মঙ্গল শোভা-যাত্রা কি আসলেই মঙ্গলজনক? মাওলানা আব্দুল মালেক

মাওলানা মুহাম্মাদ আব্দুল মালেক


হামদ ও ছানার পর :

وَ هُوَ الَّذِیْ جَعَلَ الَّیْلَ وَ النَّهَارَ خِلْفَةً لِّمَنْ اَرَادَ اَنْ یَّذَّكَّرَ اَوْ اَرَادَ شُكُوْرًا .

وقال عليه الصلاة والسلام : كُلُّ النَّاسِ يَغْدُو فَبَائِعٌ نَفْسَهُ فَمُعْتِقُهَا أَوْ مُوبِقُهَا.

[তিনিই সেই সত্তা, যিনি রাত ও দিনকে পরস্পরের অনুগামী বানিয়েছেন; তার জন্য, যে চিন্তা-ভাবনা করতে চায় বা শোকর করতে চায়। -সূরা ফুরকান (২৫) : ৬২

নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, প্রতিটি মানুষ প্রত্যুষে উপনীত হয়ে নিজেকে বিক্রয় করে। এরপর সে হয়ত নিজেকে মুক্ত করে অথবা ধ্বংস করে। -সহীহ মুসলিম, হাদীস ২২৩]

হিজরী নববর্ষ শুরু হয়েছে এক দু’মাস আগে। তখন কিন্তু পয়লা মুহাররমের কোনো অনুষ্ঠান করেননি। আসলে ইসলামে থার্টি ফার্স্ট নাইট, পয়লা বৈশাখ বা নববর্ষ নামে কিছু নেই। কারণ এ ধরনের আনুষ্ঠানিকতায় যদি ভালো কিছু থাকে, তা বছরে একবার করার বিষয় নয়; তা হওয়া দরকার প্রতিদিন। ইসলাম শুধু নববর্ষের কদর করতে বলে না; বরং নব দিন, নব রাত, নব সকাল, নব দুপুর- সকল সময়েরই কদর করতে বলে; এ সবই তো নতুন। সবগুলোই তো আমার ইবাদতের অংশ। এ সবকিছুরই আমার কদর করতে হবে। এ সব কিছুর জন্য আমাকে মুহাসাবা করে ভালোর জন্যে শোকর আদায় করতে হবে, মন্দের জন্যে ইস্তিগফার করতে হবে।

সূরা ফুরকানের উক্ত আয়াতে ইরশাদ হয়েছে-

وَ هُوَ الَّذِیْ جَعَلَ الَّیْلَ وَ النَّهَارَ خِلْفَةً لِّمَنْ اَرَادَ اَنْ یَّذَّكَّرَ اَوْ اَرَادَ شُكُوْرًا.

তিনিই সেই সত্তা যিনি রাত ও দিনকে পরস্পরের অনুগামী বানিয়েছেন তার জন্যে যে চিন্তা-ভাবনা করতে চায় বা শোকর করতে চায়। -সূরা ফুরকান (২৫) : ৬২

তো এই যিকির ও ফিকির এবং হামদ ও শোকর সময়ের প্রতিটি পরিবর্তনের সময় কাম্য। এই যে দিন রাত আরবীতে কিন্তু এ দুটিকে একসঙ্গে ‘আলজাদীদান’ (দুই নতুন) বলা হয়। কারণ প্রতিটি দিনই নতুন, প্রতিটি রাতই নতুন। পেছনের কোনো দিন আবার কিন্তু ঘুরে আসছে না। তো যদি আমরা নতুন-এর জন্য কিছু করতে চাই- প্রতিটি দিনই নতুন, প্রতিটি রাতই নতুন; প্রতিটি সকাল নতুন, প্রতিটি সন্ধ্যা নতুন। শরীয়তে ইবাদতের বিধান, যিকির ও দুআর অযীফা সেভাবেই দেওয়া হয়েছে।

হাদীস শরীফে মুহাসাবার যে তাকীদ করা হয়েছে, তা বছরে একবার নয় সে মুহাসাবা হতে হবে প্রতি সকালে, প্রতি সন্ধ্যায়; ২৪ ঘণ্টায় একবার তো বটেই। শোয়ার সময় তুমি হিসাব লাগাও তোমার দিন কেমন কেটেছে। আজকে কার উপর যুলুম করেছ, কার হক নষ্ট করেছ। তোমার দায়িত্ব যথাযথ পালন করেছ কি না। আল্লাহর হকগুলো পালন করেছ কি না। বান্দার হকগুলো আদায় করেছ কি না। দৈনিক কমপক্ষে একবার তোমার হিসাব মিলাও। শুধু দোকানের খাতার হিসাব নয়, এটাও মিলাও। তোমার নিজের আমলের, নিজের আখলাকের, নিজের চরিত্রের, দিনরাত কার সাথে কী আচরণ করেছ- এরও হিসাব লাগাও। কোন্ আচরণে আল্লাহ খুশি হয়েছেন, কোন্ আচরণে আল্লাহ নারায হয়েছেন। এ হালখাতা বছরে একবার হয় না! এ হালখাতা দৈনিকের!

আলী রা.-এর ঘটনা কতবার শুনিয়েছি- আলী রা. কী বলেছিলেন? আমাদের মাযহাবের ইমামের কী নাম? হানাফী মাযহাবের ইমাম, ইমাম আবু হানীফা রহঃ.। ইমাম আবু হানীফা রহঃ.-এর আব্বার নাম ছাবিত। দাদার নাম যূতাহ। প্রথমে তিনি (দাদা) ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন। তাঁরা পারস্যের ছিলেন। অগ্নি পূজক ছিলেন। তাঁর সন্তান হলেন ছাবিত, ছাবিতের সন্তান হলেন ইমাম আবু হানীফা রহঃ.। ইমাম আবু হানীফা রহঃ.-এর পিতা ছাবিতকে তার আব্বা নিয়ে গিয়েছিলেন আলী রা.-এর কাছে। কুফাতে থাকতেন তাঁরা। আলী রা.ও তাঁর খেলাফতের সময় কুফায় ছিলেন। তিনি ছাবিতকে আলী রা.-এর কাছে নিয়ে বললেন- এ আমার ছেলে। ছাবিত রহঃ.-এর জন্য দুআ করে দিয়েছেন আলী রা.। দুআর সময় শুধু ছাবিতের জন্য দুআ করেন নি; ছাবিত এবং তার বংশধরের জন্য করেছেন। ওই দুআর সবচেয়ে বেশি ভাগ পেয়েছেন ইমাম আবু হানীফা রহঃ.। যেহেতু আলী রা.-এর সাথে ইমাম আবু হানীফা রহঃ.-এর দাদার সম্পর্ক ছিল, তাই বিভিন্ন উপলক্ষে যাতায়াত ছিল। তাঁরা যেহেতু পারস্য থেকে এসেছেন, নতুন নতুন ইসলাম গ্রহণ করেছেন, এখনও ইসলামের সব বিধিবিধান আয়ত্তে আসেনি। তাই আগের তালে তালে মনে হল যে, আজকে তো আমাদের নওরোয, এটা একটা সুযোগ, তিনি আলী রা.-এর জন্য কিছু হাদিয়া নিলেন। হাদিয়া নিলেন নববর্ষ উপলক্ষে। আলী রা. জিজ্ঞেস করলেন, এটা কী? তিনি বললেন, আজকে তো আমাদের ওখানে (পারস্যে) নওরোয, সে হিসেবে কিছু হাদিয়া আনলাম। এ কথা শুনে আলী রা. বললেন, ‘নওরোযুনা কুল্লা ইয়াওম’ (প্রতিটি দিনই আমাদের নববর্ষ)। তুমি তো মুসলিম, ইসলাম গ্রহণ করেছ; জান মুসলিমের নওরোয কী? প্রতিটি দিনই মুসলিমের নওরোয। এটা বছরে একবার আসে না, প্রতিদিন আসে।

এখন আমরা সেই ইসলামী শিক্ষা ভুলে গিয়েছি। যখন আমার প্রধান পরিচয় বানিয়ে দেওয়া হয়েছে ‘বাঙালী’, তো বাঙালী নববর্ষ আমি পালন করব। এখন প্রশ্ন হল, বাঙালী নববর্ষ কোনটা? ২০ বছর আগে আমরা যেটা দেখেছি ওটা? ৫০ বছর আগে যেটা দেখেছি ওটা, নাকি বছর বছর এর সাথে যুক্ত হওয়া সবকিছু? কোনটার নাম বাঙালী নববর্ষ? আপনারা মুরব্বিরা বলেন আমাদেরকে, কোনটার নাম? আমরা তো ছোট, কালো দাড়িওয়ালা, আপনারা যারা মুরুব্বী আপনারা বলেন, আপনারা কী নববর্ষ দেখেছেন? মুরুব্বীদের দায়িত্বে পড়ে নতুন প্রজন্মকে জানানো, বুঝানো- এটা কি আসলে নববর্ষ পালন, না ঈমান ও আখলাক নষ্ট করা। পশ্চিম বঙ্গে যারা আসা যাওয়া করেন, অনেকের তো বাড়িও আছে পশ্চিম বঙ্গে। এখানে থাকেন, জন্ম হয়েছে পশ্চিম বঙ্গে। কিছু দিন পশ্চিম বঙ্গে কাটিয়েছেন। পশ্চিম বঙ্গে নববর্ষের কথা বলুন। যে ভয়াবহ অবস্থা হয় এখানে, ওখানেও কি ঠিক এরকম?

শুভ নববর্ষ। মঙ্গল শোভাযাত্রা। আমার বছর শুভ হবে কীভাবে? মঙ্গল-কল্যাণ দান করবেন কে? আল্লাহ। আল্লাহ তাআলার বিধান কি আপনি শোনেন? মূর্তি-ভাস্কর্যের সাথে কি রহমত আছে, কল্যাণ-মঙ্গল আছে? এর সাথে কোনো রহমত নেই, কল্যাণ নেই। আমার নববর্ষ যদি মূর্তি-ভাস্কর্যের সাথে যুক্ত হয়, রহমত আসবে কোত্থেকে? মঙ্গল হবে কীভাবে? আমার বছর শুভ হবে কীভাবে?

যত অশ্লীলতা আছে, আল্লাহ তা অপছন্দ করেন। আল্লাহ কোনো ধরনের অশ্লীলতা পছন্দ করেন না। إِنَّ اللهَ لَا يُحِبُّ الْفُحْشَ، وَلَا التَّفَحُّشَ। রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামও পছন্দ করেন না। অশ্লীলতার প্রতি আল্লাহ তাআলার ক্রোধ অনেক বেশি। পৌত্তলিকতার সাথে, অশ্লীলতার সাথে, পর্দাহীনতার সাথে যে যাত্রা হবে সেই যাত্রায় মঙ্গল হবে কীভাবে? এর মাধ্যমে আমার বছর শুভ হবে কীভাবে? আর যদি আমাদের আক্বীদা হয় -নাউযুবিল্লাহ- হিন্দুদের মতো! এক একটা দেব-দেবী এক একটার মালিক। ওরা যেভাবে মঙ্গল কামনা করে আমরাও…। তাহলে তো আর ‘লা-ইলাহা ইল্লাহ’ থাকল না। শুভ-অশুভর মালিক যদি আল্লাহ হন, লাভ-ক্ষতির মালিক যদি আল্লাহ হন, কল্যাণ-অকল্যাণের মালিক যদি আল্লাহ হন, আমার বছর শুভ হবে কীভাবে তা আল্লাহর কাছ থেকে জানতে হবে। আল্লাহর দ্বীন থেকে আল্লাহর শরীয়ত থেকে জানতে হবে।

আমি মুরুব্বীদের কাছে অনুরোধ করব, সামনের প্রজন্মকে আমরা জানাই- এটা আসলে নববর্ষ নয়, এটা আমাদের ঈমান ও আখলাককে নষ্ট করা। একেকবার একেক ধরনের অশ্লীলতা যোগ হচ্ছে, একেক ধরনের পৌত্তলিকতা যোগ হচ্ছে, আর সব নববর্ষের নাম দিয়ে চালিয়ে দিতে চাচ্ছে। কেউ কিছু বলতে পারবে না; কারণ, বললেই তো শেষ। কিছু বললেই রাষ্ট্রদ্রোহী হয়ে যাবে। যে বলল, সে দেশের সভ্যতার বিরুদ্ধে বলল নববর্ষের বিরুদ্ধে বলল। আমরা তো ভয় পাই না। আমরা একমাত্র আল্লাহকে ভয় পাই। একমাত্র আল্লাহকে ভয় করি। আমরা এসব ফাঁক-ফোঁকর আল্লাহর রহমতে বুঝি। কোনটা বাঙালী সংস্কৃতি আর কোনটা হিন্দুয়ানী সংস্কৃতি। হিন্দুয়ানী সংস্কৃতিকে বাংলাদেশী সংস্কৃতি, বাংলার সভ্যতা বলে আমাদেরকে খাইয়ে দিবেন, খেয়ে খেয়ে আমাদের নতুন প্রজন্ম নষ্ট হবে, আমরা কিছু বলতেও পারব না, এই কি তাহলে আমাদের স্বাধীন বাংলাদেশ? এটা কী স্বাধীনতা যে, হক কথা বলতে পারব না। আল্লাহ রাব্বুল আলামীন আমাদেরকে রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসালামের সুন্নত মোতাবেক চলার তাওফিক দান করুন। মুমিনের সভ্যতা হল রাসূলের সুন্নাহ। বাংলার মুমিন হোক, হিন্দুস্তানের মুমিন হোক, পাকিস্তানের মুমিন হোক, আমেরিকার-লন্ডনের মুমিন হোক, যেই জায়গার মুমিন হোক, মুসলিম হোক; মুসলিম আর মুমিনের সভ্যতা হল রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সুন্নাহ।

لَقَدْ كَانَ لَكُمْ فِي رَسُولِ اللهِ أُسْوَةٌ حَسَنَةٌ

রাসূলুল্লাহর কালচার যা, আমাদের কালচারও তা।

আল্লাহ রাব্বুল আলামীন আমাদেরকে সহীহ সমঝ নসীব করুন। আল্লাহ বলেছেন- إِنْ تَكُونُوا صَالِحِينَ

তোমরা যদি উপযুক্ত হয়ে যাও, ভালো হয়ে যাও। ভালো মানে? এমনি বলে দিলাম, সে ভালো মানুষ। এটাকে ভালো বলে না। ভালো মানে, সব দিক থেকে আল্লাহর বিচারে, আল্লাহর আদালতে আমি উপযুক্ত হই তাহলেই আমি ছালেহ-ভালো। ভালো হলে কী পাওয়া যাবে? আল্লাহ বলেন, তোমরা ছালেহ হও, আমি চাই তোমরা ছালেহ হয়ে যাও। ছালেহ হলে তোমাদের দোষত্রুটি যা হয়েছে তওবা করে ফেল, ক্ষমা করে দিব। কিন্তু হতে তো হবে! নিয়ত তো করতে হবে ছালেহ হওয়ার, উপযুক্ত হওয়ার, আমরা তো নিয়তই করছি না। হিম্মত করতে হবে, নিয়ত করতে হবে। আল্লাহ তাআলা তাওফিক নসীব করুন। আমীন!

وآخر دعوانا أن الحمد لله رب العالمين.

[ধারণ : মাওলানা যুবায়ের আহমাদ
অনুলিখন : খায়রুল বাশার]

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *