মানুষ নফসের পূজারী হয়ে যায়। লা মাযহাবের নামে আরো একাধিক মনগড়া মাযহাবের সৃষ্টি হয়। যা মোটেও কাম্য নয়। একথা শুনে সে আমাকে আফওয়ান /সরি বলে এখান থেকে কেটে পড়ে।
আজকের এই ঘটনা থেকে যা জানা /বুঝা গেল এবং মদীনা ইউনিভার্সিটিতে যা শিক্ষা দেয়া হয়।তা হল:
১/ মদীনা ইউনিভার্সিটির অধিকাংশ/ প্রায় সকল স্কলারই কোন না কোন মাযহাবের অনুসারী। ভারতবর্ষীয় স্বল্পসংখ্যক বাদে।
২/ মদীনা ইউনিভার্সিটির পাঠ্যসূচিতে ফিকহে হাম্বলী ও চার মাযহাবের উপর বেদায়াতুল মুজতাহিদ কিতাব পড়ানো হয়।
৩/ উস্তাদগণ মাযহাবের উপর গুরুত্বারোপ করেন।
৪/ মাযহাবের নামে বাড়াবাড়ি করতে নিষেধ করেন।
৫/ এখানে শিরক ও বেদআতমুক্ত বিশুদ্ধ আকীদা পাঠদান করা হয়।
৬/ যাদের ইজতেহাদের যোগ্যতা আছে, তাদের ইজতেহাদ করতে বলা হয়। আর যাদের নেই তাদেরকে তাকলীদ করতে বলা হয়।
৭/ নিজ দেশের স্বীকৃত মাযহাবের বিরুদ্ধে না যেতে ও বিরোধী ফতওয়া না দিতে শিক্ষা দেয়া হয়।
৮/ ইসলামের নামে নতুন করে দল উপদল সৃষ্টি না করতে বলা হয়।
৯/ এখানে কোরআন ও সহীহ সুন্নাহর উপর অত্যধিক গুরুত্ব দেয়া হয়।
১০/ সর্বোপরি দ্বীনি কাজে বাড়াবাড়ি ও ছাড়াছাড়ি থেকে বিরত থাকতে বলা হয়।
আল্লাহ্ আমাদের সবাইকে উপরোক্ত সকল বিষয়ের উপর আমলের তাওফীক দান করুন।
—————————————————————————–
মাহফুজ আহমাদ
শিক্ষার্থী, কুল্লিয়াতু হাদীস বিভাগ
মদীনা ইউনিভার্সিটি, সৌদি আরব।
ফেব্রুয়ারী ১৮, ২০২০
আসসালামু আলাইকুম। লেখাটা পড়লাম বেশ ভালো। এক্ষণে আপনার নিকট জানতে ইচ্ঠে করছে যে, আপনি কি চার মাযহাব ই মানেন? আপনি মুসলমান না হয়ে আহলে হাদিস বা হাম্বলী বা শাফেয়ী বা হানাফি হতে গেলেন কেন? শুধু মুসলমান বললে কি ক্ষতি ছিলো?
জাযাকাল্লাহ খাইর