দৈনন্দিন জীবনে মহানবী (সা.) এর ১৩ টি সুন্নাহ

মুহাম্মদ ফয়জুল্লাহ

প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মদ মুস্তফা (সা.) আমাদের অনুসরণ ও অনুকরণের জন্য সর্বোত্তম আদর্শ। পৃথিবীতে আখেরাতমুখী এক উন্নত জীবন গঠনের জন্য তাঁর পূর্ণ জীবনই আমাদের জন্য শিক্ষার অনুপম দৃষ্টান্ত। এ নিবন্ধে দৈনন্দিন জীবনে পালনীয় রাসুলুল্লাহ (সা.) এর তেরোটি সুন্নাহ প্রদত্ত হল।

১. ঘুমানোর আগে বিছানা ঝেড়ে নিন

রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন,

“যখন তোমাদের মধ্যে কেউ ঘুমাতে যায়, তবে সে যেনো প্রথমে তার বিছানাকে তার কাপড় দিয়ে ঝেড়ে নেয়, কেননা সে জানেনা সেখানে কি থাকতে পারে। এরপর সে যেনো ডান দিকে কাত হয়ে ঘুমায়।” (বুখারী ও মুসলিম)

অর্থাৎ আপনি যখন ঘুমাতে যাবেন, প্রথমেই আপনার বিছানা ঝেড়ে পরিষ্কার করে নেবেন। যাতে করে আপনার জন্য ক্ষতিকর কিছু আপনার বিছানায় না থাকে। আপনার শিশুকেও এই বিষয়ে শিক্ষা দিতে ভুল করবেন না।

২. বাজারে গেলে দুআটি পড়ুন

রাসূল (সা.) বলেছেন,

“কেউ যদি বাজারে যায় এবং পড়ে, ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু ওয়াহদাহু লা শারীকালাহ, লাকুল মুলকু ওয়া লাহুল হামদু ইউহয়ি ওয়া ইউমিতু ওয়াহুয়া হাইউন লা ইয়ামুতু, বিয়াদিহিল খাইরু ওয়াহুয়া আলা কুল্লি শ্যাইয়িন কাদির।’ (অর্থাৎ, আল্লাহ ছাড়া যথার্থ উপাসনার কেউ নেই, তার কোন শরীক নেই, তিনিই সকল ক্ষমতা ও প্রশংসার অধিকারী, তিনি জীবন দেন এবং তিনিই জীবন নেন এবং তিনি চিরন্তন ও তার মৃত্যু নেই, তার হাতেই সকল কল্যান এবং তিনি সকল কাজের জন্য সক্ষম।) আল্লাহ তার নামে হাজার হাজার সওয়াব লিখবেন, তার হাজার হাজার গুনাহকে ক্ষমা করবেন এবং তার মর্যাদাকে হাজার হাজার গুন উন্নত করবেন এবং তার জন্য জান্নাতে ঘর নির্মান করবেন!” (তিরমিযি, নাসায়ী)

বাজার বা কোথাও কেনাকাটা করতে গেলে আমরা এই দোয়াটি পড়ার অভ্যাস করতে পারি এবং এর থেকে কল্যান লাভের চেষ্টা করতে পারি।

৩. দুধ পানের পর পানি পান করছেন তো?

রাসূল (সা.) যখন দুধ খেতেন, দুধ খাওয়ার পরপর সামান্য পানি পান করতেন। সহীহ বুখারী এবং মুসলিমে এই বিষয়ে বর্ণনা করা হয়েছে। মূলত দুধ খাওয়ার পর মুখ পরিষ্কার করতে রাসূল (সা.) পানি পান করতেন।

৪. পোশাক বদলাচ্ছেন? ‘বিসমিল্লাহ’ বলেছেন?

টয়লেটে প্রবেশ বা কাপড় ছাড়ার সময় ‘বিসমিল্লাহ’ পাঠ করুন। রাসূল (সা.) বলেছেন,

“যখন তোমরা টয়লেটে প্রবেশ করবে, তখন বিসমিল্লাহ পাঠ কর। যাতে করে আদম সন্তানের লজ্জাস্থান জ্বীনের চোখের আড়াল থাকতে পারে।” (তিরমিযি)

আমাদের শিশুদেরও এই বিষয়ে আমাদের শিক্ষা দেওয়া উচিত।

৫. নামায পড়ার সময় মনোযোগ হারাচ্ছেন?

উসমান ইবনে আবুল আস (রা.) একবার রাসূল (সা.) এর কাছে এসে জিজ্ঞেস করেন, হে আল্লাহর রাসূল, শয়তান আমার নামায ও তেলাওয়াত এবং আমার মাঝে হস্তক্ষেপ করে ফেলে এবং আমাকে প্রায়ই অপ্রস্তুত করে। রাসূল (সা.) বলেন,

“এই শয়তানের নাম খিনযিব। যদি তোমার এরূপ অনুভব হয়, তবে আল্লাহর কাছে আশ্রয় চাও (আউযুবিল্লা…) এবং তোমার বামে তিনবার থুথু নিক্ষেপ করো।”

উসমান ইবনে আবুল আস (রা.) বলেন, আমি এরূপ করলাম এবং আল্লাহ তাকে আমার উপর অক্ষম করে দিলেন। (মুসলিম)

৬. ঘুম থেকে উঠে নাক পরিষ্কার করুন

রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন,

“যখন তোমাদের কেউ ঘুম থেকে উঠে, সে যেনো তার নাককে তিন বার পরিষ্কার করে নেয়, কেননা রাতে নিদ্রাকালে শয়তান সকলের নাসারন্ধ্রে অবস্থান করে।” (বুখারী ও মুসলিম)

৭. নামায ধীরে ধীরে পড়ুন

হযরত আনাস (রা.) বলেন, আমি রাসূল (সা.) কে যেভাবে নামায আদায় করতে দেখেছি, ঠিক সেভাবেই নামায আদায় করি।

পরবর্তীকালে তার শিষ্য সাবিত (রহ.) বলেন,

আনাস (রা.) এমন কিছু করতেন, যা তোমরা আজকাল কর না; যখন তিনি রুকু থেকে উঠতেন তখন এত দীর্ঘ সময় থাকতেন যে, লোকেরা বলত: তিনি কি সিজদা করতে ভুলে গেলেন। এবং যখন তিনি সিজদা থেকে উঠতেন, তখন এত সময় অপেক্ষা করতেন যে কেউ হয়তো চিন্তা করতো, তিনি দ্বিতীয়বার সিজদা দিতে ভুলে গেলেন। (বুখারী ও মুসলিম)

ইমাম ইবনুল কাইয়্যিম (রহ.) বলেন, রাসূল (সা.) এর এই সুন্নাহ তার সাহাবীদের পর অধিকাংশ লোকই ছেড়ে দিয়েছে। যখন তোমরা দুই সিজদার মাঝখানে সামান্য সময়ের জন্য বসো, তখন পড়ো: রাব্বিগ-ফিরলি রাব্বিগ-ফিরলি (হে রব, ক্ষমা কর! হে রব, ক্ষমা কর!), যেভাবে রাসূল (সা.) দুআ করতেন।

৮. নামায আদায়ে সুতরাহ

রাসূল (সা.) বলেছেন,

“যখন তোমাদের কেউ তার সামনে এমন কোন বস্তু রাখে যা অন্তত ঘোড়ার জিনের সমান উঁচু হয়, তার সামনে কারো চলাচলের ব্যাপারে সতর্ক না হয়েই সে নামায আদায় করতে পারে।” (মুসলিম)

সামনে বাধাস্বরূপ এই বস্তুকে সুতরাহ বলা হয় এবং এটি অন্যকেউও নামায আদায়রত ব্যক্তির সামনে রেখে দিয়ে চলাচল করতে পারে।

৯. জুতা পরছেনশুরুটা ডান পা দিয়েই হোক  

রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন,

“যখন তোমাদের কেউ জুতা পরিধান করে, সে যেনো তা ডানদিক থেকে শুরু করে। আবার সে যখন জুতা খুলে, তখন সে যেনো বামদিক থেকে তা শুরু করে। এবং জুতা পরলে সে যেনো দুই পায়েই পরে এবং খোলা রাখলে দুই পায়েই খোলা রাখে।” (বুখারী ও মুসলিম)

আমরা জুতার পরার জন্য ডান পা থেকে পরার সুন্নাহ সম্পর্কে সাধারনভাবে জানি। কিন্তু জুতা খোলার সময় বাম পা থেকে খোলার সুন্নাহ আমাদের খুব কমলোকেরই জানা রয়েছে।

১০. খাবারের সমালোচনা করবেন না

আবু হুরাইরা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূল (সা.) কখনোই কোন খাবারের সমালোচনা করতেননা। তার যদি পছন্দ হত তবে তিনি খেতেন আর পছন্দ না হলে, তিনি তা পরিহার করতেন। (বুখারী, মুসলিম)

আমরা প্রায়শই কোন খাবার পছন্দ না হলে তার সমালোচনা করতে শুরু করে দেই। আমাদের উচিত রাসূল (সা.) এর সুন্নাহ অনুসারে আমাদের পছন্দনীয় খাবার গ্রহণ করা এবং আমাদের অপছন্দনীয় খাবার নিরবে তা পরিহার করা।

১১. অন্যের ঘরে প্রবেশের আগে অনুমতি নিন

রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন,

“কারো ঘরে প্রবেশ করতে তোমরা তিনবার অনুমতি প্রার্থনা কর। যদি তোমাদের অনুমতি দেওয়া হয় তবে প্রবেশ কর, অন্যথায় ফিরে এস।” (মুসলিম)

১২. হাই তোলার সময় কি শয়তানকে খুশি করছেন?

রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন,

“হাই তোলা শয়তানের পক্ষ থেকে। যদি তোমাদের কেউ হাই তোলে, তবে সে যেনো যতটা সম্ভব একে চেপে রাখে। কেননা যখনই তোমাদের কেউ শব্দ করে হাই তোলে, তখন শয়তান খুশি হয়।” (বুখারী)

সুতরাং, শব্দ করে হাই তোলা পরিহার করুন।

১৩. ধীরে ধীরে পান করুন

রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন,

“উটের মত এক নিঃশ্বাসে পানি পান করো না। বরং, দুই বা তিনবারে পান করো এবং পান করার আগে আল্লাহর নাম নাও এবং শেষে আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করো।” (তিরমিযি)

কোনকিছু পান করার জন্য বসে ধীরে ধীরে পান করা এবং পান করার পর আল্লাহর শোকর আদায় করাই হল কোনকিছু পান করার সঠিক পদ্ধতি।

আল্লাহ আমাদের সকলকে এই সুন্নাহগুলো জীবনে বাস্তবায়নের তাওফিক দান করুন। আমীন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.