মাওলানা আবদুল মাজীদ
দেওবন্দ দ্বীনের অতন্দ্র প্রহরী জামাত। তাদের ত্যাগ ও কুরবানী দ্বারা বহুবার তা প্রমাণিত হয়েছে। দখলদার ব্রিটিশ থেকে নিয়ে পরবর্তী কোনো শাসকই ইসলামের স্বার্থের প্রশ্নে এ জামাতকে নত করতে পারেনি। জেল, জুলুম, ফাঁসি-কাষ্ঠ সবকিছুকেই তারা আলিঙ্গন করেছেন, কিন্তু ইসলামের ন্যূনতম ক্ষতিও তারা মেনে নিতে পারেন নি। এতকিছুর পরও এ জামাত প্রতিটি সিদ্ধান্তে ভারসাম্য বজায় রাখার ব্যাপারে ছিলেন দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। কারণ কুরআনের এ আয়াত তাদের চিন্তার জগতের পথ প্রদর্শন করত : (তরজমা) কোনো জাতির প্রতি শত্রুতা যেন তোমাদেরকে অবিচারে উৎসাহিত না করে। ন্যায়বিচার কর, এটাই তাকওয়ার অধিক নিকটবর্তী। -সূরা মায়েদা : ৮
এটা ঠিক যে, ইংরেজদের কৃষ্টি-কালচার এবং সমাজ ও সভ্যতার মধ্যে প্রবৃত্তি পরায়ণতা একেবারেই স্পষ্ট। এর প্রভাব তাদের ভাষাতেও রয়েছে, কিন্তু মূল কথা হচ্ছে ভাষা তো একটি মাধ্যমমাত্র। যেমন একটি লাঠি। এটি জালিমের হাতে থাকলে মানুষ জুলুমের শিকার হবে পক্ষান্তরে বিচারকের হাতে থাকলে দুষ্টের দমন হবে। ইতিহাস বলে, উলামায়ে কেরাম অতীতে জালিমের হাতের লাঠি বিচারকের হাতে তুলে দিয়েছেন এবং তার ইনসাফের হাতকে মজবুত করেছেন। এর একটি দৃষ্টান্ত হল ফারসী ভাষা। অগ্নি-উপাসকদের মূর্খতা ও খোদাবিস্মৃতির সবচেয়ে বড় মাধ্যম হিসাবে এ ভাষা ব্যবহৃত হচ্ছিল যুগ যুগ ধরে, কিন্তু উলামায়ে কেরাম এ ভাষার নিয়ন্ত্রণ নিজেদের হাতে নিলেন। ফলে তা এখন ইসলামী তাহযীব ও তামাদ্দুন এবং উলূম ও মাআরিফে সমৃদ্ধ একটি ভাষা।
এজন্য ইসলামী ভাষা আরবী ছাড়া অন্য কোনো ভাষা নিছক ভাষা হিসেবে গ্রহণীয়ও নয়, বর্জনীয়ও নয়। তা একটি বাহন বা মাধ্যমমাত্র। এজন্য শুধু ভাষা হিসেবে ইংরেজি বা অন্য কোনো ভাষার বিরোধিতা আলিমগণ করবেন, তা যুক্তিসঙ্গত নয়। যদিও একশ্রেণীর মানুষ এই প্রোপাগান্ডা করেছে যে, উলামায়ে দেওবন্দ বা তৎকালীন উপমহাদেশের আলিমগণ ইংরেজি ভাষা শেখাকে হারাম বলেছেন, কিন্তু তা বাস্তবতাহীন একটি প্রচারণা ছাড়া আর কিছু নয়।
উলামায়ে দেওবন্দের মাথার মুকুট হযরত মাওলানা কাসিম নানুতবী রাহ. (১২৯৭ হি., ১৮৭৯ ঈ.) ইংরেজি ভাষায় পারদর্শিতা অর্জন করে একে দাওয়াতের মাধ্যম হিসাবে গ্রহণ করার আকাঙ্ক্ষা প্রকাশ করেছিলেন।
নিম্নে কিছু উদ্ধৃতি উল্লেখ করছি-
‘দারুল উলূম দেওবন্দের প্রতিষ্ঠাতা শেষ জীবনে ইচ্ছা প্রকাশ করেছিলেন যে, আমি যদি ইংরেজি জানতাম তাহলে ইউরোপের পাণ্ডিত্যের দাবিদারদের সামনে ঘোষণা দিতাম যে, তোমরা যাকে জ্ঞান মনে কর তা আদৌ জ্ঞান নয়; বরং জ্ঞান হল যা নবীদের (আ.) সিনা থেকে বেরিয়ে আলোকিত অন্তরে এসে অবস্থান নিয়েছে। -আর-রশীদ, দারুল উলূম দেওবন্দ সংখ্যা, পৃ. ১৬৪
হযরত মাওলানা রশীদ আহমদ গাঙ্গুহী রাহ. এক প্রশ্নের উত্তরে লেখেন, ইংরেজি ভাষা শেখা জায়েয।-ফাতাওয়া রশীদিয়াহ পৃ. ৫৭৪
তদ্রূপ হযরত মাওলানা কাসিম নানুতবী রাহ.-এর সমসাময়িক বিখ্যাত আলেম, হযরত মাওলানা আবদুল হাই লখ্নভী রাহ. লেখেন, (তরজমা) ‘ইংরেজি পড়া ও ইংরেজি শেখা জায়েয যদি এতে দ্বীনদারীর ক্ষতি না হয়।’ -ফাতাওয়া মাওলানা আবদুল হাই লখ্নভী, ২/২৩৩
শায়খুল হিন্দ হযরত মাওলানা মাহমুদ হাসান দেওবন্দী রাহ. ১৯২০ ঈ. সালে মাল্টার জেল থেকে মুক্তি পাওয়ার পর যখন ভারতে পৌঁছলেন তখন আলীগড় বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের দাওয়াতে আলীগড় গিয়েছিলেন। সেখানে বলেছিলেন, ‘ওলামায়ে কেরাম কখনো ইংরেজি ভাষায় ও আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত হতে নিষেধ করেননি।’-আর রশীদ, দারুল উলূম দেওবন্দ সংখ্যা, পৃ. ৬৬০ ইমদাদুল ফাতাওয়া ৫/১৫৬-১৫৭
হযরত থানভী রাহ.-ইংরেজি পড়ার বিষয়ে এক প্রশ্নের উত্তরে লেখেন, ‘‘তাহকীকে তা’লীমে আংরেজী পুস্তিকায় বিস্তারিতভাবে লিখেছি। সারকথা এই যে, অন্যান্য ভাষার মতো ইংরেজিও একটি মোবাহ ভাষা, কিন্তু আনুষঙ্গিক বিভিন্ন কারণে তা দোষযুক্ত হয় …।
যদি কেউ সেইসব অনুষঙ্গ থেকে মুক্ত থাকে অর্থাৎ তার আকীদা-বিশ্বাস বিনষ্ট না হয়, যার সহজ বরং একমাত্র পথ হচ্ছে, ইলমে দ্বীন হাসিল করে চিন্তা-চেতনায় তা বদ্ধমূল রাখা এবং আমল-আখলাকও নষ্ট না হয়, সংকল্পও এই থাকে যে, এর দ্বারা জীবিকা উপার্জনের শুধু এমন পথ অবলম্বন করব, যা শরীয়তের দৃষ্টিতে জায়েয। অতঃপর কার্যক্ষেত্রেও এ নীতির উপর অটল থাকে, তো এমন ব্যক্তির পক্ষে ইংরেজি শেখা জায়েয ও মোবাহ। আর যদি নিয়ত এই থাকে যে, একে দ্বীনের খেদমতের জন্য ব্যবহার করবে তবে তা ইবাদত বলে গণ্য হবে …। মোটকথা, ইংরেজি কখনো হারাম, কখনো মোবাহ এবং কখনো ইবাদত।’’
এরপরও যারা উলামায়ে দেওবন্দ সম্পর্কে উপরোক্ত প্রোপাগান্ডা ছড়ায় তাদেরকে ইতিহাস বিকৃতকারী ছাড়া আর কী বলা যেতে পারে?
এখন প্রশ্ন হল, এ প্রোপাগান্ডার উৎস কী? এখানে জেনে রাখা দরকার যে, উলামায়ে দেওবন্দের ধারা শুরুই হয়েছে ব্রিটিশ বিরোধিতার মধ্য দিয়ে। ব্রিটিশ খেদাও আন্দোলনে তারা সর্বশক্তি নিয়োজিত করেছিলেন এবং এ পথে তাদেরকে সীমাহীন ত্যাগ স্বীকার করতে হয়েছে। তাদের লোমেরও যদি ভাষা থাকত তাহলে প্রতিটি লোম থেকেও ব্রিটিশের বিরুদ্ধে জিহাদের ধ্বনি উচ্চারিত হত।
ব্রিটিশ ভারতের উত্তর প্রদেশের গভর্নর স্যার জেমস শায়খুল হিন্দ রাহ. সম্পর্কে বলেছিলেন, যদি তাকে জ্বালিয়ে ছাই বানিয়ে দেওয়া হয় তাহলে সেই ছাইকেও এমন কোনো ভূখণ্ড থেকে সরান যাবে না যেখানে কোনো ইংরেজ আছে ….।’
তিনি আরো বলেন, যদি তাকে কেটে টুকরো টুকরো করা হয় তাহলে তার দেহের প্রতিটি টুকরা থেকে ইংরেজদের প্রতি বিদ্বেষ টপকাতে থাকবে।-টীকা সাওয়ানেহে কাসেমী ২/৮৪
তাই ইংরেজ সাম্রাজ্যবাদী শক্তি উলামায়ে দেওবন্দকেই তাদের প্রধান প্রতিপক্ষ মনে করেছে এবং তাদেরকে দমন করার কোনো ত্রুটি করেনি। তপ্ত বুলেট দিয়ে যেমন তাদের বুক ঝাঁঝরা করেছে তেমনি অজস্র মিথ্যা প্রোপাগান্ডা দ্বারা তাদের সামাজিক মর্যাদা বিনষ্ট করার সর্বাত্মক চেষ্টা চালিয়েছে। তাদের পলিসি এই ছিল যে, হিন্দুদেরকে শিক্ষা-দীক্ষা ও কর্মসংস্থানের ব্যাপক সুবিধা দিয়ে মুসলমানদের চেয়ে অগ্রসর করে দেওয়া। কারণ তারা জানত, হিন্দুদের বিশ্বাস ও আদর্শিক মেরুদণ্ড মুসলমানদের মতো দৃঢ় নয়।
অতএব এদের আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত করলে রাষ্ট্র-পরিচালনায় লোকবলের অভাব যেমন পূরণ হবে তেমনি রাষ্ট্রক্ষমতাও হুমকির সম্মুখীন হবে না। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির একজন ডাইরেক্টর অনারেবল মি. চার্লস গ্রান্ট লেখেন, ‘হিন্দুরা এত দুর্বল মানসিকতার অধিকারী যে, তাদের মধ্যে রাজনৈতিক স্বাধিকার ও সার্বভৌমত্ব অর্জনের যোগ্যতা আদৌ কোনো দিন আসবে বলে মনে হয় না।’-মুসলমানোঁ কা রৌশন মুসতাকবেল পৃ. ১৬৫
১৮৫৭ সালের বিদ্রোহের পর ব্রিটিশরা মুসলমানদেরকেই একমাত্র প্রতিপক্ষ ভাবতে শুরু করল। তাই রাষ্ট্রের যে কোনো ধরনের সুযোগ সুবিধা থেকে তাদেরকে বঞ্চিত করার ব্যবস্থা পাকাপোক্ত করল। তারা ভাবতে লাগল, শিক্ষায় যদি এদেরকে বিকলাঙ্গ করা না যায় তাহলে এদের মাথা থেকে ক্ষমতা দখল ও উন্নত মম শিরের স্বপ্ন দূর করা যাবে না।-আর-রশীদ, দারুল উলূম দেওবন্দ পৃ. ১৯৭
এখানে ব্রিটিশরা এক ঢিলে দুই পাখি শিকার করল :
১. মুসলমানদের উপর মূর্খতাকে চাপিয়ে ভারতে শাসন ক্ষমতাকে নিষ্কণ্টক করল।
২. আমাদেরকে তোমরা পরিকল্পিতভাবে মূর্খ বানিয়ে রেখেছ-এ অভিযোগ থেকে আত্মরক্ষার জন্য তারা ইংরেজি ভাষা ও আধুনিক শিক্ষার দানাকে ব্রিটিশের প্রতি বিদ্বেষের মালায় গেঁথে দিল।
আর এই অপকৌশলকে জোরে সোরে উলামায়ে কেরামের বিরুদ্ধে প্রোপাগান্ডা চালাতে লাগল যে, তারাই হারাম ফতোয়া দিয়ে ইংরেজি ভাষা ও আধুনিক শিক্ষা থেকে তোমাদেরকে বঞ্চিত করছে।
এই প্রোপাগান্ডা দ্বারা ইংরেজ সাম্রাজ্যবাদী শক্তি দুটি গুরুত্বপূর্ণ লক্ষ্য পূরণে সফল হয়েছে :
১. সাধারণ মুসলমান ও আলিমদের মাঝে বিভক্তি সৃষ্টি, যা আজও দূর হয়নি। কারণ এই প্রচারণার দ্বারা সাধারণ মানুষের মনে বদ্ধমূল ধারণা সৃষ্টি হয়েছে যে, আলিমদের কথা শুনলে মূর্খ হয়ে থাকতে হবে এবং একশত বছর পিছিয়ে যেতে হবে। তদ্রূপ আলিমদের মাধ্যমে মসজিদ-মাদরাসা, দুআর অনুষ্ঠান ইত্যাদি পরিচালনা সম্ভব হতে পারে, কিন্তু সমাজ ও রাষ্ট্র এবং আইন ও আদালত চালানো কোনোভাবেই সম্ভব নয়।
২. উপমহাদেশের সাধারণ মুসলমান একসময় ব্রিটিশ রাজশক্তিকে আজাব মনে করে তা থেকে নিষ্কৃতি লাভের চেষ্টা করত। কিন্তু এইসব প্রোপাগান্ডার পর তারা ব্রিটিশকে রহমত আর উলামায়ে কেরামকে উন্নতি-অগ্রগতির পথে অন্তরায় বলে মনে করতে আরম্ভ করল। বলাবাহুল্য, কোনো জাতি যখন তার আদর্শবান ও কল্যাণকামী অংশকে প্রতিপক্ষ মনে করতে থাকে এবং আদর্শহীন ও স্বার্থবাদী সম্প্রদায়কে মিত্র মনে করে তখন তাদের ধ্বংস ঠেকিয়ে রাখা কঠিন হয়ে যায়।
আমাদের সমাজে যারা ইসলাম ও ইসলামপন্থীদের বিরুদ্ধে বিষোদগারে লিপ্ত তাদের উপর ঐ প্রোপাগান্ডার যথেষ্ট প্রভাব রয়েছে। তৎকালীন ইংরেজ রাজশক্তি উপরোক্ত প্রচার-প্রচারণার জন্য বিভিন্ন সাময়িক পরিস্থিতিকেও কাজে লাগিয়েছে এবং তিলকে তাল করে উপস্থাপন করেছে। কখনো কোনো অপরিণামদর্শী মুসলিম নেতার বক্তব্য বিবৃতির দ্বারা ফায়দা নিয়েছে। যদিও তারা আলিম ছিল না, কিন্তু শুধু বাহ্যিক সামঞ্জস্যের কারণে তাদের বক্তব্য ও মন্তব্যকে আলেমসমাজের উপর চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে।
একটি দৃষ্টান্ত দিচ্ছি-
১৮৭৭ সালের ৮ জানুয়ারি ব্রিটিশ ভারতের গভর্নর জেনারেলের হাতে আলীগড়ে মাদরাসাতুল উলূমের ভিত্তি প্রস্তর স্থাপিত হয়, যা পরে স্যার সাইয়েদ আহমদের আলীগড় মুসলিম ইউনিভার্সিটি নামে পরিচিত হয়। এই প্রতিষ্ঠানের তহবিল গঠনের জন্য তিনি চাঁদা সংগ্রহ, পত্রিকায় লেখালেখি এবং দূর-দূরান্তে সফর করা শুরু করলেন। এই প্রতিষ্ঠানের লক্ষ্য-উদ্দেশ্য, কর্মপদ্ধতি ও সিলেবাসের সাথে গণমানুষকে পরিচিত করতে লাগলেন। এ সময় স্যার সাইয়েদ ও তার প্রতিষ্ঠানের কট্টর দুইজন সমালোচক ছিলেন কানপুর জেলার ডেপুটি কালেক্টর মৌলভী এমদাদ আলী ও গৌরখপুরের সাব জজ মৌলভী আলী বখশ।
এদের একজন শায়খ মুহাম্মাদ ইবনে আবদুল ওয়াহহাব নজদীর দর্শনে বিশ্বাসী ছিলেন, অন্যজন ছিলেন বিদআতি। তারা উভয়ে স্যার সাইয়েদের বিরুদ্ধে সমস্ত ভারতবাসীকে একজোট করার কর্মসূচি হাতে নিলেন। একথা সবাই জানেন যে, স্যার সাইয়েদের আকীদাগত কিছু মারাত্মক বিভ্রান্তি ছিল। তারা এই সব বিষয়ের সাহায্যে তাকে কোণঠাসা করে ফেলেন। এমনকি মক্কা ও মদীনার আলেমদের নিকট থেকেও তার বিরুদ্ধে ফতোয়া সংগ্রহ করেন এবং তা প্রচার করেন।-মাওলানা কাসিম নানুতবী রাহ. : হায়াত আওর কারনামে , আসীর আদরবী, পৃ. ২১৪-২১৫
এটা ছিল ইংরেজি শিক্ষিত লোকদের গৃহযুদ্ধ, কিন্তু এই সকল বিষয়ের দায় চাপিয়ে দেওয়া হল আলিমদের উপর। আর এটা সহজ হয়েছে এজন্য যে, ইংরেজ-বিরোধী বলে তারা পূর্ব থেকেই পরিচিত ছিলেন। অতএব তাদের ইংরেজ-বিরোধিতা খুব সহজেই ইংরেজি ভাষার বিরোধিতা বলে প্রচার করে দেওয়া হল।
অথচ স্যার সাইয়েদের বিভিন্ন ভ্রান্ত বিশ্বাসের কারণে মাওলানা কাসিম নানুতুবী তার উপর মনক্ষুণ্ন থাকলেও তার বিরোধিতায় কখনো মুখ খুলতেন না। কারণ তিনি ভাবতেন যে, তার ইংরেজি ভাষা ও আধুনিক শিক্ষা সংক্রান্ত কর্মসূচি দ্বারা মুসলমানদের দুনিয়াবী কিছু উপকার হচ্ছে। -মাওলানা কাসিম নানুতুবী, হায়াত আওর কারনামে পৃ. ২১৮
উলামায়ে কেরাম ফতোয়া প্রদানকে অত্যন্ত দায়িত্বপূর্ণ ও কঠিন বিষয় বলে মনে করতেন। একটি দৃষ্টান্ত থেকে তা কিছুটা অনুমান করা যবে। ১৯২০ সালের কথা। ব্রিটিশের বিরুদ্ধে সারা ভারত উত্তাল হয়ে আছে। মুসলমান-হিন্দু মিলে যে জোট গঠন করেছিল তার নেতারা অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দিলেন, কিন্তু প্রশ্ন দেখা দিল যে, ইসলামে এমন আন্দোলন জায়েয আছে কি না? রাজনীতিবিদ ও উলামায়ে কেরাম ফতোয়া চাইলেন শায়খুল হিন্দ মাহমুদ হাসান দেওবন্দী রাহ.-এর নিকট। তিনি বললেন, আমার মধ্যে ইংরেজদের বিরুদ্ধে ঘৃণা ও বিদ্বেষ এক কঠিন পর্যায়ে পৌঁছে গেছে।
তাই আমি নিজের উপর আস্থা রাখতে পারছি না যে, আমার দ্বারা ফতোয়ার রুচি ও চাহিদা রক্ষা করা সম্ভব হবে। তারপর এই আয়াত বললেন, (তরজমা) কোনো জাতির প্রতি বিদ্বেষ যেন তোমাদেরকে ন্যায়বিচার থেকে সরিয়ে না দেয়। তারপর তিনি তাঁর যোগ্য তিন শিষ্যকে ডাকলেন : হযরত মাওলানা মুফতী কেফায়েতুল্লাহ রাহ., হযরত মাওলানা সাইয়িদ হুসাইন আহমদ মাদানী রাহ. ও হযরত মাওলানা শাব্বীর আহমদ উসমানী রাহ. তাদেরকে বললেন, এ ফতোয়ার জবাব আপনারা লিখুন। তাঁরা বললেন, আপনার উপস্থিতিতে আমরা লিখব? তখন তিনি এ ফতোয়ার ব্যাপারে নিজের উপর অনাস্থার কথা ব্যক্ত করেন।-সাওয়ানেহে কাসেমী পৃ. ৮৪ টীকা
প্রিয় পাঠক, যে জামাত প্রতিটি সিদ্ধান্তে, প্রতিটি ফতোয়ায় এমন সতর্কতার পরিচয় দিয়ে থাকে তাদের বিরুদ্ধে এমন একটি প্রোপাগান্ডা ছড়ানো কোনোভাবেই ন্যায়নিষ্ঠার পরিচায়ক হতে পারে না।
সর্বশেষ কথা এই যে, আমাদের পূর্বসূরিরা কোনো ভাষার বিরোধিতা নিছক ভাষা হিসেবে করেননি। তদ্রূপ পার্থিব জ্ঞানার্জনেও মানুষকে বাধা দেননি। তারা ইংরেজি শেখার নয়, ইংরেজ হওয়ার বিরোধিতা করেছেন। আকীদা-ফিকির, আদব-আখলাক এবং সূরত-সীরাত সকল বিষয়ে মুসলমান থাকা প্রত্যেক মুমিনের উপর ফরয।
কেউ ভাষার দিক দিয়ে ইংরেজ না হয়েও চিন্তা-চেতনা এবং কৃষ্টি-কালচারে ইংরেজ হলে তার ইংরেজি না-জানা প্রশংসার বিষয় হবে না তদ্রূপ বিশ্বাস ও কর্মে মুসলিম হয়ে ভাষা যদি ইংরেজি হয়, সে মাতৃভাষা হোক বা চর্চার দ্বারা অর্জিত হোক, তা কখনো তার মর্যাদাকে বিনষ্ট করবে না।