আখতারা মাহবুবা
নারী জাতিকে যে মর্যাদা দিয়েছে ইসলাম, পৃথিবীর অন্য কোনো ধর্ম বা সমাজব্যবস্থায় আজও তা দেখা যায় না। ইসলামী সমাজে নারীদের অধিকার ও কর্তব্য সম্পর্কে সুস্পষ্ট নির্দেশ রয়েছে। পবিত্র কোরআনে ঘোষণা করা হয়েছে, নারীদের ওপর যেমন পুরুষের অধিকার রয়েছে, তেমনি পুরুষদের ওপরও নারীদের অধিকার রয়েছে।
ইসলামপূর্ব যুগে নারীদের জীব-জন্তুর মতো ক্রয়-বিক্রয় করা হতো। বিয়ে-শাদির ব্যাপারে নারীর মতামতের অধিকার ছিল না। নারীরা কোনো সম্পদ বা মিরাসের অধিকারিণী হতো না। নারীদের মনে করা হতো পুরুষের অধীন, কোনো জিনিসেই তাদের নিজস্ব কোনো সত্তা ছিল না। পিতার পক্ষে কন্যাকে হত্যা করা, জীবন্ত কবর দেয়াকে বৈধ মনে করা হতো। এমনকি এই কাজকে পিতার জন্য সম্মানজনক বিবেচিত ছিল।
বিশ্বজুড়ে সব ধর্মে ও সমাজে নারীদের সঙ্গে যে ব্যবহার করা হতো, তা ছিল অমানবিক, হৃদয়বিদারক ও লোমহর্ষক। ইসলামপূর্ব যুগে নারী ছিল অত্যন্ত অসহায় ঘৃর্ণিত, লাঞ্ছিত এবং অধিকারবঞ্চিত। হজরত মোহাম্মদ (সা.) এবং তাঁর প্রবর্তিত ইসলাম ধর্মই নারীদের মণিকোঠায় স্থান দিয়ে বিশ্ববাসীর চোখ খুলে দিয়েছেন। ন্যায়-নীতির বিধিবিধান প্রয়োগ করে নারী সমাজের অধিকার সংরক্ষণ পুরুষদের ওপর ফরজ করে দিয়েছেন।
বিবাহ-শাদি এবং ধনসম্পদে নারীদের মালিক করা হয়েছে। প্রাপ্তবয়স্ক নারীকে তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে পিতা পর্যন্ত বিবাহ দিতে বাধ্য করতে পারে না। নারীর সম্পদে তার অনুমতি ছাড়া কোনো পুরুষই হস্তক্ষেপ করতে পারবে না। উত্তরাধিকার আইনে নারীদের সম্পত্তির অংশীদার করা হয়েছে। পবিত্র কোরআনে পুরুষের সঙ্গে সঙ্গে নারীদের কথাও স্বতন্ত্রভাবে বর্ণনা করা হয়েছে।
এতে নারীর মর্যাদার বা পৃথক সত্তারই ইঙ্গিত বহন করে। অর্থাৎ ‘ইবাদত-বন্দেগি, আল্লাহর নৈকট্য লাভ, বেহেশতে স্থান লাভ ইত্যাদিতে স্ত্রী ও পুরুষের মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই।’
ইসলাম নারী-পুরুষ নির্বিশেষে শিক্ষা গ্রহণ ফরজ করে দিয়েছে। নারীরাও জ্ঞানপিপাসু, জ্ঞানের সেবক, বিজ্ঞানের ধারকবাহক। তবে পুরুষের মতো নারীদের জ্ঞান ও কর্মক্ষমতা স্বাধীনভাবে বিকাশ লাভ করতে পারে না। কিন্তু সঠিক ও নিরাপদ কর্তৃত্ব ও নেতৃত্বের মাধ্যমে এই শক্তির যথাযথ বিকাশ লাভ করে সমাজে সম্প্রীতির এক অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপনে ভূমিকা রাখতে পারে।
ইসলামের ঊষালগ্নে হজরত মোহাম্মদ (সা.) ব্যবসার মুকুট সম্রাজ্ঞী নারী হজরত খাদিজাকে বিয়ে করে ইসলামকে পরিপুষ্ট করে তোলেন। জয়নব নামে এক মহিলা আতর ব্যবসায়ী থেকে আতর কিনে তাকে ব্যবসায়ে উদ্বুদ্ধ করেন। রাসূল (সা.)-এর যুুগে সর্ব প্রথম ইসলাম গ্রহণকারী একজন নারী। তিনি ছিলেন হজরত খাদিজা (রা.)। ইসলামে সর্ব প্রথম শহীদও ছিলেন একজন নারী। তিনি হলেন হজরত সুমাইয়া (রা.)। কারবালা যুদ্ধের ধারাভাষ্যকারও ছিলেন একজন নারী। তিনি হলেন হজরত ইমাম হোসাইন (রা.)-এর বোন হজরত জয়নব (রা.)।
প্রতি বছর ৮ মার্চ বিশ্ব নারী দিবস। বাংলাদেশসহ বিশ্বের অন্যান্য উন্নয়নশীল দেশে নারী সমাজের অধিকার আদায়ের অঙ্গীকারের মধ্য দিয়ে যথাযোগ্য মর্যাদায় বিশ্ব নারী দিবস উদযাপিত হয়ে থাকে। উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে নারী সমাজের অংশগ্রহণ খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ১৮৫৭ সালের ওই দিনে নিউইয়র্কের একটি সুচ কারখানায় নারী শ্রমিকদের অধিকার আদায়ের সংগ্রামের মধ্য দিয়ে সূচিত হয়েছে এই আন্তর্জাতিক নারী দিবস।
কিন্তু আজ থেকে ১৪০০ বছর আগে বিশ্বমানবতার মুক্তিদূত হজরত মোহাম্মদ (সা.) দীর্ঘ ২৩ বছরে নারীর ব্যক্তিত্ব, নারীর শিক্ষা, নারীর অধিকার, নারীর মর্যাদা, নারীর পোশাক পরিচ্ছদ, নারীর সাজসজ্জা, পারিবারিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে পুরুষের সঙ্গে নারীর অংশগ্রহণের পূর্ণাঙ্গ কাঠামো তৈরি করে দিকনির্দেশনার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করে গেছেন।
রাসূলের যুগে নারীরা যে সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক স্বাধীনতা ও অধিকার ভোগ করেছিলেন আজ তা অনেকটা বিলীন হয়ে গেছে। তাই নারীরা আজ সমাজে বঞ্চিত, নির্যাতিত। রাসূল (সা.) প্রবর্তিত অধিকারগুলো যদি প্রতিষ্ঠা করা হয় তা হলে নারীরা পূর্ণ মানবিক ও সামাজিক মর্যাদা পাবে এবং বিশ্ব নারী দিবসের উদ্দেশ্য সফল হবে। রাসূলের যুগে নারীরা রাসূলের সঙ্গে হিজরত করত, যুদ্ধে অংশগ্রহণ করত। ইবাদত বন্দেগি, জ্ঞানচর্চা, অর্থনৈতিক কার্যক্রম, সমাজকল্যাণমূলক কার্যক্রমে পুরুষের সঙ্গে অংশগ্রহণ করে ইসলামী সমাজের ভারসাম্য প্রতিষ্ঠা করেছিল।
আজও দুনিয়ার যে কোনো দেশে যে কোনো পরিবেশে হজরত খাদিজা (রা.) হজরত ফাতেমা (রা.) ও হজরত আয়েশা (রা.) হজরত জয়নব (রা.) নারী জাতির উত্তম আদর্শ হয়ে বিরাজ করছেন। আল্লাহ আমাদের মহীয়সী নারীদের জীবন অনুসরণ করে নারী অধিকার ও শান্তি প্রতিষ্ঠার তৌফিক দান করুন। এই হোক আমাদের অঙ্গীকার।
লেখক : অধ্যাপিকা, শেরপুর